Let the wind blow out the candles
সিলেট আসার পর একটা সমস্যা, খালি ঘুম পায়।
না যখন তখন না, সিএনজি-তে উঠার পর। শেষ পর্যন্ত আামাদের এডভেঞ্চার টিম এই বিরল আবিষ্কারে সম্মতি জানালো, সিলেটের সিএনজিগুলো চলার সময় ঝিমায় বলে যাত্রীদের চোখেও ঘুমপরী কাতুকুতু দিতে থাকে। সিলেট ট্যুরে আসার পর ট্রান্সপোর্ট নিয়ে একটু সমস্যা তৈরি হয়েছে - মাইক্রো এর ভাড়া শুনলে কেমন কেমন জানি লাগে। যদিও যাবার আগে একটা ব্লগে পড়ে গেছি মাইক্রো নাকি স্বস্তা, কিন্তু ভাড়া শোনার পর আমাদের স্বস্তার ডেফিনেশন সেটাকে গ্রহণ করতে অসম্মতি জানালো।
তাই আগের দিন জাফলং চলে গেলাম "বিরতিহীন" বাসে চড়েই। জাফলং এর প্রসঙ্গ যখন উঠলো, একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করেই ফেলি! ওখানে ঘাট থেকে নৌকায় জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত যাওয়া যায়, (ইন্ডিয়ার বর্ডারের কাছে) ইন্ডিয়ার পাহাড়ের মাঝে ঝুলন্ত সেতু দেখা যায়, নদীতে গোসল করবেন, পাহাড় সংগ্রহ করা দেখবেন - এসব কোন ট্যুরিস্টই মিস করতে চাইবেন না! তবে জাফলং যাবার পর প্রথমেই যে সাদর অভ্যর্থনা পাবেন, সেটার ধাক্কা সামলে নিতে একটু কষ্ট হতে পারে! আপাতত: এটুকু মাথায় রাখুন, নৌকা ভাড়া খুব বেশি হলে দেড়শো কি দু'শো, যদিও এরা চারশো'র নিতে যেতে চাইবে না। একটু সামনে হাটলেই দেখবেন অনেক ইন্জিন নৌকা- ভাড়া করলে এগুলোই করবেন।
আসার সময় সি.এন.জিতে আসলাম। এখানকার সিএনজিগুলোর সামনের সিটে দু'জন বসা যায়।
আমরা মানুষ পাচজন, তাই সামনে দু'জনকে বসতে হবে। সিএনজিতে ওঠার সময় আমি সবসময়ই সামনে বসতে চাই, পেছনের সিটে চাপাচাপি করে মরার চেয়ে সামনে বসা ঢের ভালো, তাই এবারো স্বেচ্ছায় সামনের সিটে চলে গেলাম। সিএনজি স্টার্ট দিয়েছে পাচ মিনিটও হয়নাই, আমার চোখের পাতা দেখি বিশ কেজি হয়ে গেছে। কোন মতে পড়তে পড়তে সামনে নিলাম। নাহ, ভুলে ঝিমানো শুরু করেছিলাম, সিএনজির সামনের সিটে কেউ ঘুমায়! ঘুম এড়াতে অন্যকিছুর কথা ভাবতে লাগলাম।
বুড়া হয়ে যাইতেছি, প্রেম ট্রেম এখনো করতে পারলাম না। প্রেমিকা থাকলে আজ হয়তো তাকে নিয়েই ঘুরতে আসতাম, ইন্ডিয়ান পাহাড়ের ঝর্ণাগুলো দেখতে দেখতে রোমান্টিক দুএকটা কথা বলতাম... ক্রমে আজকের সবগুলো কর্মকাণ্ডে কাল্পনিক প্রেমিকাকে জড়িয়ে ফেলে বিষয়টা আপত্তিকর কিংবা মধুরতম হয়ে যাচ্ছিল, ড্রাইভার মামু ধাক্কা দিয়ে বলল মামা ঘুমায়েন না। এ্যা, আবার ঘুম, পোলাপানরা জানলে তো পচানি থেইকা কেউ বাচাইতে পারবো না। তখন যদি জানতাম যে সামনের তিনঘন্টার জার্নিতে পালা করে সামনের সিটে বসা পাচজনই একে একে ঘুমে ঢলে পড়বে, তাহলে আর এ ভয় করতাম না! সবশেষে আমাদের ঘুমদর্শন অনেক কষ্টে সহ্য করা ড্রাইভার মামুও নিদ্রাদেবীর বাহুডোরে নিজেকে সপে দিচ্ছিলেন, তবে আল্লাহর রহমতে ততক্ষণে আমরা মাজারগেইটে পৌছে গেছি।
এই ছবিটা জাফলং এর!
