সেদিন এক ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি চমকে উঠলাম। দাঁড়িগোঁফ গুলো একটার চাইতে আরেকটা বেশ তফাতে অবস্থান করছে, অনেকটা আমার মতই। মাঝে মাঝে ভাবি বয়স কত হল যেন? এখানে ওখানে অপরিকল্পিত ভাবে ছড়িয়ে রয়েছে চুল দাঁড়ি, যেন এক বদ্ধপাগল। যদিও কেউই এই বিশেষনটি কখনও আমার ক্ষেত্রে ব্যবহার করেনা। তো লোকটি হেঁটে যাওয়ার সময় তার শার্টের পকেট বরাবর টিপ্ করে সাদাকালো রঙ ছড়িয়ে দিল কালো রং এর বেরসিক একটি পাখী।
বেচারা আবার পেছনের পথ ধরলেন শার্ট বদলাতে। নানা রঙের এইসব পাখীরা আমাকেও বড্ড জ্বালায়, যাক সে কথা না হয় পরে বলা যাবে। বলছিলাম বয়সের কথা। ঠিক বলতে পারব না জন্মের সন তারিখ। তবে মনে আছে মানুষ জন অনেক কম ছিল তখন।
এখন যেদিকে তাকাই শুধু মানুষ আর মানুষ। তখনকার দিনের মানুষেরা ছিল সহজ সরল নম্র, আর এখন কেমন যেন যান্ত্রিক-বেপরোয়া। নাকি পুরনোরা নতুনকে স্বাচ্ছন্দে গ্রহণ করতে পারেনা খুব একটা, হবে হয়তো। তবে একটা বিষয় বদলেছে আগে আমার খাবারের অভাব হতো বেশী, পেট ভর্তি হতে সময় লাগত বেশ। আর এখন নিমিষেই ভর্তি হয়ে যায়।
কি যেন বলছিলাম... ও হ্যাঁ বয়স .. হাহ্ হাহ্ হা হা হা হা .. স্মৃতি শক্তিও বুঝি নষ্টের পথ ধরল। শরীরটা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। তাই জন্যেই বয়সের কথাটা বেশী করে মনে পড়ছে। বাঁ পাশটায় কি যে হল, একদিকে বেশ বড় সড় একটি গর্তের মত হয়েছে দেখতে। বুঝিবা আস্ত একটি বিড়ালই ঢুকে যেতে পারবে তার ভেতর দিয়ে।
খাবারের কথা যেটা বলছিলাম, ইদানিং পেটটা ভর্তি হয়ে যায় খুব তাড়াতাড়ি। কোরবানির ঈদের সময়তো আমার উপর রীতিমত জুলুম চালান হয়। পেট ভর্তি হওয়ার পর গলা মুখ উপচে আমার চারিদিক একাকার হয়ে যায়। তারপর শুরু হয় সিটিটাকে তিলোত্তমা বানানোর চেষ্টায় সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতা অভিযান। অলিতে গলিতে বিক্ষিপ্ত ভাবে ছড়ানো ব্লিচিং পাউডারের আস্তরন মনে করিয়ে দেয় নিশিপ্রেয়সীদের সাজ।
ওদিন একটি মজার ঘটনা ঘটল, সম্ভবত বাপের জনমে এই প্রথম দেখলাম। আচ্ছা এখানে কি ‘বাপের জনম’ কথাটা যৌক্তিক হবে? যাক তো যেদিনের কথা বলছিলাম, দেশে তখন জরুরি অবস্থা চলছে এবং ভোটার তালিকা তৈরীর জন্য পাড়ায় পাড়ায় ছবি তোলার কাজ শুরু হয়েছে। এই পাড়ায় যেদিন থেকে কাজ শুরু হবে তার আগের দিন চারিদিকে ধোয়া মোছার ধুম পড়ে গেল। একেতো জরুরি অবস্থা তার ওপর সেনা বাহিনী নাকি সার্বিক সহযোগিতার জন্য সার্বক্ষনিক মাঠে থাকবেন। সুতরাং অজানা ভয়ে কর্তাব্যক্তিরা তটস্থ, চারপাশ পরিষ্কার থাকা চাই।
আমি যে কারণে অবাক, তারা এই অধমকে পর্যন্ত সুন্দর করে গোসল করিয়ে দিয়েছে। ভাবলাম আমি কে বা কি অবশেষে সেটাই না লোকে ভুলে যায়। দেখলাম আমার ধারনা ভুল। পরদিন মানে ছবি তোলার দিন, এপাড়ার নতুন বিবাহিত ছেলেটি সকালে অফিসে যাওয়ার সময় আমার দিকে কি যেন ছুঁড়ে দিল। তাকিয়ে দেখি চমৎকার চৌকোণা ছোট্ট প্যাকেট, যার ভেতর থেকে লাজুক ভাবে উঁকি দিচ্ছে পাতলা একটি বেলুন।
ভাল লাগল, বাইরে ফেলেনি। বেশীর ভাগ মানুষের আবার ভেতরের দিকে ময়লা ফেলতে কিসে যেন বাধে। তারা বাইরে ফেলতেই বেশী স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। আমার খাবারেরও বেশ সমস্যা হয়। পরে বলার কথা বলে ফেলে রেখেছিলাম কোন ব্যাপারটা যেন, ও হ্যাঁ পাখীদের বিষয়টা তাই না? এরা ক্ষেত্র বিশেষে মানুষের মত বুদ্ধিমান হয়ে থাকে।
