আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রয়াত ড. আলাউদ্দিন আল আজাদ, কবরের জায়গা না পেয়ে এখনো দাফনের অপেক্ষায়...!

``চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই। তা প্রকাশ করতে যদি লজ্জাবোধ হয়, তবে সে ধরনের চিন্তা না করাই বোধ হয় ভাল। ' -- প্রাচীন গ্রীক কবি ইউরিপিডিস (৪৮০-৪০৬ খ্রীঃ পূঃ)
[লেখাটা দু'দিন আগের] মৃত্যুর পর তাঁকে যেন শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়, তাঁর এই শেষ ইচ্ছেটা তিনি একবারও কি উচ্চারণ করতেন, যদি জানতেন কবরের একটুকু জায়গা না পেয়ে দাফনের অপেক্ষায় তাঁর নিথর মরদেহটি পাঁচ পাঁচটি দিন হাসপাতালের হিমঘরে পড়ে থাকবে ! এই জাতির কাছে তাঁর চাওয়াটা কি খুব বেশি কিছু ? বায়ান্নতে তৎকালীন শাসক গোষ্ঠি কর্তৃক বাঙালির স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে গড়ে তোলা একুশের তাৎক্ষণিক ও প্রথম শহীদ মিনারটি ভেঙে ফেলার প্রেক্ষিত-প্রতিবাদে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সে সময়কার টগবগে তরুণ ছাত্র-কবি আলাউদ্দিন আল আজাদের রচিত ‘স্মৃতিস্তম্ভ’ কবিতার অমর পঙক্তিগুলো শুরুই হয়েছিলো যে নির্ভরতার পঙক্তি দিয়ে- ‘স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার ? ভয় কি বন্ধু, আমরা এখনো চার কোটি পরিবার খাড়া রয়েছি তো !...’ যা প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশের প্রথম সংকলন ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’তে; বাঙালির সকল আন্দোলন সংগ্রাম আর আবেগের উৎস হিসেবে এই শহীদ মিনারকে বুকে ধারণ করে সেই চার কোটি পরিবারের উত্তর প্রজন্ম হিসেবে আমাদের উপরও তাঁর অন্তহীন আস্থা আর নির্ভরতার কমতি ছিলো না হয়তো। নইলে দেশের বরেণ্য একজন কথাশিল্পী, শিক্ষক ও ভাষাসৈনিক অধ্যাপক ড. আলাউদ্দিন আল আজাদের শেষ ইচ্ছেটা আর যাই হোক মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফনের সরকারি অনুমতি না পেয়ে তাঁর মরদেহ হিমাগারে পড়ে থাকার মতো এতোটা দুর্ভাগ্যজনক নিয়তি-নির্দিষ্ট হতে পারতো না। এ লজ্জাও আমাদের এই মাটিকেই ধারণ করতে হবে ! গত শুক্রবার (০৩-০৭-২০০৯) রাতে রাজধানীর উত্তরায় নিজ বাসভবন ‘রত্নদ্বীপ’-এ মৃত্যুর পর শুক্র ও শনিবার তাঁর মরদেহ বারডেম হাসপাতালের হিমাগারে রাখা হয়েছিলো।

রোববার সর্বস্তরের মানুষের শেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণের পর পরিবারের ইচ্ছানুযায়ী তাঁর মরদেহ শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফনের কথা। কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের অনুমতি না পাওয়ায় তাঁর মরদেহ নিয়ে রাখা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হিমাগারে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়া হয়েছে, যেহেতু আলাউদ্দিন আল আজাদ খেতাবধারী মুক্তিযোদ্ধা নন কিংবা মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় তার নামও নেই, তাই তাঁকে বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের যেখানটায় মুক্তিযোদ্ধাদের দাফন করা হয় সেখানে দাফন করা যাবে না। তবে বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের অন্য যে কোনো জায়গায় তাঁকে অস্থায়ীভাবে দাফন করা যাবে। সে ক্ষেত্রে ঢাকা সিটি করপোরেশানের অনুমতি লাগবে।

কিন্তু প্রয়াতের পরিবার এতে রাজি নন। সরকারের এ বক্তব্যে তাঁর পরিবার থেকে প্রচণ্ড ক্ষোভ ও বিস্ময় প্রকাশ করে প্রয়াতের শ্যালক বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের স্ত্রী মিলি রহমান বলেন, তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা না হলেও বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে ড. আলাউদ্দিন আল আজাদের ভুমিকা অসীম। তাঁকে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে দাফন করার জন্য প্রধানমন্ত্রী বরাবরে একটি ফ্যাক্স বার্তাও পাঠানো হয়েছে। আশা করা যায় তিনি বিষয়টি বিবেচনা করবেন। আর তা না হলে ড. আজাদকে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে নয়, অন্য কবরস্থানে দাফন করা হবে [সূত্র: দৈনিক ‘সমকাল’ (০৭-০৭-২০০৯)]।

