আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সভ্য জীবন চর্চার বিকল্প নেই -- মঈনুল আহ্সান

মঈনুল আহসান

প্রিয় পাঠক, পরিস্থিতির ভয়াবহতা তুলে ধরতে বাধ্য হয়েছি দৃশ্যমান ঘটনাসমূহের খোলামেলা বর্ণনায়। তাই লিখাটা পড়তে গিয়ে গা ঘিণ ঘিণ করতে পাড়ে। বমি বমি ভাবও হতে পারে অনেকের। তাই অণুরোধ করবো খাওয়ার সময় বাদ দিয়ে লিখাটা পড়ার জন্য। বঙ্গভবনের সমান্তরাল রাস্তা ধরে গুলিস্থানের পার্কের ভেতর দিয়ে যচ্ছিলাম রিক্শায়।

দেখলাম গাছের গোরায় গোরায় দাঁড়িয়ে এবং বসে অগুণিত আদমপুত্র প্রেসিডেন্ট সাহেবের দরজা বরাবর নিখুঁত নিশানায় একাগ্রচিত্তে মূত্রত্যাগে ব্যস্ত। লুঙ্গী পরিহত প্রায় পদ্মাসনে উপবিষ্টদের কেউ কেউ যে বড় কাজেও ব্যস্ত ছিলেন তা বলাইবাহু্ল্য। তাছাড়াও মূত্রতো আর একা নির্গত হয়না সাথে বের করে আনে চরম দুর্গন্ধময় পরম দুষিত বায়ুও। সুতরাং বুঝতেই পারছেন ওখানকার বাতাসের ঘণত্ব ছিল তখন কী ভয়াবহ। ঐ অবস্থায় ফুসফুসের মধ্যে নিজের দমটাকে কোন রকমে চেপে ধরে পথটুকু পারি দেয়াই ছিল আমার সামনে একমাত্র উপায়।

ট্রেনে যাবো দেশের উত্তরে। শুনেছি ‘নীল সাগর’ আন্তঃনগর বড়ই আরামদায়ক। ট্রেন ধরতে যেতে হলো ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট ষ্টেশনে। টিকিট করেছিলাম তাপাণুকুল কামরার এবং ট্রেনে উঠছি বিশেষ এলাকা থেকে সুতরাং নিশ্চিত ছিলাম নিরমল এক ভ্রমনের জন্যে। ধারনা ভুল ছিল না।

সকালের নিরিবিলি ক্যান্টনমেন্ট ষ্টেশন ছিল পরিচ্ছন্ন এবং সুশৃঙ্খল। প্লাটফর্মেই দাঁড়ানো ছিল ‘নীল সাগর’। পুলকিত বোধ করছিলাম নির্দিষ্ট সময়ে ছেড়ে গিয়ে যথাসময়ে গ্রামের বাড়ী পৌঁচ্ছাবো ভেবে। নম্বর মিলিয়ে কামরায় উঠতে যবো, দেখি কামরার ভেতর থেকে রেল লাইনের ওপর ঝরঝর করে ঝরছে খাঁটি ‘তরল মল’। বিভৎস সেই দৃশ্য।

মনে পড়লে এখনো গুলিয়ে ওঠে সারা গা। কোন রকমে নাক-মুখ ঢেকে, পরনের পোষাক বাঁচিয়ে কামরায় উঠে দেখি না কোন যাত্রী নয়, রেলেরই কর্মনিষ্ঠ মহিলা পরিচ্ছন্ন কর্মী নির্বিবাদে পরিষ্কার করছে যাত্রী কর্তৃক নোংড়া করে যাওয়া টয়লেট, যদিও টয়লেটের দরজায় ঝকঝকে বাংলায় লিখা আছে ‘ষ্টেশনে গাড়ী দাঁড়ানো অবস্থায় টয়লেট ব্যবহার করবেন না’। মগবাজার-মালিবাগ থেকে সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী যেতে কমলাপুর ষ্টেশন ঘেষে বিশ্বরোড ধরাটা রিক্শা বা স্কু্টার চালকদের কাছে খুবই প্রিয়। কিন্তূ ওরে বাবা। ঐ দুর্গন্ধ বর্ণনার ভাষা আমার জানা নাই।

