সুখি হওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় বিবেক হীন হওয়া।
শাহবাগে গণজাগরণ শুরু হওয়ার দিন থেকেই ব্যক্তিগত অনিবার্য অসুবিধার কারণে সশরীরে হাজির হতে না পারায় ব্যর্থতার তীব্র দহনে দগ্ধ হয়ে আসছিলাম বেশ কয়দিন। গতকাল ফাগুনের আগুণ লাগা সন্ধ্যায় আমিও একাত্ম হওয়ার সুযোগ পেলাম প্রজন্ম চত্বরের গণজোয়ারের মহাস্রোতে। শাহবাগ এসে আগে বুক ভরে শ্বাস নিলাম কিছুক্ষণ। এতদিন সশরীরে উপস্থিত থাকতে না পারার অব্যক্ত অপরাধবোধটা কেটে গেল এক নিমিষে।
আজ আমিও ঐতিহাসিক মহাজাগরণের অংশ। ভাবতেই শিরদাড়া বেয়ে কেমন একটা শিহরণ জাগানো অনুভূতি টের পেলাম। আন্দোলনের এ অভূতপূর্ব চেহারা দেখে আমি রীতিমত বিমোহিত, আবেগে আপ্লুত। যারা এখানে সমবেত হয়েছেন সবাই দেশ প্রেমের বজ্র কঠিন প্রত্যয়ে তেজদীপ্ত। এখানে কোন দল নেই, নেই কোন নেতা।
তারপরও দৃষ্টিগোচরে আসল দারুন সুশৃঙ্খল, অহিংস এক গণসমাবেশ! এটা নিঃসন্দেহে সকল রাজনৈতিক দলের জন্য একটা অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এ রকম একটা সমাবেশ করতে তাদের কত কাঠ খড় আর রসদ পোড়াতে হয়। অথচ মুক্তি যুদ্ধের চেতনা আর দেশপ্রেমের মূলমন্ত্র হৃদয়ে ধারণ করে কি অনায়াসে একটা অসাধ্য সাধন করে ফেলল দেশের তরুণ প্রজন্ম। তরুণ প্রজন্মের সমালোচনা কারীদের প্রতি তারুণ্যের এ যেন এক মধুর প্রতিশোধ!
রূপসী বাংলা হোটেলের সামনে বাস থেকে নেমে পায়ে হেঁটে ভেতরে ঢুকেতেই হকারের আওয়াজ –রাজাকারের ফাঁসির দাম দশ টাকা, খালি দশ টাকা। এ কথা শুনে আন্দোলনে আসা এক আগুন্তুক বিরক্তির সুরে বলল- আমরা রাজাকারের ফাঁসির জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলছি , আর ব্যাটা বলে কিনা ফাঁসির দাম মাত্র দশ টাকা! লোকটির কথা শুনে একটু মুচকি হেসে সামনে এগিয়ে চললাম।
পি জি হাসপাতালের সামনে দেখলাম স্কুল ড্রেস পরা একদল ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের। ওরা এসেছে মণিপুর স্কুল থেকে। কোমল কণ্ঠের প্রত্যয়ী শ্লোগানে তারাও জানিয়ে গেল যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি। প্রজন্ম চত্বরের পরিবেশ দেখে মনে হয়েছে , যেন আন্দোলনের মেলা বসেছে এখানে। একেক মঞ্চের আন্দোলনের ভাষা একেক রকম।
কেউ শ্লোগানে, কেউ ব্যানার- ফেস্টুনের মাধ্যমে, কেউ কবিতা আবৃত্তি করে, কেউ গান গেয়ে আবার কেউবা ঢাক -ঢোল - খঞ্জনীর তালে তালে নেচে কুদে জানাচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি চরম ঘৃণা। শাহবাগের এক কোনে চলছে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচিত্র। বারডেমের সামনের রাস্তায় একটা লম্বা সাদা কাপড় বিছানো। কাপড়ের উপর অনেক গুলি কলম রাখা। এখানে আসা আন্দোলনকারীরা সাদা কাপড়ের উপর মন্তব্য লিখে যাচ্ছেন অনবরত ।
যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসীর দাবি সম্বলিত শ্লোগানে শ্বেত শুভ্র কাপড় খানা ধীরে ধীরে জীবন্ত হয়ে উঠছে। আমি লিখলাম-
‘ কাঁদতে আসিনি আজ ফাঁসির দাবিতে একাত্ম হয়েছি
হিসাব চাই এত দিন যত বঞ্চনা সয়েছি’ ।
এটি গণ জাগরণ মঞ্চে শোনা একটা গানের কলি। রক্তে অসম্ভব উন্মাদনা জাগানিয়া একটা গান এটি। গীতিকার আর সুরকার কে স্যালুট।
আন্দোলনের এ মেলায় বিভিন্ন মঞ্চের প্রতিবাদের ভাষা এবং প্রকৃতি ভিন্নতর হলেও সবার একটাই প্রাণের দাবি- রাজাকার যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি। আমি সকল মঞ্চ ঘুরে ঘুরে সবার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করলাম। মাইকে ভেসে আসছে নানা রকম ব্যতিক্রম ধর্মী শ্লোগান –
‘ রাজকারের কাল দাগ
এই বসন্তে মুছে যাক.....’
