আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

'লাইফ অফ পাই' হতাশায় যে বই আশা জাগানিয়া গল্প শুনাতে পারে

.................।
২০০৮ সালের এই সময়কার একটু আগেকার সময়। বেশ কিছু দিনের জন্য বন্ধু-বান্ধব ও ফ্যামিলি ছেড়ে দেশের বাহিরে যাব। ব্যক্তিগত কারণে মন খারাপ থাকত প্রায় সময়। যাওয়ার আগে আমার এক দোস্ত 'সৈনিক' একটি বই হাতে দিয়ে বললঃ"মামা বই খান পড়তে পার সময় পেলে, প্রথমে খারাপ লাগবে কিন্তু পরে ভাল লাগবে, বই খান পড়লে জীবন সম্পর্কে একটু হলে ও উদাস ভাব কাটবে"।

বইটির নাম "লাইফ অফ পাই"। "লাইফ অফ পাই" বইটি ইয়ান মার্টেলের লেখা একটি অনবদ্য বই যা বুকার পুরস্কার প্রাপ্ত হয়েছে ২০০২ সালে। পাইসাইন মলিটর প্যাটেল নামক এক কিশোর কে নিয়ে গল্পের ডাল-পালা ছড়ানো যে কিনা গল্পের শুরুতে বাস করত পন্ডিচেরি নামক এক শহরে, যে শহর ফ্রান্স থেকে সদ্য স্বাধীনতা পেয়ে ভারতে যোগদান করেছে। পাইসাইন মলিটর প্যাটেলের জন্মের সময় নামকরণ হয়েছে এক সাতারু মামাজীর বদৌলতে, ফ্রান্সের এক বিখ্যাত সুইমিংপুলের নামে। গল্পের শুরুতেই দেখা যায় অন্তর্মুখী স্বভাবের পাইসাইনের নাম স্কুলের ছেলেদের বদৌলতে সংক্ষিপ্ত হয়ে যায় পিসিং(প্রসাব)প্যাটেল।

নতুন অন্য এক স্কুলের শুরুতে যেন পুরনো স্কুলের মত নাম নিয়ে ব্যাঙ্গাত্যময় কিছু শুনতে না হয় সেই জন্য প্রথম দিনে প্রতি ক্লাশের শুরুতে নিজের ডাক নাম ব্ল্যাক বোর্ডে স্পস্ট করে লিখে দিত পাই=3.14. কিন্তু হায়রে অন্তর্মুখী প্যাটেল এত প্রচেস্টা সত্ত্বেও বর্হিমুখী স্বভাবের স্কুলের ক্রিকেট এক্সপার্ট বড় ভাই রবির ছোট ভাই হিসেবে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হয় স্কুল মহলে। পাইয়ের বাবা গল্পের শুরুতে থাকে একজন চিড়িয়াখানার পরিচালক এবং মালিক, যিনি চিড়িয়াখানা পেশার পূর্বে হোটেলের সাথে জড়িত ছিলেন। পাইয়ের কৈশর জীবনের বাকে বাকে আসতে থাকে কমিউনিস্ট নাস্তিক শিক্ষক সতীশ বাবু, চার্চের পাদ্রী ফাদার মার্টিন,মুসলমান ধার্মিক রুটির দোকানি সতীশ। পাই নিজে জন্মগত ভাবে হিন্দু। ক্যাথলিক পাদ্রী এবং ধার্মিক মুসলমান রুটির দোকানির প্রভাবে পাই আকর্ষণ অণুভব করে খ্রিস্টান এবং মুসলিম ধর্মের প্রতি এবং সেই সাথে আবিস্ট করে ফেলে নিজেকে এই দুই ধর্মের সাথে।

সেই সাথে নিজের জন্মসূত্রে পাওয়া সনাতন ধর্মের প্রতি অণুরাগ এবং মনোযগের যেন কোন কমতি নেই। দূর্ঘটনাক্রমে কোন এক দিনে পন্ডিচেরি সমুদ্র সৈকতে দেখা মিলে তিন ভিন্ন ধর্মীয় পন্ডিতের সাথে, যে পন্ডিতত্রয় জানত কেবল পাই তাদের ধর্মের প্রতি মনোবিস্ট। ঐ সময় পাইয়ের সাথে ছিল পাইয়ের বাবা-মা। এই বিকট উদ্ভত পরিস্থিতি থেকে পাইয়ের ক্ষণিকের মুক্তি মিলে মহাত্না গান্ধীর কথা বলে। এরি মাঝে কোন এক দিনে পাইয়ের বাবা শংকর বাঘের হিংস্রতা বুঝাতে পাই এবং তার ভাই রবিকে খুব কাছ থেকে (পাশের খাচা থেকে) দেখায় একটি ক্ষুধার্ত বাঘের হিংস্রতা।

