আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মহাজাগতিক সংস্কৃতির পথে

মহাজাগতিক সংস্কৃতির পথে .. ..

২০০৩ সালের ঘটনা। ৬০ হাজার বছরের ব্যবধানে মঙ্গল গ্রহ তখন পৃথিবীর সাথে নিকটতম অবস্থানে রয়েছে। সারা বিশ্বের মানুষ উৎসুক হয়ে রয়েছে 'মঙ্গল বরণ' নিয়ে, পিছিয়ে নেই বাংলাদেও। সৌখিন জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশনে উদ্যোগে দেশব্যাপি আয়োজন চলছে 'মঙ্গল গ্রহ পর্যবেক্ষণ ক্যাম্প'। এরই ধারাবাহিকতায় সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য লালিত ছোট্ট শহর বরিশালে ৫ সেপ্টেম্বর, ২০০৩ তারিখে বসেছিল মঙ্গলের হাট।

আগে থেকেই প্রচারের কারণে সেদিন কয়েক হাজার মানুষের ভীড় উপচে পড়ে নগরীর অমৃত লাল দে মহাবিদ্যালয়ের মাঠে। টেলিস্কোপে রাতভর মঙ্গল গ্রহ পর্যবেক্ষণে হাজারো মানুষের জমায়েত বরিশালের জন্য ছিলএক নতুন অভিজ্ঞতা। মঙ্গল যেন সেদিন খুলে দিয়েছিল বিজ্ঞান চর্চার জানালাটাকে। বরিশালের এই আয়োজনে সার্বিকভাবে যুক্ত ছিল এসোসিয়েশনের বরিশাল প্রতিনিধিসহ প্রাণ চাঞ্চল্যে ভরা বিজ্ঞানমনস্ক কিছু তরুণ। তারা অবাক বিস্ময়ে সেদিন উপলব্ধি করেছিল সামাজিক-সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় পরিমন্ডলের বাইরে সাধারণ মানুষের রয়েছে বিজ্ঞানের প্রতি প্রবল আকাঙ্খা, যা এই তরুণ কর্মীদের মাঝে নতুনএক ভাবনার জন্ম দিয়েছিল।

বিজ্ঞান চর্চাও হয়ে উঠতে পারে সংষ্কৃতির একটি অংশ। এই বোধ থেকেই বিজ্ঞান চর্চাকে ছড়িয়ে দিতে গড়ে ওঠে বিজ্ঞান সংগঠন 'কসমিক কালচার'। ২০০৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে এর যাত্রা শুরু। বিজ্ঞান স‌ংগঠন মানেই এই নয় যে বিভিন্ন মেলায় বিজ্ঞান প্রজেক্টের পসরা সাজিয়ে বসা আর মুখস্ত করা বিদ্যে উগরে দেয়া। আমরা চেয়েছিলাম ভিন্ন কিছু।

আমরা স্বপ্ন দেখেছি মেধা আর যুক্তির চর্চায় বেড়ে ওঠা প্রজন্মকে নিয়ে সৃজনশীল ভবিষ্যত গড়ার। কারণ, বিজ্ঞান-প্রযুক্তিগত ধারণার মাধ্যমে সামাজিক উন্নয়নের চেতনা ও ধারণা বিকশিত করা যত সহজ ও বাস্তবসম্মভাবে সম্ভব, তা আর কোনভাবেই নয়। মানুষকে বুজরুকি ও অন্ধবিশ্বাসের পশ্চাদমুখিতাকে সনাক্ত করিয়ে দিতে পারলে নিজে থেকেই তার মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা, বিজ্ঞানঘনিষ্ঠতা জন্ম নেবে। এই অবস্থান ও বিবেচনা থেকেই 'কসমিক কালচার' সক্রিয় ও তৎপর। কয়েকজন তরুণের নিরন্তর প্রচেষ্টার পাশাপাশি সবসময়েই প্রেরণায় ছিলেন প্রিয় দুই মানুষ - বিকাশ স্যার ও অনীশ স্যার।

