টোকনচন্দ্রিকা: ফেসবুকে বন্ধুভাজন টোকন ঠাকুর সম্প্রতি তাঁর একটি কবিতায় ("সব কবিতার শিরোনাম লাগে না") আমাকে 'ট্যাগ' করেছেন। আমি তাঁর কবিতা পড়ে গুরুতর উস্কানিপ্রাপ্ত হই। ফেসবুকে মন্তব্যের ঘরে দুই-চার বাক্যে সেই উস্কানির তৃপ্তি হয় না দেখে আলাদা একটা 'নোট'ই লিখে ফেলেছি। নিচে টোকনের কবিতা, কবিতার ফেসবুক-ঠিকানা ও তারিখ সব দিয়ে দিলাম। মোক্ষম একটা উস্কানি দিতে পারার জন্য টোকনের কাছে শুকরিয়া।
যে-প্রসঙ্গ উনি তুলেছেন, তা খুব দরকারি প্রসঙ্গ। এ-জন্য তাঁকে ধন্যবাদও জানাই। কিন্তু, এখানে আসলে আমি ঠিক শুধু টোকনের কবিতা নিয়েই কথা বলব না। তাঁর কথার উসিলায় সাধারণ একটা নৈর্ব্যক্তিক স্বরে ছন্দ নিয়ে কয়েকটা কথা বলার চেষ্টা করব। সবই জানা কথা।
টোকন ঠাকুর
সব কবিতার শিরোনাম লাগে না
রোদ তুই ছন্দ জানিস? মাত্রা মানিস?
সামান্য ফাঁক-ফুটো পেলেই ঢুকে পড়িস?
রোদ তোর আসার পথে দেখা হয়েছে কার কার সঙ্গে, বল?
মেঘরা ছিল কোন বৃত্তে, কথা হয়নি আমাকে নিয়ে?
পরিপার্শ্বের হাওয়া, কার কাছে তুই অক্ষরবৃত্ত শিখে হয়েছিস হিম?
কোন ছন্দে পাতা ঝরে? বলদ এবং বাঙলা বিভাগের
বিরাট অধ্যাপকের মধ্যে যবে এত অনুপ্রাস তবে এত মিল?
গান তুই হাওড়ের মাঠে শুয়েছিলি শীতকালে
তোর উস্তাদ কোন কুলাঙ্গার খাঁ?
ধান তুই আমার শব্দে বোনা ফসল
মহাজন সাহিত্য সম্পাদক?
রোদ আজ সব খুলে বল, আমি তো তোকে জানি-
ড ফুলস্টপ না করেও তুই কেমনে কবিতা লিখিস
অচেনা ম্লান-মুখে?
জোশ জোশ!
চটি পড়েনি, কী নিরক্ষর!
থ্রি এক্স দ্যাখেনি
কী গ্রাম্য!
চড়ুই সেক্স করছে মহাসুখে...
