ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদীপের নিচে এক অদ্ভুত অন্ধকার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাসের (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্ন্যাকস) আশপাশে যারা আড্ডা মারেন তাদের কাছে কামরাঙ্গীরচরের হুমায়ুন এক পরিচিত নাম। কতোদিন ধরে কাজ করছ? প্রায় ৬ মাস- হুমায়ুনের উত্তর। লেখাপড়া করেছো? সদা হাস্যময় হুমায়ুনের মুখ কিছুড়্গণের জন্য মলিন হয়ে যায়। গম্ভীর মুখে জানায়, বাবা রিক্সাওয়ালা, ৬ ভাইবোন। সংসারে অনেক অভাব।
পড়ার খরচ দেবে কে? খাওন দেবে কে? ডাসে দিনরাত কাজ করে মাস শেষে হুমায়ুন পায় এক হাজার টাকা। তুলে দেয় মায়ের হাতে সংসার চালানোর কাজে।
হুমায়ুনের মতোই আট-নয় বছরের ছেলে রাজা। কুমিলস্নার ছেলে রাজার বাবা সৌদি আর মা লেবাননে কাজ করেন। খালার সংসারে অনাদরে বেড়ে ওঠা রাজার খোঁজ রাখেন না তার বাবা-মা।
তাই একদিন পালিয়ে চলে আসে ঢাকা। ঠাঁই হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির যাত্রী ছাউনিতে। ফুটফরমায়েশ খাটে ডাস এবং টিএসসির ক্যাফেটেরিয়াতে। এর বিনিময়ে সে কোনো টাকা পায় না। মাঝে মধ্যে খাবার পায়।
সকাল ৭টায় যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিড়্গার্থীরা বই, খাতা, ব্যাগ নিয়ে তৈরি হয় ক্লাসে যাওয়ার জন্য, ঠিক তখন রোকেয়া হলের ক্যান্টিন পরিস্কারের মাধ্যমে দিনের কাজ শুরু করে ইলিয়াস। ৭ বছর বয়সী ইলিয়াস কাজ করে সকাল থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত। বিনিময়ে তিন বার খাবার আর মাস শেষে ৩০০ টাকা। রাত কাটায় দিনে যে টেবিলগুলো যত্নের সঙ্গে পরিষ্কার করে আপাদের চা সিঙ্গারা খেতে দেয় সেই টেবিলগুলোর ওপর। ইলিয়াস জানায়, মাসে কোনো ছুটি নেই।
শুধু ঈদের বন্ধে বাড়ি যেতে পারে। পিতৃহীন ইলিয়াস তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছে। লেখাপড়ার প্রচণ্ড আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও অল্প বয়সে সংসারের হাল ধরতে হচ্ছে তাকে। এখানে থাকতে ভাল লাগে- এমন প্রশ্নের জবাবে সবেগে মাথা নাড়ে সে। মলিন হাসি দিয়ে বলে, কি করব।
টাকার বড় অভাব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোর ক্যান্টিন ও ক্যাম্পাসের টিএসসি, হাকিম চত্বর, মল চত্বরে ভ্রাম্যমাণ চা-সিগারেটের দোকানগুলোতে হুমায়ুন বা ইলিয়াসের মতো অনেক শিশু পেটের দায়ে কাজ করছে। ঠিক পরিসংখ্যান না পাওয়া গেলেও বিভিন্ন জরিপ অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় দুই হাজার শিশু শ্রম দিচ্ছে। যে বয়সে বই-খাতা নিয়ে, কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা, সেই বয়সে ওদের কাঁধে দায়িত্বের বোঝা। সংসারের ঘানি টানতে গিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে অমূল্য শিশুকাল।
প্রজাপতির মতো রঙিন দিন আর দূরন্ত কৈশোরে কাটিয়ে দিচ্ছে চা সিগারেট আর শিঙ্গাড়া সার্ভিস দিয়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচে কর্মব্যস্ত ক্যান্টিন হলো ঐতিহাসিক মধুর ক্যান্টিন। এই ক্যান্টিনে অনেকেই দীর্ঘদিন কাজ করে কাটিয়ে দিয়েছে দূরন্ত শৈশব, অর্ধফুটন্ত কিশোরকাল, কাটাচ্ছে এক সম্ভাবনাহীন যৌবন। এমনই একজন আজিজ (ছদ্মনাম)। সে কবে এসেছিল আজ তার মনেও নেই।
শুধু মনে আছে তখন সে হাফপ্যান্ট পড়তো। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল পড়াশোনা করেছো? তার উত্তর- খাতি পারি না আবার পড়া! আজিজ জানায়, ভাল লাগে না। একবার বাড়ি চলে গেছিলাম। দেড় মাস পর আবার ফিরা আইছি। কাম না করলে খামু কি?
