আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অনন্যা



সুন্দর, ছিমছাম একটা ক্লিনিকের সোফাতে বসে আছে অনন্যা। পুরো ঘরটা কাঁঠাল রঙের। সোফাটা হালকা গোলাপী। কোনভাবেই মেলানো যায় না এই দুটি রঙের সাদৃশ্য। তবুও সামনের আয়নায় দেখতে খারাপ লাগছে না।

ঘরটাতে এসি আছে। তবু একটা ভ্যাপসা গরম অনুভব করছে সে। এই সোফা নাকি বিপুল সিএফসির উৎস! যা পৃ্থিবীর ওজন স্তরকে ভাঙছে অবিরত। কিন্তু সিএফসির কারণে কি গরম লাগে? কে জানে? অনেকক্ষণ ধরে সামনের গ্লাসটা তাকে টানছে। ওর পেছনে একটা বারান্দার মত জায়গা আছে।

অনন্যা কিউতে অনেক পিছিয়ে। তার ডাক আসতে অনেক সময় লাগবে। এই সময়টাতে তার কিচ্ছু করার নেই। তার শরীর খারাপ। কিন্তু কেউই আসেনি আজকে ওর সাথে এই ক্লিনিকে।

কিছুক্ষণ পেপারটাও নাড়াচাড়া করেছে। ভালো লাগছে না। নিজের সমস্যাগুলোকে এতদিন প্রায় তুড়ি দিয়ে উড়িয়ে এসেছে। হঠাৎ তার গাড়ি এতবড়ো একটা ব্রেকফেল করবে কখনো ভেবে উঠতে পারেনি। দোমনা থাকতে থাকতে শেষ পর্যন্ত খোলা বাতাসের ইচ্ছেটাই জিতল।

কাচের দরজা খুলে চলে এল বারান্দায়। আকাশে একফোঁটা মেঘ নেই যে, মেঘ দেখে মন খারাপ করবে। হঠাৎ তার চোখে পড়ল ডাস্টবিনের পাশের ন দশ বছরের ছেলেটা। ছেলেটা মনের সুখে হিসু করছে। একটা ছেঁড়া টি-শার্ট আর হাফ প্যান্ট।

ছেলেটার দিকে তাকাতে তাকাতে তার চোখ দুটো ঝাপ্সা হয়ে এল। তার পেটের ভেতর কিছু একটা অনুভব করল সে। তার ভেতরে একটা জীবন জন্মেছে। আস্তে আস্তে বাড়ছে। এটা কি পাপ নাকি পাপ-পুণ্য সবকিছুর উর্ধ্বে সে জানে না।

জীবন নিয়ে খুব বেশি চিন্তাশীল ছিল না সে কখনোই। তার জীবনে অনেকেই এসেছে জীবনের প্রয়োজনে অথবা নিছক কৌ্তুহলে, এদের অনেকেই আবার ওর মতন-বেখেয়ালী, উন্নাসিক। তবে এদের কাউকেই কখনো ধরে রাখার চেষ্টা করেনি অনন্যা। প্রকৃ্তির খেয়ালকে ছোট করে দেখতে অনন্যার অসম্মতি ছিল বরাবরই। ঠিকঠাক শুরু হয়েছিল অনন্যার জীবন।

আর চার-পাঁচটা মেয়ের মতই হয়ত তার বেড়ে ওঠায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলত তার মা-বাবা বিশেষ করে তার দাদী, যদি না অনন্যা জন্মাবার দুবছর পর তার মা হঠাৎ বাথরুমে পড়ে না যেতেন, আর দ্বিতীয় সন্তানটি জন্ম দিতে গিয়ে মারা না যেতেন। অনন্যার বাবা ছিলেন একজন সরকারী ব্যাংকার। চাকরীর টানে বিভিন্ন শহর-গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন। সাথে অনন্যা ও তার দাদী। অনন্যার মাকে ওর বাবা ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন।

তাই তিনি মারা যাওয়ার পর তার তেমন একটা বিয়ে করার ইচ্ছে থাকেনি। অনন্যাকে নিয়েই তার একার সংসার গড়ে উঠেছিল নীরবে, কিছু কৌ্তুক, হাসি, অস্ফুট কষ্টে, রাগে-অনুরাগে। তবু তাতে মিথ্যের মিশেল ছিল না। বলা যায়, সুখের সংসার। অনন্যা বেড়ে উঠেছিল শিশু হয়ে, কখনো উচ্ছ্বল কিশোরী হয়ে, দুরন্ত যুবকের দূর্বার কৌ্তুহল আর উচ্ছ্বাস নিয়ে।