এই হিংস্রতা দেখিয়ে পাইয়ের বাবা শংকর পাই এবং রবিকে বারণ করে দেয়, যেন বাসার নিকটস্থ চিড়িয়াখানার এই বাঘকে ভুলেও যেন স্পর্শ না করে, বুঝিয়ে দেয় বাঘ কত হিংস্র প্রাণী। খারাপ সময় ঘনিয়ে আসতে থাকে পাইদের সুখী পরিবারে। ১৯৭০ সালের দিক, ইন্ধিরা গান্ধী তামিলানাড়ু তথা পন্ডিচেরিতে জারি করে কেন্দ্রের শাসন। গণতন্ত্র হয়ে পরে বাকরুদ্ধ। পাইয়ের মতে, চিড়িয়াখানার মত একটি শিল্পময় বাণিজ্য টিকিয়ে রাখার স্বার্থে মুক্তিবুদ্ধ তথা গণতন্ত্রের চর্চা দরকার।

তাই গল্পের পরক্ষণেই দেখা যায়, পাইয়ের বাবা শংকর ব্যবসা গুটিয়ে কানাডা প্রবাসি হওয়ার চিন্তা এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। ভাঙ্গনরত পাইদের চিড়িয়াখানার বিভিন্ন জন্তু কিনতে ছুটে আসতে থাকে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন চিড়িয়াখানার মালিক। তাই কানাডা কিংবা আমেরিকাগামি কিছু জন্তু নিয়ে জাপানি এক জাহাজে চড়ে শংকর পরিবারের যাত্রা শুরু হয় কানাডার দিকে। কোন এক রাত্রিতে জাহাজস্থ যাত্রী শংকর পরিবারের সবাই যখন ঘুমে আচ্ছন্ন, তখন কোন এক বিস্ফোরণে জাহাজ ডুবি ঘটে। বিস্ফোরণের শব্দে ঘুম ভাঙ্গে শুধু পাইয়ের।

পাইকে জাহাজস্থ নাবিকরা একটা লাইফবোটে ছুড়ে ফেলে দেয়। পাই অক্ষত অবস্থায় পরে লাইফবোটে। পাইয়ের সাথে সাথে লাফিয়ে পড়ে একটি জেব্রা,যে কিনা লাফিয়ে পড়তে গিয়ে পা ভেঙ্গে ফেলে। সে লাইফবোটে আশ্রয় নিতে চায় এক জীবন্ত বাঘ, সুন্দরবনের বাঘ নাম যার রিচার্ড পার্কার। দূর্ঘটনার কারণে বাস্তব জ্বানহীন পাই লাইফবোটের দিকে সাতঁরাতে থাকা রিচার্ড পার্কারকে প্রথমে লাইফবোটে উঠতে সাহায্য করে একটা বয়া ছুড়ে দিয়ে।

পরক্ষণেই বাস্তব অণুভুতি ফিরে আসে পাইয়ের, বৈঠা দিয়ে বাধা দেওয়ার চেস্টা করে পার্কার নামক বাঘকে লাইফবোটে উঠতে, কিন্তু সুন্দরবনের জীবন্ত ভয়ংকর সুন্দর বাঘ ততক্ষণে লাইফবোটে উঠে বসে পাইয়ের বাধা এড়িয়ে। বাঘ লাইফবোটে উঠার পর পাই একটি বৈঠা এবং বয়ার সহায়তায় পানিতে ভেসে থাকতে। পরবর্তীতে সকাল হলে লাইফবোটে পাই দেখতে পায় একটি হায়েনা,তারপরে আসে ওরাং-ওটাং যার নাম অরেঞ্জ জুস। রিচার্ড নামক বাঘের তখন আর কোন দেখা নেই লাইফবোটের উপরে,পাই প্রথমে ভাবে ঝড়ে অথবা অন্য কোন কারণে বোট থেকে ছিটকে পানিতে পরে মারা গিয়েছে কিন্তু বাস্তবিক অর্থে বাঘের অবস্থান তখন পাটাতনের নিচে। গল্পের তারপরে দেখা যায়, এক পা ভাঙ্গা জেব্রার উপর হায়েনার নৃশংস আক্রমণ এবং প্রথমে ওরাং-ওটাংয়ের কথ্য বাধা দেওয়ার চেস্টা ও পরে ওরাং-ওটাংয়ের পিছুটান, সেই সাথে আহত জেব্রার রক্তের লোভে বোটের চারিধারে হিংস্র হাঙ্গরের ঘুরঘুর।

