মানুষ আর প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য হলো-চেতনাগত ও সংস্কৃতিগত।
নারীমুক্তি আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা_সুফিয়া কামাল
বিংশ্ব শতাব্দীর শুরুতে থেকে আজ পর্যন্ত এই উপমহাদেশে নারীমুক্তি আন্দোলনে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াতের পর যে মহিয়সীর নাম চলে আসে তিনি হলেন সুফিয়া কামাল। তাদের একান্ত কর্ম প্রচেষ্ঠার ফলে নারী সমাজ কিছু মানবিক অধিকার নিয়ে জীবন-যাপন করছে। তাদের কাজের ধারাবাহিকতায় নারীমুক্তি আন্দোলনে বর্তমানে অনেকেই জড়িত। এক্ষেত্রে তাঁদের মতো দক্ষ সংগঠকের অভাব।
সেই অভাব পূরণ করার মাধ্যম হলো এই মহিয়সীদেরকে শুধু স্মরণ নয়, অনুস্মরণ-অনুকরণ করা। তাঁদের রেখে যাওয়া কাজ সম্পন্ন করার দায়িত্ব নেওয়া। এভাবেই মানুষের শ্রমে মানুষের মুক্তি এসেছে। গড়ে উঠেছে মানুষের সভ্যতা। মানুষের প্রকৃত মুক্তির আন্দোলনও মানুষকে করতে হয়।
যারা এই আন্দোলনে আজীবন লড়াই-সংগ্রাম করেছেন তাদের মধ্যে সুফিয়া কামাল অন্যতম। তিনি শুধু সমাজ বদলের যোদ্ধাই ছিলেন না, একজন শক্তিমান কবি ও সাহিত্যিক ছিলেন।
সুফিয়া কামালের জন্ম ১৯১১ সালের ২০ জুন (১০ আষাঢ় ১৩১৮)। বরিশালের (চন্দ্রদ্বীপ) শায়েস্তাবাদের এক উচ্চবিত্ত মুসলিম পরিবারে। বাবা সৈয়দ আবদুল বারী, মা সাবেরা খাতুন।
নানার দেওয়া নাম ছিল সুফিয়া খাতুন। সুফিয়ার বয়স যখন সাত মাস তখন তাঁর বাবা সাধকদের অনুসরণে নিরুদ্দেশ যাত্রায় বেরিয়ে পড়েন। সুফিয়ার মা সাবেরা খাতুন এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে বাবার বাড়িতে এসে আশ্রয় নেন। সুফিয়া বড় হয়েছেন তাঁর নানার বাড়িতে তাঁর শৈশব স্মৃতি তাই মাতৃকেন্দ্রিক। সাবেরা খাতুনের অপরিসীম ধৈর্য ও সহনশীলতা মেয়ে সুফিয়াকে রীতিমত অভিভূত করেছে।
যে কারণে আমরা দেখতে পাই, সুফিয়া কামাল তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘কেয়ার কাঁটা’ উত্স র্গ করেছেন মাকে।
সুফিয়ার শৈশব কেটেছে শায়েস্তাবাদের নবাবী ঐশ্বর্যের মাঝে। এই পরিবারের ভাষা ছিল উর্দূ। অন্দর মহলে মেয়েদের আরবি-ফারসি শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও বাংলার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। সুফিয়া বাংলা শিখেন তাঁর মায়ের কাছে।
তাঁর বড় মামার বিরাট লাইব্রেরীটি সর্বভারতে প্রসিদ্ধ ছিল। মায়ের উত্সাসহ ও সহযোগিতায় চুরি করে বই পড়তেন। ছোটবেলা থেকেই সুফিয়ার মধ্যে বাংলা ভাষার প্রতি আকর্ষণ ও মমত্ববোধ ছিলো। গ্রামের সাধারণ মানুষ ও গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতি তাঁর ভালবাসার কমতি ছিলো না। সহজ-সরল-সুন্দর চালচলন ছিল তাঁর বৈশিষ্ট।
তৎকালীন সময়ে মুসলিম পরিবার থেকে মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার কোনো সংস্কৃতি ছিল না। কিন্তু শিশু সুফিয়া স্কুলে যাবেই। তাঁর ইচ্ছা পূরণের জন্যে অভিভাবকরা তাকে স্কুলে পাঠালেন। এটি ছিল বাড়িতে স্কুল-স্কুল খেলার নাটক। কিন্তু অবাক কাণ্ড, এই স্কুল-স্কুল খেলায় শিশু সুফিয়া বাংলা-ইংরেজিতে কৃতিত্বের পরিচয় দেন।
