আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গুরু যেভাবে শিষ্য হইলেন



জন্মের আগেই আমার দাদাজি মারা যান। উনার একটা ছবি আমাদের বৈঠকখানায় ঝোলানো আছে। সাদা দাড়ি এবং সাদা চুল নিয়ে গম্ভীর মুখে কী যেন ভাবছেন? ছোটবেলায় ছবিটার দিকে আঙ্গুল তুলে বাবাকে বলেছিলাম, দাদার ছবিটা খুব সুন্দর। বাবা বেশ গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, ওটি তোমার দাদার ছবি এটা কে বললো।

উনি একজন বিরাট কবি, নাম শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কথাটা শুনে আমার মনটাই গেল খারাপ হয়ে। আসলে শিশুমন খুবই বিচিত্র একটা জিনিস। আমার নানা-নানী, দাদী সবাই তখন বেঁচে আছেন , কেবল দাদা নেই। বাবার মুখে দাদার গল্প আর বর্ণনা এতো শুনেছি যে, আমি নিজেই মনে মনে ধরে নিয়েছিলাম দেয়ালের ঐ ছবিটাই আমার দাদার।

গুরুদেবের সাথে এভাবেই আমার প্রথম পরিচয়। এরপর সেই পরিচয় কীভাবে ঘনিষ্ঠায় রূপান্তরিত হলো এবং ক্রমেই গুরুদেব কীভাবে আমার গুরু থেকে শিষ্য হয়ে গেলেন সেই গল্পটাই এবার বলব। অবশ্য গুরুদেব আমার জীবনের একদম শুরু থেকে আমার পেছনে লেগে আছেন। আমার জন্ম হয়েছিল রবিবারে এবং নামকরণের সার্থকতা প্রমাণ করতে গিয়েই আমার নামটিও রাখা হয়েছে রবি। একটা ঘটনা বললে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে।

ক্লাস ওয়ানে পড়ি। বছর শেষে স্কুলে পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠান হয়, সেখানে ছাত্ররা কবিতা আবৃত্তি, সঙ্গীত- ইত্যাদি পরিবেশন করে। এই সময়টা বেশ মজার। অনুষ্ঠানের কয়েক সপ্তাহ আগ থেকেই বেশ সাজো সাজো রব পড়ে যায়। কে কে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবে- সেইসব ছাত্রদের নির্বাচিত করা হয়, অনেকটা ক্লোজআপ ওয়ান স্টাইলে।

গান আর কবিতা দুটো বিভাগেই নাম লেখালাম। অল্পের জন্য গানের বিভাগ থেকে বাদ পড়ে গেলাম। কেননা গানের বিভাগের বিচারক ছিলেন স্বয়ং হেডস্যার। আমি দারুন একটা পল্লীগীতি গেয়ে শোনালাম। গান শুনে অন্য স্যাররা মুখ টিপে হাসতে লাগলেন, কেবল হেডস্যার আমার গান শুনে বেশ কিছুক্ষণ ঝিম মেওে কিছুক্ষণ বসে রইলেন।

তারপর ঘোষণা করলেন, আবার যদি তুমি গান গাও, তাহলে তোমাকে টিসি দিয়ে স্কুল থেকে বের করে দেবো ... উনি খুবই রাগী লোক ... টিসির ভয়ে আমি আর কোনদিনই গান গাইনি, এমনি আমার গলাটা মন্দ না। যাই হোক, কবিতা বিভাগে টিকে গেলাম। আমার ভাগে পড়েছে রবীন্দ্রনাথের তালগাছ কবিতাটা। খুবই সহজ কবিতা, একটানে মুখস্থ করে ফেলা যায়। টানা দুই সপ্তাহ রিহার্সাল চললো।

