স্পেনের গৃহযুদ্ধের উজ্জ্বল শহীদ, খ্যাতিমান কবি ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকার বাড়ি এখন আন্দালুসিয়ার অন্যতম সংস্কৃতিতীর্থ। গ্রানাদার সেই বাড়ি ঘুরে এসে লিখছেন সাজ্জাদ শরিফ
ইউরোপের সূর্য বড় প্রতারক। লোরকা পার্কে যখন গিয়ে পৌঁছলাম, তখন রীতিমতো রাত। কিন্তু পশ্চিমে সামান্য হেলে পড়া সূর্য সেটা টের পেতে দেয়নি। অদ্ভুত ছায়াময় আলো জেগে আছে।
গাছের সুবিন্যস্ত প্রবাহের ফাঁকে ফাঁকে মানুষের চিহ্ন। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বেড়াতে এসেছে বাবা-মা, গাছে গা এলিয়ে বান্ধবীকে আদর করছে মুগ্ধ যুবক। অপার্থিব এই প্রেমময় আবহাওয়া লোরকার কবিতার কোনো ছিন্ন পাতা বলে বিভ্রম তৈরি হয়।
লোরকার বাড়ি, হুয়ের্তা দে সান ভিসেন্তে, পেতে অসুবিধা হলো না। চৌচালা সাদা বাড়ি।
দেয়াল আর জানালা সবুজ। বাড়ির মাথায় ঝুঁটির মতো হাওয়ামোরগ। বাড়িটা পেলাম সত্যি, কিন্তু জাদুঘর ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে। তা যাক। মনের তৃষ্ণা না মিটুক।
চোখের তৃষ্ণা তো আপাতত মিটল। কাল আসব আবার।
পর দিন সকালে সাইনাসের প্রচণ্ড ব্যথা। নাশতা সেরে, ওষুধ খেয়ে, এক পশলা ঘুম দিয়ে বেরোতে বেরোতে বেজে গেল ১২টা। সঙ্গে শাওন—আমার স্ত্রী।
লোরকা পার্কে ঢুকতেই কানে এসে ঢুকল গাছের পাতায় বাতাসের সরসর শব্দের সঙ্গে মিশে থাকা অনুচ্চ আরেকটি ধ্বনি। বয়ে চলেছে যেন একটানা চাপাকান্নার এক প্রবাহ। দ্রুতই জানা হয়ে যায়, এ ধ্বনির উৎস জায়গায় জায়গায় বসানো ফোয়ারা আর পানির চলমান ক্ষীণ স্রোত। আরব ঐতিহ্য স্প্যানিয়ার্ডদের মনে পানির গভীর সম্মোহ স্থায়ী করে গেছে। এই চাপাকান্না তো লোরকার কবিতারও অন্তর্লীন সুর।
ভূমধ্যসাগরীয় রোদে ঝলমল করছে লোরকার বাড়ি। কাল সন্ধ্যার ম্লান আলোয় যাকে মনে হচ্ছিল বিষণ্ন, এখন তা দিব্যি হাসিখুশি। ১৯২৬ সালে লোরকার বাবা রদরিগেস লোরকা সপরিবারে এই গ্রীষ্মাবাসে এসে উঠেছিলেন। লোরকা তত দিনে নানা কর্মোদ্যোগে ছুটে বেড়াচ্ছেন স্পেনের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। তবু এই বাড়ির আবেশ তিনি কাটিয়ে উঠতে পারেননি।
রক্তবিবাহ বা ইয়ের্মার মতো নাটক আর ইগনাসিও সানচেস মেহিয়াসের জন্য শোকগাথা বা দিওয়ান ই তামারিত-এর কবিতাগুলো লিখেছেন এখানে বসেই। স্পেনের গৃহযুদ্ধের সূচনায়, আগস্ট ১৯৩৬-এ, ফ্রাংকোর গুণ্ডাদের হাতে খুন হওয়ার আগের কয়েকটা দিনও ছিলেন এখানে। লোরকার হত্যাকাণ্ডের পর তাঁর পরিবার এই বাড়ি ছেড়ে সেই যে চলে যায়, আর কখনো ফিরে আসেনি। লোরকার উত্তরসূরিরা এখন এটিকে জাদুঘরে রূপ দিয়েছে। তাঁদের সাহায্য করেছে এখানকার স্থানীয় সরকারও।