তাই দ্বিতীয়দিন মাধবকুণ্ডু জলপ্রপাত দেখতে যাবার সময় ভয়েই ছিলাম আজকে না ঘুম নিয়ে কি কাহিনী ঘটে।
আজকে যে ড্রাইভার মামু আমাদের ভ্রমণসঙ্গী হলেন, আল্লাহর অশেষ রহমতে তিনি একটু বেশিই মোটা। তাই ঘোষণা দিলেন তার সিট শেয়ার করা দু'জন হালকা পাতলা হলে ভালো হয়। একথা শুনে আমি সম্ভবত: জীবনে প্রথমবারের মত সাইজ বড়সর হওয়ার সুফল পেলাম। ফলাফল পরিষ্কার: কারো পৌষমাস কারো সর্বনাশ, জার্নির বাকি রাস্তাটুকু বেচারা ফ্রেন্ডগুলো সিট অদলবদল করতে করতে আর আমার প্রতি মধুবর্ষণ করতে করতে কাটালো, আর আমি পুরা রাস্তাটা পেছনের সিটে গা এলিয়ে জীবনের সব ঘুম ঘুমিয়ে নিলাম। মাধবকুণ্ডু পৌছালাম প্রায় একটার দিকে।
আমার সঙ্গে আসা বাকি চারটার সবগুলোই আমার চেয়ে বড় বান্দর। কাজেই তারা যখন ঘোযণা দিল জলপ্রপাতের মাথায় উঠবে, খুব একটা অবাক হলাম না। আমি ভাবছিলাম এই ঝর্না কত আর উচু হবে, তাই পাহাড় পিছলে মেধাবী হবার ভয় না দেখিয়ে আমিও অভিযানে শরীক হয়ে পড়লাম। ঝর্ণার চুড়ো দেখার শখ সবার নেই, কাজেই এজন্য কোন সিড়ি টিরি নেই, পাহাড় ডিঙিয়ে উঠতে হবে। অবশ্য মানুষজন সংখ্যায় কম হলেও উঠে এখানে, তাই সামান্য ঝুকিপূর্ণ হলেও পথ একটা তৈরি হয়ে গেছে ওপরে ওঠার।
পথটা একটু অনিয়মিত, আর জলপ্রপাতের শব্দও পরিষ্কার শোনা যাচ্ছিল না। এরওপর আমরা পাহাড়ে ওঠা শুরু করেছি জলপ্রপাত না দেখেই, তাই ঠিক রাস্তায় যাচ্ছিলাম কিনা সেটা নিয়েও সন্দেহ ছিল মনে। অনেকখানি ওপরে উঠে গেলাম, হাপাচ্ছি সবাই, ভাবছি এরপর যাব কোনদিকে। চাইলে আরো ওপরে ওঠা যাবে, কিন্তু পানির শব্দ যেটিকটা থেকে আসছে সেটা চলে গেছে নিচের দিকে। ভাগ্য ভালো, আরো কয়েকজনকে তখন দেখলাম নিচের দিকের পথটা থেকে উঠে আসছে।
সেই দলে আন্টিও আছেন দুইএকজন, তাই উচ্চতাভীতির জন্য ফ্রেন্ডরা আমাকে পচানি দিয়েনিল একটা। কি আর করা নিচের দিকের রাস্তাটা নিয়ে একটা জায়গায় আসার পর কনফিউজ হয়ে গেলাম, যেদিকে ঝর্নাটার মাথা দেখা যাচ্ছে সেটা বেশ বিপজ্জনক, নামার কোন সহজ কোন পথ নেই। ঝুলে ঝুলে নামতে হবে, আর পড়ে গেলে তটৈুোৃস। এতদূর আসার পর শেষটা না দেখে কেউ যাবেনা। তাই শুরু হল অভিযানের বিপজ্জনক অংশ।