জেব্রার মৃত্যর পর হায়েনা এবং ওরাং-ওটাংয়ের পূর্বেরকার কথ্য সংঘর্ষ শারিরীক সংঘর্ষে রুপ নেওয়া এবং তৃণভোজ়ী ওরাং-ওটাংয়ের মৃত্য। ওরাং-ওটাংয়ের মৃত্যর পর পাই প্রথমবারের মত পাটাতনের তলায় দেখা পায় রিচার্ড পার্কার নামক বাঘের। বইয়ের তারপরের অংশে দেখতে পাই, পাই বাঘ এবং হায়েনাকে এড়িয়ে লাইফবোট থেকে নিজের জন্য পানি সংগ্রহ এবং জীবনরসদের কিছু অংশ খুজে পাওয়া। পরিশেষে পার্কার তার ঝিম ভাব ছেড়ে গর্জন করে উঠে। বাঘের গর্জন শুনে পাই ব্যস্ত হয়ে উঠে পাই বৈঠা-বয়া দিয়ে বোটের বাহিরে কাছাকাছি লাগোয়া কোন আশ্রয় বানাতে।

বাঘ তার জেগে উঠার প্রথম পর্বেই আঘাত করে হায়েনাকে, দেখা যায় কোন প্রতিরোধ ছাড়াই হায়েনার মৃত্য। তারপরে বাঘের দৃস্টি পাইয়ের উপর স্থির হয়, কিন্তু ইতিমধ্য বাঘের তর্জন-গর্জনে একটি বড় ইদুর বাহির হয়ে এসে পাইয়ের মাথায় চড়ে বসে,যে ইদুরকে ধরে পাই বাঘের দিকে ছুড়ে মারে। বাঘ সন্তুস্ট হয়, সাময়িক আক্রমণ বন্ধ হয় পাইয়ের উপর। লাইফবোটে দিশাহারা পাই বাঘ থেকে নিজেকে বাচার অনেক ফন্দি করে এবং শেষ পর্যন্ত উপায় বাহির করে বাঘকে বশ মানানোর। বশ মানানোর পর্যায়ের প্রথম দিকে পাই ব্যবহার করে বাশি যেমনটি সার্কাসের অনেকেই করে থাকে।

তারপরের অংশে দেখতে পাই, পাইয়ের সমুদ্র থেকে মাছ ধরে বাঘের আহার হিসেবে সেই মাছকে যোগান দেওয়া। কখনো কখনো কচ্ছপ ধরে সেই কচ্ছপের রক্ত পানীয় হিসেবে পাই নিজে গ্রহন করে অবশিস্ট অংশ রিচার্ডকে যোগান দেওয়া। অচিরেই পাই শুরু করে বাঘের বিষ্ঠা পরিস্কার করা,সবার স্বাস্থ্য টিকিয়ে রাখার স্বার্থে। লাইফবোটস্থিত রসদ ফুরিয়ে আসায় ইতিমধ্য পাই নিজের খাবার অংশ কমিয়ে সাগর থেকে ধরা মাছের উপর নির্ভর করতে থাকে। তখন পর্যন্ত অধিকাংশ সময় কাটাত নৌকার পাশ্বস্থর্থিত ভেলায়।

কোন একদিন খাবার দখলের চোখাচোখি লড়াইয়ে বাঘ হার মানার পর থেকে পাই ভেলা থেকে অধিকাংশ সময় নৌকায় কাটাতে থাকে। অন্য একদিন কাছে এক তেলবাহি জাহাজ চলে যায় কিন্তু দৃস্টিগোচর করতে ব্যর্থ হয় পাই। পাই বোটে থাকা শুরু করলেও কখনো বাঘের জায়গায় যেত না। বস্তুত দুই জনের মধ্য এলাকা ভাগ করা ছিল,কেউ কার এলাকা মাড়াত না। একসময় চোখে একধরনের পর্দা জমে পাইয়ের,ঐ সময়ে অন্য এক লাইফবোট এসে ভিড়ে পাইয়ের লাইফবোটের সাথে।