তারাই এখন এর তদারকিতে।
কিন্তু আজ ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৩। সোমবার। সময়সূচি না দেখেই আমরা চলে এসেছি। উঁকিঝুঁকি মারছি বাড়ির চারদিকে ঘুরে ঘুরে।
সব দরজায় তালা। ব্যাপার কী! বাড়ির সংলগ্ন একটি ঘরের জানালা খোলা দেখে এগিয়ে গেলাম। অফিসমতো ঘর। কিছু প্রদর্শবস্তুও সাজানো। ভেতরে একজন মাত্র লোক, মধ্যবয়সী ও সুদর্শন, চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
আমাদের দেখে হাত নেড়ে নেড়ে এস্পানিওলে যা বোঝাতে চাইলেন, তার সরল অর্থ, সোমবার মানে আজ জাদুঘরের সাপ্তাহিক ছুটি।
মাথায় বাজ পড়ল। দ্রুত ব্যাগ হাতড়ে লোরকার কবিতার সংকলন রক্ত ও অশ্রুর গাথা বের করে তাঁর হাতে ধরিয়ে দিলাম। প্রিন্টার্স লাইন বের করে ইংরেজি হরফে লোরকা আর আমার নামটি দেখিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, আমিও লোরকার এক অকিঞ্চিৎকর অনুবাদক বটে। সেটাই ভোজবাজির মতো কাজে দিল।
দরজা খুলে তিনি আমাদের ভেতরে টেনে নিলেন।
তিনিই জাদুঘরের কিউরেটর। মোটেই ইংরেজি বোঝেন না। কিন্তু ভাষার ব্যবধান উবে গেল আন্তরিকতার স্পর্শে। পাশেই বইয়ের তাকগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে বোঝাতে চাইলেন, আমার অনুবাদ-সংকলনটিও ওখানে ঠাঁই পেতে চলেছে।
তাকিয়ে দেখি, লোরকাকে নিয়ে নানা ভাষায় লেখা বই ওখানে যত্ন করে সাজানো।
এবার আমাকেও তিনি উপহার দিতে শুরু করলেন। লোরকার অনুবাদক বলে কথা। লোরকার ছবি আঁকার নেশা ছিল। পাণ্ডুলিপির ওপর আঁকিবুকিরও করতেন রবীন্দ্রনাথের মতো।
ছবিসমেত লোরকার কবিতার একটি মুদ্রিত পাণ্ডুলিপি দিলেন আমাকে। দিলেন জাদুঘরের বিভিন্ন স্মারক ও লোরকার কিছু আলোকচিত্র।
এরপর তিনি আমাদের নিয়ে এলেন লোরকার মূল বাড়ির দরজার সামনে। তালা খুলে আমাদের নিয়ে ঢুকলেন ভেতরে। একের পর এক খুলে দিতে লাগলেন জানালা।
একরাশ আলো হুড়মুড় করে ঢুকে উদ্ভাসিত করে দিল বাড়িটির চাঞ্চল্যভরা অতীত ছবি। খাবার টেবিলে এখনো সূচিকর্মের রঙিন আবরণী। পাশেই বাসন, পেয়ালা, হাঁড়িকুড়ি। যেন এখনো ব্যবহার্য। যেন ওপরতলা থেকে এখনই নেমে এসে লোরকা চেয়ার টেনে খেতে বসবেন।
