আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জন্ম যখন আজন্ম পাপ

সবাইকে শুভেচ্ছা...
মা যতদিন বেচে ছিলেন ঘন ঘন দেশে যাওয়া হত। বিশেষ করে সিডনীতে যতদিন ছিলাম কারণে অকারনে চলে যেতাম কোন একটা উপলক্ষ পেলেই। ঈদ, বাবার মৃত্যু বার্ষিকী, বিয়ে এ ধরনের যে কোন একটা অনুষ্ঠানের আওয়াজ পেলেই হাতের ব্যাগটাতে সামান্য কিছু কাপড় গুছিয়ে সোজা এয়ারপোর্ট। আমার আগমনী তারিখ কিংবা সময় দ’টোর কোনটাই আগ বাড়িয়ে জানাতাম না। কোন এক সুন্দর সকাল অথবা সন্ধ্যায় বাসায় নক করলে ভেতর হতে মার গলা শোনা যেত, ’দেখত বাইরে কে?’।

এই একটা বাক্য শোনার জন্যেই ছিল এ লুকুচুরি। পরের দৃশ্যগুলো ছিল বর্ণনাতীত। চারদিকে শুধুই সূখের জোয়াড়। আপ্রত্যাশিত সূখের প্লাবনে ভেসে যেত আমাদের গোটা পরিবারা। অষ্ট্রেলিয়া ছেড়ে মার্কিন দেশে পাড়ি জমানোর কারণে লাগাম টানতে বাধ্য হই হঠাৎ খুজে পাওয়া এসব শিহরনে।

২০-২২ ঘন্টা বিমান ভ্রমনের ধকল চাইলেও সামলানো সহজ ছিলনা, এমন একটা বাস্তবতা মার পক্ষে হজম করাও ছিল বেশ কষ্টের। যাই হোক, আমার এ লেখা মা-ছেলের আনন্দ বিরহ নিয়ে নয়। অন্যকিছু নিয়ে, আসছি সে কাহিনীতে। যতবারই দেশে যাই খুব সকালে ঘুম হতে উঠেই দু’টো জিনিষ করতে ভূল করিনা; এক, আশপাশের অতি সস্তা কোন রেষ্টুরেন্টে বসে পরোটা ভাজি দিয়ে সকালের নাস্তা (সাথে নোংরা কাপে এক কাপ চা) । দুই, হুড খোলা রিক্সায় চড়ে সকালের ঢাকায় এলোমেলো কিছুক্ষন ঘুরে বেড়ানো।

মাকে দেখা এবং সকালের বাকি দু’টো অভিযান শেষে প্রতিবারই মনেহত আমার দেশে আসা বোধহয় সম্পূর্ণ হয়ে গেছে, এবার ফিরে গেলেও আফসোস থাকবেনা। শীতের সকালে ঢাকার চেহারাটায় অন্যরকম একটা মাধূর্য্য থাকে যা উপভোগ করতে রিক্সার কোন বিকল্প আছে বলে জানা নেই। কুয়াশাচ্ছন্ন এমনি এক সকালে লুংগিতে শক্ত গিট্টু এবং সমস্ত শরীর চাঁদরে ঢেকে বেরিয়ে পরলাম সৃত্মির অলিগলি হাতড়াব বলে। উদ্দেশ্য, কাকরাইল মোড় হতে রমণা পার্ক, শাহবাগ মোড় এবং এলিফ্যান্ট রোড হয়ে ঢাকা কলেজ। বাচাল একজন রিক্সাওয়ালা খুজে পেতে কষ্ট হলনা, টাকার অংক অফার করতেই তার চোখ ছানাবড়া! শুরু হল স্বপ্নের ঢাকা পরিক্রমা।

ঢাকা ক্লাবের কোল ঘেষে রমণা পার্কের কাছাকাছি আসতেই পেছন হতে দ্রুত ধাবমান একটা স্কুটারের ধাক্কায় ছিটকে পরলাম রিক্সা হতে, রিক্সাওয়ালা গেল একদিকে আর রিক্সা গেল অন্যদিকে। কিছু বুঝে উঠার আগে স্কুটারওয়ালা দানবীয় গতিতে স্কুটার হতে বের হয়ে লাথি মারতে শুরু করল রিক্সাওয়ালাকে। বেচারার আঘাত এমনিতেই ছিল চোখে পরার মত, তার উপর এই বর্বরতা! লুংগির গিট্টু খুলে আমিও দিগম্বর প্রায়, কনুই এবং হাটু ছিলে রক্তক্ষরন কিছুক্ষনের জন্যে হলেও আমাকে বোবা বানিয়ে রাখল। আহত রিক্সাওয়ালাকে ততোধিক আহত বানিয়ে স্কুটারওয়ালা চলে যেতে উদ্যত হতেই আমার হুশ এল। স্কুটারের সামনে দাড়িয়ে বাধা দিলাম, অনুরোধ করলাম আমাদের নিকটস্থ পিজি হাসপাতালে পৌছে দিতে।