জানা যায় এক বছর আগে ড. আজাদের একমাত্র পুত্রও মারা গেছে। নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানার রামনগর গ্রামে বাবা গাজী আবদুস সোবহান ও মা আমেনা খাতুনের চার কন্যার পর ৬মে ১৯৩২ সালে জন্ম নেয়া পরম আকাঙ্ক্ষার ধন একমাত্র পুত্র শৈশবের ‘বাদশা’ থেকে দেশে বিদেশে খ্যাতনামা আলাউদ্দিন আল আজাদ হয়ে ওঠার কাহিনী বেশ রোমাঞ্চকর বলেই জানা যায়। মাত্র দেড় বছর বয়সে মাতৃহারা ও দশ বছর বয়সে পিতৃহারা হলে এই এতিম শিশুর জমি-জিরাত যা ছিলো গ্রামের আত্মীয়-স্বজনরা সব জবরদখল করে নেয়। নিঃস্ব দাদীমার কাছেই লালিত পালিত হতে থাকলেন তিনি। তেরশ পঞ্চাশে দেশজুড়ে ভয়াবহ মন্বন্তরে হৃতসর্বস্ব এক আশ্রিত শিশু বাদশার মনে যেন অলৌকিকভাবেই এই উপলব্ধি আসে যে একমাত্র শিক্ষা ছাড়া তাঁর আর কোথাও যাবার জায়গা নেই।

নানান জনের সাহায্য সহযোগিতায় বেড়ে ওঠা বাদশা সেই থেকে যে বইয়ের জগতে ডুব দিলেন, সেখান থেকে আর ফিরেন নি তিনি। প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষে উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনের শেষ পর্যন্ত প্রথম ছাড়া জীবনে কখনো আর দ্বিতীয় হননি। স্কুল জীবন শেষে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে ভর্তি হন। লেখাপড়ার খরচ চালানোর জন্য রাতে খবরের কাগজের অফিসে খণ্ডকালীন চাকরি করতে হয় তাঁকে। ইতোমধ্যে তাঁর দাদী বিনা চিকিৎসায় মারা গেলে সিদ্ধান্ত নেন ডাক্তারি পড়ার।

কিন্তু খরচের টাকার সংস্থান না হওয়ায় সেটা বাদ দিয়ে বাঙলা অনার্স নিয়ে বিএ পরীায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। এমএ-তেও তাই। এরপর প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে বৈদেশিক বৃত্তি নিয়ে উচ্চতর শিক্ষার জন্য লণ্ডনে পাড়ি জমান তিনি। ১৯৭০ সালে লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রী নেন এবং রয়েল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন। পরে আমেরিকা আধুনিক ভাষা সমিতির সদস্য হন এবং ১৯৮৩ তে অরেগন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক সাহিত্যে উচ্চতর ডিগ্রি নেন।

অথচ এর বহু আগেই অতি ছোট বেলা থেকে সাহিত্য চর্চায় জড়িত হয়ে অসাধারণ মেধা ও সৃজনশীল রচনার মাধ্যমে বাদশা থেকে আলাউদ্দিন আল আজাদ হিসেবে তাঁর খ্যাতিও সেই অল্প বয়সেই দেশে বিদেশে ছড়িয়ে যায়। গল্প, উপন্যাস, নাটক, কাব্য, প্রবন্ধ, শিশুতোষ রচনা, ভ্রমণ কাহিনী, জীবনী গ্রন্থ ইত্যাদি সাহিত্যের এমন কোন শাখা বাকী নেই যেখানে তিনি তাঁর অনন্য প্রতিভার স্বাক্ষর না রেখেছেন। ‘নিমন্ত্রণ’ নামে তাঁর প্রথম রচনা প্রকাশিত হয় ১৯৪৩ সালে যুগান্তর পত্রিকার ছোটদের পাতায়। ১৯৪৭ সালে মাসিক ‘সওগাত’ পত্রিকায় সাহিত্য কর্মে আবেগের ভূমিকা নিয়ে প্রকাশিত তাঁর মননশীল প্রথম প্রবন্ধ ‘আবেগ’ যে কোন কিশোরের রচনা হতে পারে, তা ভাবতেই পারে নি কেউ। সেই থেকে নিয়মিত লিখে গেছেন তিনি।

এবং তাঁর সাহিত্যকৃতির গুণে মানে সেই সময়ে তাঁকে অলৌকিক বালক হিসেবে ভাবা হতো। প্রথম গ্রন্থ ‘তেইশ নম্বর তৈলচিত্র’ থেকে অবিরাম লিখে চলা আলাউদ্দিন আল আজাদের বিভিন্ন বিষয়ের উপর লেখা গ্রন্থ সংখ্যা ১২০ টি। বাংলা একাডেমী পুরস্কার, একুশে পদক সহ বহু পুরস্কার ও পদকে ভূষিত ড. আলাউদ্দিন আল আজাদ ও তাঁর সাহিত্য কর্ম বাঙালির গর্ব ও অনিবার্য সম্পদ হয়ে ওঠলেও মৃত্যুর পর এই বাঙালি সন্তানের মরদেহ হিমঘরে পড়ে থেকে আমাদের নগ্নতাকে শেষ পর্যন্ত নগ্নভাবেই উপহাস করে যায় ! আজ ০৭ জুলাই, ২০০৯ ড. আলাউদ্দিন আল আজাদের পূর্বনির্ধারিত কুলখানি হবার কথা থাকলেও লাশ দাফন করতে না পারার কারণে তাও আর হয়নি। তবু মৃতের গন্তব্য অনির্দিষ্ট হলেও অপেক্ষা অন্তহীন হয় না কখনো। কিন্তু আমাদের লজ্জা নিবারণের উপায়টাই অনিশ্চিৎ রয়ে গেলো, শেষপর্যন্ত।


 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.