লাল-নীল ফ্রকের সাথে জিন্স আর ঢোলা প্যান্ট ও শোভা পেতে থাকে তার আলনায়। বার্বি ডলগুলো যেমন সাজানো থাকত তার বিছানায়, তেমনি ব্যাডমিন্টন র‌্যাকেট আর ঘুড়ি লাটিমও থাকত তার ওয়্যারড্রবে। একবার অনন্যারা বেড়াতে গেল নানাবাড়ীতে। অন্যসব কাজিনদের চেয়ে ভীষণ দুরন্ত অনন্যা। সেবার তাদের বাড়ির কাছে বসল বৈশাখী মেলা।

বাবার সাথে গিয়ে কিনে নিয়ে এল ইঞ্জিনের নৌকা। কেরোসিন তেল আর কাপড়ের সলতে এই হল রসদ। এক্টুখানি আগুন ধরিয়ে পুকুরে ছেড়ে দিলেই হত। ভটভট করে পুরো পুকুরময় ঘুরে বেড়াত নৌকাটা। একদিন নৌকাটা চলতে চলতে বিরাট পুকুরটার মাঝখানে কচুরীপানা আর গাছের ডালে আটকা পড়ে গেল।

অন্য কোন মেয়ে হলে কান্না শুরু করে দিত। অনন্যা অমনি নেমে পড়ল পুকুরে। ভালো করে সাঁতারও জানেনা। তবু তাকে তো যেতেই হবে। সাঁতরে গিয়ে সরিয়ে দিয়ে এল মরা ডাল আর কচুরীপানার জঞ্জাল।

তার নৌকার অবাধ সঞ্চারনে কেউ বাধা হতে পারবে না। তার সমবয়েসী কাজিনরা হা করে তাকিয়ে রইল। কিন্তু অনন্যার দৃপ্ত প্রত্যয়ে ধাক্কা খেল সবাই। অনন্যা এমনই। ইচ্ছেকে কৌ্টোয় ভরে রাখার মত মেয়ে সে নয়।

দুরন্ত, জীবন্ত, স্বতঃস্ফূর্ত সবসময়। কিন্তু আজ? জীবনের বেতাল ভুলগুলোর একটি তার মাথা চিবিয়ে খাচ্ছে। এর কোন সমাধান বের করতে পারছেনা সে। এই ক্লিনিকে সে এসেছে অ্যাবোরশান করতে। তার ভেতরে বেড়ে ওঠা আরেকটি স্বতঃস্ফূর্ত জীবনকে গলা টিপে খুন করতে এসেছে সে।

পড়ালেখা বলতে যা বোঝায়, তা ঠিক গা সয়নি অনন্যার। সে প্রকৃতির কাছ থেকে শিখতে ভালোবাসত। যেকোন কৌ্তুহলকে হাতে মেখে চোখে দেখে চেখে দেখত সবসময়। দাদী মোটেও পছন্দ করত না এসব। তার অভিযোগের ফর্দটা বাজারের ফর্দের চেয়েও বড়।

এসবকিছুর পরেও তার বাবা ভীষণ খুশি হত মেয়ের কান্ডকারখানায়। ভীষণ মজা পেত। একবার তো এক ছেলেকে ইট মেরে মাথা ফাটিয়ে দেয়। পরে সে ছেলের বড় ভাই অনন্যাকে মেরে ঠোঁট ফাটিয়ে দেয়। তার বাবা সারারাত ধরে তার পাশে বসেছিল।

মাঝ্রাতে অনন্যার ঘুম ভাঙ্গে। সে অস্ফুট স্বরে তার বাবাকে বলেছিল- বাবা জানালাটা বন্ধ করে দেবে? বাবা যখন এগিয়ে গেল জানালাটা বন্ধ করে দিতে হঠাৎ অনন্যা বলে উঠল বাবা এই জানালা দিয়ে হুটহাট হাওয়া ঢুকে পড়ে, কখনো কি মা ঢুকে যেতে পারেনা? মা মা...চোখ মুছে বাবা। পড়ার বই বলতে অনন্যার প্রথম পছন্দ তিন গোয়েন্দা। অনন্যা হাই স্কুলে তখন। তার দুজন বন্ধু- রাজু আর সাকিব।