শুধু মনে হতো আমার জানটা বুঝি এই গেলো। ভুল বুঝবেন না ওটা মিউনিসিপালিটির ডাম্পিং এলাকার গন্ধ নয়। ওটা হলো প্রায় মাইল খানেক লম্বা ফুটপাথ জুড়ে ছড়ানো টাটকা মল-মূত্রের গন্ধ। ফকিরাপুলের বিখ্যাত পানির টাঙ্কীর সাথে আছে ঢাকা ওয়াসার গুরুত্বপূর্ণ একটা অফিস। যেতে হয়েছিল সেখানে।

ভাল লেগেছে নীচ তলার ইনফর্মেশন ডেস্কে সাহায্যকারী কর্মচারীর যথাযথ উপস্থিতি। উনার নির্দেশনা মত যেতে হলো তিন তালায়। সেখানে সিড়িঁর গোড়াতেই বাথরুম। ওরে বাপরে সে কী গন্ধ। রুমাল-টুমাল কিচ্ছু মানেনা অবাধ্য সেই দুর্গন্ধ।

সব ভেদ করে যেন চেপে ধরতে চায় হৃৎপিন্ড। অথচ ওখানে বসেই অবলিলায় চা-সিগারেট-সিঙ্গারা খাচ্ছে আর গল্প করে অলস সময় পার করছে কত না মানুষ। ড্র্রাইভারকে বলালম একটা ভাল জেনারেল ষ্টোর দেখে থামতে। রুটি, পানি, ডিংস কিনতে হবে। গাড়ী তখন মগবাজার চৌরাস্তার কাছে।

অভিজ্ঞ ড্র্রাইভার দ্রুতই গিয়ে থামলো এক ষ্টোররের সামনে, বললো, এখানেই সব পাওয়া যাবে। দোকানটার সামনে রাস্তার ওপর বিশাল এক ডাস্টবিন। ঢাকার ডাস্টবিন কী জিনিস টের পালাম গাড়ী থেকে নামার পর। আশেপাশের হাইরাইজগুলোর গৃহস্থলী সব আবর্জনার সাথে সেখানে রয়েছে ঢাকার অবধারিত ট্রেডমার্ক কাঁচা মল-মূত্র, ছড়াচ্ছে দুর্বিসহ দুর্গন্ধ আর সেটা পেরিয়েই ঢুকতে হবে সুসজ্জিত জেনারেল ষ্টোরে। সে এক ভয়াবহ আভিজ্ঞতা।

বাড়ী ফিরে বারবার সাবান দিয়ে হাত-মুখ ধুয়েও সহজে তাড়াতে পারিনি সেই দুর্গন্ধ। ককটেল সেই দুর্গন্ধ যেন ঢুকে গিয়েছিল আমার অস্থি-মজ্জায়। বেইলী রোডের অভিজাত নাটক স্মরণীতে গিয়েছিলাম শাড়ী কিনতে। সামনেই দেখি পিঠা ঘর এবং এখানেও সেই একই অবস্থা। রাস্তা জুড়ে ডাষ্টবিন আর ককটেল দুর্গন্ধ।

সেখানে সেই দুর্গন্ধের মাঝে দাঁড়িয়েই সুবেশী তরুণ-তরুণী আর ভদ্রলোকেরা খাচ্ছেন মজাদার পাটিশাপ্টা আর ভাপা পিঠা। অদ্ভুত এবং বড় বিচিত্র সেই দৃশ্য। ঢাকাকে বিশ্বমানে উত্তীর্ণ করার কথিত প্রয়াসে এই শহরে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে পিজাহাট আর কেন্টাকি ফ্রায়েড চিকেনের মত বরেণ্য ফাস্টফুড সপ। পরিবার নিয়ে যেতে হয়েছিল শঙ্করের কেন্টাকি চিকেনে। অর্থের তুলনায় খাবার যা পেলাম তা নিতান্তই নগণ্য।

