সংস্কৃতির শিকড় ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা
ফকির ইলিয়াস
=====================================
সময় এবং সুযোগ পেলেই আমি যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সমৃদ্ধ মিউজিয়ামগুলো ঘুরে দেখি। আমার দুমেয়ে এগুলো দেখতে খুবই আগ্রহী। সঙ্গ দিতে আমিও বেরিয়ে পড়ি তাদের সঙ্গে। বিশ্বের রাজধানী বলে পরিচিত নিউইয়র্ক নগরীতে অনেক দর্শনীয় স্থান আছে, যেগুলোর প্রবেশ ফিও বেশ উচ্চমূল্যের। তারপরও জ্ঞানার্জনে অর্থ ব্যয়ে আমি বেশ আনন্দই পাই।
গেলো ৫ জুলাই ২০০৯ রোববার আমরা ঘুরে এলাম ‘রক এন্ড রল হল অব ফেম অ্যানেক্স নিউইয়র্ক’- নামের মিউজিয়ামটি। এটি মূলত সঙ্গীতের কালেকশন এবং ইতিহাসভিত্তিক মিউজিয়াম। লয়ার ম্যানহাটানের সহো এলাকায় মার্সার স্ট্রিটে অবস্থিত এই মিউজিয়াম। মিউজিয়ামটির ভেতরে ঢুকেই একটি প্রদর্শনী কক্ষ। তাতে বিশ্বের খ্যাতিমান গায়ক-গায়িকাদের অটোগ্রাফ স্থান পাচ্ছে খোদাই করা প্লেটে।
প্রতিটি অটোগ্রাফে হাত রাখলেই বেজে ওঠে সে সব খ্যাতিমান শিল্পীদের গাওয়া গান। চমৎকৃত হতে হয় তা দেখে এবং শুনে।
এরপর একজন গাইড এসে সঙ্গে করে নিয়ে যান মূল থিয়েটারে। সংক্ষিপ্ত ভূমিকার পর শুরু হয় ১৯০০ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বিভিন্ন বিখ্যাত কনসার্টের অংশ বিশেষ। এই কালেকশনে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সাহাযার্থে অনুষ্ঠিত ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ এর অংশ বিশেষও রয়েছে।
প্রাণভরে দেখলাম সেই ধ্বনি ‘বাংলাদেশ-বাংলাদেশ’ প্রিয় শিল্পী জর্জ হ্যারিসনের কণ্ঠে।
প্রায় পৌনে এক ঘণ্টাব্যাপী এই মিউজিক কালেকশন শোটি শেষ হওয়ার পর মিউজিয়ামটি ঘুরে দেখার পালা। সকল দর্শনার্থীকে একটা করে হেডফোন দেয়া হয়েছে। এই মিউজিয়ামে শোভা পাচ্ছে, বিশ্বখ্যাত কনসার্টগুলোতে ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র, পোশাক সামগ্রী। এমন কি লেখা গানগুলোর হাতে লেখা মূল পাণ্ডুলিপিও।
গাইড আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন কোনো ছবি তোলা যাবে না। ছবি না তুলতে পেরে মনটা বেশ খারাপই হয়ে গেলো আমার। তারপরও ঘুরে ঘুরে নোট করতে থাকলাম হাতে রাখা কাগজে।
এক সময় গিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম মাইকেল জ্যাকসনের সেই জ্যাকেটটির সামনে। যেটি পরে তিনি ‘বেড’ অ্যালবামটি রেকর্ড করেছিলেন।
সে জ্যাকেটটি পরা ছিল সেই অ্যালবামে ব্যবহৃত ছবিতে। ‘বেড’ অ্যালবামের গানগুলো গেয়ে মাইকেল জ্যাকসন পঞ্চাশ মিলিয়ন ডলার সাহায্য সংগ্রহ করেন আফ্রিকান ফ্যামিনিন রিলিফ ফান্ডের জন্য। মাইকেলের প্রতি শ্রদ্ধায় বুকটা আবারো ভরে উঠলো। তার হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি পড়লাম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। গ্লাসে আবৃত অক্ষর পত্রটি স্পর্শ করতে চাইলাম।
আরেক বিখ্যাত পপ তারকা ম্যাডোনার ‘লাইক এ প্রেয়ার’ অ্যালবামটি বের হয় ১৯৮৯ সালে। এই অ্যালবামের বিখ্যাত গান ‘এক্সপ্রেস ইওরসেলফ’-এর মূল পাণ্ডুলিপিও সংরক্ষিত আছে এই মিউজিয়ামে। দেখলাম ম্যাডোনার হাতের লেখাও। পাশেই তার ব্যবহৃত জুতা, গাউন- যা তিনি ঐ অ্যালবাম করার সময় ব্যবহার করেছিলেন।
এই মিউজিয়ামটির বিশেষত্ব হচ্ছে, সংরক্ষিত যে কোনো বস্তুর সামনে দাঁড়ালেই ঐ শিল্পীর গান বেজে উঠবে।
ধারাবাহিকভাবে বলা হবে বিভিন্ন আনুষাঙ্গিক ঘটনা। ধারাবর্ণনাগুলো শুনতে শুনতে শ্রোতা জেনে যাবেন আমেরিকান মিউজিক তথা বিশ্ব মিউজিকের খণ্ড ইতিহাস।
