বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা: স্পেনের কবি, নাট্যকার ও মঞ্চনির্দেশক। ক্রর রাজনীতির জন্য স্পেনের গৃহযুদ্ধের ঠিক আগে আগে প্রাণ দিতে হয়েছিল ... পৃথিবীর কৌতূহলী মানুষ কিন্তু লোরকাকে ভুলে নাই; সেটি সম্ভবও নয়। কেননা, একটি কবিতায় লোরকা লিখেছেন: সকালের গান/ যা ভবিষ্যতের শান্ত জলাশয়কে কাঁপাবে ;/ যা, তরঙ্গ ও কাদায় থাকবে পূর্ন আশা।
ভীষনই মরমী ছিলেন লোরকা। লিখেছেন : A flock of blind doves/thrown into mystery. কথা কটি বাংলা করলে দাঁড়ায় এরকম: রহস্যের মাঝে ছুঁড়ে 'দেয়া একঝাঁক অন্ধ পায়রা ...কী এর মানে? এমন কথা পাঠ করে লালনের দেশের আমরা ভীষনই কাতর বোধ করি .. বোধ করি কি না?
স্পেন। গ্রানাডা শহরের কাছে ফুয়েন্তে ভাক্যুয়েরস। সেখানেই ১৮৯৮ সালের ৫ জুন এক ভূস্বামীর ঘরে এক ছেলে হল। সেই ছেলের নাম রাখা হল ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা; তো বালক লোরকা একেবারেই যেন অন্যরকম।
প্রানশূন্য বস্তুর সঙ্গে বালক কথা কয় ...যেন ওগুলো জীবন্ত।
লোরকার সংগীতের হাতেখড়ি হয়েছিল বালক বয়েসেই।
স্পেনের গ্রানাডা মানচিত্র
কিশোর বয়েসে কবিতা লেখা শুরু। স্থানীয় ফুয়েন্তে ভাক্যুয়েরস-এর স্থানীয় কাফেতে কবিতাগুলি পড়া হত।
দর্শন ও আইন পড়ার জন্য তরুন বয়েসে গ্রানাডা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হল লোরকা।
পরে হঠাৎই আইন বাদ দিয়ে শিল্পসাহিত্য ও মঞ্চ নিয়ে পড়তে শুরু করলেন। ১৯১৯ এ মাদ্রিদ গেলেন-ওটাই তো স্পেনের তাবৎ শৈল্পিক আন্দোলনের কেন্দ্র। মাদ্রিদ-এ মঞ্চ নিয়ে মতে উঠলেন। জনসমক্ষে কবিতাও পড়তেন ।
কি, তাঁর হৃদয়টি পরিস্কার হয়ে যাচ্ছে তো?
সে সময় একদল দারুন রোম্যান্টিক আলোকিত মানুষ ছিল মাদ্রিদ-এ।
দলটাকে জেনেরাসিওন দেল টুয়েন্টি সেভেন বলে পরিচিত। তো কারা কারা ছিল জেনেরাসিওন দেল টুয়েন্টি সেভেন এ? সালভাদর দালির মতন আঁকিয়ে; বুনুয়েল-এর মতন চলচ্চিত্র নির্মাতা ও রাফায়েল আলবারটি-র মতন কবি ।
লোরকা নিশ্চয় ছিলেন জেনেরাসিওন দেল টুয়েন্টি সেভেন এর এক উজ্জ্বলতম নক্ষত্র!
যাক। তো সেই নাটকপাগল কবিটি ১৯২০ সালে প্রথম মঞ্চায়ন করলেন তাঁরই লেখা একটি নাটক। নাম? ‘দ্য বাটারফ্লাইস ইভিল স্পেল।
’ বাংলায়- প্রজাপ্রতির অশুভ মোহ। ‘স্পেল’ এর বাংলা কি হবে? মোহ? যাক। নাটকটি লোরকাকে এনে দিয়েছিল অপরিমেয় খ্যাতি। ১৯২১ এ প্রথম কাব্যগ্রন্থ বেরুল। এর আগে থেকেই অবশ্য খুচরো লেখা (বিশেষ করে কবিতা) বেরুত বিভিন্ন লিটল ম্যাগ-এ।
১৯২৮ সালে বেরুল লোরকার ২য় কাব্যগ্রন্থ; ‘দ্য জিপসি ব্যালাড। ’ এটিই সমগ্র স্পেনজুড়ে লোরকাকে কাব্যখ্যতি এনে দিল। সেই সঙ্গে অবশ্য একটা মন্দ ঘটনাও ঘটল। কি সেটা? স্পেনের লোকে লোরকাকে বলল জিপসি কবি। ভালো লাগেনি।
(নজরুলও নিশ্চয়ই ব্যথিত বোধ করতেন ‘বিদ্রোহী’ কবি আখ্যা পেয়ে। যিনি লিখেছেন-
প্রিয়, এমনও রাত যেন যায় না বৃথা
পড়ি চাঁপা রঙের শাড়ি খয়েরি টিপ,
জ্বালি বাতায়নে জ্বালি আঁখিপ্রদীপ
মালা চন্দনও দিয়ে মোর ডালা সাজাই ...
‘বিদ্রোহী’ কবি ? কি সঙ্কীর্ণ উপাধি! যা হোক। জীবনানন্দকে বলা হয়: নির্জনতার কবি। আশ্চর্য! ধীরে ধীরে বোঝা যাচ্ছে -জীবনানন্দর মতন কেন্দ্র-স্থিত সচেতন মন দক্ষিণ এশিয়ার সাহিত্যে বিরল!)