ভিনদেশী ফাড়িয়ারা যে কত অনায়াসে আমাদের জনগণকে বোকা বানিয়ে অর্থ কামাচ্ছে তা দেখে হতবাক হয়েছি। খাওয়া শেষে নাতিশীতোষ্ণ ফুড সপ ছেড়ে বের হতেই যেন ধাক্কা খেলাম দুর্গন্ধের এক সুবিশাল দেয়ালের সাথে। এখানেও সেই উপচে পরা ডাষ্টবিন। কেন্টাকি সাহেবের চিকেনের স্বাদ মূহুর্তেই রূপ নিয়েছিল প্রসাবের উৎকট গন্ধে। ভেতরের পরিচ্ছন্ন পরিবেশের প্রেক্ষাপটে বাহিরের অবস্থা যেন দুর্বষহ হয়ে উঠেছিল আরও।

কোরবানী ঈদের দিন। ফজরের নামাজ সেরেই ছুটলাম জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে প্রথম জামাত ধরবো বলে। যথা নিয়মে যথা সময়ে শেষ হলো নামাজ। তাড়া আছে কোরবানীর। তারপরও ঈদের দিন বলে কথা।

বাচ্চা-কাচ্চার ঘরে খালি হাতে ফেরা চলে না। এগুতে চাইলাম বেলুন বিক্রেতার দিকে। কিন্তু একি সমস্ত ফুটপাত-রাস্তা যে ভেজা। বৃষ্টিতো হয়নি। অবশ্য বৃষ্টির কোন দরকারও হয়নি ঈদের দিনের সেই সকালে।

আদমের পুত্ররাই সদল বলে সেরেছিল বৃষ্টির সেই কাজ। জাতীয় মসজিদ আর জাতীয় ষ্টেডিয়ামের প্রবেশ পথ থেকে শুরু করে গুলিস্থান পর্যন্ত পুরো এলাকা তারা সয়লাব করে ফেলেছিল শুধু মূত্র ত্যাগ করে। একেবারে থৈথৈ অবস্থা আর সেকি ঝাঁঝাঁলো দুর্গন্ধ। ভোরের খালি পেট গুলিয়ে উঠে বেরিয়ে পড়তে চাইছিল নাড়ী-ভুড়ীসহ। অথচ বেচা-বিক্রি কিন্তু থেমে ছিল না।

ঐ থৈ থৈ মূত্রের উপর দাঁড়িয়েই চলছিল কেনাবেচা। পায়ের নীচে দেখার সময় ছিল না ক্রেতা- বিক্রেতা কারোরই। সায়েদাবাদ থেকে যাচ্ছি মগবাজার। স্কুটার ড্রাইভার ধরলো গুলিস্থানের পথ। আমি প্রমাদ গুণলাম।

কারণ সথে ছিল আমেরিকার স্কুল পড়ুয়া আমার টিনএজ পুত্র। কঠিন নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে বেড়ে ওঠা এসব ছেলেমেয়েরা সাধারনত হয়ে থাকে সরল-সহজ এবং স্পষ্টভাষী। এরা সহ্য করতে পারে না নিয়মের কোন ব্যতিক্রম এবং কথা বলে, কাজ করে সোজা-সাপ্টা। আর ভয়টা ছিল ওখানেই। এয়ারপোর্ট ছেড়ে রাস্তায় নামার পর থেকেই সে বিরক্ত ছিল ট্রাক, বাস, গাড়ী আর রিক্শার উশৃঙ্খল চলাফেরায়।