এবার স্কুটারের যাত্রীর গলা শোনা গেল, ‘আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে, অন্য কোথাও যাওয়ার সূযোগ নেই’। মহিলার তীক্ষ্ন গলা বুলেটের মত হিস হিস করে উঠল। সাধারণ সুন্দরীর চাইতে একটু বেশী সুন্দরী এক যুবতী, পরনে সাদা এপ্রোণ। হয় ডাক্তার নয়ত মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রী। জানা গেল পুরান ঢাকার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজের দিকে যাচ্ছে স্কুটার।

অন্তত রিক্সাওয়ালাকে ঐ হাসপাতাল পর্য্যন্ত নিয়ে যাওয়ার অনুনয় করলাম। কে শোনে কার কথা, উলটো ইংরেজীতে সস্তা একটা গালি ছুড়েদিল আমার দিকে। এবার আমার ভেতরের পশুটা জেগে উঠতে বাধ্য হল। খাটি ইংরেজীতে গনধোলাই দিলাম পাক্কা ১০ মিনিট। লুঙ্গি আর চাদর পরা একজন টোকাইয়ের মুখে এ ধরনের ইংরেজী শুনে কিছুটা অপ্রস্তূত হলেও মুখ আর শরীরের তীব্রতা কমলোনা এক ছটাক।

আমাকে অনেকটা গলাধাক্কা দিয়ে স্কুটার নিয়ে বিজয়নী সোনাভানের মত কুয়াশায় মিলিয়ে গেল বাংলাদেশের অন্যতম শিক্ষিত অংশের গর্বিত প্রতিনিধি, ডাক্তার! পেছনে ফেলে গেল আহত দু’জন রুগী। গালাগালির ফাকে ফাকে যে কথাগুলো কথিত ডাক্তারবিবিকে বুঝানোর চেষ্টা করেছি তার সারমর্ম পাঠকদের জন্যে তুলে ধরলাম, এ নিয়ে চিন্তা ভাবনার দরকার আছে বোধহয়। একজন ডাক্তারের পেশাজীবি মনোভাবের পাশাপাশি এমন কিছু মানবিক মূল্যবোধ থাকা চাই যা তাকে এই মহান পেশার যোগ্য করে তোলে। ঢাকা শহর পৃথিবীর অন্যতম দূষিত শহর, এ শহরের খোলা রাস্তায় একজন ডাক্তার সাদা এপ্রোণ পরে ঘুরে বেড়াবে তা কোন মতেই স্বাস্থ্য সম্মত হতে পারেনা। স্থান, কাল নির্বিশেষে এ ধরনের পোশাক পরিধান সমাজে রোগ বিস্তারের সহযোগী হিসাবে কাজ করবে মাত্র।

আর যদি রাস্তা-ঘাটে সাদা এপ্রোণ পরিধানের মূল উদ্দেশ্য হয়ে থাকে সমাজে নিজদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান, তা হলে তার প্রতি সূবিচার শুধূ হাসপাতালে নয় বরং রাস্তা-ঘাটে করাও বাঞ্চনীয়। সগোত্রীয় ক’জন রিক্সাওয়ালার সযোগীতায় আহত রিক্সাওয়ালাকে নিয়ে পিজি হাসপাতালে হাজির হতেই দেখি অন্য এক মহামারী, একদল ডাক্তার ধাওয়া করছে অন্য এক দলকে, চারদিকে ভাংচুরের কেয়ামত। পরে জানতে পারলাম বাংলাদেশী জাতিয়তাবাদী ডাক্তাররা তাড়া করছে বাঙালী জাতিয়তাবাদীদের। নিজকে ধিক্কার দিলাম এমন একটা দেশে জন্মেছি বলে! ঘটনাটা অনেক বছর আগের। এ ফাকে অবস্থার উন্নতি হয়ে থাকলে ডাক্তারকুলের কাছে ক্ষমা চাইছি।


 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.