গার্মেন্টস শিল্প : উন্নয়নের পথ ও প্রত্যয়
ফকির ইলিয়াস
------------------------------------------------------------------
সম্প্রতি একটি ঘোষণা আমাকে বেশ ভাবিয়েছে। গার্মেন্টস শিল্প রক্ষায় ব্যবসায়ীরা তাদের নিজস্ব গোয়েন্দা সংস্থা গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। তারা বলেছেন, তাদের এই গোয়েন্দারা সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সম্পূরক শক্তি হিসেবে কাজ করবে। উদ্যোগটি খুবই ভালো, তাতে সন্দেহ নেই। বাংলাদেশে গার্মেন্টস শিল্পে অস্থিরতা তৈরির একটি প্রবণতা প্রায়ই লক্ষ্য করা যায়।
এটা কারা করছে, কেন করছে- তা ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ হয়ত জানেন। হয়ত জানে রাষ্ট্রের আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও। তা জানারই কথা। কারণ রাষ্ট্রে এমন কোনো অশুভ তৎপরতা চলতে পারে না, যা রাষ্ট্রের ব্যবসা-বাণিজ্য ও রফতানিকে ব্যাহত করে।
অধুনা বিশ্বে গার্মেন্টস শিল্প একটি লাভজনক ব্যবসা।
বিশেষ করে শ্রমের মূল্য যেসব দেশে তুলনামূলক কম সেসব দেশে পাশ্চাত্যের দেশগুলো তাদের প্রস্তুতকারক এজেন্ট নিয়োগ দিচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুরোবাজার দখল করে নিয়েছে চীন। ‘মেড ইন চায়না’ তা এখন একটি কমন দ্রষ্টব্য বিষয়। তা ছাড়াও ভারত, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড ও মেক্সিকো প্রভৃতি দেশেও ম্যানুফ্যাক্সারিং ফ্যাক্টরি গড়ে তুলেছে যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক বিক্রেতারা। এর প্রধান লক্ষ্য হচ্ছেÑ মূল্যের সাশ্রয়।
বিশেষ করে কম শ্রমমূল্যে ভালো কোয়ালিটির তৈরি পোশাক বাজারজাত করা।
যুক্তরাষ্ট্রে সিয়ার্স, জেসি পেনি কিংবা মেসিজের মতো বৃহৎ স্টোরগুলোতে বাংলাদেশী তৈরি পোশাক যে পাওয়া যায় না তা নয়। পাওয়া যায়। তবে তা তুলনামূলক হারে কম। চীনই এখন দখল রেখেছে প্রথম স্থান।
এই প্রথম স্থানটির রেকর্ড ভাঙার একটি প্রচেষ্টা চলছে বেশ জোরালোভাবে। সে চেষ্টা করছেন খোদ তৈরি পোশাক বিক্রেতারাই।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবলে বাংলাদেশ একটি ভালো ম্যানুফ্যাক্সারিং জোন হতে পারে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তা গড়ে তুলতে স্বাগতিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ সঠিক ভূমিকা রাখতে পারছে তো? এই প্রশ্নটি আসছে বিভিন্ন কারণে। এ কথাটি আমরা সবাই জানি বাংলাদেশে শ্রমের মূল্য বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের তুলনায় অত্যন্ত কম।
যারা গার্মেন্টসে কাজ করে তারা গেল দেড় দশক আগে অন্য পেশায় ছিল। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোর বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই এই পেশায় যোগ দেন। কিন্তু কথা হচ্ছে, এই শিল্পের বিকাশের তুলনায় গার্মেন্টস কর্মীদের ভাগ্য ফিরেছে কি?