তবে চেষ্টা করছিল কিছু না বলতে আমরা কষ্ট পাব ভেবে। কিন্তু গুলিস্থানের অবস্থা দেখলে সে যে চুপ থাকতে পারবে না সে বিষয়ে আমি ছিলাম নিশ্চিত। আর হলোও তাই। গুলিস্থানের কুখ্যাত যান ও মানব জটে আটকা পড়ে যে জায়গাতে থেমে গেল আমাদের স্কুটার তার পাশেই ছিল ঠাটারী বাজারের মুরগীপট্টি। বড়ই জটিল ছিল সেই অবস্থা।

আমাদের আপাত শান্ত এবং ভদ্র ছেলে মুখ খুললো। খুব স্পষ্ট উচ্চারনে বললো, ‘ইটস্ এন আন-সিভিলাইজড কানট্রি’। ভারী পরিবেশটা হাল্কা করতে একটু জোক করার চেষ্টা করলাম, বললাম, ‘ঠিক আন-সিভিলাইজড নয়, এরা আসলে ফ্রীডম লাভার, যখন যেখানে যা খুশী করা, যেমন খুশী চলা এদের পছন্দ এবং অভ্যাস’। ছেলে জবাব দিল ছোট্ট কারে, ‘দ্যাটস্ নট ফ্রীডম’। এরপর আমার আর কিছু বলার ছিল না।

দেশের এই দুর্বিষহ অবস্থা দেখে নীরব থাকতে পারে নি সফর সঙ্গী ভাগ্নেও। আমার ছেলের মতই অনন্য মেধার জন্যে একাধিকবার গোল্ডেন প্রেসিডেন্টস্ এওয়ার্ড পাওয়া এই ভাগ্নেও যারপর নাই বিস্মিত হয়েছে মানুষের জীবন যাত্রার করুণ অবস্থা দেখে, বলেছে, ‘এ দেশে বাস করাটাই দুর্ভাগ্যের, তা টাকা, পয়সা, বাড়ী, গাড়ী যতই থাকুক না কেন’। পরিস্থিতি সাপেক্ষে বললে অতুক্তি হবে না যে ঢাকার মাটি, পানি, আকাশ, বাতাস সবকিছুই আজ মানব মল-মূত্র আচ্ছাদিত। এয়ার কন্ডিশান্ড গাড়ী-বাড়ীতে থেকে যারা নিজেদেরকে এথেকে মুক্ত ভাবছেন তারা আসলে বোকার স্বর্গে বাস করছেন। কারণ ফিল্টার বলেন আর পানি ফুটানো বলেন, সব কিছুরই বিশুদ্ধ করার একটা নির্দিষ্ট মাত্রা (maximum capacity) আছে।

উপরন্তু মশা, মাছি আর বাতাসের ধুলাবালি, যা থেকে মুক্তির সাধ্য আমাদের নাই সেগুলোতো আসলে মল-মূত্রে মাখামাখি হয়ে এসে পরে আমাদের গায়ে, গতরে আর খাবারে। খুব খারাপ শোনা গেলেও আমরা ঢাকাবাসীরা যে প্রতিনিয়ত মল-মূত্র মথিত খাদ্য গ্রহন করছি একথা বললে খুব একটা ভুল বলা হবে না। ঢাকার মাটি, বাতাস, পানি, খাদ্যদ্রব্য, এমন কি প্রতিনিয়ত গায়ে এসে পড়ছে যে মশা-মাছি সেগুলোর কলিফরম টেষ্ট (Coliform test : মল-মুত্রবাহিত জীবাণু সনাক্ত করার সুনির্দিষ্ট পরীক্ষা) করে খুব সহজেই প্রমাণ করা সম্ভব এসবে মল-মুত্রের উপস্থিতি। দেশের অগণিত বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণাগারগুলোর জন্য এটা হতে পরে খুবই সময়োপযোগী ও খুব দরকারি একটা থিসিসের বিষয়। পরবাসী হওয়ার আগে এই ঢাকা শহরে কেটেছে আমার কৈশোর আর যৌবনের কুড়িটি বছর।

