আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আধুনিক গবেষনায় দেশের সায়েন্স ও টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় গুলির দীর্ঘ ব্যর্থতা।মূল কারনটা কোথায়?যোগ্যতা-প্রতিভার অভাব না অন্যকিছু? কিস্তি-২

নুতন পুরাতন সব লেখাতেই আপনার মন্তব্য প্রত্যাশিত।

কিস্তি-১ ছোট একটা গল্প বলি। আইনস্টাইন তখন খ্যাতির শীর্ষে। প্রায়ই দেশে-বিদেশে যেতে হয়। থিওরি অব রিলেটিভিটি হাতেগোনা কয় ডজন বিজ্ঞানি ছাড়া কারো মাথায় ঢোকেনা।

তারপরেও উনাকে একপলক দেখতে, বক্তৃতা শুনতে শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই বেচাইন। বিশ্ব জুড়ে আইনস্টাইন ক্রেজ। এমনি এক সভায় সংবাদিক প্রশ্ন করলেন, আপনার মতো স্বনামধন্য বিজ্ঞানীর গবেষনাগার বা ল্যাবরেটরী সম্পর্কে আমরা দুটো কথা শুনতে চাই। উত্তরে তিনি বললেন, আমার গবেষনাগারে গুরুত্বপূর্ন দুটি যন্ত্র আছে। এ দুটি আমার নিত্য সঙ্গী।

সভায় পিনপতন নীরবতা… । একটি হচ্ছে আমার এই কলম, আরেকটি হচ্ছে এই কাগজ । এরপর নিজের মাথায় টোকা দিয়ে বলেছিলেন, আর এইটি হচ্ছে আমার সেই ল্যাবরেটরী যেটা আমি সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়াই। গল্পের মোজেযাটা পরে বলি, তার আগে সংক্ষেপে একটু পেছনে ফিরে দেখি। দেশে এখন পর্যন্ত সর্বমোট পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩১ ।

অনেকগুলি ৫০ থেকে ৯০ বৎসরের পুরনো আবার অনেকগুলির যাত্রা সবেমাত্র শুরু। ১৯২১ সালে অনেক প্রতিকূলতা ও ষড়যন্ত্র অতিক্রম করে শুরু হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা। ১৯৫৩ তে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৬১ এ ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৬৬ তে চিটাগাং, ১৯৭০ এ জাহাঙ্গিরনগর এরপর একে একে বাকিগুলি। বর্তমানের মূলধারার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের পত্তনটা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় নাম নিয়ে শুরু হয়নি। যেমন ১৯৪৮ তে আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হিসাবে বুয়েট আর ১৯৬৪ তে রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হিসাবে রুয়েট এর যাত্রা শুরু।

কেন্দ্রে অবস্থানের কারনে, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে কিংবা আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় কোনটি একটু আগে, আবার কোনটি বেশ দেরিতে ইউনিভার্সিটি গ্র্যান্ট কমিশনের তালিকাভুক্ত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে নুতন নাম ধারণ করেছে । তবে যাইহোক, আর্কিটেকচারাল বিউটি, স্থানের প্রাচূর্য, অবকাঠামো, আবাসিক সুবিধা,পাঠ্যক্রম, কিংবা অরগানোগ্রাম কোনো দিক দিয়েই এই সব প্রাচীন প্রতিষ্ঠানগুলি বিশ্বের সমসায়িক অন্যসকল প্রতিষ্ঠানের থেকে পিছিয়ে ছিলোনা। বেসিক সায়েন্স অর্থাৎ ফিজিক্স, কেমেস্ট্রি কিংবা জীববিজ্ঞানের মতো বিষয়গুলি আমাদের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে বরাবরই পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত ছিল ও আছে। একটা কথা বলার লোভ সামলাতে পারছিনা। জানামতে সেই পঞ্চাশ,ষাট এমনকি সত্তর এর দশকেও মেধাবী ছাত্রদের একটা বিরাট অংশের স্বপ্ন থাকতো ফিজিক্স পড়ার।

লক্ষ্য একটাই, ভবিষ্যতে নাসাতে(NASA)গবেষক হিসাবে কাজে যোগদান করা। নাসাতে সত্যই তখন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক এদেশীয় গবেষক কর্মরত ছিলেন। উল্লেখ্য যে নোবেল বিজয়ী প্রফেসর আব্দুস সালামেরও সম্পৃক্ততা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্স বিভাগের সঙ্গে। আর সত্যন্দ্রনাথ বোস এর নাম কে না জানে। যে নামটি জড়িয়ে আছে স্বয়ং আইন্সটাইনের সঙ্গে, বোস-আইন্সটাইন থিওরী নামে।