যে কারণেই ‘সন্দেশ’ পত্রিকার গ্রাহক হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। মাত্র ৭ বছর বয়সে কলকাতায় বেগম রোকেয়ার সাথে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়। প্রথম সাক্ষাতেই বেগম রোকেয়া সুফিয়াকে তাঁর স্কুলে ভর্তি করে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তব সমস্যার কারণে তা আর সম্ভব হয়নি।
১৯২৪ সালে মামাত ভাই সৈয়দ নেহাল হোসেনের সাথে সুফিয়ার বিয়ে হয়।
সৈয়দ নেহাল হোসেন ছিলেন প্রগতিবাদী ও নারী শিক্ষার সমর্থক। স্বামীর উত্সা হ ও অনুপ্রেরণায় সুফিয়া লেখাপড়া করার পূর্ণ সুযোগ পেলেন। সময়ের বিচারে নেহাল হোসেনের এই পদক্ষেপ সত্যিই যুগান্তকারী ছিল। ১৯২৩ সালে বিয়ের পর সুফিয়া ও নেহাল হোসেন বরিশাল শহরে চলে আসেন। বরিশালে সে সময় খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের পর এ.কে. ফজলুল হক ও আবুল হাশেমের নেতৃত্বে জমিদারদের বিরুদ্ধে প্রজারা আন্দোলনে শুরু হয়।
শুধু রাজনৈতিক অঙ্গনে নয়, সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও বরিশাল তখন অনেক অগ্রসর। এ সময় বরিশাল থেকে বেশ কয়েকটি সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হতো। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তের ভ্রাতুষ্পুত্র সরল কুমার দত্ত সম্পাদিত ‘তরুণ’। এই পত্রিকার সাথে জড়িত ছিলেন সৈয়দ নেহাল হোসেন। সুফিয়ার ২/৩ টি লেখা সম্পাদকের কাছে নিয়ে গেলেন নেহাল।
সম্পাদক একটি গল্প ও একটি কবিতা ‘তরুণ’ পত্রিকার প্রথম বর্ষ ৩য় সংখ্যায় এস.এন. হোসেন নামে সুফিয়ার প্রথম লেখা ‘সৈনিক বধূ’ প্রকাশিত হয়। প্রথম লেখা প্রকাশের সাথে সাথে হিন্দু-মুসলমান সকলে অত্যন্ত প্রশংসা করে আরো লেখার জন্য তাঁকে উত্সাবহিত করেন। এ সময় বাংলার শ্রেষ্ঠ মহিলা গীতিকবি কামিনী রায় আসেন বরিশালে। একজন মুসলমান মেয়ে গল্প ও কবিতা লিখছেন এ কথা শুনে তিনি নিজে সুফিয়ার বাসায় গিয়ে তাঁকে উত্সাএহিত করেন।
সুফিয়ার ছোট মামা ফজলে রাব্বী সাহেব কাজী নজরুল ইসলামের সাথে দেখা করে ভাগিনী সুফিয়ার কবিতা লেখার কথা কবিকে অবহিত করেন এবং কিছু কবিতা তাঁকে পড়তে দেন।
তাঁর কবিতা পড়ে নজরুল অত্যন্ত মুগ্ধ হয়ে ঢাকার ‘অভিযান’ পত্রিকায় কয়েকটি কবিতা ছাপার ব্যবস্থা করেন। এরপর নজরুল কলকাতায় ফিরে গিয়ে ‘সওগাত’ পত্রিকায় লেখা পাঠানোর আহ্বান জানিয়ে বরিশালে সুফিয়াকে চিঠি লেখেন। মূলত এ সময় থেকেই কবি-সাহিত্যিকদের সাথে সুফিয়ার পরিচয়ের সূত্রপাত। ‘সওগাত’-এ তিনি বেশ কিছু কবিতা প্রকাশের পর ১৩৩৪ এর অগ্রাহায়ণ সংখ্যায়ও সুফিয়ার কবিতা প্রকাশিত হয়। প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদী গোষ্ঠী এবং প্রগতি বিরোধীদের নানা সমালোচনা সত্ত্বেও মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের সৃজনশীলতা ও কৌশলী পদক্ষেপের কারণে সওগাতের প্রচার ও প্রসার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে।
এতে উত্সালহী ও আত্মবিশ্বাসী হয়ে তিনি ১৯২৯ সালে (বাংলা ১৩৩৬) লেখিকাদের ছবিসহ ‘মহিলা সওগাত’ প্রকাশ করার সংকল্প করেন। এরপর সুফিয়া এন. হোসেনের ছবিসহ ‘বিড়ম্বিতা’ কবিতাটি প্রথম সংখ্যা ‘সওগাত’-এর (ভাদ্র ১৩৩৬) ছাপা হয়।