তখন আবস্থা যে খুব ভাল ছিল, তা নয়, তবে বলাই বাহুল্য এত ভয়াবহ পরিস্থিতি ছিল না। এখন যখন অনেক দিন পর পর দেশে ফিরি তখন স্পষ্টতঃই বুঝতে পারি যে এই মাটিতেই গড়ে ওঠা আমার ভেতরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আর কাজ করছে না। অসুস্থ হয়ে পড়ছি যেন এই মাটিতে নিঃশ্বাস নেয়ার সাথে সাথেই। এই অবস্থার একমাত্র ব্যাখা হলো এই দেশের অসুখ-বিসুখের জীবাণুগুলো পরিবর্তিত হচ্ছে খুব দ্রুত এবং সর্বব্যাপী অপরিচ্ছন্নতার কারণে আবির্ভূত হচ্ছে নিত্য নতুন জীবাণু। তাই কয়েক বছরের ব্যাবধানে দেশে পা রাখতেই প্রবাসীরা হয়ে পড়ছেন অসুস্থ।

ক্ষেত্র বিশেষে এই অসুস্থতা এতই গুরুতর হয়ে উঠছে যে প্রবাসীর কষ্টার্জিত ছুটির পুরোটাই কাটাতে হচ্ছে হয় টয়লেটে নয়তো হাসপাতালে। নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে গিয়ে প্রবাসীদের কথা বলছি ঠিকই কিন্তু আসলে এই সব নতুন নতুন জীবাণুর প্রধান শিকার হচ্ছে এদেশবাসীই। তার নমুনা দেখেছি এবার দেশের পথে-ঘাটে। মাত্র একমাসের মধ্যে ঘরে-বাহিরে, রাস্তা-ঘাটে, বাসে-ট্রেনে, স্কুটারে-রিক্সায় অসংখ মানুষকে দেখেছি মুখ ভরে বমি করতে। স্পষ্টতঃই মনে হয়েছে দেশটা যেন পরিণত হয়েছে দুরারোগ্য রোগ-ব্যাধির এক ভাগাড়ে।

তবে সবচেয়ে ভয়াবহ মনে হয়েছে মানুষের নির্লিপ্ততা। সর্বগ্রাসী অপরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে মানুষকে মনে হয়েছে একেবারেই নির্বিকার। যতদূর জানি, খ্যাতিমান লেখক অধ্যাপক হুমায়ন আজাদ যখন আক্রান্ত হয়েছিলেন সোহরোওয়ার্দী উদ্যানের কোনায় তখন সেখানে তিনি মুত্রত্যাগ শেষ করেছিলেন মাত্র। বাংলা একাডেমীর বই মেলা থেকে বাসায় ফেরার পথে ঐখানে তিনি নিয়মিত মুত্রত্যাগ করেন, এমন তথ্যের ভিত্তিতেই সন্ত্রাসীরা সেখানে ওত পেতে ছিল বলে জানা গেছে পরবর্তীতে। এ থেকেই বোঝা যায় আমাদের এই বদ অভ্যাসের শেকড় কত গভীরে এবং আমরা কতটা সিদ্ধহস্ত এই দুরাচারে।

ইদানীং প্রচুর কথা হচ্ছে ঢাকার দুষণ নিয়ে। নদী দুষণ, ইটের ভাটার কারণে দুষণ, আর্সেণিক দুষণ, কল-কারখানার বর্জ্য, ওয়াসার পানিতে ময়লা ইত্যাদি সবই আলোচিত হচ্ছে। এমনকি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে এসব বিষয়। কিন্তু যত্রত্ত্র মল-মূত্রজনিত ভয়াবহ এই দুষণের কথা কেন যেন গতি পাচ্ছেনা কোন আলোচনাতেই। অথচ এ কথা আজ প্রমাণিত সত্য যে বিশ্বের সিংহভাগ মরণব্যাধির ধারক-বাহক এবং উৎসই হলো মানুষের মল-মূত্র।

