shamseerbd@yahoo.com
রাত এগারটায় আমরা এগারজন সিল্ক লাইনের ভলভোতে চেপে বসলাম সাগর সৈকতের পানে। উদ্দেশ্য বৃষ্টি দেখব -জলের বুকে জলের পতন। নিজেদের আমরা ক্রেজি ট্রাভেলারই ভাবি। চারজনের তৈরী এই দল বৃষ্টি উৎসব করতে গিয়ে এগার জনের দলে পরিনত হল। বৃষ্টি উৎসব-বৃষ্টিকে দেখতে যাবার খবর সে সম্ভবত আগেই জেনে গিয়েছিল।
সঙ্গী হল ঢাকা থেকেই। সিল্ক লাইনের ভলভোর এসিও যেন টের পেয়ে গেছে বৃষ্টি উৎসব এর কথা। আর তাই ক্ষনে ক্ষনে সেও ভিজিয়ে দিচ্ছিল আমাদের ।
চৌদ্দ গ্রামে ভরপেট খেয়ে আমাদের হইহুল্লোড় থেমে গেল। এক ঘুমে কক্সবাজার।
আরিফ , রুমন এর ছিল প্রথম কক্সবাজার যাত্রা , আরিফেরত প্রথম সাগর দেখা। তার চোখ বেধে ফেলার তোড়জোড়ে সে তীব্র বাঁধা দিল। বাস যাত্রীদের সামনে আইটেম হতে সে রাজি না। কি আর করা। সৈকতের সবচেয়ে কাছাকাছি সি ক্রাউন এ আমাদের অস্হায়ী ঠিকানা হল।
উৎসবের প্রথম অনির্ধারিত আয়োজন হয়ে গেল সাগর পাড়ের কিশোর দের সাথে ফুটবল ম্যাচ। গোল শূন্য আধা ঘন্টার পর সবার অবস্হা নেসলের এ্যাডের " আমার ব্যাটস ম্যানের এখন একটা রানার লাগে " র মত। তুমি না বুঝলেও আমি বুঝি একথা বলে কেউত আর নেসলে নিয়ে এগিয়ে এলনা অগত্যা মিনারেল ওয়াটার ই ভরসা।
এরপর উদ্যাম সাগরে নিজেকে বিলিয়ে দেবার পালা। হাত পা ছড়িয়ে দিগ্বিদিক লাফালাফি , একজনকে ধরে ছুড়ে দেয়া।
ঝাপাঝাপি করতে গিয়ে দেখা হয়ে গেল দুই স্কুল বন্ধু রিয়াজ আর মাসুমের সাথে।
মাইকেল জেকসন সপ্তাহ খানেক ধরে মাটির দেখা না পেলেও তিনজনকে জীবিত গলা পর্যন্ত বালি চাপা দেয়া হল। বালির চাপায় ব্যাপক মজা পেলাম। ওয়াটার স্কুটার এ না চড়লে পুরা ক্রেজী হওয়া যাচ্ছেনা। সবাই দেখি সৈকতের বামে ডানে কূল ধরে চালাতে বলে।
সোজা দিগন্ত বরাবর চালাব বলায় সাহসী যাত্রী পেয়ে বাইক ওয়ালাও চান্স পেল তার কসরত দেখানোর। ঢেউয়ের মাথায় মাথায় স্কুটার চালানো তাও আবার কক্সবাজারের উত্তাল সাগরে , আপনার আনন্দ দিগুন করে দিবে।
দুপুরের খাবার ছিল ছুরি শুটকি , রূপচাঁদা ফ্রাই আর রাতে লটিয়া মাছের সাথে কোরাল মাছের দোপেয়েজা। সাগর পাড়ে সাগরের মাছে রসনায আপত্তির কারনে দু তিনজন যথারীতি ফার্মের মুরগী নিয়ে বসল। অলস বিকেল কেটেছিল সাগর চৌকিতে শুয়ে শুয়ে সূর্য্যের হারিয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে।
