হাঁটা পথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে হে সভ্যতা। আমরা সাত ভাই চম্পা মাতৃকাচিহ্ন কপালে দঁড়িয়েছি এসে _এই বিপাকে, পরিণামে। আমরা কথা বলি আর আমাদের মা আজো লতাপাতা খায়।
কে ভাবতে পেরেছিল, এই ২০০৯ সালে দুনিয়ার তাবড় তাবড় সরকারগুলো একযোগে জলদস্যুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে? এই লেখা যখন আপনি পড়ছেন, তখন ব্রিটিশ রয়্যাল নেভি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনসহ দুই ডজনেরও বেশি দেশের যুদ্ধজাহাজ নিয়ে সোমালিয়ার জলসীমায় ঢুকছে। জলদস্যু বলতেই কাঁধে তোতাপাখি নিয়ে থাকা শয়তান মানুষের ধারণা আমাদের মনে গেঁথে দিয়েছে হলিউডি ছবিগুলো।
আন্তর্জাতিক নৌবহর যখন সোমালিয় জাহাজগুলোকে তাড়া করে ধ্বংস করবে এবং প্রয়োজনে ভূমিতেও সেই আক্রমণ ছড়িয়ে দেবে, তখনও আমরা ভাবব কোথাও একদল পাষণ্ড ডাকাতদের শায়েস্তা করা হচ্ছে। সামুদ্রিক এই অভিযান নব্বই দশক থেকে একের পর এক মার্কিন আক্রমণ, সিআইয়ের গোপন অভিযান, মার্কিন মদদে ইথিওপিয়ার আগ্রাসনে বিধ্বস্ত দেশটি আর তার দুর্ভিপীড়িত কোটি খানেক মানুষকে নরকের সদর দরজা দেখিয়ে দেবে। অথচ যে মানুষগুলোকে পশ্চিমা সরকারগুলো ‘আমাদের সময়ের কুৎসিত ব্যাধি’ বলে দেখাচ্ছে, তাদেরও বলবার আছে অসাধারণ মানবিক এক গল্প, তারাও তুলতে পারে সুবিচারের দাবি।
আমরা যেমন ভাবি জলদস্যুরা কখনোই তেমনটি ছিল না। জলদস্যুতার স্বর্ণযুগ ছিল ১৬৫০ থেকে ১৭৩০ সাল।
সেসময় থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মুখপাত্ররা কুৎসা রটায় যে তারা হলো অমানুষ, বর্বর ডাকাত। সেই ধারণা আজো অনেকে বিশ্বাস করে। কিন্তু বারবারই আমজনতা তাদের ফাঁসিকাঠ থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। কেন? তারা কি বুঝেছিল যা আমরা বুঝি না? ভিলেইনস অব অল ন্যাশনস বইয়ের লেখক ইতিহাসবিদ মারকাস রেডাইকার এ বিষয়ে আমাদের কিছু স্যাপ্রমাণ দিয়েছেন। ধরুন আপনি সেসময়ের কোনো নাবিক বা সওদাগর, লন্ডনের ইস্ট এন্ড বন্দর থেকে ুধার্ত ও তরুণ আপনাকে তুলে নেয়া হলো জাহাজে।
যাত্রা শুরু করে একসময় দেখতে পেলেন এক কাঠের নরকে করে আপনি ভাসছেন। উদয়াস্ত খাটতে খাটতে আপনার পেশি কুঁচকে গেছে, আধাপেটা খাওয়া, এক মুহূর্তের জন্য কাজে উদাস হয়ে গেছেন। সর্বশক্তিমান সারেং আপনাকে চাবুক পেটা করবে। বারবারই যদি আপনার ফাঁকি ধরা পড়ে তো আপনাকে ছুঁড়ে ফেলা হবে সাগরে। অথবা মাস শেষে দেখলেন আপনার মজুরি মেরে দেওয়া হয়েছে।
এই বর্বর দুনিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহী ঐ জলদস্যুরা। তারা তাদের বর্বর ক্যাপ্টেনদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সমুদ্রের কারবারের নতুন নিয়ম তৈরি করেছিল। জাহাজ পাওয়া মাত্র তারা তাদের ক্যাপ্টেন নির্বাচিত করতো এবং সকল সিদ্ধান্তই নিতো এজমালি ভাবে। লুটের মাল তারা এমনভাবে ভাগ করতো যা থেকে রেডাইকার বলছেন, ‘সেটা ছিল আঠারো শতকের সবচেয়ে সমতাবাদী ভাগযোগ’। এমনকি তারা পালিয়ে আসা আফ্রিকি দাসদের তুলে নিতো, দিত তাদের সমান মর্যাদা।
