আন্দোলন দুই ফ্রন্টে চলছে। একটি ফ্রন্ট শাহবাগের গণজাগরণ চত্বরে আর অপরটি সাইবার স্পেসে। প্রথম যেদিন মেসেজ পেলাম সবাই ‘শাহবাগে জড়ো হন’। সেদিন আরও একটি মেসেজ পেয়েছিলাম, শাহবাগে কিছু গাঁজাখোর আর পতিতার সমাবেশ হয়েছে। একেবারে প্রথম থেকেই চেষ্টা শুরু হয়েছিল এই আন্দোলনকে গুরুত্বহীন করার।
সাইবার যুদ্ধের একদিকের প্রচেষ্টা গুলো ছিল নেহাত সস্তা টাইপের কিছু মেসেজ দেয়া এবং আর অন্য দিকে ছিল নান্দনিকতায় ভরপুর কিছু পোস্ট।
আন্দোলনটি ঘিরে শুরু হওয়া সাইবার যুদ্ধের প্রথম দিকের চেষ্টা ছিল বেশ মজার। একদিকে ব্লগার গ্রুপ আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে সকলকে সংগঠিত করার। সকল গ্রুপে, ফেসবুকের ফ্রেন্ডদের আহ্বান করা হচ্ছে শাহবাগে আসবার জন্য। মনে তখনও দোদুল্যমানতা, ‘কতজন আসবে?’ কোন রাজনৈতিক ট্রেনিং নেই, পেছনে কোন দলের সাপোর্ট নেই।
এমন সব মানুষকে ডাক দেয়া হচ্ছে যাদের সঙ্গে সত্যিকারের জানা শোনাও নেই। প্রথমটায় দু একটি চ্যানেল ছাড়া কেউ সরাসরি দেখানোর প্রয়োজনও মনে করে নি। ওপর পক্ষের প্রচেষ্টাও ছিল বেশ হালকা ধাঁচের। ‘কয়জন লোক দাঁড়ালে, মানুষজন তো ভিড় করবেই’। এমন সব প্রচারণা।
এরপর চরিত্র হনন, ‘গাঁজাখোর’ আর ‘পতিতা’।
এরপর হঠাৎ করে গতি প্রকৃতি পাল্টে গেল। জনস্রোত বাড়তে লাগলো। দেশের অধিকাংশ ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়ায় উল্লেখযোগ্য কাভারেজ দিল। প্রতিদিন নতুন আইডিয়া, নতুন নান্দনিকতা আন্দোলনটিকে নতুন করে রাখলো।
যদিও একই আন্দোলনের কাভারেজ আসছিল কিন্তু প্রতিদিনই মনে হচ্ছিল নতুন কিছু দেখছি। প্রায় সবাই ই তাঁদের নান্দনিক চিন্তার প্রয়োগ করে কিছু না কিছু নতুন দেয়ার চেষ্টা করছিল। যেহেতু একটা নির্দিষ্ট মঞ্চ ছিল না তাই সবাই যে যার আইডিয়া নিয়ে রাস্তায় বসে পড়ছিল। যে যা পারে। কেউ ছবি আঁকছিল, কেউ শুরু করলো স্বাক্ষর অভিযান।
কেউ তৈরি করল প্রতীকী খাঁচা। তখনও কেউ কেউ আসলো ‘কি হচ্ছে’ দেখতে। আর বেশীরভাগ আসলো নিজের তাগিদে। প্রথমদিকের দোদুল্যমানতা ‘আদৌ কিছু হবে তো?’ ‘আমরা পারবো তো?’ ধীরে ধীরে কাটতে লাগলো। ওপর পক্ষ তখন আপ্রাণ বোঝানোর চেষ্টা হয়েছিল মাত্র গুটি কয়েক লোকের এই আন্দোলন।
খুব বেশিদিন টিকবে না।
এরপর এলো শুক্রবার। মহাসমাবেশ। পুরো কাহিনী পাল্টে গেল। যোগ হল আস্থা।
‘আমরা পারবো’। শুরু হল নীতি নির্ধারণ জাতীয় কার্যকলাপ। আসলো শপথ। আসলো দৃঢ়তা ‘আমাদের পারতেই হবে’। যেন পথভ্রষ্ট না হয়, যেন একঘেয়ে না হয় এসব চিন্তা শুরু হল।