১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে সুফিয়ার জীবনে নেমে আসে নিদারুণ বিষাদের ছায়া। মাত্র ২৬ বছর বয়সে ১৯৩২ সালের ১৯ ডিসেম্বর তিনি মারা যান। তখন তাদের একমাত্র কন্যা আমেনা খাতুন দুলুর বয়স ৬ বছর।
স্বামীর অকাল মৃত্যুতে সুফিয়ার জীবনে নেমে আসে চরম দুর্ভোগ।
শুরু হয় জীবন যুদ্ধে এক নতুন পর্ব। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সার্টিফিকেট তাঁর ছিল না। এ সময়ে তাঁকে সহায়তা করেন কলকাতা কর্পোরেশনের তত্কানলীন এডুকেশন অফিসার শ্রীযুক্ত ক্ষিতীশ প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। তিনি নিজ উদ্যোগে কলকাতা কর্পোরেশন স্কুলে সুফিয়াকে শিক্ষকতার চাকুরির ব্যবস্থা করে দেন।
পঞ্চাশ টাকা মাইনের এই শিক্ষকতার চাকুরি তখন সুফিয়ার জন্যে ছিল পরম পাওয়া। তিন মাসের মধ্যে সুফিয়া নিজ যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে শিক্ষয়িত্রী পদে স্থায়ীভাবে বহাল হন। এ সময় কর্পোরেশনের শিক্ষকদের মধ্যে তিনি পান কবি আব্দুল কাদির, কবি খান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন, কবি জসীমউদ্দীন, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ কবি সাহিত্যিককে। এই সময়ে জ্ঞাতি-ভগ্নি বেগম মরিয়ম মনসুর তাঁকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। তার অনুপ্রেরণায় নতুনভাবে বাঁচতে শিখেন তিনি।
১৯৩৯ সালের ৮ এপ্রিলে চট্টগ্রামের কামালউদ্দিন খানের সাথে তাঁর বিবাহ হয়। বিবাহের পর তিনি সুফিয়া কামাল নামে পরিচিত হলেন। উচ্চশিক্ষিত সুদর্শন কামালউদ্দিন খান ছিলেন অত্যন্ত চিন্তাশীল ব্যক্তি। তিনি কবির কাব্য-প্রতিভার সম্মান করতেন। সুফিয়া কামালের প্রতিভা বিকাশের ক্ষেত্রে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
এ পরিবারে জন্ম হয় পাঁচ সন্তানের। শাহেদ কামাল শামীম, আহমদ কামাল শোয়েব, সাজেদ কামাল শাব্বীর এবং মেয়ে সুলতানা কামাল ও সাঈদা কামাল। শোয়েব ১৯৬৩ সালে ১৩ মে মারা যান। ১৯৭৭ সালের ৩ অক্টোবর হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে সুফিয়া কামালের স্বামী কামালউদ্দীন খান মারা যান।
কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা সুফিয়ার চেতনায় এক নতুন জগত সৃষ্টি করে।
গদ্য লেখার নেশা পেয়ে বসে তাঁকে। বেগম রোকেয়া, বেগম সারা তাইফুর ও বেগম মোতাহেরা বানু প্রমুখের লেখাও তাঁকে উৎসাহ যুগিয়াছে। ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর জীবনের প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘কেয়ার কাঁটা’ ও ১৯৩৮ সালে কাব্যগ্রন্থ ‘সাঁঝের মায়া’। কবি বেনজীর আহমদ নিজ খরচায় ‘কেয়ার কাঁটা’ ও ‘সাঁঝের মায়া’ প্রকাশের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এ জন্য তিনি তাঁর ‘মন ও জীবন’ কাব্যগ্রন্থটি বেনজীর আহমদকে উত্সওর্গ করেন।
কাজী নজরুল ইসলাম স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ‘সাঁঝের মায়া’র ভূমিকা লিখে দিয়ে সুফিয়ার সাহিত্যিক মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব শরত্চান্দ্র চট্টোপাধ্যায়, গায়ক কে. মল্লিক, হরেন ঘোষ প্রমুখের সাথে সুফিয়ার পরিচয় করিয়ে দেন। নজরুলের যে কোনো বই প্রকাশ হলেই তিনি সুফিয়াকে এক কপি উপহার পাঠাতেন। সাথে লিখতেন কবিতার কয়েকটি লাইন বা কোনো মন্তব্য। এই উপহারগুলো অমূল্য সম্পদ হিসাবে ছিল তাঁর কাছে।