১৯২১ সালে তিনি যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। একটু ফিরে যাই প্রকৌশল শিক্ষায়। ষাট এর দশক থেকে এইচ,এস,সি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের প্রকৌশল শিক্ষার জন্য মূলতঃ যে চারটি প্রতিষ্ঠানে ভর্ত্তি হতে হয় সেই বুয়েট, রুয়েট, চুয়েট ও কুয়েট এর যাত্রা যথাক্রমে ৪৮,৬৪,৬৮ এবং ৬৯ তে । প্রতিষ্ঠানগুলি প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল যথাক্রমে দেশের মধ্য, উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিন অংশের সেন্টার অব এক্সিলেন্স হিসাবে ভূমিকা রাখবে। মানে স্বস্ব অঞ্চলের ভারী শিল্পকারখানার বিকাশ, তার জন্য প্রকৌশলী ও প্রযুক্তি সরবরাহ, তদ্‌সংক্রান্ত গবেষণা ও দিক্‌নির্দেশনা প্রদান করে তারা চালকের ভূমিকা পালন করবে।

কেন সেই লক্ষ্য অর্জিত হয়নি সেই প্রশ্নটা আপাততঃ শিকেয় তুলে রাখি, নয়তো কোন মূর্খ -‘কোথায় আদমজী, প্লাটিনাম-জুবলী? কোথায় সেই কর্নফুলি আর দর্শণা চিনিকল?’ বলে উলটো প্রশ্ন করে বসতে পারে। খুব বাজে প্রশ্ন এটি। তারচেয়ে বরং দেখি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি শত বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে এখনও আধুনিক গবেষনায় অবদান রাখার মতো অবস্থায় আছে কিনা। যেটা আমাদের এই আলোচনার বিষয়বস্তু। ল্যাবরেটরীগুলি কি প্রকৌশলী-বিজ্ঞানী তৈরীর জন্য যথেষ্ঠ? অনেক প্রকার অভাব অভিযোগের পরেও বলবো যে হ্যাঁ যথেষ্ঠ।

আসলে নিজের দেশ সম্পর্কে এক ধরনের হীনমন্যতাবোধ আমাদের ভেতরে এমনভাবে প্রবেশ করানো হয়েছে যে আমাদের যেটুকু ভাল সেটাও মেরুদন্ড শক্ত করে বলার মতো নৈতিক সাহস আমরা হারিয়ে ফেলেছি। বলা তো অনেক দুরের কথা, মর্মটুকু বুঝার মানসিক শক্তি আর সময়টা আমাদের কোথায়? আমাদের ধারনা বিদেশের ল্যাবগুলি শুধু জেমসবন্ড-০০৭ মার্কা আধুনিক যন্ত্রপাতিতে ঠাসা। সেখানের ছাত্রগুলি এই সকল যন্ত্রপাতি নিয়ে করে নিত্য নাড়াচাড়া, আর বানায় আয়রনম্যান মার্কা হলিউড মুভির আদলে সব তাকলাগানো কলকব্জা। আসলে কি তাই? ছিলিমে টান না দিয়ে কিংবা সস্তা কোন আবেগের ধার না ধরেও বলা যায়- এটম ভাঙ্গার মত জটিল সব প্রযুক্তি আমাদের না থাকলেও পাঠ্যবিষয়ের বেসিকটা হৃদয়ঙ্গম করার জন্য ল্যাবগুলি যথেষ্ঠই বলা চলে। ল্যাবগুলি শুধু শিক্ষার্থির শিক্ষার কাজেই নয়, সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের বিভিন্ন কারিগরী টেস্টিং এর প্রয়োজনে হামেশাই ব্যাবহৃত হচ্ছে বহু পূর্ব থেকেই।

শুধু প্রয়োজন আন্তরিকতা ও সতর্কতার সংগে এর সর্বত্তম ব্যবহার আর সঠিক রক্ষনাবেক্ষণ। যাবতীয় গবেষনার জন্যই যে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার দামের জটিল সব যন্ত্রপাতি অপরিহার্য, এই চিন্তাটা থেকেও বের হয়ে আসা খুব জরুরী। ফেলে দেয়া চা-চামচের উলটো দিকটাও যে স্ক্রু ড্রাইভারের বিকল্প হতে পারে সেটা আবিষ্কারের জন্যে নিজের মতো করে ভাববার স্পর্ধা দরকার প্রথমে। আর দরকার চিন্তার শক্তিমত্তা। ওই যে উপরের অংশে বললাম, গবেষনার যন্ত্র যাঁর সাকুল্যে দুটি, একটা কলম আর একটা কাগজ, সেরকম।

বর্তমানে আধুনিক গবেষনার একটা বিশাল অংশ শুধু এই দুটি মূল যন্ত্রকে ব্যবহার করেই উত্তরোত্তর এগিয়ে চলছে। উন্নত বিশ্ব বলতে আমরা যাদের বুঝি, মানে সেই সাদাদের দেশ, সেখানেও গবেষককের টেবিলে দেখা যায় হার্বাটশিল্ডের একটা সি++ বই, আইনস্টাইনের সেই অঙ্ক কষার খাতাকলম আর একটা লিনাক্স টারমিনাল। ব্যাস। এই তিনটা বস্তুকে সম্বল করেই তারা জগতকে উপহার দিয়ে চলছেন আগামীদিনের প্রযুক্তি, নিত্য নুতন চিন্তা । চলবে-


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।