নানা জায়গায় গিয়ে এটা ওটা খাবে তারপর ওসব ছাড়ার জায়গা পাবে আমার এখানে এসে। অবশ্য এরা এই ক্ষেত্রে আরও এক কাঠি বেশী বুদ্ধিমান, জায়গা মত ফেলে। পলেস্তারা খসা অথবা ইঠ খুলে আসা কোন খাঁজে টুপ্ করে বংশধরটাকে ত্যাগ করে দেয়। যার কারণে নানান জাতের বজ্জাত সব গাছ আমার মত অধমকে আশ্রয় করে দিব্যি বেড়ে ওঠে। এদিক ওদিক ঝুলতে থাকে ছোট বড় শেকড় বাকড়।
আচ্ছা আমি নিজেকে ‘বদ্ধপাগল’ ভেবেছিলাম কেন? একজন বয়োবৃদ্ধ মনিষিও তো ভাবতে পারতাম। আসলে জঞ্জালের মধ্যে থাকতে থাকতে এত হীনমন্যতায় ভুগি নিজেকে কি নামে ডাকবো তা-ই ভেবে পাই না। পাড়ার যাবতীয় এঁটো নিকৃষ্ট বস্তুরাই যেখানে আমার সাথে গা ঘেঁষে খেলা করে সেখানে কি নিজেকে আর উৎকৃষ্ট কিছু ভাবতে পারি? সাংসারিক কাজে সহযোগীতা করতে বেশকিছু কর্তাকে রাতের আহার শেষে আবর্জনার বালতি হাতে বেরিয়ে আসতে দেখি। সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বিদ্ধস্ত পায়ে আমার দিকে এগিয়ে আসে। কেউ কেউ ধীরে সুস্থে অত্যন্ত যত্ন করে আমাকে খাবার খাওয়ায়।
মনে হয় যেন বাসায় একটু দেরী করে ফিরতে পারলেই বাঁচে। তখন আবার নিজেকে ভারী সুখী মনে হয়। আমার বাড়ী নেই ঘর নেই, রাস্তার বাঁকে জন্ম আমার রাস্তার বাঁকেই বেঁচে থাকা। হয়ত ক্ষয়ে ক্ষয়ে রাস্তার বাঁকেই একদিন..। সিটি কর্পোরেশনের সেবকেরা যখন আমার পেট পরিষ্কার করতে আসে তখন তাদের দিকেও তাকিয়ে থাকি।
কি করব? এটা ওটা দেখা ছাড়া আমারতো আর কোন কাজ নেই। মাঝে মাঝে ভাবি তারা এত কিছু পরিষ্কার করে নিয়ে গিয়ে কোথায় ফেলে? আরেকটি জায়গাকে অপরিষ্কার করে নিশ্চয়? আচ্ছা তাদের ঘর দুয়ার কি খুবই পরিষ্কার?
আমার ডানপাশে কয়েক গজ দূরে নতুন একটি অত্যাধুনিক দালান তৈরী হয়েছে, খুবই সুন্দর! সেখানে অনেক ভদ্রলোকের বাস। ওখান থেকে প্রায় প্রতিদিনই আমার জন্য কোর্মা, পোলাও, বিরিয়ানির ব্যবহৃত অংশ উপহার হিসাবে পাঠানো হয়। সত্যি বলতে কি আমিতো আর খাই না, হাড্ডিসার কিছু মানুষ সেখান থেকে অমৃত খুঁজে বেড়ায়। অবশ্য তারা খুবই অতিথিপরায়ন।
একা খায়না, সাথে থাকে কুকুর, বেড়াল, চামচিকা।
আঁধার ঘেরা নাগরিক এক রাতে, মনটা খুবই বিমর্ষ ছিল। প্রকৃতির সব আয়োজন যেন থমকে আছে। মনে হচ্ছে আকাশের চন্দ্র তারাদের গুরুত্বপূর্ণ কোন নিমন্ত্রণ রয়েছে কোথাও। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনায়ও শুরু হয়েছে অচলাবস্থা।
ইলেক্ট্রিসিটি নেই অনেক্ষণ। জাতীয় গ্রীডে নাকি ধ্বস নেমেছে। শীতের রাত, মানুষজন নিশ্চয় ঘুমিয়ে পড়েছে এতক্ষণে। অন্ধকারের নিজস্ব আবছা আলোয় দেখতে পেলাম নতুন দালান হতে এক বয়ষ্কা মহিলা এগিয়ে আসছেন আমার দিকে। হাতে ওটা কি? বিরিয়ানির প্যাকেটের মতই মনে হচ্ছে।
চুপিসারে এসে আমার ভেতর অনেকটা ছুঁড়েই ফেলে দিল যেন প্যাকেটটা। মুখের মাংসপেশীতে ফুটে উঠেছে মুক্তির যতিচিহ্ন। দু’তিন সেকেন্ড দাঁড়িয়ে ফিরতি পথ ধরলেন মহিলা, অন্ধকারে ভয় পেয়েছে বলে মনে হল। আমার ভেতরে পড়ার সাথে সাথে প্যাকেট তার মুখটা খুলে দিল উদার ভাবে। নাকে এসে লাগল অচেনা একটি সুবাস।
আরে.. ধরিত্রি হঠাৎ হেসে উঠল কেন? প্যাকেটের ভিতর হতে উঁকি দিল এটা কি? পূর্ণিমার চাঁদ! আহ্ কি চমৎকার দেখতে অসমাপ্ত দেবশিশু! আমি অতি তুচ্ছ, উচ্ছিষ্টের সাথে সহবাস করতে করতে নিজেকে আরও বেশী তুচ্ছ মনে হয়। ধন্যবাদ প্রকৃতিকে, পাপ সর্বস্ব ইট পাথরের এই জীবনে এই প্রথম কোন এক দুর্লভ পূর্ণিমার পূণ্যে পূর্ণ হলাম আমি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।