অন্যদিকে সাথে রবীন্দ্রনাথের প্রশংসা ও আশীর্বাদ বাংলা সাহিত্যে তাঁকে একটি স্থায়ী আসনে অধিষ্ঠিত করে। রবীন্দ্রনাথের সাথে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয় ১৭/১৮ বছর বয়সে। প্রথম পরিচয়ের পর কবির জন্মদিনে তিনি কবিতা লিখে পাঠালেন। কবিও তাঁকে কবিতায় উত্তর দিলেন। এ যোগাযোগ প্রায় মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ছিল।
১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর কলকাতার নাগরিক শোকসভায় সুফিয়া কামালকে স্বরচিত কবিতা পাঠ করার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের চিঠিগুলো ষাটের দশক পর্যন্ত সুফিয়া কামালের পরিবারের কাছে ছিল। ১৯৮৬ সালে সুফিয়া কামাল শান্তিনিকেতনে বেড়াতে যান। তখন রবীন্দ্র ভবনের পরিচালক ড. নরেশ গুহ শান্তিনিকেতনে রাখা তাঁকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠিসমূহের অনুলিপির একটি সেট উপহার দেন।
বেনজীর আহমদের মাধ্যমে নৃপেন্দ্র কৃষ্ণ চট্ট্যোপাধ্যায়ের সাথে সুফিয়ার পরিচয় ঘটে।
এই পরিচয়ের সুবাদে তিনি প্রথম মুসলমান মহিলা হিসাবে অল-ইন্ডিয়া রেডিওতে স্বরচিত কবিতা পাঠের সুযোগ পেয়েছিলেন। ‘সওগাত’, বিশেষ করে সওগাত মহিলা সংখ্যার মাধ্যমে বেশ কিছু সংখ্যক মহিলা সাহিত্যচর্চায় এগিয়ে আসে। তার ধারাবাহিকতায় ‘সওগাত’ সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ‘সাপ্তাহিক বেগম’ প্রকাশের পরিকল্পনা নেন। ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই ‘সাপ্তাহিক বেগম’ আত্মপ্রকাশ করে । ‘সওগাত'’ অফিস থেকে প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক বেগম’-এর প্রথম সম্পাদিকা ছিলেন কবি সুফিয়া কামাল।
১৯২৬-৪৭ সাল পর্যন্ত সুফিয়া কামাল ‘সওগাত-এ লিখেছেন। ১৯৪৭ সালে তাঁর সর্বশেষ লেখা ‘মালতীর প্রত্যাশ’ প্রকাশিত হয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব ও পটভূমির প্রেক্ষাপটে তিনি ৬৫ টি কবিতা লিখেছিলেন। যা ১৯৯১ সালে বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত ‘একুশের সংকলন’-এ রয়েছে। সুফিয়া কামালের মোট প্রকাশিত গদ্যগ্রন্থ ৪ টি।
অগ্রন্থিত গদ্যের মধ্যে রয়েছে একটি অসম্পূর্ণ উপন্যাস ‘অন্তরা’। ১৯৪৬-এ কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় সুফিয়া কামাল এ দাঙ্গা প্রতিরোধে কাজ করেন। এ সময় তাঁর সাথে সাক্ষাৎ ঘটে দুই উদীয়মান তরুণ শিল্পী কামরুল হাসান ও জয়নুল আবেদিনের সাথে। তিনি তাদেরকে ভাইয়ের স্নেহ-মমতায় আবদ্ধ করেন। ১৯৪৭ সালের শেষের দিকে সুফিয়া কামাল চলে আসেন ঢাকায়।
সে সময় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষাকল্পে গঠিত হয়েছিল শান্তি কমিটি। প্রখ্যাত নারীনেত্রী লীলা রায়ের অনুরোধে তিনি এ কমিটিতে যুক্ত হন। এক পর্যায়ে তিনি এ কমিটির সভানেত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৪৮ সালের আগস্টে পূর্বপাকিস্তানের বিভিন্ন জেলার প্রগতিশীল মহিলা নেত্রী ও কর্মীদের উদ্যোগে গঠিত হয় ‘পূর্বপাকিস্তান মহিলা সমিতি’। এই সংগঠনেরও সভানেত্রী নির্বাচিত হন সুফিয়া কামাল।