না, ফিরেনি। বরং তুলনামূলক চাকরির বাজারে বিভিন্নভাবে নিগৃহীত হচ্ছেন গার্মেন্টস শ্রমিকরা। তাদের জীবন ধারণের চাহিদার তুলনায় প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিতান্তই অপ্রতুল।
এটা খুবই দুঃখের কথা বাংলাদেশে শ্রমক্ষেত্রে ‘ওভারটাইম’ পদ্ধতি এখনো শক্তভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারেনি। অতিরিক্ত ঘণ্টা কাজ করিয়েও ন্যায্য পাওনা পরিশোধ করা হয় না। এই ব্যবস্থার অবসান দরকার।
বাংলাদেশে শ্রমক্ষেত্রে শ্রমিক ইউনিয়ন গড়ে তোলার প্রবণতা দীর্ঘদিনের। শ্রমিকদের ইউনিয়ন বিদেশেও আছে।
কিন্তু সেসব ইউনিয়নগুলো এতই শক্তিশালী এবং সুসংহত যে, তারা সব সময় শ্রমিকের অধিকারকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে সবচেয়ে বেশি। অথচ বাংলাদেশের শ্রমিক ইউনিয়নগুলো সব সময়ই আপোসকামী। তারা সরকার কিংবা বিরোধীদলের সঙ্গে আঁতাত করে সব সময়ই লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতিতে ব্যস্ত থকে। সরকারি শ্রমিক ইউনিয়ন বনাম বিরোধীদলীয় শ্রমিক ইউনিয়নের প্রতিযোগিতায় পিষ্ট হয় সব সময় সাধারণ শ্রমিক। আর নেতারা ফুলেফেঁপে কলাগাছ হয় রাতারাতি।
একটি দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সব সময়ই অর্থনীতির রক্ষাকবচ হিসেবে বিবেচিত হয়। রাজনৈতিকভাবে শান্তি না থাকলে সমাজও এগুতে পারে না। বিশেষ করে গেল দুই দশকের এই রাজনৈতিক অস্থিরতাই বাংলাদেশে উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় হয়েছে। সেই সুযোগে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে দুষ্ট দুর্নীতিবাজ চক্র। তারা সরকার এবং বিরোধীদল উভয়ের ছত্রছায়ায় কায়েম করেছে নিজ নিজ রাজত্ব।
এই রাজত্বের দীর্ঘসূত্রিতা এবং সঞ্চিত অপশক্তিই আজ দেশে সব উন্নয়নকে চ্যালেঞ্জ করছে। যা একটি দেশের জন্য চরম বিপজ্জনক সংকেত। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রয়োজনে শ্রমশক্তির দক্ষতা বাড়ানো খুবই দরকারি কাজ। গার্মেন্টস শিল্প এবং শ্রমিকের মূল্যায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী এক্সপোর্ট জোন গড়ে তোলা খুব কঠিন কোনো কাজ নয়। এর স্বপক্ষে আমি কিছু সুপারিশ এখানে তুলে ধরতে চাই।
১. বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পকে আরো লাভজনক করতে হলে তুলনামূলক মূল্য নির্ণয়ের মাধ্যমে বিশ্বে নতুন বাজার খুঁজতে হবে। ক্রেতাদের বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের গুণগত মানের বিশেষত্ব দেখাতে হবে।
২. বাইরের শক্তির সব ষড়যন্ত্র রুখতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে এই শিল্পের ক্ষতি হলে গোটা দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে অর্থনৈতিকভাবে।
৩. শিল্পের কোয়ালিটি কন্ট্রোল ভ্যালু বাড়াতে হবে।
এই তদারকির কোনোভাবেই যেন গাফিলতি না হয়।
৪. শ্রমিককে যথার্থ পারিশ্রমিক দিতে হবে। শিশুশ্রম বিষয়টিকে কোনোভাবেই পৃষ্ঠপোষকতা করা উচিত নয়। ন্যায্য ওভারটাইম মানি যাতে সবাই পায় সেদিকে ব্যবসায়ী সমিতিগুলোর ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত প্রয়োজন।
৫. গার্মেন্টস শিল্পে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির সব প্রবণতাকে রুখতে হবে।
মালিকদের মনে রাখতে হবে, ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিলে সুনাম পুনরুদ্ধার বেশ কঠিন কাজ। তাই রাজনৈতিক মারমুখী নীতি কোনোভাবেই যেন বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়।
গোয়েন্দা সংস্থা পুষে ভেতরের আগুন নেভানো যাবে না যদি শ্রমিক তার ন্যায্য পাওনা না পায়। এ ছাড়া আমরা দেখছি অত্যন্ত অপরিসর, অস্বাস্থ্যকর ছোট চিলেকোঠায়ও গড়ে উঠছে অনেক গার্মেন্টস কারখানা। এর অবসান হওয়া দরকার।
কারণ এমন ছোট পরিসর স্থানে আগুন লেগে বেশ কিছু গার্মেন্টসে কর্মী মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। তা ছাপাও হয়েছে দেশ-বিদেশের পত্র-পত্রিকায়, যা বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প সম্পর্কে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে বিদেশে। এই অবস্থার দ্রুত অবসান প্রয়োজন।
বাংলাদেশ সরকারের উদার বাণিজ্যনীতি, বিনিয়োগে সঠিক তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সাহায্য করলে অনেকেই বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হবে। সরকারি সব নীতিগত প্রতিবন্ধকতা দূর করা এখন সময়ের দাবি।
কারণ বাণিজ্য করতে হলে নিজ উৎপাদিত সামগ্রীকে ভালোবাসতে শিখতে হবে।
--------------------------------------------------------------------
দৈনিক ডেসটিনি। ঢাকা। ৯ আগস্ট ২০০৯ রোববার প্রকাশিত
ছবি - সি এস সাভেজ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।