Click This Link
Saturday, August 29, 2009 at 10:48am
ছন্দ প্রসঙ্গে: ছন্দ বা অন্য যেকোনো স্বতঃস্ফূর্ত ব্যাপার নিয়ে যাঁরা ব্যাকরণগিরি করেন, তাঁরা শুধু বাংলা বিভাগের লোকই নন, গণিত বিভাগের লোকও হতে পারেন। এঁরা আসলে মাতব্বর গোছের, কর্তৃত্বপরায়ন লোক। এঁরা কানা বিচারকের মতো ততোধিক আইন/মাত্রা/ব্যাকরণ গণনা করে 'রায়' দিতে চান কোনো রচনা 'কবিতা' হয়েছে কি হয়নি। বহু কাল হলো, এঁদের অতি-আচারের দাপটে কবিতা লেখা এবং প্রকাশ করা সত্যিই ভীতিকর/দুঃসাহসী কর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপাতত, জীবনের সকল এলাকায় এঁদেরকেই অধিষ্ঠিত দেখতে পাওয়া যাবে।
*
এঁদেরকে নিয়ে হাসিতামাশা করা যেতেই পারে। তবে মনে রাখা দরকার, হাসিতামাশা-ব্যঙ্গবিদ্রুপ যে-কেউ-ই যে-কাউকে নিয়ে করতে পারেন। তার জন্য বিশেষ কিছুর প্রয়োজন পড়ে না। অন্যকে একটু হেয় জ্ঞান করতে পারলেই মোটামুটি চলে, সাথে একটু রাগ, প্রকাশ্যে কটু কথা বলার মতো একটু আস্পর্ধা ইত্যাদি প্রভৃতি থাকলে তো কথাই নেই। সব মিলিয়ে কখনো-কখনো এগুলো বেশ মূল্যবানও হয়ে উঠতে পারে, সন্দেহ নাই।
এবং এতেও কোনো সন্দেহ নাই যে, পাণ্ডিত্য বা অধ্যাপনা মাত্রেই অপরাধের বা বিদ্রুপের বিষয় নয়।
তবে, ছন্দ বলে একটা ব্যাপার থেকেই যায়। বাস্তবে এরকম একটা পদার্থ আসলে আছে। কিন্তু, তার সাথে ব্যাকরণ, ব্যঙ্গবিদ্রুপ অথবা গাণিতিক মাত্রা-গণনার কোনোরকম কোনো সম্পর্ক নেই। প্রকৃতপক্ষে, কোনোকিছুর 'চাল' বা 'চলন'-ই তার ছন্দ।
জগতে কোনো কিছুই স্থির নয়, সবই গতিশীল। গতির বিশেষ বিশেষ চলন-প্রকাশই ছন্দ। রোদ-বৃষ্টি-মেঘ, পাতা ঝরা, হাওরের গান, ফসলের আত্মপ্রকাশ, আমাদের হাঁটা-চলা-কথা-বলা-শোয়া-বসা-ঘুমানো-দাঁড়ানো — এই সবকিছুরই নিজের নিজের ছন্দ আছে: অকল্পনীয় রকমের বৈচিত্র্যপূর্ণ, আলাদা-আলাদা সব ছন্দ।
সুর-তাল-লয়-ছন্দ-মাত্রা মানুষের সহজাত-স্বাভাবিক-স্বতঃস্ফূর্ত ব্যাপার। ওমুক লোকের তাল-জ্ঞান না-থাকা, ওমুকের খুব ঢিমে তালে চলা, তমুক লোকের একেবারে মাত্রা-ছাড়া কথা বলা, অথবা কোনো একটা কাজের ছন্দ কেটে যাওয়া, কোনোকিছুর সুর হারিয়ে ফেলা, কিছু লোকের বেতাল-বেসুরো হওয়া কিংবা দ্রুত লয়ে/ধীর লয়ে কাজ সম্পাদন করা — এসব আমাদের নিত্যদিনের অভিজ্ঞতা।
এগুলো নতুন কিছু নয়, বরং এতো স্বাভাবিক ব্যাপার যে, কাব্যছন্দ নিয়ে কথা বলার সময় আমরা অনেকে এসব হয়ত বিবেচনাতেই রাখি না।
মানুষের লিখিত বা মৌখিক রচনার বেলায়, শাদা চোখে তাকালে খুব সহজেই বোঝা যায়, প্রত্যেকটা রচনাই আলাদা, প্রত্যেকটা রচনার ছন্দই আলাদা। বিশেষত, কবিতার কথা বললে, পৃথিবীর প্রত্যেকটা কবিতার ছন্দই আলাদা। মিশ্রকলাবৃত্তে তথা অক্ষরবৃত্তে লেখা দুইটা কবিতার সামগ্রিক অন্তর্নিহিত/দৃশ্যমান ছন্দ কোনোদিন এক নয়। দুইটা স্বরবৃত্তের ছড়ার চলন জীবনেও হুবহু এক হতে পারে না।