‘ আম পাতা জোড়া জোড়া
তুই রাজাকার সইরা দাঁড়া
গোলাম আজম বুডডা ঘোড়া….’
নবজাগরণের এ মহোৎসব দেখে আমার ভেতরে কিছু ভাবনার উদয় হয়েছে। প্রথম যেদিন শুরু হয় প্রজন্ম চত্বরের এ গন জোয়ার, সেদিন কেউ ভাবতে পারেনি আন্দোলন এত বেগবান হবে। অনেক সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত লোক এ আন্দোলনের স্থায়িত্ব নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন।
তাদের মুখে চুন কালি দিয়ে শাহবাগ স্কয়ারের এ গনআন্দোলন গতকাল গৌরবময় নবম দিন অতিবাহিত করেছে। এ আন্দোলনের সূতিকাগার হচ্ছে ভার্চুয়াল জগত। আর অনলাইন প্রজন্ম অর্থাৎ নেটিজেনরাই এর মূল চালিকা শক্তি। তাই এ গনজাগরণকে কিছুতেই দাবিয়ে রাখা সম্ভব নয়। তরুন প্রজন্মের দাবির সাথে সংহতি প্রকাশ করে সরকার ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে।
আশা করা যায় এর মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির গণদাবী আলোর মুখ দেখবে। এত দিনে রাজনৈতিক দল সমূহ নিশ্চয়ই জনগণের পালস বুঝে গেছেন । এখন সে অনুযায়ী দূরদর্শী সিদ্বান্ত তাদের নিতে হবে। আগামী ভোট যুদ্ধে এ তরুণ প্রজন্মই হবে তাদের ট্রাম কার্ড। তাই তরুণ প্রজন্মের অনুভুতিকে মূল্যায়ন করে তাদের নিকট নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করার এখনি মোক্ষম সময়।
এ সুযোগ কাজে লাগাতে না পারলে ভবিষ্যৎ নির্বাচনে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব অবশ্যম্ভাবী।
শাহবাগের এ গন জাগরণের ফলে অন্তত একটি জিনিস সবার নিকট পরিষ্কার হয়েছে; যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুটিকে এখন আর কেউ রাজনীতির মাঠে ফায়দা হাসিলের লক্ষ্যে অপব্যবহার করতে পারবেনা। কারণ এটা এখন আর কোন রাজনৈতিক ইস্যু নয়, এটি পরিণত হয়েছে দেশের জাতীয় ইস্যু তথা গণ দাবিতে।
সরকার গণদাবীর প্রেক্ষিতে যুদ্ধাপরাধের সাথে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের জড়িত থাকার সুস্পষ্ট অভিযোগে দলটির কর্মকাণ্ড নিসিদ্ধ করার কথা ভাবছে। বর্তমানে জামায়াতের আচরণ ধীরে ধীরে জঙ্গিবাদের দিকে মোড় নিচ্ছে।
এদেরকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হলে দেশে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা তারা করতে পারে। তাদের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে জন নিরাপত্তা বিপন্ন হচ্ছে। জনসাধারণ ও নিজেদের সার্বিক নিরাপত্তা নিয়ে হয়ে পড়েছে বেশ উদবিঘ্ন। তাই সরকারের তরফ থেকে জামাতকে এই আল্টিমেটাম দেওয়া যেতে পারে – নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে দলের সকল পদ থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বরখাস্ত করে তাদের সাথে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করার বিষয়ে প্রকাশ্যে সংবাদ সম্মেলন করে জাতিকে মুচলেকা দিতে হবে, তবেই এ দেশে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার সুযোগ পাবে তারা, অন্যথায় নয়। বল টা জামায়াতের কোর্টে দিয়ে তাদেরকে সিদ্বান্ত গ্রহণের দায়িত্ব দেওয়া হোক তারা নিষিদ্ধ হবে নাকি যুদ্ধাপরাধীদের প্রেতাত্মা মুক্ত হয়ে দেশের সুস্থ রাজনৈতিক ধারায় ফিরে আসবে।
স্বাধীনতার পর ৪২ বছর জামায়াত কে অনেক সুযোগ দেওয়া হয়েছে। হীন রাজনৈতিক স্বার্থে যুদ্ধাপরাধীদের এ দেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে, মন্ত্রী বানিয়ে জাতীয় পতাকার অবমাননা করা হয়েছে। এ সংস্কৃতি আর কিছুতেই চলতে দেওয়া যায় না।
যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি কার্যকর হয়ে দেশ কলংক মুক্ত হোক। তারুণ্যের বিজয় কেতন উড়ুক ভাষা আন্দোলন আর বিজয়ের মাসে।
শহীদ মুক্তি যোদ্ধাদের রক্তের ঋণ কিছুটা হলে ও পরিশোধিত হোক চিহ্নিত রাজাকারদের মৃত্যুদণ্ডের মাধ্যমে, এ আশাবাদ আজ সমগ্র জাতির।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।