গাছের শিকড় আর মাটি খামচে ধরে আস্তে আস্তে নিচে নামা শুরু করলাম। একটু পড়েই অবশ্য সাহস এসে গেল খানিকটা। শেষ লাফটা দিয়ে যখন এসে পড়লাম ঝর্নার মাথায়, প্রকৃতির নির্লজ্জ্ব সৌন্দর্য্য দেখে এতক্ষণের সব কষ্টের কথা ভুলে গেলাম। ঘুরতে আসা কিছু পোলাপানের চিল্লাফাল্লা জায়গাটার সৌণ্দর্য্য প্রায় নষ্ট করে দিচ্ছিলো অবশ্য।
আমি ভাবছিলাম যাক ভালোয় ভালোয় শেষ হল এডভেঞ্চার, ভয়ে ভয়ে পোলাপানের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রমাদ গুণলাম।
এরা এতক্ষণে শার্ট টার্ট খুলে ভেতরের দিকে যাওয়ার প্ল্যান নিয়ে নিয়েছে। ঝর্ণার উৎস তো দেখা হল, কিন্তু পানি আসলেই আসছে কোথা থেকে? এতক্ষণ গোসলের জন্য আনা আমাদের অতিরিক্ত কাপড়ের ঝোলাটা হিরা বহন করছিল, সেটা থেকে থ্রিকোয়ার্টার বের করে বদলে নিলাম। শার্ট, জিন্স ব্যাগে নিয়ে বহন করা সম্ভব নয়। সবার পা কাপছে, আর এতক্ষন টানা পাহাড় বেয়ে উঠে সবার এনার্জি শেষ। তাই জামাকাপড় সব ওখানেই রেখে শুধু মোবাইল আর মানিব্যাগ নিয়ে শুরু হল এডভেঞ্চার: পার্ট টু।
কেউ যদি আমাদের টিশার্ট আর জিন্সগুলো নিয়ে চম্পট দেয় তাহলেও সমস্যা নেই, খালিগায়ে সি.এন.জিতে তুলতে ড্রাইভার মামু নিশ্চয়ই আপত্তি করবেনা।
অভিযানের এই অংশটা বেশি বিপজ্জনক, কারণ আমরা এগুনো শুরু করেছি পানির রাস্তাটা ধরে। পানির সঙ্গম পেয়ে রাস্তার পাথরগুলো এমনই পিচ্ছিল হয়ে গেছে যে হাত দিয়ে ধরে ধরে যেতে হচ্ছে। অসাবধান হবার প্রশ্নই আসেনা, ব্যাপক সতর্কতার সাথে চলার পরও সবাই পালা করে পিছলে পড়তে লাগল। হাড্ডি না ভাঙ্গলেই হয় এখন।
অনেকখানি সামনে আসার পর পুরোপুরি নির্জন এলাকায় এসে পড়লাম, ইনজাম বললো সে নাকি বানর দেখেছে। বাশ কেটে ফেলে রাখা হয়েছে, এগুলো দিয়ে সম্ভবত: পাহাড়ি ডাকাতদের পেটানো হয়। ডাকাতের কথা মনে হতেই পানির তেষ্টা পেয়ে গেল। অসম্ভব সুন্দর পাহাড়ি ঝর্ণার পথ বেয়ে এগিয়ে চলেছি, পাহাড়ি গাছপালা, পোকামাকড়, নিস্তব্ধতা ভেঙে মাঝে মাঝে অচেনা পাখির ডাক সব মিলিয়ে ভয়ংকর সুন্দর একটা অনুভূতি। আফসোস ছবি তোলা সম্ভব ছিলনা, তাই হৃদয়বন্দী অনুভূতিটুকু ক্যামেরাবন্দী করা গেল না।