সত্যিই তাই।
কাজ না করলে ওদের চলবে কেমন করে। ওরা কাজ করে, তাই খাবার পায়। তবে কাজ বেশি, প্রাপ্তি কম। এর পরও সমাজ, রাষ্ট্র কারো প্রতি তাদের কোনো অভিযোগ নেই। অভিযোগ শুধু নিজের অদৃষ্টের প্রতি।
সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে কাজ করা শুরু করে। সূর্য ডুবে সন্ধ্যা হয়, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত- তবুও ফুসরত নেই এসব শ্রমজীবী শিশুদের। মধ্যরাতে যখন নিস্তব্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ে আঁধার নামে, তখন একটু বিশ্রাম পায় এরা। ওদের মাথা গোঁজার ঠাঁই ক্যান্টিনের টেবিল, হলের বারান্দা অথবা খেলার মাঠের গ্যালারি।
এভাবেই চলছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত প্রায় দুই হাজার শিশুশ্রমিকের জীবন।
এ দেশে ঘটা করে শিশু অধিকার পালন করা হয়, ঢাকঢোল পিটিয়ে শিশু দিবস পালিত হয়, শিশু অধিকার নিয়ে সেমিনার হয়, সিম্পোজিয়াম হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের এই ভাগ্যবঞ্চিত শত শত শিশুর ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় না।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারি প্রক্টর এবং লোকপ্রশাসন বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ডক্টর নাজমুল আহসান কলিমউলস্নাহ বলেন, আশির দশকে আমরা যখন ছাত্র ছিলাম, তখন আওলাদ খান নামের এক শিড়্গার্থী শামসুননাহার হল ও জগন্নাথ হলের মাঝখানের মধ্যে খালি জায়গায় এসব বঞ্চিত শিশুদের জন্য স্কুল চালু করেছিলেন। কিন্তু যে আলোকবর্তিকা তিনি জ্বালিয়েছিলেন পরবর্তীতে ধারাবাহিকতার অভাবে এটি থেমে যায়। আমি মনে করি, বিএনসিসি, স্কাউট, রেঞ্জার থেকে এ ধরনের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।
এটি আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে আলোর নিচে তারা কেন আলোহীনভাবে বেড়ে ওঠবে? আমাদের বিষয়টি নিয়ে ভাবা উচিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, নীলড়্গেত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এসব শিশুদের জন্য সুযোগ রয়েছে। যাদের আগ্রহ রয়েছে তারা হল কর্তৃপড়্গের মাধ্যমে বা যাদের সঙ্গে কাজ করছে তাদের মাধ্যমে ভর্তি হতে পারে। কিন্তু আমাদের আসন সংখ্যা সীমিত হওয়ায় আমরা সবাইকে সুযোগ দিতে পারি না।
এ বিষয়ে সবার দৃষ্টি দেয়া উচিত। ইতিমধ্যে একজন ক্যান্টিনবয় কাজের পাশাপাশি জিপিএ-৫ পেয়েছে।
যে বিশ্ববিদ্যালয় হতে প্রতিবছর শত শত ছাত্র ডিগ্রি নিয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তৈরি করছে, উচ্চতর গবেষণা করছে, বিদেশের নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তি পাচ্ছে, সেই একই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটিতে অবস্থান করে আরেক দল ভাগ্যহীন বঞ্চিত শিশু উজ্জ্বল ভবিষ্যতের বদলে এগিয়ে চলেছে অন্ধকারের দিকে। একই আলো-বাতাসে একদল উচ্চ শিড়্গায় শিড়্গিত হচ্ছে, আরেক দল প্রদীপের ঠিক নিচে অন্ধকারের মতো দেশের সর্বোচ্চ বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করেও বঞ্চিত হচ্ছে শিড়্গা থেকে যেটা তাদেরও মৌলিক অধিকার।
Courtesy ঝর্ণা মনি:
The Daily Bhorerkagoj, 6th Jul২০০৯
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।