আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চেতনার অমাবস্যায় এক ধর্মদ্রোহী যুবকের দেশত্যাগ

Set sail, ye hearts~ into the sea of hope.. বাংলাদেশের একটি সশস্ত্র বাহিনীর নিজস্ব কমপ্লেক্সের নয় তলার একটি রুম। নিরাপত্তার জন্য জানালাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, ভেতরে কয়েকজন অফিসার এক নগ্ন বন্দীকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। “খুলে বল কারা তোকে স্পাইং করতে পাঠিয়েছে? একটা একটা করে নাম বল নাইলে খবর আছে…তুই তো মরবি-ই, তোর বউ বাচ্চাদেরও কোনও হদিস থাকবে না…” একজন অফিসার এগিয়ে গেলো বন্দির দিকে। বন্দী লোকটির সারা শরীর কাঁপছে, কিন্তু প্রশ্নের উত্তর দেয়ার ব্যাপারে সে কোনও চেষ্টা করছে না। গত কয়েক ঘণ্টায় এই প্রশ্নটা সে কম করে হলেও এক হাজারবার শুনেছে, কিন্তু কি উত্তর দিবে সে এটার?? যতবারই বলতে গেছে সে কারও স্পাই না, যা করেছে নিজের ইচ্ছায় করেছে, ততবারই তাকে নির্মমভাবে পেটানো হয়েছে।

অফিসার বিরক্ত মুখে এবার নিজেই এগিয়ে গেলেন, দুই হাতের তালু দিয়ে রাম থাপ্পড় কষে বললেন, “কুত্তার বাচ্চা, চুপ করে আসিস ক্যান! কানে কথা যাচ্ছে না??” শেষ বারের মতো মুখ খুললো বন্দী, “স্যার আমি আসলেই কোনও স্পাই না, আমি একজন সাধারণ ছাত্র, সমাজকর্মী…এর বেশী কিছু না। আপনারা ভুল করছেন…” কিন্তু কথা শেষ হওয়ার আগেই প্রহরীর কঠিন আঘাতে জ্ঞান হারালো সে। সাধারণত টর্চার সেলে প্রহরীরা এমনিতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে অফিসারদের ইশারা পেলে অ্যাকশনে যায়, কিন্তু কিছু কিছু সময় অর্ডার ছাড়াই অ্যাকশনে যাওয়ার অনুমতি আছে। এই যেমন একটু আগে, বন্দীটা আরেকটু হলেই বলে ফেলছিলো যে স্যার ভুল করছেন। “স্যারের কখনো ভুল হতে পারে না, অন্তত টর্চার সেলের ভেতরে তো না-ই…” মনে মনে হাসলো প্রহরীটা।

“আপাতত একে লকারে ঢুকায় রাখো, পরে কি করতে হবে জানাবো…“আদেশ করে বের হয়ে আসলো অফিসার। তাকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। ডেস্কে বসেই বেয়ারাকে ডেকে চা এর অর্ডার দিলেন তিনি, তার পর ডেকে পাঠালেন আরেক অফিসারকে। সেই বন্দীর ব্যাপারে কথা বলতে, ব্যাটাকে দিয়ে স্পাইং এর অভিযোগ কবুল করাতে পারলে কেল্লাফতে হয়ে যেতো, কিন্তু সে তো কিছুই বলতে পারছে না… চা হাতে নিয়ে বিড়বিড় করে নিজেই কথা বলছে সেই অফিসারটি, মুসলমানের দেশে বসে খ্রিষ্টান হওয়ার খায়েশ, কত বড় আস্পর্ধা! তুই নিজে খ্রিষ্টান হলে সেটাও একরকম মানা যায়, আবার সেটা প্রচার করে বেড়াতে হবে?? “কি ভাবলেন স্যার, কেসটা কি এগুবে…?” জুনিয়রের কথায় সম্বিত ফিরে পেলেন সেই অফিসার, “না জুবায়ের, ব্যাটাকে নিয়ে সুবিধা করা যাবে বলে মনে হয় না। জোর করে স্টেটমেন্ট নেয়া যেতে পারে।