আমাদের সাথে সী ক্রাউনে ছিল কন্ডিশনিং ক্যাম্পে থাকা বাংলাদেল ফুটবল দল। জার্সি দেখেই বুঝতে হল তাদের পরিচয়। দুঃখ হল তাদের জন্য , দেশ ক্রিকেটের জোয়ারে ভাসতে থাকায় বেচারাদের নামটা পর্যন্ত কেউ জানেনা। ক্রিকেটার হলে দু একজনের সাথে হয়ত কথাটতাও হত। এদের কাউকে যে চিনিইনা।
রাতটা ছিল অসাধারন। একটার দিকে আমরা নেমে এলাম কলাতলী সৈকতে। লাবনী পয়েন্টের দিকে হাটছি। পুরা বীচে আমরা ছাড়া আর কেউ নেই। দিগন্তে যৌবনে পা দেয়া দশমীর চাঁদের নিত্য লুকোচুরি মেঘের কোলে।
গলা ছেড়ে তারস্বরে গান (চিৎকার ও বলা যায়। ) , সাগর জলে পা ডুবিয়ে হাঁটা। রাতযে ছুটে চলেছে ভোরের পানে।
মাথার ভেতর গুনগুন করছিলাম সাগরের তীর থেকে মিষ্টি কিছু হাওয়া এনে তোমার কপালে ছোঁয়াবো গো , ভাবি মনে মনে .....আপন করে কখনো পাওয়া হয়নি তাই হয়ত হারনোর তীব্রতা অত বেশী জলের দামে বুঝিনি কখনও....একটু বুঝলাম যখন একজনকে দেখলাম আকাশ পানে সব হারানোর দৃষ্টি নিয়ে চাঁদের লুকোচুরি দেখছে আর চোখ বেয়ে টপটপ করে বৃষ্টি ঝরছে। তারজন্যই হয়ত অন্জনের গাওয়া -
আমি বৃষ্টি দেখেছি বৃষ্টির ছবি একেছি
আমি রোদে পুরে ঘুরে ঘুরে
অনেক কেঁদেছি
আমার আকাশ কুসুম স্বপ্ন দেখার খেলা থামেনি
শুধু তুমি চলে যাবে
আমি স্বপ্নেও ভাবিনি ...........
সুবীর নন্দীর গানটি শুনলে হয়ত তার এমনটি হতনা ...
আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছি
আমায় কান্নার ভয় দেখিয়ে কোন লাভ নেই ....
কিংবা কে জানে এমনও হতে পারে-
আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে মনে পড়ল তোমায়
অশ্রু ভরা দুটি চোখ...................
কতদূরে যাবে বল-তোমার পথের সাথী হব আমি ।
।
হোটেলের সামনে ড্রাইভার হারুন ভাই তার চান্দের গাড়ি নিয়ে হাজির।
প্রাতঃরাশ ছেড়ে যাত্রা শুরু হল মেরিন ড্রাইভ ধরে। সাগর আর পাহাড়ের অপরূপ মিতালী... বাপ্পার গানের মত - এই সাজ মন মাতানো পাগল যে করে দেয় ...আমায় কাছে কখনো টানে কখনো দূরে ঠেলে দেয়।
জোয়ারে ভাঙ্গতে থাকা মেরীন ড্রাইভ রক্ষায় ব্যস্ত সেনা জোয়ানরা।
মেরিন ড্রাইভ শেষে মনে হল -কখনো দূরে ঠেলে দেয়। টেকনাফের রাস্তা বেশীক্ষন এমনটি মনে হতে দেয়নি। আঁকাবাকা পথে সামনে হাজির হয় নাফ নদী। পথিমধ্যে হালকা যানজটে এক তরুন বাস যাত্রী বিদ্রুপ ছুড়ে দেয় -এতগুলি পোলা একটা মাইয়াও নাই দেখি
নাটং পর্যটন মোটেলের সামনে নাফ নদীর রূপসুধা পানের জন্য হালকা বিরতি। টেকনাফ পৌছে দেখা করলাম বন্ধু জুয়লের বড় বোন জেবা দিদির সাথে।