কবিতা আবৃত্তি গানের চাইতেও অ-নে-ক কঠিন, এতে কেবল গলার কারিশমা না; অভিনয় প্রতিভাও থাকতে হয় ... যেমন তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে Ñ এই লাইন আবৃত্তি করার সময় সত্যি সত্যি এক পায়ে দাঁড়িয়ে দেখিয়ে দিতে হয়... যাই হোক আস্তে আস্তে সেই দিন চলে আসলো। স্কুল মাঠে বড় করে স্টেজ সাজানো হয়েছে। পুরো মাঠ লোকে লোকারণ্য। স্টেজে গিয়ে দাঁড়াতেই মাথা ঘুরে গেল, হাজারে হাজারে লোক বসা, সবাই আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। আমি শুরু করলাম, তালগাছ, লিখেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর..... তালগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে - বলে এক পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ালাম।

মনে সাধ কালো মেঘ ফুঁড়ে যায়- একেবারে উড়ে যায়- কোথা পাবো পাখা সে - এই জায়গায় এসে দুই হাত পাখার মতো মেলে দিতে গিয়ে সামান্য একটা বিপত্তি ঘটে গেল। ব্যালান্স হারিয়ে কাত হয়ে পড়ে গেলাম। দর্শক সারিতে সমস্ত শ্রোতা দর্শক হাসতে হাসতে গড়াগড়ি, কেবল আমার বাবা মা মুখ কালো করে বসে আছেন। উঠে দাঁড়িয়ে আবার প্রথম থেকে শুরু করলাম কিন্তু দুই লাইন পড়ে আর মনে পড়ছে না। ওদিকে দর্শকরা হেসেই যাচ্ছেন- বাবা মা’র কেবল মুখ না গোটা শরীরই যেন কালো হয়ে গেছে।

স্টেজ থেকে নেমে আসলাম, দেখি স্টেজের পেছনে হেডস্যার মুখ গম্ভীর করে দাঁড়িয়ে আছেন, তবে মুখ কালো করে না, লাল করে। বললেন, যা মুরগি হয়ে বসে থাক ... এবার বলি রবীন্দ্রনাথের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা হলো কীভাবে। তখন সবে ম্যাট্রিক পাশ করেছি, চাচাতো ভাই বোনদের সাথে মানিকগনজ বেড়াতে গিয়েছি। ঘোর বর্ষা। রাতের বেলায় হারিকেন জ্বালিয়ে প্ল্যানচেট করা হলো।

এই জিনিস আগে কখনো করি নাই। প্রথমে কবি নজরুলকে ডাকা হলো। তিনি এসেই লম্ভঝম্ফ শুরু করে দিলেন। গেল হারিকেন নিভে। সেই অন্ধকারেই তিনি বহু উল্টাপাল্টা কথা বলতে লাগলেন।

যেমন তার বিদ্রোহী কবিতা পড়ে নাকি কবিগুরুর চুল দাড়ি সব পেকে সাদা হয়ে গিয়েছিল, তার আগে নাকি ওগুলো কালোই ছিল। নজরুলকে বিদায় করে হারিকেন জ্বালিয়ে গুরুদেবকে আনা হলো। এসেই তিনি শোনালেন, আলো আমার আলো ওগো ... সেই থেকে আজ এতোগুলো বছর ধরে নিয়মিত গুরুদেবের সাথে আড্ডা মারছি, ওই প্ল্যানচেটের মাধ্যমেই। তিনিই আমার গুরু। বিপদে আপদে তিনিই পরামর্শ দেন।

তবে পরামর্শগুলো হাইথটের। যেমন, আমার একবার চাকরি চলে গেল। পকেটে এক পয়সাও নাই। প্ল্যানচেট করবো সেই মোমবাতি কেনার পয়সাও ধার করতে হচ্ছে। যাই হোক, তাকে ডাকলাম।