কিন্তু কোর্টে যেয়ে উলটা আমাদের ফাঁসায় দিলে অসুবিধা আছে। আমি উপরে কথা বলে দেখেছি, তারাও এটা ফোকাস হোক সেটা চায়না…” হতাশ মুখে টেলিফোনের দিকে তাকালেন তিনি। “কিন্তু স্পাইং এর অভিযোগ আপাতত প্রমাণ করতে পারলেও তো আপনার প্রমোশন নিশ্চিত হয়ে যেতো…” বলে উঠলো জুবায়ের, “হ্যাঁ তা হতো ঠিক আছে, কিন্তু পরে ঝুলায় দিবে আমাদের। ছেলেটা যে জিনিষ…দেখেছ তো, কিছুতেই মুখ খোলানো গেলো না…” এই কথার পর দুই জনই কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে গেলো। “এখন তো স্যার আমরা অনেক কিছু করে ফেলেছি, ছেড়ে দিলেও তো সমস্যা…” জুবায়ের নামের অফিসারটির গলায় এবার কিছুটা দুশ্চিন্তা।

“নাহ, এই নিয়ে একদম ভেবোনা। সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি, দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেবো এটাকে, তুমি মিডিয়া গুলোকে ইনফর্ম করো এই ব্যাপারে। একে নিয়ে কেউ যেন নিউজ না করে, এই ব্যাপারটা এনশিওর করো…” ইয়েস স্যার বলে স্যালুট করলো জুবায়ের, তারপর সোজা হেঁটে চলে গেলো, ডেস্কে থাকা অফিসার আনমনা হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর পাশ থেকে একটা ফাইল তুলে নিলেন। .2. অডিটোরিয়ামের এক কোনায় চেয়ারে বসে স্টেজ সাজানোর কাজ তদারকি করছেন তোফায়েল।

সময়টা বর্ষাকাল হলে কি হবে, প্রচণ্ড গরমে সবার প্রাণ ওষ্ঠাগত প্রায়। রাতের অনুষ্ঠানের জন্য ইলেক্ট্রিসিটির লাইন ঠিক করা হচ্ছে, তাই টেবিল ফ্যান আপাতত বন্ধ। দুই পাশে দুই জন পাখা হাতে দাঁড়িয়ে বাতাস করছে কিন্তু তাতেও গরম যাচ্ছে না। এর ভেতর আবার বিভিন্ন রকম ঝামেলায় চিৎকার করতে হচ্ছে, “এই আকবর…আগে সোফা গুলা বসায় তারপর চেয়ার লাগাইস, আঁকাবাঁকা হইতেসে ক্যান ! হালার পুত, সোজা দেখিস না??” কিছুক্ষণ পরপরই মোবাইল বেজে উঠছে তার। কথা বলতে বলতে হঠাৎ করে তিনি লক্ষ্য করলেন অনেকক্ষণ থেকে কাদের তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু কোনও কথা বলছে না।

এলাকায় কাদের হলো তার ডান হাত, তার হয়ে সে-ই বিভিন্ন প্রব্লেম ট্যাকল করে। …। কাদেরের দেখা পাওয়া মানেই হলো, জরুরী কোনও নিউজ আছে। মাথা নাড়লেন তিনি “খুবই খারাপ লক্ষণ, নিশ্চয়ই এলাকায় কিছু একটা হয়েছে, মেজাজ দেখে বলার সাহস পাচ্ছে না। ” এমপি হওয়ার পর থেকেই তিনি খেয়াল করছেন তার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে।

মানুষের চালচলন দেখলেই এখন অনুমান করতে পারেন সে কি ভাবতে বা কি করতে পারে। “দাঁড়িয়ে আছ কেন কাদের? বসো…” ইশারায় পাশের একটা চেয়ার টানতে বললেন তাকে। “না বস, কাজ দেখছিলাম। মেহমানরা আসবেন সন্ধ্যার পর এখনই তো কাজ মোটামুটি তো গুছিয়ে ফেলেছেন। ” মৃদু হাসলেন তোফায়েল, “হ্যাঁ নির্বাচনের পর প্রথম সব কেন্দ্রীয় নেতারা আসছেন এলাকাতে, আগেভাগে সব ঝামেলা তো মিটায় রাখতেই হবে।

তো এলাকার খবর কি ভালো? মনে হচ্ছে কিছু বলতে চাও…” অস্বস্তির হাসি হাসলো কাদের, “না বস ছোট্ট একটা ঝামেলা হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। আমরাই সামলে নিয়েছি, আসলাম আপনার কানে একটু দিয়ে রাখা দরকার ঘটনাটা। ” নিজের অনুমান সত্য হয়েছে বুঝতে পেরে মিটিমিটি হেসে উঠে দাঁড়ালেন তোফায়েল, “অনেকক্ষণ বসে পা লেগে গেছে, চলো একটু সামনের দিকে যাই। হাটতে হাটতে সংক্ষেপে বলো কি হয়েছে…” “এলাকার একটা ছেলে কিছুদিন আগে ইসলাম ধর্ম ছেড়ে খ্রিষ্টান হয়েছে, বউ আর দুই ছেলে সহ। সে এখনো ছাত্র, কিন্তু একটা এনজিওতে কাজ করতো…” এই টুকু বলে এমপি সাহেবের দিকে তাকালো কাদের।