মিউজিয়ামের একটি কক্ষ সম্পূর্ণরূপে সংরক্ষিত করা আছে প্রখ্যাত শিল্পী জন লেননের প্রতি ভালোবাসায়- শ্রদ্ধায়। জন লেনন ছিলেন বিশ্ব বিখ্যাত ব্যান্ড ‘দ্যা বিটেলস’-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ইংল্যান্ডে ৯ অক্টোবর ১৯৪০ সালে জন্মগ্রহণ করেন জন লেনন।
রক মিউজিশিয়ান, সঙ্গীত লেখক এবং পিস অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে তিনি খ্যাতি পান।
সত্তর দশকের শুরুতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। এবং সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে ভিসা নিয়ে কিছুদিন অবস্থান করেন। এক সময় তার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। তাকে ডিপোর্ট করার চেষ্টা চালায় যুক্তরাষ্ট্র ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ।
কিন্তু তাকে যুক্তরাষ্ট্রে থেকে যাওয়ার অনুরোধ জানান তার লাখ লাখ শ্রোতা। জন লেনন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক নগরীতে থেকে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। কিন্তু তাতে বাঁধ সাধে সেই সময়ের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন প্রশাসন। শুরু হয় আইনি লড়াই। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র জন লেননের ‘গিভ পিস এ চান্স’ শিরোনামের শান্তিবাদী আন্দোলনের তীব্র বিরোধিতা করে।
শেষ পর্যন্ত আইনি লড়াইয়ে জয়ী হন সঙ্গীতজ্ঞ জন লেনন ও তার স্ত্রী ইওকো অনো।
গানের মাঝেই শান্তি খুঁজে বেড়াতেন জন লেনন। তার এই বাণী উদ্বুদ্ধ করেছে কোটি সঙ্গীতপ্রেমীকে। তার জীবদ্দশায় মার্কিনি গোয়েন্দারা তার পিছু ছাড়েনি কখনোই। তার অপরাধ ছিল তিনি বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ছিলেন একান্তই আপোষহীন।
৮ ডিসেম্বর ১৯৮০ নিউইয়র্কে নিজ বাসভবনের সামনে রাত দশটা ঊনপঞ্চাশ মিনিটের সময় মার্ক ডেভিড চ্যাপম্যান নামক একজন খুনি জন লেননকে পেছন থেকে পরপর চার রাউন্ড গুলি করে। লেনন সঙ্গে সঙ্গেই নিহত হন। তার চোখের চশমার রক্তের চিহ্ন বহন করে এখনো বেঁচে আছেন তার প্রিয়তম স্ত্রী ইওকো অনো। হত্যার দায়ে খুনি চ্যাপম্যান ভোগ করছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। জন লেননের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ভবনের এই অংশটিতে সংরক্ষিত রয়েছে তার ব্যবহৃত গিটার, তার গ্রিনকার্ড, তার পোশাক পরিচ্ছদ, হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি, আর্ট, গ্রাফসহ অনেক তথ্য ও তত্ত্ব।
বিশ্বব্যাপী তার কনসার্টের বিভিন্ন অংশ বেজেই চলেছে অনবরত।
এই মিউজিয়ামটিতে প্রায় চার ঘণ্টা কাটিয়ে আমার বারবারই মনে হয়েছে, সংস্কৃতির শিকড় এভাবেই লালিত হয়। এভাবেই প্রজন্মে প্রজন্মে বিস্তৃত হয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের আলো। একটি সমাজের প্রতি একজন শিল্পীর দায় অপরিসীম।
মানুষের প্রতি এই যে ভালোবাসার শক্তি- তা ই সুসংহত করে প্রজন্মের পথচলার ভিত।
এটা খুবই দুঃখের কথা- বাংলা সংস্কৃতি, কৃষ্টির অন্যতম শক্তি লোকজ গান ও গায়কদেরকে নিয়ে একটি মিউজিয়াম এখনো বাংলাদেশে গড়ে ওঠেনি। প্রতিষ্ঠিত হয়নি একটি স্বতন্ত্র বাউল সঙ্গীত একাডেমি। অথচ বাউল বা মরমি ধারার শিল্পী, সাধক, গীতিকাররা শান্তির অন্বেষণ করে গেছেন যুগে যুগে। এখনো তারা নিগৃহীত এই সমাজে। বাংলাদেশের সঙ্গীত বিশারদ এবং সরকারের এ বিষয়ে উদ্যোগী হওয়া জরুরি।
--------------------------------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ। ঢাকা। ১১ জুলাই ২০০৯ শনিবার প্রকাশিত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।