সেই লাইফবোট থেকে একজন অন্ধ লোক পাইয়ের বোটে উঠে, এই অন্ধ লোক আবার মানুষের মাংশ খেয়ে বেঁচে আছে। সেই অন্য লাইফবোটের অন্ধ লোক ভুলক্রমে বাঘের এলাকায় পা দেওয়া মাত্রই বাঘের খাবার সামগ্রী হয়ে যায়। পাই সেই অন্য বোট থেকে কিছু খাবার খুজে পায় এবং কাঁদে সেই অচেনা অন্ধ লোকের জন্য একাকিত্বের বেদনায়। কান্নার পানি পাইয়ের চোখের পর্দা খুলে দেয়, আগের মত দেখতে পেতে থাকে পাই। একসময় গুল্ম জাতীয় এক দ্বীপের দেখা মিলে, যে দ্বীপে নেই মাটির কোন অস্তিত্ব।

সেই গুল্ম দ্বীপের সবুজ মিস্টি শৈবাল আহার হিসেবে নেয় পাই, আর দ্বীপের মধ্যস্থিত মীরকাট খাবার হিসেবে যায় রিচার্ডের পেটে। একসময় পাই বুঝতে পারে এই গুল্ম দ্বীপে রয়েছে মাংশাসি গাছ। বিদায় হয় গল্প থেকে এই অদ্ভুত দ্বীপের। তারপরেই আমরা দেখতে পাই লাইফবোট নিয়ে পাই এবং রিচার্ডের মেক্সিকো তীরে অবতরণ, সেই সাথে রিচার্ড এবং পাইয়ের বিচ্ছেদ। সমুদ্রতীরে পানিতে দাঁড়ানো পাইয়ের মাথার দিয়ে এক লাফে রিচার্ডের সমুদ্র তীরে যাওয়া এবং হেটে হেটে জঙ্গলের দিকে গমন।

গল্পের শেষাংশে দেখতে পাই, অসুস্থ পাইকে হাসপাতালে সেখানে ডুবন্ত ঐ জাপানি জাহাজ কোম্পানির কর্মকর্তাগণ পাইকে জিজ্বাসা করে জাহাজ ডুবি এবং পাইয়ের বেচে আসা নিয়ে। কর্মকর্তাগণ পাইয়ের লাইফবোট করে এক বাঘের সাথে বেচে আসার ঘটনা অবিশ্বাস করে। পরিশেষঃ গল্পটি যখন পড়ি, তখন আমি থিম্পুতে। আমি বইটি পড়তাম সকালের দিকে হোটেলের ডাইনিং টেবিলে বসে,যখন আমার চোখের সামনে থাকতে থিম্পুর নিকটের পর্বতের গায়ে সাদা শুভ্র মেঘ,মাঝে মাঝে হালকা সুরে সুমনের গান শুনতাম বই পড়ার সাথে সাথে। মাঝে মাঝে বইটি হাতে নিয়ে হেটে বেড়াতাম থিম্পুর পূর্বদিকের এক উচু পাহাড়ের গা কেটে করা রাস্তা দিয়ে,যেই রাস্তার অনেক নিচু দিয়ে খরস্রোতা থিম্পু নদী বয়ে চলত।

মাঝে মাঝে রাস্তার এক কিনারে সাইজ করে কাটা কোন পাথরের উপরে বসতাম, পা দুটি ঝুলিয়ে দিতাম নিচের দিকে, হাত থাকত 'লাইফ অফ পাই' নামক বই। বইয়ের পাতা থেকে চোখ তুলে হঠাৎ করে তাকাতাম, নিজেদের সভ্যতা ধরে রাখার আপ্রাণ চেস্টায়রত থিম্পু শহরকে, হয়তবা আমার চোখ চলে যেত আর দূরে কোন পর্বতের শিখরে। আবার একটু পরে উঠে দাঁড়াতাম, হেটে বেড়াতাম থিম্পুস্থ পাহাড়ের বাকে-বাকে ,ঠিক যেমনটি হেঁটে বেড়াত চৌদ্দ-পনের বছর আগে পাহাড়ী শহর চট্রগ্রামের পাহাড়ের খাজ কেটে করা রাস্তায় সপ্নাতুর এক কিশোর।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।