প্রতিক্রিয়া কি হয় সেটা দেখে বাকী কথা বলবে, “মাঝপথে থেমো না কাদের, বলতে থাকো। আমি শুনছি…” হতাশ হয়ে আবার শুরু করলো সে, “এমনিতে ছেলেটার আদব কায়দা ভালো। দেখা হলে সম্মান-টম্মান করে, কিন্তু এনজিওর কাজে মসজিদ, চার্চ আর মন্দির গুলায় ঘুরতে ঘুরতে মাথা খারাপ হয়ে গেছে মনে হয়। তাই আমরা নিজের থেকে কিছু বলি নি। কিন্তু এলাকার লোকজন তো এগুলা বুঝে না, তারা..” “..তারা কি করেছে? পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছে?” কথা কেড়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন তোফায়েল।

“জ্বি হ্যাঁ বস…” সরু চোখে তাকিয়ে কাদের বললো, “এরপর…” এবার হাত তুলে কাদেরকে থামিয়ে দিলেন এমপি। “আমি বলি এরপর তুমি কি করেছ, ওকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে, লাঠিসোটা নিয়ে ওদের পরিবারকে গ্রাম ছাড়া করেছ। তারপর লোকদের বলেছ যে আমি আসলে ওদের বিচার করবো। ” মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে কাদের, সব কথা গুছিয়ে আনার পরও এমপি সাহেবের সামনে আসলে কেন জানি কখনোই সে গুছিয়ে কথা বলতে পারে না। “ভালোই করেছ, দেখা যাক এখন কি করা যায়।

চলো ভেতরে গিয়ে বসি…” অনেক বড় বিপদ থেকে বেচে গেছে এরকম একটা ভাব করে উপরের দিকে তাকালো কাদের। “এমপি সাহেব হাসছেন, তার মানে সব ঠিকঠাক আছে…” ইলেক্ট্রিসিটি এসেছে কিছুক্ষণ আগে, স্টেজের কাজও প্রায় শেষ। তোফায়েল কাদেরসহ তার নিজস্ব কিছু লোক নিয়ে বসে আছে অডিটোরিয়ামের ভেতর। ডেকোরেশনের সমস্ত কাজ শেষ, এসি’র ঠাণ্ডা বাতাসে গরমের অস্বস্তি চলে গেছে। এলাকার সমস্যাটা নিয়ে এখন তিনি কথা বলছেন, “গোপনে ধর্মত্যাগ করলে সমস্যা হয় না, কিন্তু এই নিয়ে মাইকিং করে বেড়ালে সমাজ সেটা স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিবে না।

ওই ছেলে কে ফিরিয়ে আনা তো দুরের কথা, ওদের পরিবারও কখনো এলাকায় ফিরতে পারবে না। গোপনে দূরের কোনও জায়গায় পাঠিয়ে দেয়া যায় কি না ভাবছি…” আশেপাশের অনুচরদের সাথে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো কাদের। তারপর বললো, “কিন্তু বস এটা নিয়ে তো সালিশ বসবে, সেখানে আপনাকে ওদের বিচার করতে হবে। আর পুলিশও ঐ ছেলেকে নিয়ে প্যাচ কষছে, বড় স্যার তো বলছিলেন ওকে টিকটিকি বানাবে…” “সালিশে আমি নিজের গরজে ওদের শাস্তি দিবো, কেউ কিছু বলার আগে, তারপর তোমরা গোপনে ওদের বাইরে পাঠায় দিবা…” একটু কঠিন শোনালো এবার এমপির কণ্ঠ। “এখন দেশের আইন কানুন পরিবর্তন হয়ে গেছে, যে যার ধর্ম পালন করবে, প্রধানমন্ত্রীর কড়া নির্দেশ।