ব্যবহৃত শব্দের গড়নের কারণে, নানারকম ধ্বনির নানারকম জোর বা ঝোঁকের কমবেশির কারণে, আরো অনেক রকম কারণে তারা আলাদা আলাদা হতে বাধ্য। এইমাত্র লিখিত কবিতাটিরও একেবারে নিজস্ব, সম্পূর্ণ অনন্য একটি চলন আছে, নিজস্ব রঙ আছে, গন্ধ আছে, স্বাদ আছে। দূর থেকে সব ঘাসই একরকম লাগে, কাছে গেলে প্রত্যেকটা সবুজের শিরা-উপশিরা-আকার-আকৃতি-রঙ আলাদা।
একটু গোড়ায় গিয়ে দেখতে চাইলে দেখা যাবে, আমরা যখন গড়পরতা বা মোটা দাগের ব্যাখ্যা দিতে চাই, তখন আমরা নানাকিছুকে কতিপয় পৃথক-পৃথক বর্গে ভাগ করি। জাগতিক নানা কারণে এরকম মোটা দাগের মোটা মোটা আলাপ আমরা জীবনের সব এলাকাতেই করে থাকি।
এর বাস্তব উপযোগিতা আছে বৈকি। কিন্তু, যতই বর্গে-বর্গে, খুপরিতে-খুপরিতে ভাগ করি না কেন, সূক্ষ্ম বিচারে শেষ পর্যন্ত প্রত্যেকটা বস্তুই পৃথক, আলাদা, স্বতন্ত্র, অনন্য। এই দুনিয়ার সকল বস্তুপ্রাণসত্তার সকল ছন্দই অনন্য। কবিতারও তা-ই।
ঠিক যে, কবিতা লিখতে ছন্দ না জানলেও চলে।
হয়ত আমি একটা কবিতা সাত-মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দে লিখেছি, কিন্তু আমি 'মাত্রাবৃত্ত' বা 'কলাবৃত্ত' কাকে বলে জানি না— এটা খুবই সম্ভব। কিন্তু, গতিশীল পদার্থ হিসেবে কবিতার চালচলন-গতিবিধি বুঝতে এবং ব্যাখ্যা করতে ছন্দ অবশ্যই জানা লাগে। যে-বাচ্চা চমৎকার হাঁটে, শরীরসংস্থানতত্ত্ব কিংবা পদার্থবিজ্ঞানের বলগতিসূত্রাবলী অথবা গণিতের গতিধর্ম (স্ট্যাটিক্স-ডিনামিক্স) তার না-জানলেও চলে। কিন্তু, বাঁশের সরল খুঁটির মতো লম্বা-ঠ্যাংঠ্যাঙা দুইখানা ঠ্যাঙের উপরে মানুষের দাঁড়িয়ে থাকা এবং চলাচলের আশ্চর্য কাব্যময় রহস্যকে যথোপযুক্তভাবে ব্যাখ্যা করতে পারার জন্য অনেক জটিল বিষয়ে পাণ্ডিত্য অর্জন করতে হয় তো বটেই। কেউ চাইলে সেই কাজে রত হতে পারেন, আবার কেউ চাইলে মনের সুখে হেঁটেই ধন্য বোধ করতে পারেন।
সংসার আনন্দময়, যার মনে যা লয়।
সুতরাং, ছন্দ বলে কিছু নাই, বা কবিতার বেলায় ছন্দ থাকার দরকার নেই: এরকম দাবি করাটা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ কোনো অর্থ বহন করে না। বরং প্রায়শই ছন্দশাস্ত্র সম্পর্কে দাবি-প্রণেতার অজ্ঞতা বা আগ্রহের বা অনুভূতির অভাবকেই তা চিহ্নিত/আড়াল করতে চায়। ছন্দ তো থাকেই। সব কবিতাতেই থাকে।
বে-তালও একটা তাল বটে; বে-সুরও একটা সুর বটে। তেমনি, ছন্দহীনতাও একটা ছন্দ তো বটেই। কোন তালটা তাল, আর কোনটা বেতাল, সেটা যেমন যার যার তালজ্ঞানের ওপর নির্ভর করে, তেমনি কোন কবিতাটা ছন্দে সুলিখিত, আর কোন রচনাটা ছন্দহারা-ছন্দছাড়া-ছন্নছাড়া সেটাও যার যার ছন্দজ্ঞানের ওপরই নির্ভর করে। এক্ষেত্রে কোনো পণ্ডিত বা কোনো মূর্খের কথাই চরম-চূড়ান্ত নয়।