তারুন্যের উচ্ছলতায় ভরপুর এই দু'জন তাদের মেধা ও শ্রমে ম্বপ্ন দেখার সাহস জুগিয়েছেন বরাবর। ধীরে ধেরে এর সাথে যুক্ত হয়েছে আরও অনেক নাম . . . . প্রাণোচ্ছলতায় ভরা আরও কিছু প্রাণ। একটি সফল কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রয়োজন পৃষ্ঠপোষকতার। বাংলাদেশে যত সহজে কনসার্ট বা উৎসব উদযাপনের জন্য পৃষ্ঠপোষক পাওয়া যায় বিজ্ঞানের কিছু আয়োজনের জন্য তা অমাবস্যার চাঁদ। আর বরিশালের প্রেক্ষাপটে সেটা চিন্তা করাও যেন বারণ।

একবারের ঘটনা, চাঁদে মানুষের অবতরণের ৩৫ বছর পূর্তিতে (২১ জুলাই, ১৯৬৯ সালে এপোলো ১১ অভিযান) আমরা সিদ্ধান্ত নেই একটি বিজ্ঞান বিষয়ক সেমিনার আয়োজন এবং চন্দ্রাভিযানের উপর পোস্টার ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর। এজন্য ঢাকা থেকে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি নিয়ে আসি। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে একটি মাল্টিমিডিয়া প্রোজেক্টর ভাড়া পাওয়া নিয়ে। কারণ বরিশালে তখন প্রোজেক্টর ভাড়া পাওয়া যেত না। অনেক দেন-দরবারের পর তথ্য অধিদপ্তর থেকে কাজ চালানোর মতো একটি পাওয়া গেলেও উপস্থিত হয় নতুন বিপত্তি।

অনুষ্ঠানের জন্য বিনামূল্যে যে হলরুম পাওয়ার কথা ছিল সেটি নির্ধারিত দিনে পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে প্রস্তুতিতে বাজেটের পুরোটই খরচ হয়ে যাওয়ায় সেই মুহুর্তে টাকা খরচ করে নতুনভাবে হলরুম ভাড়া করার সামর্থ্য আমাদের ছিল না। বিকল্প কোন উপায়ও ছিল না পরিস্থিতি মোকাবিলার। ফলে নিতান্ত বাধ্য হয়েই ভারাক্রান্ত মনে বাতিল করে দিতে হয় সমস্ত আয়োজন। যদিওএর পর থেকে সংগঠনের প্রায় সকল ব্যয় কারও মুখাপেক্ষা না করেই হাসি মুখে বহন করে চলেছে এর সদস্যরই।

সংগঠনের সাতটি বছর পার করে যখন নতুন করে হিসেব মিলাতে বসি তখন ভাবি আমরা আসলে কি করেছি? 'ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো'র যে উপাধি আমরা কাঁধে বয়ে চলেছি তা বয়ে নিয়ে যাওয়াই কি সার্থকতা? যে তরুণ প্রাণের সম্মিলন ঘটেছে এই সংগঠনটির মাধ্যমে তারা চাইলেই লেজুড়বৃত্তিগত ছাত্রনেতাদের মতো গলা চিতিয়ে গুন্ডামি করে বেড়াতে পারতো, রাস্তার আনাচে-কানাচে বা দেয়ালে পাছা ঠেস দিয়ে শিস দিয়ে ইভ টিজার বনে যেতে পারতো, বরং তাতে হয়তো তার জৌলুস কিছুটা বাড়তো, পাড়ায় দাদাগিরি করার লাইসেন্স জুটতো আর পকেটে বাড়তি রোজগারও হতো, কিন্তু নিজ পকেটের টাকা আর শরীরের ঘাম ঝড়িযে শুকনো মুখে যুক্তিবাদ, মুক্তবুদ্ধিচর্চা আর বিজ্ঞান চর্চার পেছনে হন্যে হয়ে ছোটার মূল্য কি রইল? ভুল না সঠিক পথে আমরা হাঁটছি তা হয়তো আপেক্ষিক কিন্তু আমরা এরপরেও চাই এই অনগ্রসর সমাজের দৃশ্যপট বদলে দেয়ার দুঃসাহস নিয়ে আরও কিছুটা পথ চলতে। আয়োনীয়া বা আলেক্সান্দ্রিয়া সভ্যতার মতো বাঙলার সভ্যতাও আলো ছড়াবে জ্ঞান আর যুক্তির বাতিঘর হয়ে- সেই স্বপ্ন খুব শক্ত করে লালন করে চলেছি আমরা। মানবিক স্বপ্নে বিভোর আমরা সেই ভবিষ্যত রেণেঁসার জন্য প্রতিক্ষিত। আমরা শুধু এই মহাজাগতিক সংস্কৃতির পথে এক মহাজাগতিক পথিক।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।