জলদস্যুরা পরিষ্কারভাবে কিন্তু ঘোষণা ছাড়াই দেখিয়ে দিয়েছে যে, সওদাগরি কোম্পানি বা রয়্যাল নেভির বর্বর কায়দায় জাহাজ চালানো চলবে না। সেজন্যই নিষ্ফলা চোর হওয়া সত্ত্বেও তারা ছিল জনপ্রিয়।
সেই হারানো যুগের এক তরুণ ব্রিটিশ জলদস্যুর কথা আজো শতাব্দী পেরিয়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। তাকে ফাঁসিতে ঝোলানোর ঠিক আগে সে বলে, ‘আমি যা করেছি তা কেবলই ধ্বংস থেকে বাঁচার জন্য। বাঁচার জন্যই আমি জলদস্যু হতে বাধ্য হয়েছি।
’ ১৯৯১ সালে সোমালিয়ার-আফ্রিকার শিং-সরকার ভেঙ্গে পড়ে। এর কোটিখানেক মানুষ তারপর থেকে আজ অবধি দুর্ভিরে সঙ্গে লড়ছে। তখন থেকে পাশ্চাত্যের জঘন্য রাষ্ট্রশক্তিগুলো মওকা বুঝে দেশটির খাদ্য সরবরাহ কেড়ে নেয় এবং এর উপকূলে তেজষ্ক্রিয় বর্জ্র্যপদার্থ ফেলতে শুরু করে।
সরকার গায়েব হয়ে যাওয়ার মুহূর্ত থেকেই সোমালিয়ার উপকূলে হানা দিতে থাকে রহস্যময় ইউরোপীয় জাহাজ। তারা বিরাট বিরাট ব্যারেল ফেলতে থাকে সেখানে।
উপকূলীয় অধিবাসীরা অসুস্থ হতে শুরু করে। প্রথম প্রথম তাদের গায়ে অদ্ভুত দাগ দেখা দিত, তারপর শুরু হলো বমি এবং বিকলাঙ্গ শিশু প্রসব। ২০০৫ সালের সুনামির পর, তাদের উপকূল ভরে যায় হাজার হাজার পরিত্যক্ত ও ফুটো ব্যারেল। মানুষ তেজষ্ক্রিয়তায় ভুগতে থাকে। ৩০০ এরও বেশি মানুষ মারা যায়।
সোমালিয়ায় জাতিসংঘ প্রতিনিধি আহমেদু আবদাল্লাহ বলেন, ‘কেউ এখানে একটানা পারমানবিক উপাদান ফেলছে। আরও ফেলছে সীসা, ক্যামিয়াম ও মার্কারি। ’ খুঁজলে দেখবেন এর বেশিরভাগই আসছে ইউরোপীয় হাসপাতাল ও কারখানাগুলো থেকে। ইতালিয় মাফিয়াদের মাধ্যমে সস্তায় তারা এগুলো এখানে খালাস করে। ইওরোপীয় সরারগুলো এ নিয়ে কিছু করছে? না, না তারা এগুলো পরিষ্কার করছে, না দিচ্ছে তিপূরণ, না ঠেকাচ্ছে এগুলো ফেলা।
একইসময়ে অন্য কিছু ইউরোপীয় জাহাজগুলো সোমালিয়ার সমুদ্র লুট করে চলেছে। সোমালিয়ার প্রধান সম্পদ তাদের সামুদ্রিক মাছের ভাণ্ডার। ইওরোপ আগে অতিশোষণের মাধ্যমে নিজেদের মাছের ভাণ্ডার নিঃশেষ করেছে, এখন হামলে পড়েছে অন্যের পানিতে। সোমালিয়ার অরতি পানি থেকে তারা ফিবছর ৩০০ মিলিয়ন ডলারের টুনা, চিংড়ি, গলদা চিংড়ি ও অন্যান্য মাছ ধরে নিয়ে আসে। স্থানীয় জেলেরা দেখতে পেল হঠাৎ, তাদের সর্বস্ব খোয়া গেছে এবং তাদের ুধার কোনো নিবারণ নাই।
রয়টারের কাছে মোহাম্মদ হোসেন নামে এক যুবক বলে, ‘যদি কিছুই করা না হয়, অল্পদিনের মধ্যেই আমাদের সমুদ্র মাছহীন হয়ে পড়বে। ’
