আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সোমালিয়ার ক্ষুধার্ত মুসলমান এবং যাকাতখোর ডাঃ জাকির নায়েকেরা

সবকিছুই চুকিয়ে গেছে গালিব! বাকি আছে শুধু মৃত্যু!!

১৯৯২ সালের দিকের কথা। আমি তখন হাইস্কুলের ছাত্র। স্যাটেলাইট টিভির আগমনটা সবেমাত্র শুরু হয়েছে। বিটিভি পরীক্ষামূলকভাবে বিশ্ববিখ্যাত দুটি নিউজ চ্যানেল সিএনএন (ক্যাবল নিউজ নেটওয়ার্ক) এবং বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস টেলিভিশনের সম্প্রচার শুরু করেছে। অন্যান্যদের মতো আমারও এই নিউজ চ্যানেল দুটির সংবাদের প্রতি ব্যাপক আকর্ষণ ছিল।

ইংরেজিটা যে তখন খুব ভাল বুঝতাম তা কিন্তু না। তবে চ্যানেল দুটির খবর উপস্থাপন, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ এবং সংবাদের মান সময় বিবেচনায় আমাদের অভিজ্ঞতা বা চিন্তারও অনেক উর্ধ্বে ছিল। শুধুমাত্র বিটিভি দেখতে অভ্যস্ত আমাদের মতো আমজনতার কাছে এ চ্যানেল দুটির সংবাদ দেখতে পাওয়া ছিল অনেকটা বামুনের চাঁদ স্পর্শ করার মতো। তাই ইংরেজি তেমনটা না বুঝা চ্যানেল দুটির সংবাদের প্রতি আকর্ষণ অন্যান্যদের মতো আমাকেও দমাতে পারেনি। আমার স্মৃতি থেকে বলতে পারি ঠিক সেই সময়ে এই চ্যানেলগুলোর প্রধান সংবাদ ছিল, সোমালিয়া নামক আফ্রিকার একটি কালো মুসলিম দেশের দুর্ভিক্ষ।

একটু পরে পরেই টিভি পর্দায় ভেসে আসত কংকালসার শিশুদের দেহ এবং না খেয়ে মারা যাওয়া হতভাগ্য মানুষগুলোর অবয়ব। করুণ দৃশ্যগুলো দেখে বাবা হাহাকার করে বলে ওঠতেন, আহা! সব মুসলমান না খেয়ে মরে গেল। মানুষ মরে যাচ্ছে, এ ভাবনার চেয়েও তাঁর কাছে বড় ভাবনা ছিল 'সব মুসলমান মরে যাচ্ছে'। অবশ্য সমাজ তাঁকে যে খন্ডিত মূল্যবোধ শিখিয়েছে সে তা বহন বা লালন করেছে মাত্র। এক্ষেত্রে তাই তাঁর এই ভাবনার মাঝে আমি কোন দোষ দেখিনা।

যাহোক, একটি মুসলিম দেশের জনগণ কেন এমন না খেয়ে মারা যাচ্ছে তার উত্তর আমার কিশোর মন খুঁজে পেতনা। কারণ ঠিক সে সময়ে মুসলিম দেশগুলোর সম্পর্কে ধারণা ছিল অনেক উচ্চ। মধ্যপ্রাচ্যের যেসব মুসলিম দেশগুলোর নাম জানতাম সেগুলোকে আমি বিশ্বের সবচেয়ে ধনী রাষ্ট বলে মনে করতাম। একজন নিম্ন-মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির সন্তান হিসেবে আত্মীয় স্বজনদের অনেককেই মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করতে যেতে দেখতাম। এটাও বুঝতাম যে তারা সেখানে খুব ভাল কোন কাজ করেনা।