” “কিন্তু ইমাম সাহেব বলছিলেন, ওদের জোর করে তওবা পড়ায় দিতে। ভালো মতো চাপ দিয়ে বুঝালে এরা তওবা পড়বে। ” “না! ইমাম সাহেবরে বইলো বিচার শুরুর আগেই মুখ না নাড়তে, নাইলে সামনের নির্বাচন আসার আগেই উনার তওবা পড়ার টাইম হয়ে যাবে। ” থতমত খেয়ে থেমে গেলো কাদের, ইমাম সাহেবের প্রসঙ্গটা তুলে সে ঝামেলাটাকে আরও বেশী পাকিয়ে দিয়েছে। “দাঁড়াও উপরে কথা বলে দেখি কি অবস্থা।

এইটা উপরের কেস তো, উনাদের তাদের কথামতই কাজ করতে হবে শেষ পর্যন্ত…” একপাশে গিয়ে মোবাইলে নম্বর ডায়াল করা শুরু করলেন তোফায়েল। দূর থেকে সেটা দেখে কাদের ঠিক বুঝতে পারছেনা ফলাফল কি হবে। সে এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে ফেলেছে। তারা সবাই হার্ড লাইনে যাওয়ার পক্ষে। তারা চায় যেন ঐ ছেলে দেশ ছাড়া হয়, আর তারপর পরিবারের সবাইকে একঘরে করে ফেলা হয়।

পরে ওরা নিজেরাই বাপ বাপ করে তওবা পড়তে আসবে। ইমাম সাহেব তো বলেছেন শরীয়ত অনুযায়ী কেউ ধর্মত্যাগ করলে তার আসল শাস্তি হতো কতল করা, আর নাইলে দেশছাড়া করা। সেটা করা যাচ্ছে না বলেই তওবা পড়ানোর প্রসঙ্গ আসছে। পুলিশের বড় সাহেবের তো তাকে নিয়ে অনেক প্ল্যান, এরই মধ্যে হয়তো তাকে দিয়ে টিকটিকি গিরির কথা কবুল করিয়ে ফেলেছে। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর অবসন্ন মুখে চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন এমপি সাহেব।

“এক গ্লাস পানি দে আমাকে…” ভার মুখ দেখে এরই মধ্যে অবস্থা বুঝে ফেলেছে সবাই। কেউ কোনও কথা বলছে না, পানি আনার পর পুরো গ্লাস শেষ করে কথা শুরু করলেন এমপি। “ওই পরিবারকে একঘরে করার ব্যবস্থা করো। আর দেখ চাপ দিয়ে তওবা পড়ানো যায় কি না কোনও ভাবে…” চিন্তিত মুখে মাথা নাড়লেন, “বাকীসব কিভাবে কি করতে হবে মন্ত্রী এসে বলবেন…” .3. ভিআইপিদের বিকালের মধ্যেই আসার কথা থাকলেও তারা এসে পৌঁছলেন রাত নয়টার পর। সাথে এক ডজন ক্যামেরা আর সাংবাদিকের পদচালনায় মুখর হয়ে গেলো অডিটোরিয়াম।

হোস্ট হিসেবে মন্ত্রীর পাশে কখনো দাঁড়িয়ে আবার কখনো বসে ছবি তুলছেন তোফায়েল, আর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে হালকা আলাপও হচ্ছে। এলাকার প্রসঙ্গ উঠতে মন্ত্রী নিজের থেকেই জিজ্ঞেস করলেন, “ঐ ছেলেটাকে নিয়ে কি করবেন চিন্তা করলেন?” “এখনো কিছু করিনি, ওকে এরেস্ট করা হয়েছে আর ওর ফ্যামিলিকে লোকজন একঘরে করে রেখেছে…তারা কোথাও বের হতে পারছে না…” হাসি হাসি হয়ে গেলো মন্ত্রীর মুখ, “বাহ! ভালোই তো সামলে নিয়েছেন। আমি পরে অফিসারদের সাথে কথা বলে জেনেছি সব। ওকে বর্ডার ক্রস করানোর ব্যবস্থা হচ্ছে। আপনি শুধু গ্রিন সিগনাল পেলেই ওই ফ্যামিলিকে ধরে বড় কোনও হুজুরকে দিয়ে তওবা পড়িয়ে নেবেন।