এই পটভূমিতেই ওই মানুষদের আবির্ভাব, যাদের আমরা বলছি ‘জলদস্যু’। সকলেই মানে যে, এরা আসলে সাধাসিধা জেলে। প্রথমে তারা স্পিডবোট নিয়ে বর্জ্র্য ফেলা ও মাছ ধরার জাহাজ ও ট্রলারগুলিকে তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। একপর্যায়ে তাদের ওপর ‘ট্যাক্স’ বসানোরও চেষ্টা চলে।
এক পরাবাস্তব টেলিফোন সংলাপে জলদস্যুদের এক নেতা সুগুল আলি বলেন, তাদের উদ্দেশ্য ছিল ‘বেআইনী মাছ ধরা এবং উপকূল দূষণ থামানো...আমরা জলদস্যু নই...ওরাই জলদস্যু যারা আমাদের মাছ কেড়ে নেয়, যারা আমাদের সমুদ্র বিষ দিয়ে ভরে ফেলে এবং আমাদের পানিতে অস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করে। ’
না, এ জন্যই নাবিকদের জিম্মি করার পপাতি নই আমরা। এবং এও সত্য যে, ওই জলদস্যুদের মধ্যে বেশ কিছু গুণ্ডা-বদমাশও রয়েছে। তারা জাতিসংঘের খাদ্য সরবরাহও লুট করে। এবং এও সত্য যে, স্থানীয়দের কাছে এই জলদস্যুরা বিপুলভাবে জনপ্রিয়।
স্বাধীন সোমালিয় সংবাদ-সাইট WARDHERNEWS এ বিষয়ে সবচেয়ে ভাল একটি জরিপ চালিয়ে দেখেছে যে, ‘৭০ ভাগ সোমালিয় মনে করে জলদস্যুতাই এখন তাদের সমুদ্র প্রতিরার জাতীয় কৌশল। ’ আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময়, জর্জ ওয়াশিংটনসহ মার্কিন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতারা জলদস্যুদের দিয়ে মার্কিন সমুদ্রসীমা রার কাজ করিয়ে নিতেন। এজন্য তাদের টাকাও দেওয়া হতো, কারণ সেসময় আমেরিকার কোনো নৌবাহিনী ছিল না। বেশিরভাগ মার্কিনির কাছেও এটাকে ঠিকই মনে হয়েছিল। সোমালিয়রা কি তাদের থেকে খুবই আলাদা?
আমরা কি চাইছি যে, ক্ষুধার্ত ও তেজষ্ক্রিয়ায় রুগ্ন সোমালিয়রা সমুদ্র সৈকতে ধুকে ধুকে মরবে কিন্তু নীরবে চেয়ে দেখবে তাদের থেকে চুরি করা মাছ পরিবেশিত হচ্ছে লন্ডন, প্যারিস আর রোমের রাজকীয় রেঁস্তোরায়! যখন তাদের বিরুদ্ধে এই অপরাধগুলো আমরা হতে দিয়েছি।
কিন্তু যেই তারা বিশ্বের বিশ ভাগ তেল পরিবহনের সমুদ্রপথে বাধা দেওয়া শুরু করলো, সেই আমরা ‘শয়তানদের’ নিয়ে পড়লাম। যদি সত্যিই জলদস্যুতা বন্ধ করতে হয়, তাহলে এর গোড়ায় হাত দিতে হবে। থামাতে হবে আমাদের অপরাধগুলো।
২০০৯ সালের এই জলদস্যুদের গল্পের সারাংশটি সবচেয়ে ভালভাবে প্রকাশ করা যায় খ্রীস্টপূর্ব চার শতাব্দী কালের এক জলদস্যুর কথায়। তাকে বন্দি করে মহান আলেকজান্ডারের সামনে আনা হয়।
সম্রাট আলেকজান্ডার জানতে চান, ‘সমুদ্রের দখল ধরে রাখা বিষয়ে সে আসলে কী বোঝাতে চায়?’ জলদস্যুটি মুচকি হেসে জবাব দিল, ‘গোটা পৃথিবী দখল করা দিয়ে আপনি যা বোঝাতে চান; কিন্তু ওই কাজ আমি করছি ছোট্ট এক জাহাজ নিয়ে আর আপনি করছেন বিরাট নৌবহর দিয়ে। সেজন্যই আমি ডাকাত আর জাঁহাপনা আপনি সম্রাট’।
আবারো, আমাদের মহান রাজকীয় নৌবহর মহান এক অভিযানে রওনা হলো আজ- কিন্তু বলতে পারেন, কে আসলে ডাকাত?
জোহান হারি, ব্রিটেনের দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট এর লেখক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।