তারপরেও দেখতাম যে, আমার সরকারি চাকরিজীবী বাবার চেয়ে তাঁদের ফ্যামিলির বিলাসিতা বা উজ্জ্বলতা অনেক বেশি। এসব দেখে ধরে নিয়েছিলাম যে এগুলো ধনী দেশ বিধায় সেখানে ছোটখাট কাজ করেও অনেক বেশি রোজগার করা যায়। তাছাড়া এমনও শুনতাম যে, নিজেদের দেশে যাকাত বা ছদকা দেয়ার মতো লোক না থাকায় এসব দেশ বাংলাদেশের মতো অন্যান্য গরীব মুসলিম দেশগুলোতে প্রতি বছর প্রচুর অর্থ দান করে থাকে। এমন দান-দক্ষিণার পরেও একটি মুসলিম দেশের জনগণ কীভাবে না খেয়ে মারা যাচ্ছে তার হিসাবটা কোন প্রকারেই তখন মিলাতে পারতাম না। তবে হিসাবটা তখন না মিলাতে পারলেও এখন খুব সহজেই মিলাতে পারি।

দুর্ভিক্ষের ঘটনার কিছুদিনের পরের কথা। আমাদের বাড়ির ঠিক দুটি প্লট পরেই একজন মৌলানা টাইপের লোক তৈরী করা একটি টিনসেড বাড়ি কিনলেন। এরপরের দু'বৎসর বাড়িটা টিনসেডই ছিল। তারপর দেখলাম চোখের পলকে বাড়িটা পাঁচতলা হয়ে গেছে। ভদ্রলোক স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় পড়ানোর পাশাপাশি এলাকার একটি মসজিদে জুমআর নামাজ পড়াতেন।

ফাকে ফাকে ছোটখাট একটা ইসলামী দলের সাথে জড়িত ছিলেন। এমন একজন লোকের দ্বারা এমন একটি বাড়ি নির্মাণ কীভাবে সম্ভব, তা ছিল সে সময়ে এলাকায় আলোচিত বিষয়। পরে জেনেছিলাম ছোটখাট ইসলামী দলের নেতা হওয়ার কারণে তিনি সৌদিআরব থেকে প্রচুর যাকাতের টাকা পেয়েছিলেন। টাকাটা তিনি হাসিল করেছিলেন এতিমখানা ও মাদ্রাসা নির্মাণের কথা বলে। অবশ্য তিনি যে তাঁর কথার একেবারে বরখেলাপ করেছিলেন তা কিন্তু নয়।

পাঁচতলার মধ্যে দুটি তলা তিনি মহিলা মাদ্রাসার জন্য বরাদ্দ করেছিলেন। যেখানে তুলনামূলকভাবে সাধারণ শিক্ষার চেয়েও অনেক বেশি টাকার বিনিময়ে ইসলামী শিক্ষা দেয়া হত। বাকি তলাগুলো তিনি নিজের থাকাসহ ভাড়ার জন্য বরাদ্দ রেখেছিলেন। অবশ্য এই ভাড়ার টাকা দিয়ে তিনি কোন এতিমের পুনর্বাসন করেছিলেন কিনা বা এখনও করেন কিনা তা আমার জানা নেই। বর্ণিত মৌলানার মতো যাকাতের টাকা মেরে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে এমন ধর্মব্যবসায়ীরা এদেশের স্থানে স্থানে ছড়িয়ে আছে।

এদের-কে খুঁজে বের করার জন্য কোন অনুবীক্ষণ যন্ত্রের প্রয়োজন নেই। ইসলামী আন্দোলনের নাম করে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা তথাকথিত সংগঠনগুলোর তহবিলের প্রধান উৎসও মধ্যপ্রাচ্যের যাকাতের টাকা। এমনকি শুনা যায় যে, ইসলামী জেহাদীদের রসদের যোগানটাও এই যাকাতের টাকা হতে আসে। আফগানিস্তানের কম্যুনিস্ট নজিবুল্লাহ সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত মুজাহিদ বাহিনী বা পরবর্তীতে তালিবানরা বলবান হয়েছে সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের দানের টাকায়। অথচ এর পরিনতি যে আজকে কি ভয়াবহ পর্যায়ে পৌছেছে তাতো সবাই খোলা চোখেই দেখতে পাচ্ছেন।