এর মাঝে পায়ের নিচের পাথরগুলো পিছলে হতে হতে এখন প্রায় অনতিক্রম্য হয়ে উঠেছে... পানি আমাদের কোমড় ছাড়িয়ে গেছে। এর মাঝেই আমি কয়েকবার রাস্তায় বাঘের ডিমের খোসা দেখে বন্ধুদের সতর্ক করেছি আর সামনে যাবার দরকার নেই, এতক্ষণে সবাই রণে ভঙ্গ দিলো। ঠিক হল আবার আসা হবে এখানে, পানির উৎস খুজে না পাওয়ার অপ্রাপ্তিটা মেটাতে, ক্যম্পিং এর জন্য পারফেক্ট একটা জায়গা (যদিও পানির উপরে কোথায় ক্যাম্প করবো জানিনা)
নিচে নামার সময় অন্য রাস্তা নিতে হল - যার একপাশে কিছুই নেই, খাড়া পাহাড় নেমে গেছে ! পা হড়কে গেলে সোজা ২৩০ ফুট নিচে থেথলে মেধাবী হয়ে যেতে হবে। সবার পা এরমাঝেই কাপাকাপির প্রবণতা দেখানো শুরু করেছে, তাই পায়ের ওপরে ভরসা ছেড়ে দিয়ে হাত দিয়ে ধরে নামা শুরু হল।
নিচে যখন নামতে পারলাম শেষ পর্যন্ত, শরীরে এতটুকু এনার্জি নাই।
তবে ঝর্নার পানিতে গোসল করে সব অবস্বাদ চলে গেল! ম্যাজিক ছাড়া আর কিছু না!!
এবার তোলা কিছু ছবি.....................
ঝর্ণার মাথা থেকে তোলা
এটাও ঝর্ণার মাথা থেকে.....
জলপ্রপাতের উৎস। খেয়াল করলে দেখবেন , পানির স্রোত কিন্তু নেই বললেই চলে। কিন্তু নিচে নামতে নামতে ঝর্নার পানির যা অবস্থা হয়, ঝর্ণার নিচে দাড়ালে মাথা মনে হয়না আস্ত থাকবে!
এবার নিচ থেকে তোলা ঝর্ণার ছবি...
জলপ্রপাতের আরেক সৌন্দর্য্য: রংধনু! বিকেলের সূর্যরশ্মি ছিটকে পরা পানির সাথে মিলে অপূর্ব একটা রেইনবো ইফেক্ট তৈরি করে... ক্যামেরাবন্দী কিছু দৃশ্য:
রংধনুর আরেকটি শট: Click This Link
পরে যা জানলাম: মাধবকুণ্ডু জলপ্রপাত দেশের সর্বোচ্চ জলপ্রপাত, ২৩০ ফুট ওপর থেকে জলপতনে তৈরি হয়েছে ছোট্ট খালের মত।
ঝর্নার নিচ থেকে তোলা আরেকটা অপ্রাসঙ্গিক ছবি!
সিলেট থেকে মাধবকুণ্ডু সি.এন.জিতে দু ঘন্টার মত লাগে। ভাড়া আমাদের কাছ থেকে রেখেছে ৮০০ টাকা।
মাইক্রোতে খরচ কিছুটা বেশি পড়বে। ভেঙ্গে ভেঙ্গে বাসেও যাওয়া যায়। তবে সরাসরি বাসও থাকতে পারে, সঠিক তথ্য আমরা পাইনি যদিও।
সিলেটে ঘুরতে গেলে তাই মাধবকুণ্ডু মিস করবেন না!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।