রাজু সাইজে ভীষণ ছোট। একারণে বাকী ছেলেরা তেমন একটা পাত্তা দেয় না তাকে। তবে রাজুর বিশেষত্ব হচ্ছে সে ভীষণ ভালো গুলতি মারতে পারে। সাকিবের ধরণটা একটু অন্যরকম। একটু ত্যাড়া টাইপের।

অকারণে ঝগড়া বাধিয়ে দেয় সবার সাথে। তবে খুব ভালো গায়। রেডিওতে গান শুনে বাংলা আর হিন্দি গানের কালেকশান গড়ে তুলেছে তার মনের স্টোরহাউজে। মন চাইলেই স্বরযন্ত্রে চালান করে দেয়। মাঝে সাঝে কিছু মেয়ে যেমন তাহমিনা কিংবা সুমির সাথে বন্ধুত্ব হলেও তাদের টিমস্পিরিট সবাই বুঝে উঠতে পারত না।

বিশেষ করে কোন চুরিচামারীতে অন্য যেকোন দলের মতন তাদের টিম ছিল সমান দক্ষ। তবে অদ্ভূত দল বলে তেমন একটা চোখে পড়ত না কারো। এই টিমের টিমলিডার অনন্যা। ভীষণ কৌশলী। চুরির চাইতে চুরির আগের প্ল্যানটাই ভীষণ মজার।

প্রায়ই প্ল্যানমত কিছুই হত না। অনন্যা বড় হতে থাকে প্রকৃতির হাত ধরে। তার বাবা অনেকবার এগিয়ে এসেছেন মেয়ের শিক্ষার সহায়ক হয়ে। কখনোই শিক্ষক হওয়ার চেষ্টা করত না। কিন্তু এই বয়সেই অনন্যা এত কিছু শিখে ফেলেছে দেখে ওর বাবা মুগ্ধ হয়ে ওর কথা শুনত।

অনন্যার বিশেষত্ব ছিল দুটি ক্ষেত্রে। সে খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারত। যেকোন আড্ডায় উল্টো করে শুরু করত। তারপর বিশ্লেষণে ঢুকত। সহজবোধের বিপরীতের দর্শনগুলো তাকে সবসময় টানত।

সে ছিল স্কুল ডিবেট টিমের ক্যাপ্টেন আর জ্ঞান জিজ্ঞাসায় সবসময় প্রথম হত থানায়। একবার জেলায়ও গিয়েছিল। থার্ড হয়েছিল। সেবারও প্রথম যে হয়েছিল সে যেসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি তার অনেকগুলো উত্তর অনন্যা দিয়েছিল। হঠাৎ একবার অনন্যার শখ হল সিনেমা দেখতে যাবে।

রাজু আর সাকিবকে নিয়ে যাবে। রাজু একটু ভীতু কিসিমের। ওকে ম্যানেজ করতে অনেক সময় চলে যায়। তারপর তারা সিনেমা হলে গেল। হলে গিয়ে সে যেসব মেয়েকে দেখল সবার চোখে অন্যরকম একটা ভাষা দেখল সে।

কেমন জানি সব হারানোর খেলা। অন্ধকার হলরুমের গুমোট অন্ধকারকে আত্মসমর্পণের আনন্দের মহিমায় মহিমামন্ডিত করে তুলতে ব্যস্ত। শরীরী ব্যাপারগুলোকে সে নেহায়েত সর্দি-কাশি জ্বরের মতন দেখে এসেছে। আঁতকে ওঠার চাইতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে সে। আজ হলরুমে এসে নিজেকে কেমন মেয়ে মেয়ে মনে হচ্ছে।

হঠাৎ সে হাত রাখল সাকিবের হাতে। প্রথমটায় বুঝতে না পারলে একটু পরেই সাকিবেরও শিহরণ হল। সে বুঝতে পারল এ তার চেনা অনন্যা নয়। যাকে সে নিজের চেয়েও ত্যাড়া মনে করে। ঠিক এখন, অনন্যা তার কাছে এক ভীষণ বিস্ময়।

কৌ্তুহলজাগানিয়া নিষিদ্ধ জগত। বাড়ি ফিরতে ফিরতে পুরো সিনেমার রিক্যাপ দিল তার। সবচাইতে মুখর রাজু। সিনেমায় গুলতি মারার একটি দৃশ্য ছিল। রাজু বলে উঠল, এর চেয়ে অনেক ভালো গুলতি মারি আমি।

এরপর কয়েকবার সাকিব আর অনন্যার হাতে হাত লাগল। দুজনেই কেঁপে উঠেছিল বারবার। (চলবে

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।