সেক্স প্রসঙ্গে: চড়ুই পাখি কি থ্রি-এক্স দেখে, চটি পড়ে 'সেক্স' করে? আদর-ভালোবাসা-সঙ্গম যতটা স্বাভাবিক, 'সেক্স'-ও কি ততটাই স্বাভাবিক, নাকি ট্রেনিংপ্রাপ্ত? প্রেমের গান, প্রেমের উপন্যাস, প্রেমের নাটক, চটি-গ্রন্থ, সুন্দরী কবিতা, বাইবেলের সোলায়মানের গজল, দেবদেবীদের আকর্ম-কুকর্ম, কোরানের কৃষিকাজ, ইস্কুলের নাড়িভুড়ি, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদমন, মাদ্রাসা-ক্যাডেটকলেজ-হলহোস্টেলব্যারাকের কামাকামি, সায়েন্টিফিক ইরোটিকা, যৌনতার দর্শন, থ্রি-এক্স, ফোর-এক্স, বলিউড-এক্স, হলিউড-এক্স, টেলিভিশনের বাতাস, জ্বীনের আসর, দশ টাকা বিশ টাকার চিপাগলি ইত্যাদি প্রভৃতি আরো কতকিছুর সার্বক্ষণিক দৃশ্য-অদৃশ্য দীক্ষায়ন-প্রকৌশল/ট্রেনিং-প্রণালীতে আচ্ছন্ন প্রশিক্ষিত 'সেক্স' আর চড়ুই পাখির স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ত সঙ্গমের আনন্দ কি এক রকম? সামরিক কম্যান্ডো প্রশিক্ষণের চেয়েও গুরুতর এসব ট্রেনিঙের আচ্ছন্নতা-আবিলতা কি আমাদের কবিতাতেও পড়ছে না? চড়ুই পাখির জীবন-আনন্দের চেয়ে 'সেক্স'টাই এখন বড় হয়ে যাচ্ছে।
আশঙ্কা হয়: কবিরাও আদর-ভালোবাসা ভুলে ওয়ান-টু-থ্রি-আদিক্রমে এক্স-ওয়াই-জেড 'সেক্স'-এর কথাই ভাবছেন। তবু, চড়ুই পাখির 'সেক্স'-এর 'মহাসুখে'রও একটা ছন্দ আছে। মানুষের আদর-যৌনতা-সঙ্গম ক্রমাগত ছন্দ হারিয়ে ফেলছে। কথা হলো: ক্যালকুলেটর দিয়ে মাত্রা গুনে গলদঘর্ম হয়ে ছন্দ-যন্ত্রের ঠেলাগাড়ি যাঁরা চালান, তাঁদের যান্ত্রিক প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে গিয়ে যদি আমরা এইসব কম্যান্ডো-সেক্সচুয়ালিটির প্রশিক্ষণের ছায়ায় আরামেই বসে থাকি, তবে তা আমাদের চিন্তার বিক্ষিপ্ততার ছবিই আঁকে। চড়ুই পাখির স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ত সঙ্গমের আনন্দ কয়টা কবিতায় মুদ্রিত হয় বা হয় না, সেটা অবশ্যই ভিন্ন প্রসঙ্গ।
বলা বাহুল্য।
-----------------------
* সংকোচ সহকারে জানিয়ে রাখি: এসব নিয়ে কিছু কথা আমি "কবিতা কি হাতিদের ধবধবে দাঁতের মতোন" জাতীয় শিরোনামে দুই কিস্তিতে দুটো রচনায় লিখেছিলাম। বদরে মুনীর এবং রিপন মাহমুদ কর্তৃক সম্পাদিত ও নাটোর থেকে প্রকাশিত উটপাখি নামের একটি ছোটকাগজের দুটো সংখ্যায় সেগুলো ছাপাও হয়েছিল। এসব নিয়ে তাই এখন আর কোনো কথা তুলছি না।
রাবি: ২রা সেপ্টেম্বর ২০০৯
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।