বললাম, গুরুদেব ঘোর বিপদ, চাকরি চলে গেছে। শুনে তিনি মিহি গলায় বললেন, বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা ... আরেকবার ইউনিভার্সিটির এলামনাই এসোসিয়েশনের নির্বাচনে সভাপতি পদে দাঁড়িয়েছে। ভোট গণনার সময় দেখা গেল, আমি পেয়েছি মাত্র একটা ভোট। কে দিলো আমাকে ভোট, মনে পড়লো আমি নিজেই সেই লোক। চারিদিকে হাসাহাসি পড়ে গেল।

এমনকি আমার বউও একথা শোনার পর কয়েখদিন এতো হাসলো যে দুদিন পর তার হালকা অ্যাজমার প্রবলেম ধরা পড়ল। চরম অপমানিত অবস্থা। এ সময় গুরুদেবের শরণাপন্ন হলে তিনি বললেন বললেন, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে ...আবার, তাঁর অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে - ঐ কবিতা শুনে ট্রাফিক পুলিশের অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করতে গিয়ে ওদের হাতে মার খেয়ে হাত ভেঙ্গে টানা দুই সপ্তাহ বিছানায় পড়ে রইলাম। তবুও ইনই আমার গুরু। এইবার ঢাকায় প্রথম বৃষ্টি হবার পর, গুরুদেবকে বললাম, বস কিছু আষাঢ়ে গল্প শোনান, খুব বোক্ষ লাগছে।

তিনি কঙ্কাল নিয়ে একটা গল্প শোনালেন, শুনে আমি ভয়ে নিজেই কঙ্কাল হয়ে গেলাম। আজও বৃষ্টি হচ্ছিল। প্ল্যানচেট করে গুরুদেবকে নিয়ে এলাম আড্ডা মারার জন্য । আজকে উনিই উল্টা রিকোয়েস্ট করলেন , বালক রবি ( উনি আমাকে এই নামেই ডাকেন) তুমিই আজ বরং একটা গল্প বলো, আমি শুনি। আমি শুরু করলাম, টিপু সুলতানের লেখা একটা কাহিনী বলি।

- বেশ বলো। টিপু সুলতান মানে মহীশুরের ...দি সোর্ড অব টিপু সুলতান ... - না না , উনি সাংবাদিক টিপু সুলতান ... - ও আচ্ছা, বেশ বলো। কাহিনীটা আমি বললাম। মাদারীপুরের পুকুর পাড়ে কিংবা নির্জন পাটক্ষেতে বসে মোবাইলে সারা দেশে চাঁদাবাজি হচ্ছে। এর নাম হ্যালো ব্যবসা ।

দশ বছর ধরে প্রশাসনের নাকের ডগায় এই ব্যবসা চলছে। শ্রেফ ভয় দেখিয়ে এই জমজমাট ব্যবসা চলতে, ওদের কাছে একটা চাকুও নেই, খালি আছে চাপার জোর ...কয়েকটা তরুন মিলে এই ব্যবসা চালাচ্ছে। তারা লোকজনকে ফোন দিয়ে বলে আমি কালা জাহাঙ্গীরের লোক বলছি, এক লাখ টাকা দেন, তা না হলে চরম ক্ষতি হয়ে যাবে। এই ভয়ে কাজ হয়। লোকজন টাকা দেয়।

এভাবে প্রশাসনের নাকের ডগায় এই ব্যবসা চলছে দশ বছর। ঐ নির্জন গ্রামে বসে সারা দেশেই তারা ফোনেই চাঁদাবাজি চালায় ... গল্পটা শুনে গুরুদেব আমার ফ্যান হয়ে গেলেন। উনার ধারণা গল্পটি আমি বানিয়ে বানিয়ে বলেছি। তবে বানিয়ে বলি আর যাই বলি, গল্পটা খুব সুন্দর সাজিয়েছি। এই একটি গল্পে উনি এতোটাই মুগ্ধ হয়ে গেছেন যে, উল্টো উনিই আমাকে গুরুদেব ডাকা শুরু করেছেন।

আমার এতো লজ্জা লাগছে। আবার একটু একটু ভালোও লাগছে!!!!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।