তাঁর হত্যাকাণ্ডের তিন বছর আগে এই বাড়ি সম্পর্কেই লোরকা লিখেছিলেন, ‘সবাই মিলে পুরো গ্রীষ্মঋতুটি আমরা এখানে কাটাব। পরিশ্রমও করব কঠোর। আর সেটা এখানেই, আমার এই হুয়ের্তা দে সান ভিসেন্তেতে। এখানেই সবচেয়ে প্রশান্ত মনে আমি আমার নাটকগুলো লিখে উঠতে পারি। ’
ফটক দিয়ে ঢুকেই প্রবেশকক্ষ।
পর পর খাবার ঘর আর হেঁসেল। খাবার ঘরের ভেতর দিয়ে দোতলায় উঠে যাওয়া মোজাইক বসানো কাঠের সিঁড়ি। দোতলায় লোরকার পিয়ানোকক্ষ আর শোবার ঘর। জানালার পর্দা, বিছানার চাদর, রান্নাঘরের তৈজসপত্র লোরকা-পরিবারের সজীব মুহূর্তকে এই বাড়িতে চিরস্থির করে রেখেছে। লোরকার বন্ধুদের আঁকা ছবিগুলো দেয়ালে ঝোলানো ঝুলছে।
বিশেষভাবে চোখে পড়ে সালভাদোর দালি ও রাফায়েল আলবের্তির নাম।
আমার মগ্নতা ভেঙে আবারও কথা বলে উঠলেন কিউরেটর। আমার মাথায় ছবি তোলার কোনো চিন্তাই কাজ করছিল না। জাদুঘরের ভেতরে ছবি তোলাও নিষিদ্ধ। কিন্তু শাওনকে তিনি ছবি তুলতে বললেন।
বলা যায়, তুলতে বাধ্য করলেন।
আমরা দোতলায় লোরকার শোয়ার ঘরে ঢুকলাম। এক চিলতে ঘর। ধবধবে সাদা বিছানাটি যেন কোনো কিশোরের। মাথার কাছে সবুজ দরজাঅলা ঝুলবারান্দা।
বিছানার উল্টোপাশে সেই টেবিল, যার ওপরে বিশ শতকের কিছু অমর সাহিত্যকর্ম রচিত হয়েছে।
সেখান থেকে এলাম পিয়ানোকক্ষে। ছোট্ট পরিসরের প্রায় পুরোটাই দখল করে আছে পিয়ানোটি। আমাদের অবাক করে দিয়ে পিয়ানোটা খুলতে শুরু করলেন কিউরেটর। তারপর আমার অনুবাদবইটি খুলে লোরকার একটি ছবি দেখালেন: এই ঘরে, ঠিক এই পিয়ানোটিই লোরকা বাজাচ্ছেন।
একই ভঙ্গিতে আমাকেও ছবি তুলতে বললেন তিনি। তীব্র অস্বস্তি আমাকে আড়ষ্ট করে রাখল। কিন্তু আমাকে তিনি জোর করে বসিয়ে দিলেন পিয়ানোর সামনে। মানুষের হাতের স্পর্শ তো আর পিয়ানোর রিডে লেগে থাকে না। লোরকারও নেই।
কিন্তু সেই পিয়ানো স্পর্শ করার অনুভূতি আমি ব্যাখ্যা করব কী করে?
কিউরেটরকে ধন্যবাদ ও বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে এসেছি। আবিষ্ট মন নিয়ে ফিরে যাচ্ছি হোটেলে। আবার দৌড়ে এলেন কিউরেটর। আরেকটি উপহার নাকি আমাকে না দিলেই নয়। লোরকার পিয়ানো আর লা আর্হেন্তিনিতার কণ্ঠে ১৯৩১ সালে হিজ মাস্টার্স ভয়েস লোকগানের একটি রেকর্ড প্রকাশ করেছিল।
সেটি এখন সংরক্ষিত হয়েছে সিডিতে। সেই সিডির একটি কপি তিনি আমাকে উপহার দিলেন।
ফিরে আসতে আসতে সিডিটি হাতে নিয়ে দেখি, প্রচ্ছদে পিয়ানোয় মগ্ন লোরকার সেই চিরচেনা ছবিটি। যে পিয়ানোর মধ্য দিয়ে কিছুক্ষণ আগেই আমি তাঁর স্পর্শ নিয়ে এসেছি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।