১৯৫১ সালের শেষ দিকে সমাজ-সচেতন মহিলাদের এক সমাবেশে গঠিত হয় ‘ঢাকাশহর শিশু রক্ষা সমিতি’, এই কমিটিরও সভানেত্রী নির্বাচিত হন সুফিয়া কামাল। অবিভক্ত বাংলার শিশু সংগঠন ‘মুকুল ফৌজ’-এর আদলে ১৯৫৬ সালের ৫ অক্টোবর তাঁর বাসভবনে গঠিত হয়েছিল প্রগতিশীল শিশু সংগঠন ‘কচি কাঁচার মেলা’। এতে তিনি সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। অন্য একটিশিশু সংগঠন ‘চাঁদের হাট-এর সাথেও তিনি জড়িত ছিলেন। ১৯৬০ সালে তাঁর নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘বেগম
রোকেয়া সাখাওয়াত স্মৃতি কমিটি’।
তাঁর উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রীনিবাসের নাম ‘রোকেয়া হল’ রাখার প্রস্তাব করা হয়। ১৯৬১ সালে সামরিক শাসনের নিষিদ্ধ রাজনীতির ওই পরিবেশে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সুফিয়া কামাল। ওই বছর সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ছায়ানট' এর সভানেত্রী নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৬৫ সালে তিনি ‘নারীকল্যাণ সংস্থা’ এবং ‘পাক-সোভিয়েত মৈত্রী সমিতি’-র সভানেত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব বিরোধী মহিলাদের সমাবেশে সভানেত্রীত্ব ও মিছিলে নেতৃত্ব দেন।
১৯৭০ সালে গঠিত হয় ‘মহিলা সংগ্রাম পরিষদ’, যার সভানেত্রী হন তিনি। '৭০-এর ঘূর্ণিঝড়ে দক্ষিণ বাংলায় রিলিফ বিতরণে নেতৃত্ব দেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্যাতিত নারীদের আশ্রয় দিতে, নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে দিতে এবং নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়ে দিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। জীবন-মরণের এই চরমতম সন্ধিক্ষণে প্রতি মুহূর্তে টেনশনের মধ্যে থেকেও এই নয় মাসে তিনি প্রতিদিনের ঘটনার বর্ণনা এবং তাঁর তাত্ক্ষষণিক প্রতিক্রিয়া ডায়েরিতে লিখে রাখতেন। যা পরবর্তীতে ‘একাত্তরের ডায়েরী’ নামে প্রকাশিত হয়।
যুদ্ধ শেষে নির্যাতিত মহিলাদের পুনর্বাসনের কাজে তিনি আত্মনিয়োগ করেন। সেসময় ‘নারী পুনর্বাসন সংস্থা-র সভানেত্রী ছিলেন তিনি। স্বাধীনতার পর তিনি ‘মহিলা পরিষদ’এর মাধ্যমে নারী সমাজের সার্বিক মুক্তির কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন।
কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট নৃশংস হত্যাকাণ্ড তাঁকে আবার প্রতিবাদী করে তোলে। সম্পূর্ণ বৈরী পরিবেশে সব ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে তিনি এ হত্যাকাণ্ডেরর প্রতিবাদ করলেন।
১৯৮৮ সালে তিনি ‘বঙ্গবন্ধু পরিষদ’-এর সভানেত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় আশি বছর বয়সে কার্ফূর মধ্যে মৌনমিছিলে নেতৃত্বদান ছিল তাঁর সংগ্রামী জীবনের এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। যা সে সময়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সংগ্রামরত দেশবাসীকে উজ্জীবিত করেছিল।
১৯৯৯ সালে ২০ নভেম্বর শনিবার বার্ধক্যজনিত কারণে এই অনন্য মহীয়সী মারা যান।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।