কে জানে, হয়তো বাংলাদেশের জেএমবি বা হরকাতুল জিহাদের মতো মানুষখেকো জঙ্গীবাদী দলগুলোও বেড়ে ওঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের দান বা যাকাতের টাকায়। সারাজীবন অন্যের ঘরে খেয়ে বড় হওয়া এই মোল্লারাতো আর হাওয়া থেকে গ্রেনেড বা রকেট লাঞ্চার এর টাকা যোগার করেনি। অথচ এই যাকাত যাদের সবচেয়ে প্রয়োজন সেই দরিদ্র মানুষেরা এই দানের দু'পয়সাও কোনদিন চোখে দেখেনা। তাঁরা এবং তাঁদের সন্তানেরা ক্ষুধা নিয়ে জন্মায়, ক্ষুধা নিয়েই মারা যায়। আজকাল ইসলামী দাওয়াতের কথা বলে নতুন পন্থায় যাকাত খাওয়ার একটি সিস্টেম চালু হয়েছে।

পিস (Peace) টিভিতে ডাঃ জাকির নায়েককে একটু পরে পরেই তার টিভি চ্যানেলের জন্য যাকাতের টাকা চাইতে দেখি। এতদিন আমি জানতাম যাকাত শুধুমাত্র দরিদ্রের অধিকার। এখন তাঁর মুখে শুনি যে, ইসলাম প্রচারে নিয়োজিত স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলকেও যাকাত দেয়া যায়। আমি ইসলাম বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নই। কাজেই বক্তব্যটি কতদূর সঠিক এনিয়ে তর্কে যাবনা বা উচিতও হবেনা।

কিন্তু এ চ্যানেলে প্রচারিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সংশ্লিষ্টদের যে পরিবেশে অবস্থান করে তাদের বক্তব্য রাখতে দেখা যায় বা তাদের চারপাশে যে জৌলুস দেখা যায় তাতে বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে দরিদ্র জনগণের যাকাতের টাকাটা কীভাবে অপচয় হচ্ছে। অথচ শুনেছি ইসলামের নবী নাকি মসজিদে নববীতে খেজুর গাছের গুড়িতে বসে ইসলামের বাণী প্রচার করেছেন। সাধারণ রুটিই নাকি ছিল তার প্রধান খাদ্য। একটার অতিরিক্ত জামাও নাকি তার ছিলনা। সেই অতি সাধারণ মুহম্মদ যদি তার এই সাগরেদ ডাঃ নায়েকের পোশাকের বিলাস দেখতেন কিংবা দরিদ্র জনগণের টাকা ব্যবহার করে টিভি চ্যানেলের জৌলুস বাড়ানো দেখতেন তখন কি করতেন তিনি? আমারতো মনে হয় স্যুট, টাই পরিহিত এই বেটার দুই গালে দুইটা চড় বসিয়ে দিতেন।

সোমালিয়া, ইরিত্রিয়া, সুদানের মুসলমানেরা এখনও না খেয়ে মারা যায়। তাঁদের যাকাতের টাকা দিয়ে জাকির নায়েকেরা বিলাসিতার সমুদ্রে হাবুডুবু খায়। সোমালিয়া, ইরিত্রিয়া, সুদানের মুসলমানেরা ভবিষ্যতেও না খেয়ে মারা যাবে। তাঁদের যাকাতের টাকা দিয়ে জাকির নায়েকেরা ভবিষ্যতেও বিলাসিতার সমুদ্রে হাবুডুবু খাবেন। হায় ইসরাফিল! এতোকিছু দেখার পরেও কেয়ামতের বাশি বাঁজাতে কেন তোমার এতো দ্বিধা? ---------------------------------------------------------------------------------- Related Post (Click This Link)


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.