এই দুষণ এখনই থামানো না গেলে পরে হয়তো জনস্বাস্থ্য রক্ষায় ঘরে ঘরে আইসিডিডিআর, বি গড়েও ঠেকানো যাবেনা ডাইরিয়ার মত নিত্যদিনের মরণব্যাধির মহামারি। এমন কি আজকের এই কলুষিত ঢাকাকে পরিত্যাগ করে যদি গড়ে তোলা হয় নতুন শহর, নতুন রাজধানী তাতেও কোন লাভ হবে না যদি না পরিবর্তিত হয় আমাদের এই ঘৃণ্য স্বভাব। অথচ সুস্থতা আর সভ্যতার প্রধানতম মাপকাঠিই হচ্ছে পরিচ্ছন্নতা। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সভ্যতার বাহক হযরত মহম্মদ (সঃ) পরিচ্ছন্নতাকে শুধু ঈমানের অর্ধাংশ বলেই ক্ষান্ত হননি বরং মল-মূত্র ত্যাগে অসাবধানতার ভয়াবহ পরিনতির কথা বলে গেছেন সবিস্তারে। মসজিদের শহর ঢাকা আর ইসলামের দেশ বাংলাদেশের সব মুসলমান খুব ভাল করেই জানেন এসব হাদীস।

মসজিদে, মাহফিলে এ সংক্রান্ত বয়ান খুবই সাধারন ঘটনা অথচ সেই মসজিদের প্রসাবখানাতেই ঢোকা যায় না। নামাজে দাঁড়ালে ভুর ভুর করে নাকে এসে ঢোকে প্রসাবের দুর্গন্ধ। এ অবস্থায় আমরা কিভাবে করতে পারি এবাদত কবুলের আশা। যত্রতত্র মূত্রত্যাগ প্রতিরোধে সম্প্রতি পাঁচশত টাকা জরিমানার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে কাজ যে হবে না তা বলাই বাহুল্য।

উন্নত বিশ্বে দেখেছি প্রি-স্কুল থেকেই বিবিধ বাস্তব সম্মত উপায়ে বাচ্চাদের মধ্যে নাগরিক কর্তব্য ও দায়িত্ববোধ গড়ে তুলতে। শেষে গিয়ে পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে এরা বড় হয়ে আইন বা সামাজিক নিয়ম কানুনের পরিপন্থী কোন কিছু আর চিন্তাই করতে পারেনা। বিষয়টা আরও পরিষ্কার বোঝা যাবে নিচের উদাহরন থেকে। দেশ ছাড়ার দু-সপ্তাহের মাথায় জাপানীজ বন্ধুরা নিয় গিয়েছিল হাইকিং-এ। চারিদিকে গাছ-গাছালিময় জঙ্গলের মাঝ দিয়ে মেঠো পথ।

বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে উঠে গেছি কয়েক হাজার ফিট। এক পর্যায়ে একটা চকলেট মুখে দিয়ে আভ্যাসবসত কাগজটা ফেলেছি ঝোপের মধ্যে। সাথের এক বন্ধু দ্রুত কাগজটা তুলে নিয়ে বললো, সামনে ট্রাস ক্যানে ফেলে দেবো, এভাবে সবাই আবর্জনা ফেললে পাহাড়টা নোংরা হয়ে যাবে যে। পরবর্তিতে ঐ কাজটা আরেকবার করা আমার পক্ষে আর কখনই সম্ভব হয়নি। এসব দেশের লোকজন সাধারনত নিজের ঘর-বাড়ীর চাইতেও বেশী সচেতন রাস্তা-ঘাটে।

নিজের কোন কাজে অন্যের যাতে কষ্ট না হয় এটাই যেন এরা চিন্তা করে সব সময়। এমনকি এখানে যারা প্রতিদিন কুকুর নিয়ে রাস্তায় হাঁটতে বের হন তারা সাথে রাখেন প্লাস্টিক ব্যাগ যেটাতে নিজ হাতে তুলে নেন কুকুরের মল যদি সে মলত্যাগ করে রাস্তায়। বাংলাদেশকে ঐ পর্যায়ে নিতে সময় লাগবে নিঃসন্দেহে। কিন্তু তাই বলে চেষ্টা তদবির সব বাদ দিয়ে বসে বসে ডাইরিয়াতে মারা পরাও ঠিক হবেনা। এবার গ্রামে গিয়ে বেশ অবাক হয়েছি ভার্ক নামক কোন এক সংগঠনের সাইনবোর্ড দেখে।