মিডিয়া এই টপিকে কোনও ফোকাস করবে না, ঝামেলা শুধু কোর্টকে নিয়ে…” মন্ত্রীর কথা শেষ না হতেই তোফায়েল বলে উঠলেন, “কিন্তু স্যার, আমি ভাবছিলাম ব্যাপারটা একটু সফটলি হ্যান্ডেল করলে কেমন হয়? এই ধরেন এদের উঠিয়ে অন্য কোনও এলাকায় পাঠিয়ে দিলাম…” যেন কোনও ঠাট্টা করা হয়েছে, এমনভাবে হাসি হেসে উঠলেন মন্ত্রী। সেটা দেখে একটু বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে গেলেন তোফায়েল। মন্ত্রী সেটা বুঝতে পেরে বললেন, “এমপি সাহেব! এইসব বিষয় সফটলি হ্যান্ডেল করার কথা আমি যদি চিন্তাও করতাম, তাইলে আজকে মন্ত্রী হতে পারতাম না…এই ছেলের সাত জনমের ভাগ্য যে সে এখনো বেঁচে আছে। আমার এলাকা হলে আমি তো খ্যাপা কুত্তা লেলায় দিতাম। মুসলমানের দেশে ধর্ম নিয়া ফাইজলামী করে, কত্ত বড় হারামি…” পরিবেশ বুঝে তোফায়েল প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে।

সে বুঝতে পারছে যে এখানে তার করার মতো তেমন কিছু নাই, তাই এসব নিয়ে কথা বলে মন্ত্রীকে বিরক্ত করার কোনও মানে হয় না। মঞ্চে এখন পাতি নেতাদের বক্তৃতা চলছে, দর্শকদের গ্যালারী প্রায় ভরে গেছে অতিথিদের একজন এখনো রেস্ট হাউজ থেকে এখানে পৌছুতে পারেননি, তাই শুরু করা যাচ্ছে না। এদিকে সাংবাদিকরা একেবারে অধৈর্য হয়ে গেছে, তারা যেকোনো উপায়ে মন্ত্রীর কাছে ঘেষতে চায়। মন্ত্রীর কানে এটা দিতেই তিনি বললেন “তাই নাকি! নিয়ে আসেন, হাতে সময় তো ভালোই আছে…” সবুজ সংকেত পেয়ে সাংবাদিকরা ভেতরে চলে আসলো। দুই পাশে এক ডজন ক্যামেরা নিয়ে, রীতিমতো মাছের বাজার বানিয়ে ফেললো তারা পরিবেশটাকে।

মন্ত্রী দুই হাত তুলে সবাইকে থামার ইশারা করলেন, “এভাবে চলতে থাকলে কাউকে ইটারভিউ দেবো না আমি…” সবাই মোটামুটি চুপ হয়ে গেলেন। তারপর একজন একজন করে প্রশ্ন করা শুরু করলো। “সংবিধানের মূলনীতি নিয়ে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছে সে ব্যাপারে আপনাদের সরকারের অবস্থান কি?” প্রশ্ন কমন পড়েছে, এমন একটা হাসি দিয়ে শুরু করলেন মন্ত্রী, “দেখুন, আদালত হচ্ছে সবার উপরে। আদালতের রায় আমাদের মানতেই হবে, যেহেতু আদালত বলেছে যে পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ছিলো, তাই সরকার এখন সেই আলোকেই সংবিধানকে পরিবর্তন করবে। এখানে সরকারের নিজস্ব কোনও অবস্থান নেই।

আর যে সব মূলনীতি পুনঃ স্থাপিত হচ্ছে সেগুলোর জন্যেই তো আমরা একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছিলাম। ” অল্প বয়সী এক রিপোর্টার ব্জিজ্ঞেস করলো, “কিন্তু স্যার বিরোধীদল তো বলছে…” কথা শেষ করতে না দিয়ে মন্ত্রী এবার উঁচু গলায় বলা শুরু করলেন, “এই কারণেই তো জনগণ গত নির্বাচনে তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার জন্যে। যেখানে যে যার ধর্ম পালন করবে, কেউ কাউকে বাধা দিবে না। কিন্তু আজকে স্বাধীনতা বিরোধী চক্র আমাদের ভেতর বিভেদ তৈরি করছে, আর বিরোধীদল তাদের নিয়ে চাইছে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে।

আমি তো বলি তারা জ্ঞানপাপী। এদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করা এবং বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়া আমরা হাতে নিয়েছি সেটা ব্যাহত করা। না হলে কারো পক্ষে ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধিতা করা সম্ভব না…” রিপোর্টারদের আরও কিছু প্রশ্ন ছিলো। কিন্তু মন্ত্রী সবাইকে থামিয়ে আপাতত চলে যেতে বললেন, অনুষ্ঠান শেষে আবার সুযোগ দেয়া হবে। “আসল কথা বলা হয়ে গেছে, এই কথাগুলাই সামনের দুই দিন মাঠ গরম করবে…” তোফায়েলকে আস্তে করে বলতে গেলেন তিনি।