অফিসের কাজে সেখানে থাকা তিনিও যোগ দিলেন আমাদের সাথে। অনেকদিন পর আবার দিদির সাথে আড্ডা জমে উঠল।
টেকনাফের সৈকতে শুধু আমরা কজন ছাড়া আর কোন ভিজিটর নেই। জেলেরা মাছ ধরে ফিরে আসছে। দিদির জিম্মায় সব রেখে শুরু হল আমাদের সমুদ্র স্নান- আমি আজ ভাসাব দুচোখ সমুদ্র জলে।
।
ইতিহাস ফিরেফিরে আসে। এবার সময় নিয়েছিল দশ বছর। নিরানব্বই সালে সমুদ্র স্নানের সময় মায়ের নিষেধ থাকায় পানিতে না নামা জুয়েল আমাদের ব্যাগ পাহাড়া দিয়েছিল আর এবার দিদি , ব্যাগের জন্য পিছুটান না থাকায় চলল উদ্রদক্ষম দাপাদাপি। সম্বিৎ ফিরল ড্রাইভারের ডাকে।
ফিরতি পথে মাথিনের কূপ। আরেক জোড়া লাইলী মজনুর ইতিহাস, তাদের কান্না।
লাঞ্চ হল দিদির আগে থেকে বলে দেয়া এক রেস্তিরায় জনপ্রতি মাঝারি সাইজের আস্ত ইলিশ দিয়ে। বিদায় নিয়ে ফিরতি পথ।
প্রযুক্তির কল্যানে মানুষের সংযোগ শুধু ইচ্ছার ব্যাপার , অনেক কাছাকাছি সবহই -টের পেলাম ড্রাইভার হারুন ভাই এর বউ এর কল্যানে।
ঘন্টাখানিক পরপর তার ফোন। হারুন ভাই এই রুটে গাড়ি চালাননা -তাই বউ এর এত উদ্বিগ্নতা। হাস্যোজ্জ্বল মানুষ হারুন ভাই। সাতবছর দুবাইএ গাড়ি চালিয়ে নিজেই এখন দেশে নিজের গাড়ি চালেন। প্রতিক্ষনে তার গাড়ির প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
উখিয়া বাজারের মিষ্টিঘরের রসগোল্লা না খেলে আপনার পুরা ট্যুরটিই বৃথা যাবে একথা হলফ করে বলতে পারি। আগেরবার পনেরটা খেলেও এবার জনপ্রতি পাঁচটার বেশী জুটলনা। ইনানীতে মায়াবী সূর্য্যাস্ত। মেরিন ড্রাইভ ধরে সাজের আলোয় আবারও ছুটে চলা পাহাড় আর সাগরের মিতালী ছেদ করে।
একপশলা ঝুম বৃষ্টি শেষে ট্রপিকানায় ঢেউ এর গর্জনে আমরা হারালাম ডিনার নিয়ে।
ব্যয়বহুল হলেও এমন মনকাড়া মায়াবী পরিবেশ , চাঁদের আলোয় জলের নাচন দেখতে দেখতে সময় যে কখন পেরিয়ে গেল সেটা টেরই পাওয়া গেলনা। তিনটা বেজে গেছে তখনও আমরা একে অন্যের কাধে মাথা রেখে হাত পা ছড়িয়ে বসে আছি সৈকতে।
সকালের নাস্তা শেষে আবারও সমুদ্র দর্শন। চুপচাপ ঢেউ গুনে যাওয়া। মন বলছে - আজ ফিরে না গেলেই কি নয়।
রাত একটাই যখন ঢাকায় বাস থেকে নামি তখন মনে হল - কাল সারারত ছিল স্বপ্নের ও রাত। ।
এভাবেই শেষ হল আমাদের বৃষ্টিবিহীন বৃষ্টি উৎসব। কিমুলোনিম্বাস (যে মেঘে ব্ষ্টির সম্ভাবনা প্রবল ) মেঘ গুলো কখনোই নিম্বাস মেঘ হয়ে ঝড়ে পড়েনি। আসি আসি করে তার ছিল নিত্য আসা যাওয়া - একটু এসে আবারও পালিয়ে যাওয়া।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।