ঢাকা মহানগর এলাকায় গত জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ৭ মাসে অপরাধের সংখ্যা ও হার বেড়েছে। বেড়েছে ডাকাতি, ছিনতাই, অপহরণ, মাদক ও অস্ত্রের ব্যবহার এবং মামলার সংখ্যা। ২০০৮ এর একই সময়ে জরুরি আইনের কারণে সঙ্ঘবদ্ধ অপরাধের পরিমান তুলনামূলকভাবে কম ছিল। সন্ত্রাসীরা আবারো যে সংগঠিত হচ্ছে তা অপরাধ পরিসংখ্যানে স্পষ্ট।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের দেয়া প্রতিবেদনেই দেখা যায়, ২০০৮ এর প্রথম ৭ মাসের তুলনায় ২০০৯ এর একই সময়ে মামলার পরিমান বেড়েছে ১ হাজার ৪৫৬টি।
এর মধ্যে অস্ত্র আইনে মামলা বেড়েছে ১০৫টি। । ২০০৮এর বছর প্রথম ৭ মাসে খুন হয়েছে ১৮৫ জন। ২০০৯ এ একই সময় খুন হয় ১৮৬ জন। এদিকে একই সময় নারী নির্যাতনের ঘটনায় মামলা কমেছে ১৬৬টি।
গত সাত মাসে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে মাদকের মামলা। এ ক্ষেত্রে এক বছরেই বেড়েছে ২ হাজার ৪০৩টি। শিশু নির্যাতন, অপহরন, গাড়ি চুরির মতো অপরাধ পরিসংখ্যানের দিক দিয়ে প্রায় একই রকম রয়েছে।
তথ্য-পরিসংখ্যান কিন্তু সব সময় সত্য বলেনা। কারণ থানায় মামলা না নেওয়ার অভিযোগও হরহামেশা শোনা যায়।
আর ছিনতাই চুরিসহ অনেক অপরাধ আছে যার খুব সামান্যই থানায় তালিকাবদ্ধ হয়। হয়রানির কারণে অধিকাংশ মানুষ এসব অপরাধের অভিযোগ নিয়ে পুলিশের কাছে আদৌ যান না।
চাঁদাবাজি
গত দুই দশক ধরে চাঁদাবাজি ঢাকাসহ দেশের আইনশৃঙ্খলার জন্য বড় সমস্যা হিসেবে দেখছেন সবাই। ফুটপাত থেকে শুরু করে শীর্ষ ব্যবসায়ী কিংবা সাধারণ মানুষ কেউই এই আতঙ্কের বাইরে নেই। রাজধানীর এক সংসদ সদস্য পর্যন্ত চাঁদাবাজদের হুমকিতে থানায় সাধারণ ডায়রি করতে বাধ্য হয়েছেন।
গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর অপরাধজগতে চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ এখন মিরপুরের শাহাদাত আর পুরান ঢাকার ডাকাত শহীদের নিয়ন্ত্রণে। তাদের প্রধান লক্ষ্য গার্মেন্টস মালিক, হোটেল মালিক, পরিবহন ব্যবসায়ী, আবাসন ব্যবসায়ী, বিভিন্ন মার্কেট সমিতির নেতা, নির্মানাধীন ভবনের মালিক, ধর্নাঢ্য ব্যবসায়ী এবং জমির মালিকরা। ভারতে পালিয়ে থাকা এই দুই শীর্ষ সন্ত্রাসীর প্রত্যেকেরই রয়েছে তিন থেকে চারশ সন্ত্রাসীর বড় বাহিনী। এসব সন্ত্রাসীরা মাঠ পর্যায় থেকে তথ্য এনে তাদের নেতাদের জানায়। তারপর ভারত থেকে ফোন করে গডফাদাররা।
চাঁদা না পেলে ছোট বাক্সে করে পাঠানো হয় কাফনের কাপড় অথবা তাজা বুলেট। এতেও কাজ না হলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, কর্মচারিদের মারধর করা হয় ক্যাডার দিয়ে। এসব ক্যাডার এমনই বেপরোয়া যে তারা খুন করতেও দ্বিধা করেনা।
চাঁদাবাজদের অত্যাচারে অতিষ্ট এসব ব্যবসায়ী অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মুখ খুলতে চাননা অথবা থানায় যেতে চাননা। নীরবে চাঁদা দিয়ে ব্যবসা করেন অথবা নিজস্ব পথে এসব সন্ত্রাসীকে খুশি করার চেষ্টা করেন।
কিছু দিন আগে মিরপুরের সংসদ সদস্য ইলিয়াস মোল্লার কাছে ২০ লাখ টাকার চাঁদা দাবি করে চাঁদা দাবি করে শাহাদাত বাহিনী। না পেলে তাকে হত্যা করার হুমকি দেয়া হয়। এব্যাপারে পল্লবী থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন সাংসদ।
তবে গোয়েন্দা পুলিশের উপ কমিশনার মনিরুল ইসলামের দাবি: ডিএমপির চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ সেল প্রতিষ্ঠা এবং এর তৎপরতার কারণে চাঁদাবাজি এখন অনেকটা নিয়ন্ত্রণে। পুলিশের কাছে অভিযোগ করার মাধ্যমে অনেকেই এ থেকে রক্ষা পেয়েছেন বলে তিনি জানান।
সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজির পাশাপাশি অনেকে ক্ষেত্রে পুলিশের চাঁদাবাজির বিষয়টিও আলোচিত একটি বিষয়। পুলিশ মহাপরিদর্শক নুর মোহাম্মদ বলেছেন- পুলিশ প্রশাসন বিষয়টি নিয়ে সচেতন।
রাজধানীতে ফুটপাতে ব্যবসা করতে গেলে সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি পুলিশকেও চাঁদা দিতে হয়। সবাই বিষয়টি জানেন। কিন্তু ভয়ে কেউই মুখ খুলতে চাননা।
ছিনতাই
প্রতিদিনই রাজধানীর কোথাও না কোথাও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। বেশিরভাগই গণমাধ্যমে আসে না। অকারণ হয়রানির ভয়ে থানা পর্যন্ত যেতে চান না ভুক্তভোগীদের অনেকেই। আগে শুধু রাতে ছিনতাই হলেও, ইদানীং দিনের বেলাতেও সমান তৎপর ছিনতাইকারীরা। অথচ পুলিশের দাবি : রাজধানীর পরিস্থিতি খুবই স্বাভাবিক।
হাজার ছিনতাইয়ের ঘটনার বেশিরভাগই থানা পর্যন্ত যায় না। বড়জোর সাধারণ ডায়েরি। আসামি ধরা পড়লেই শুধু মামলা। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার মনিরুল ইসলাম দাবি করলেন : তাদের নানামুখী তৎপরতায় ছিনতাই অনেক কমেছে।
ছিনতাই ঠেকাতে পুলিশের উদ্যোগের শেষ নেই।
নিরাপত্তা চৌকি, মোটরবাইকে টহল, গোয়েন্দা নজরদারি। তারপরও থামানো যাচ্ছে না ছিনতাই- না দিনে না রাতে।
রাজনৈতিক সন্ত্রাস
দিন বদলের কথা বলে ক্ষমতায় এলেও হল দখল, টেন্ডারবাজি আর নিজেদের মধ্যে মারামারির মধ্যেই ব্যস্ত আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনগুলো। দরপত্র নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রাজধানীতে খুনোখুনির ঘটনাও ঘটেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই আগের মতো হল দখল, অন্তর্কোন্দল আর বিরোধী রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে মারামারিতেই ব্যস্ত ছাত্রলীগ।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার এক সপ্তাহের মধ্যেই ছাত্রলীগ দখল করে নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবগুলো হল। এরপর কোন পক্ষের দখলে কোন হল থাকবে, তা নিয়ে শুরু হয় মারামারি।
এক জিয়া হলের নিয়ন্ত্রণ নিয়েই অন্তত ১০ বার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পাশাপাশি বিরোধী ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের ওপরও চলে নির্যাতন। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কর্মীরা অভিযোগ করেছে : এ ৯ মাসে ১শরও বেশি হামলা হয়েছে তাদের ওপর।
অনেকটা ভয়েই ক্যাম্পাসে কোনো কর্মসূচি দিচ্ছে না ছাত্রদল। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটেও ছাত্রলীগের নিজেদের মধ্যে মারামারি রোজকার ঘটনা।
সম্প্রতি সচিবালয়ের সামনে প্রকাশ্য সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে যুবলীগের দুই পক্ষ। অন্তর্কোন্দলের জেরে এরই মধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন লিটন নামের এক যুবলীগ কর্মী। ডিএমপি পুলিশ কমিশনার এ কে এম শহিদুল হক বলছেন : বক্ষব্যাধি হাসপাতালের ১০ কোটি টাকার দরপত্র নিয়ন্ত্রণ করতেই এই হত্যাকাণ্ড।
হঠাৎ করেই যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠনগুলো। যদিও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু কদিন আগেই বলেছেন : সন্ত্রাসী, টেন্ডারবাজ যে দলেরই হোক, কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গত মাসেই স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগকে আবারো সংযত হতে বলেছেন। এর আগে সংগঠনটির সাংগঠনিক নেতার পদ থেকে ইস্তফাও দেন তিনি। তবে কাজে আসছে না এসবের কিছুই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।