কিন্তু কোনও সাড়া নেই কেন, ব্যাপার কি! একটু অবাক হয়ে পাশে তাকালেন তিনি। না তোফায়েল উঠে যায়নি কোথাও, চুপচাপ মাথা নিচু করে পাশের চেয়ারে বসে আছে। নিথর ভঙ্গিতে.. যেন স্বদেশের কাটাতার পেরিয়ে রক্তাক্ত সেই যুবকের চলে যাওয়া চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে। আর জন্মের পর থেকে যে মাটিতে সে লালিত পালিত হয়েছে এতকাল, তার দিকে তাকিয়ে কিসের যেন হিসাব মিলাতে পারছে না কোনওভাবেই। .4. ৭ জুন ১৯৭২, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে গণপরিষদের অধিবেশন চলছে, বক্তৃতা দেয়ার আগমুহূর্তে সামনে রাখা ফাইলগুলোর দিকে তাকিয়ে আছেন শেখ মুজিবুর রহমান।

“আজকের দিনটা এই দেশের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে…” মনে মনে ভাবছেন তিনি, “যে আদর্শে বাংলাদেশ পরিচালিত হবে, সেইসব মূলনীতিগুলো আজকেই চূড়ান্ত করে দেয়া হবে এই পরিষদে। আর তার প্রথমটা-ই হবে ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মহীনতার অর্থে নয়…বরং সকলে নিজের ধর্ম নির্বিঘ্নে পালন করবে, রাষ্ট্র কাউকে উৎসাহ দেবে না, আবার বাধা-ও দিবে না। দেশবিদেশ থেকে অনেক চাপ আসছে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটা বাদ দেয়ার জন্য। সৌদি বাদশাতো একরকম হুমকি-ই দিয়ে দিয়েছেন যে, ইসলামিক রিপাবলিক না হলে তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবেন না।

নয় মাস যুদ্ধ করে রক্ত দিয়ে দেশটা স্বাধীন করলাম আমরা, আর সংবিধান লিখতে হবে উনার কথামতো? আমরা কি উনার মেখে দেয়া তামাক খাই নাকি?? না, ধর্মনিরপেক্ষতা-ই থাকবে…” সামনে রাখা বক্তৃতার স্ক্রিপ্টটার দিকে একবার চোখ বুলিয় নিলেন তিনি, সেখানে লেখা আছে: “বাংলাদেশ হবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান মুসলমানের ধর্ম পালন করবে, হিন্দু হিন্দুর ধর্ম পালন করবে। খ্রিস্টান তার ধর্ম পালন করবে। বৌদ্ধও তার নিজের ধর্ম পালন করবে।

এ মাটিতে ধর্মহীনতা নেই, ধর্মনিরপেক্ষতা আছে। ” “সত্যি সত্যিই যদি এই সংবিধানের মতো করে দেশ গঠন করা যায়, তাহলে অনেক সুন্দর আর সমৃদ্ধ হবে এই দেশের ভবিষ্যৎ…” ডেস্কের উপর চশমা খুলে রেখে পাশে তাকালেন অবিসংবাদিত এই নেতা। “এরকম যে একদিন হবে সেটা নিশ্চিত জানি, তবে সেই বাংলাদেশ দেখে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়তো আমার হবে না..” (এখানে বর্ণিত কিছু কিছু চরিত্র বাস্তবতা থেকে নেয়া হয়েছে, যেমন যে ছেলেটির কথা এখানে বলা হয়েছে তার আসল নাম উইলিয়াম গোমেজ। এই গল্পটার মতোই র‍্যাব আর সমাজপতিদের অব্যাহত অত্যাচারের মুখে মাস খানেক আগে সে দেশ ত্যাগ করে হংকং-এ আশ্রয় গ্রহন করে। সেখানকার এক পত্রিকায় তাকে নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পরই এই বিষয় নিয়ে গল্প লেখার আইডিয়া আসে আমার মাথায়, গল্পের শেষ অংশে ১৯৭২ সালে ফিরে গিয়ে আমি আসলে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের অসাম্প্রদায়িক চেতনা আর বর্তমান সময়ে বাজারে প্রচলিত ‘রাজনৈতিক ধর্মনিরোপেক্ষতা’র চেতনার ভেতর পার্থক্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।

গল্পের পাশে যে ছবিটি এখানে দেখছেন সেটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উপর আঁকা নিক মারদেনিয়ানের একটি ক্যালিওগ্রাফী। ) উইন্ডচাইম ব্লগ থেকে ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।