‘কি করা হবে না’ কিংবা ‘কোন কাজ গুলো হলে আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে’ এমন সব ব্যাপার আলাদা করা হল। প্রতিটি পদক্ষেপ ভেবে চিনতে নেয়া শুরু হল। ওপর পক্ষের চেষ্টা তখন আন্দোলনটিকে দলীয় জামা পড়ানোর। ‘এটি আওয়ামী লীগের নাটক’।
সাইবার স্পেসে আরেক যুদ্ধের চেষ্টা হল।
ধর্মীয় ফ্লেভার দিয়ে কিছু বিভেদ তৈরির চেষ্টা হল। ‘তাহরির স্কয়ারে’ আন্দোলনের সময় সবাই একসঙ্গে নামাজ পড়তো এবং মেয়েরা হিজাব পড়তো। এখানে তা হচ্ছে না, অতএব এই আন্দোলন ধর্মের বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অন্যায় এর প্রসঙ্গ আনার চেষ্টা হল। বিশ্বজিৎ, হলমার্ক, শেয়ার বাজার এসব বেশী জরুরী।
এসবের বিচার শেষ হলে তবে যুদ্ধাপরাধীর বিষয়ে ভাবা যেতে পারে। কিংবা সবগুলো একসঙ্গে করেই একটা আন্দোলন হোক। এর সঙ্গে যুক্ত হল লিফলেট। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীও যুক্ত হোক। মজার ব্যাপার হল, যে আন্দোলনটি কিছুদিন আগেও গাঁজাখোর আর পতিতার ক্ষুদ্র সমাবেশ ছিল, তাঁদের কাছেই আবার আন্দোলনের মাধ্যমে নিজেদের দাবী আদায়ের চেষ্টা হল।
সম্প্রতি হওয়া ঝটিকা মিছিল কিংবা গাড়ি ভাংচুর কেন, ঠিক বোঝা গেল না। কারো মতে বিকেল চার টার মৌনতায় বাঁধা দেয়া। কারণ ঘটনাটা ঘটলো চারটা বাজবার কিছুক্ষণ আগে। তবে আরেকটি ব্যাপার উল্লেখযোগ্য। তা হচ্ছে সাইবার স্পেসে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তির যে খেলা চলছিল, সেখানে একটু ভাটা পড়ল।
কারণ প্রতিটি কৌশলের পরেই সেই কৌশলের বিবরণ দিয়ে পোস্ট চলে আসছিল ফেসবুকে। ফলে প্রচারণাগুলো সার্বজনীন না হয়ে নিজস্ব কিছু লোকের কাছেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকলো।
সাইবার স্পেসের মিথ্যে প্রচারণা গুলো কেন যেন আন্দোলনের শক্তি হয়ে যুক্ত হতে থাকলো। আন্দলনরতা মেয়েদের পতিতা বলার প্রতিবাদ হিসেবেই যেন সকল শ্রেণীর নারী, ছাত্রী, গৃহবধূ, বৃদ্ধা, শিশু সবাই যোগ দেয়া শুরু করলেন। একজন নারী কে অপমান করার সহজতম যে পথ, ‘পতিতা’ বলা, সেই পথকেই যেন সবাই সাদরে গ্রহণ করা শুরু করলেন।
বোঝাতে লাগলেন, একটা অপপ্রচারের ভয়ে আমরা বাসায় বসে থাকবো না। কিছু মিথ্যে প্রচার যে আন্দোলনের জন্য শক্তি হয়ে উঠতে পারে, ওপর পক্ষ বোধ হয় বুঝে উঠতে পারে নি। বুঝতে পারেনি একটি শব্দ তাঁদের জন্য হয়ে উঠতে পারে, ‘বুমেরাং’।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।