উন্মাদ খুলির পৃষ্ঠাগুলি
প্রথম পর্বঃ Click This Link
দ্বিতীয় পর্ব
এ গোকুলে শ্যামের প্রেমে কেবা না মজেছে সখি।
কারও কথা কেউ বলে না, আমি একা হই কলঙ্কী। ।
অনেকেতে প্রেম করে
এমন দশা ঘটে কারে
গঞ্জনা দেয় ঘরে পরে
শ্যামের পদে দিয়ে আঁখি। ।
তলে তলে তল গোজা খায়
লোকের কাছে সতী বলায়
এমন সৎ অনেক পাওয়া যায়
সদয় যে হয় সেই পাতকী। ।
অনুরাগী রসিক হলে
সে কি ডরায় কুল নাশিলে
লালন বলে, ফুটকি খেলে
ঘোমটা দেয় আর চায় আড়চোখী। ।
এই গানটা প্রথম আমি সংগ্রহ করি চাঁন ভাইয়ের কাছ থেকে।
সে ছিল নাপিত। কাঁহারদের ছেলে। লেখাপড়া ক্লাস টু পর্যন্ত। পড়তে পারে লিখতে পারে। তাঁর কাছে চুল ছাটতে যেতাম।
সেই থেকে তাঁর সাথে আমার একধরণের সখ্যতা তৈরি হয়। সে লালনের ভক্ত। সে একা একা লালনের গান গায়। নিজের জন্য গায়। এটা না গায়লে নাকি তাঁর চলে না।
এই যে চলে না, এইটার মূল্য অনেক। জীবনের একটা অংশ। জীবনবোধের কিনারা লালনের গান নাড়াচাড়া না করলে তাঁর ভরে না। এই জন্য সে লালনের গান গান মনে মনে। সে একা একা গায়।
সে লালনের গানের অর্থ তাঁর মতো করে বোঝে। গানের ভিতর দিয়ে জীবনকে দেখে। ভাবে। লালনের গানের ভিতর যে শব্দ, যেরকম বাক্য, যেরকম ভাবের অথৈ নদী তৈরি হয়, চাঁন ভাই তার ভিতর ডুবতে পারে, ভাসতে পারে। এই ভাসাটাই জরুরি।
যে ভাসতে পারে যে ভাসতে ভাসতে ভাবতে পারে আহা! জীবন! আহা!
অন্ধকারের আগে
ছিল সাঁই রাগে
আল কারেতে ছিল আলের উপর।
ঝরেছিল এক বিন্দু
হইল গম্ভীর সিন্ধু
ভাসিল দীনবন্ধু নয় লাখ বৎসর। ।
চাঁন ভাই লালনের গানের ভিতর ভাসতে পারে অবলীলায়, কোন রাখঢাক নাই। তাঁর যে শ্রেণি, যে শ্রেণিবোধ, যে সমাজের ভিতর সে প্রতিনিয়ত বেড়ে উঠেছে সেই সমাজের সবাই লালনে নাই, তাঁর ভাবনাতে নাই।
উঁচু শ্রেণির যেসব মানুষ বসবাস করেন চাঁন ভাইয়ের গ্রামে তাদেরকে আমি চিনি, মোটামুটি জানি তাদের সম্পর্কে। নফরকান্দির বেশির ভাগ মানুষ গরিব, চাঁন ভাইয়ের কাতারে। এদের ভিতরকার প্রায় সবাই লালন শোনে, যেখানে লালনের গানের আসর হয় সেখানে চলে যাই, গভীর মমতা দিয়ে গানের ভিতর বুঁদ হ্য় তারা। আর গুটিকতক মানুষ যারা একটু শিক্ষিত, জমিজমা আছে তারা এইসব গানের আসরে যাই না, এরা নামাজ পড়ে, জমি-জিরাত দেখভাল করে, মুনিশ খাটায়, বৎসর বৎসর জমি কেনে, ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাই, বাজারে দোকান দেয়; চালের আড়ৎ গড়ে তোলে, ওষুধের দোকান গড়ে তোলে, বড়বড় পুকুর কাটে, মাছের চাষ করে, রাইচমিল দেয়, এদের লালনের গানে পোষায় না। কিন্তু চাঁন ভাইয়ের গান না হলে চলে না।
সমাজের বিধিনিষেধ মানতে মন চাই না। চালের আড়ৎ ভাল লাগে না। লালনে মজে থাকে তাঁর মন। তার মতো আরো অনেক তাঁরই মতো হরেক স্বজন।
বলো বলো, কে দেখেছে গৌর চাঁদেরে।
গৌর গোপীনাথ মন্দিরে গেল, আর ত
এলো না ফিরে। ।
যার লাগি কুল গেল
সেই আমারে ফাঁকি দিল
কলঙ্কী নাম প্রকাশ হল
কেবল গো আজ আমারে। ।
আমার আশপাশে আমি দেখেছি লালনের গান সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের কাছেই বেশি গ্রহণীয়।
তারা লালনের গানের ভিতর আছে, মানে তাদের ভাষা আছে লালনের গানে, তত্ত্ব আছে কি নেই তা তারা প্রথমে ধার ধারে না। এই দিয়ে বিপ্লব হয় না কি হয় তা তারা জানতে চাই না। তাদের জীবনের কথা, সমাজের নানা অসংগতির কথা, বাটপার আর ভণ্ডদের মুখোশ খুলে দেয়ার নালা তারা টের পাই লালনের গানে, যা তাদের ভাষাতে গড়ন গড়েছেন লালন ফকির। এই গড়ন পরবর্তীতে আর আসে নাই। কেনো আসে নাই? এই ভাবনা ভাবছি বসে..
খুব মনে পড়ছে
বল রে বলাই, তোদের ধরম কেমন হারে।
তোরা বলিস চিরকাল
ঈশ্বর ঐ গোপাল
মানিস কৈ রে। ।
বনে যত বনফল পাও
এঁটো করে গোপালকে দাও
তোদের এ কেমন ধর্ম
বল সেই মর্ম
আজ আমারে। ।
চলবে...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।