সেখানে লিখা ছিল বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দা কর্তৃক উন্মুক্ত স্থানে পায়খানা না করার প্রতিশ্রুত বাণী। নিঃসন্দেহে প্রশংসণীয় কার্যক্রম। কিন্তু ঢাকায় তারা নীরব কেন তা বোঝা গেল না। এরকম বিচ্ছিন্ন একক উদ্যোগের চাইতে এক্ষেত্রে ব্যাপকভিত্তিক গণসম্প্রপ্রচার হতে পার আধিক কার্যকর। মাটি ও মানুষের মত টিভি অণুষ্ঠান যেমন বিপ্লব ঘটিয়েছে কৃষিতে তেমনি প্রতিনিয়ত নাটক, টকশো এবং প্রাসঙ্গিক অণুষ্ঠানমালার আয়োজন করে দেশের টিভি চ্যানেলগুলো ঘুরিয়ে দিতে পারে আমাদের অসভ্য অভ্যাসগুলোকে।

অতীতমুখি অপ্রয়োজনীয় প্যাচাল কমিয়ে টক শোগুলোতে নগর বিজ্ঞানী, পরিবেশ বিজ্ঞানী, অবকাঠামো বিজ্ঞানী, জনস্বাস্থ কর্মীদের ডেকে এনে আমাদের প্রেক্ষাপটে সমস্যাগুলোর সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে নিয়মিত আলোচনা করে প্রয়োজনে কম্পিউটার গ্রাফিক্সের মাধ্যমে মানুষকে হাতে কলমে পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা শিক্ষা দেয়া যেতে পারে। চলতি পথে বমি করতে হলে কিভাবে সেটাকে আকাশে-বাতাসে উড়িয়ে না দিয়ে ঠোঙ্গা বা প্যকেটে নিয়ে পরে সুবিধা মত স্থানে ফেলা যায়, কিভাবে যত্রতত্র কফ-থুথু ফেলা পরিহার করা যায়, কিভাবে কম পানি খরচ করে স্বাস্থ্য সম্মত উপায়ে বাথরুম করা যায়, কি ভাবে আফিস-আদালত-মসজিদ এবং পাবলিক টয়লেটগুলোকে স্বাস্থ্য সম্মত ও পরিবেশ বান্ধব রাখা যায়, কি করলে চলতি পথে প্রসাব-পায়খানার বেগ এড়ানো সম্ভব এসব বিষয়ে সচেতন জনগণ ও বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের আলোচনায় দেশবাসী উপকৃত হবে বলে আমার বিশ্বাস। এসব অনবরত আলোচনা ও প্রচারনার মাধ্যমে মানুষের মনে এবং মগজে এই বাণীটা গেঁথে দিতে হবে যে, আমাকে পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে আমার নিজেরই স্বার্থে এবং এটা শুধুমাত্র কয়েকজন সরকারি পরিচ্ছন্ন কর্মীর কাজ নয়। যে পথ প্রতিদিন ব্যবহার করছে হাজার হাজার মানুষ সেটা শুধু একবেলা ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার রাখা যাবেনা যতক্ষন না দায়িত্বশীল হবে সারাদিনের ব্যবহারকারীরা। বাংলাদেশকে রোগ-বালাই মুক্ত সুন্দর স্বাস্থ্যবান করার জন্যে এর চাইতে উত্তম কোন উপায় এমূহুর্তে আর মাথায় আসছে না।

লস এঞ্জেলেস, ইউএসএ জুলাই ২২, ২০০৯ Email:

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।