জিপসি কবি আখ্যা পেয়ে লোরকা ১৯১৯ এ স্পেন ছেড়ে চলে গেলেন খোদ নিউ ইয়র্ক ।
বুঝুন কী রকম অভিমানী ছিলেন! কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা নিয়ে পড়তে লাগলেন।
ঢেঁকি নাকি সগগে গেলে ধানই ভানে ...এখানে অনেক উঠতি থিয়েটার গ্র“পের সঙ্গে জানাশোনা হল; ‘নিউ ইয়র্কে কবি’ নামে কবিতার বইও লিখলেন একখানা ।
১৯৩১ এ মািতৃভূমিতে ফিরলেন লোরকা।
এখন বুঝি না ফিরলেই ভালো হত।
অ্যামেচার ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ‘লা বারাকা’ নামে নিজস্ব থিয়েটার কোম্পানি খুললেন। লোকনাট্যের ওপর ঝোঁক ছিল।
গ্রামেগঞ্জে ঘুরে বেড়াত ‘লা বারাকা’ । লোকঐতিহ্যবাহী নাটক মঞ্চস্থ করত ‘লা বারাকা’... গ্রামীণ বিয়োগান্ত ঘটনা নিয়ে লোরকাও তিনখানি নাটক লিখে ফেললেন। মঞ্চস্থও করলেন।
এসব সব ঠিকই আছে ...
তবে সময়টায় অমঙ্গল ঘনিয়ে আসছিল ....তখন স্পেনে একটা অনিবার্য রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ সূচিত হচ্ছিল।
লোরকার সময়ে স্পেন শাসন করত দ্বিতীয় স্পেনিশ রিপাবলিক।
এই সরকারকে সমর্থন করত সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ইউরোপ-আমিরিকার সমাজতন্ত্রীরা । আর, জেনারেল ফ্রাঙ্কোর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনালিষ্টরা দের সমর্থন করত ফ্যাসিস্ট ইতালি ও নাজী জার্মানি। জেনারেল ফ্রাঙ্কোর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনালিষ্টরা ১৯৩৬ সালে ঐ দ্বিতীয় স্পেনিশ রিপাবলিকান সরকারকে উৎখাত করে।
বুদ্ধিজীবিদের বিপদজনক ভাবত ফ্রাঙ্কোপন্থি জাতীয়তাবাদীরা।
১৯৩৬ সাল ।
১৯ আগস্ট। সকাল বেলা। স্থান: স্পেনের সিয়েরা নেভাদা পাহাড়ের পাদদেশ।
একজন স্কুল শিক্ষক ও ২জন বুলফাইটারের সঙ্গে ফ্রাঙ্কোপন্থি জাতীয়তাবাদীরা লোরকাকে গেরেপতার করে একটি মাঠে নিয়ে দাঁড় করায়।
তারপর গুলি করে ...।
মৃত্যুর আগে একটি কবিতায় লোরকা লিখেছেন -
If I die,
leave the balcony open.
The little boy is eating oranges.
(From my balcony I can see him.)
The reaper is harvesting the wheat.
(From my balcony I can hear him.)
If I die, leave the balcony open!
২
লোরকার প্রথম দিককার কবিতা
নতুন গান
অপরাহ্ন বলে, ‘আমি ছায়ার জন্য কাতর। ’
চাঁদ বলে, ‘তারাদের তরে আমার তৃষ্ণা। ’
স্ফটিক পাহাড় চায় জিজ্ঞাসার জন্য ঠোঁট
আর দীর্ঘশ্বাসের জন্য বাতাস।
আমিও সুগন্ধ ও হাসির জন্য কাতর।
কাতর নতুন গানের জন্য ...
যে গান -চোখের তারা ও চাঁদশূন্য
মৃতপ্রেম শূন্য।
সকালের গান
যা ভবিষ্যতের শান্ত জলাশয়কে কাঁপাবে ;
যা তরঙ্গ ও কাদায় থাকবে পূর্ন আশা।
উজ্জ্বল ও উচ্ছল একটি গান,
গভীর বিষন্ন
দুঃখে অমলিন
স্বপ্নে নির্মল ।
কথা ছাড়া একটি গান
স্তব্দতাকে যা ভরিয়ে দেবে হাসিতে।
(একদল অন্ধ ঘুঘু
নিক্ষেপিত রহস্যে)
একটি গান
যা ছোঁবে বস্তুর আত্মা ।
আর বাতাসের আত্মা
থাকবে অনন্তহৃদয়ের আনন্দে ...
এমন কবিকে হত্যা করল!
ধিক।
লোরকার পরিনত বয়েসের কবিতা
চান্দ্রগীতি থেকে
চাঁদটা
সমুদ্রের ওপরে
ফেলেছে আলোর সিঙ্গা।
কাঁপা কাঁপা আর আলোরিত
ধূসর সবুজ প্রতীক।
বাতাসের ওপর ভাসছে আকাশ
পদ্মের বৃহৎ ফুল।
(আহ্, তুমি হাঁটছ একা
রাত্রির সর্বশেষ প্রহরে!)
এমন কবিহৃদয়কে হত্যা করতে পারল!
ধিক!
(হোক বা না-হোক কবিতা দুটির অনুবাদ আমিই করেছি। অনুবাদ যে হয়নি তারই প্রমাণ হিসেবে শেষ কবিতার ইংরেজি অনুবাদ তুলে দিলাম।
)
From Moon Songs
The moon lays a long horn,
of light, on the sea.
Tremoring, ecstatic,
the grey-green unicorn.
The sky floats over the wind,
a huge flower of lotus.
(O you, walking alone,
in the last house of night!)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।