আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

লালন ফকিরঃ সহজ মানুষের সাধক

মাঝে মাঝে মন নিয়ন্ত্রনহীন হতে চায়; কিন্তু...............

আমাদের দেশটাকে বলা হয় গানের দেশ। এ দেশের জলে-স্থলে আকাশে-বাতাসে সুর মিশে আছে। পলি মাটি দিয়ে গড়া এ দেশের মানুষের মনটাও নাকি পলির মতোই নরম। সুরের ছোঁয়ায় সহজেই আপ্ল ুত হয়। ভাবরসে, ভক্তিরসে সিক্ত হয়।

এ বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণেই যুগে যুগে বহু বি-শিল্পী তাঁদের গানে-কবিতায় সুরে বাংলার মানুষকে কাঁদিয়েছেন হাসিয়েছেন। বাণী ও সুরের মাধ্যমে মানুষের মনের মণিকোঠায় ঠাঁই করে নিয়েছেন। কিন্তু ইতিহাসের নদীতে জলের প্রবাহ বিরামহীন। বয়ে আসে নতুন পলি, পুরনো ঢাকা পড়ে যায়। কিন্তু তারপরও সব ঢাকা পড়ে না।

ইতিহাসের অতলান্ত থেকে পুরনো অনেক কিছুই মাথা তুলে দাঁড়ায় যা নতুন যুগের নতুন মানুষদেরও নাড়া দেয়। লালন ফকির আর তাঁর গান তেমনই এক যুগান্তরকারী বিষয়। আজ থেকে প্রায় আড়াইশ বছর আগে তিনি জন্মেছিলেন, মারা গেছেন সেও প্রায় শত বছর পার হয়েছে। কিন্তু লালনের গান আজও বাংলার সব বয়সের সব ধরনের মানুষকে আনন্দ দেয়, ভাবরসে আন্দোলিত এবং ভক্তিরসে সিক্ত করে। সঙ্গীত-রসিকদের কাছে তাঁর গানের বাণী ও সুরের আবেদন অলঙ্ঘনীয়।

লালন হিন্দু পরিবারে জন্মেছিলেন না মুসলমান পরিবারে জন্মেছিলেন এ নিয়ে এখনো গবেষকদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। বিতর্ক রয়েছে তাঁর জন্মস্থান নিয়েও। অধিকাংশ গবেষকের মতে, লালনের জন্ম ১৭৭২ সালের ১৪ অক্টোবর (বাংলা ১১৭৯ সালের ১ কার্তিক) ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকু-ু উপজেলার হরিশপুর গ্রামে। তাঁর পিতার নাম দরিবুল্লাহ দেওয়ান, মায়ের নাম আমিনা খাতুন। দরিবুল্লাহ দেওয়ানের তিন পুত্র আলম, কলম ও লালনের মধ্যে লালন ছিলেন সবার ছোট।

অতি শৈশবেই তিনি পিতৃহারা হন। মায়েরও মৃত্যু ঘটে বাল্যকালেই। পড়াশোনা করার সুযোগ তাঁর জীবনে ঘটেনি। বড় ভাই আলম জীবিকার সন্ধানে হরিশপুর ছেড়ে চলে গেলে পিতৃমাতৃহীন লালন মেঝ ভাই কলমের পোষ্য হিসাবে পালিত হন। এ সময় তাঁকে গরুর চরানোসহ সংসারের নানা কাজ করতে হত।

হরিশপুর গ্রামে সে সময় বহু হিন্দু-মুসলমান বাউল ফকির, সন্ন্যাসী, সাধকের আশ্রম ছিল। বাউল সাধকদের আশ্রমগুলো ছিল গানের আখড়া। শৈশব থেকেই সঙ্গীতের প্রতি ছিল লালনের দুনির্বার আকর্ষণ। তিনি এ সব আখড়ায় ঘুরে বেড়াতেন। আর এ কারণে সংসারের কাজে ক্ষতি হলে কলম তাঁকে তিরস্কার করেন।

মনের দুঃখে লালন গৃহত্যাগী হন। কিছুদিন অন্য গৃহস্থদের বাড়িতে গরুর দেখভাল ইত্যাদি নানা কাজ করে জীবনধারণ করেন। এক পর্যায়ে তিনি সিরাজ শাহের তত্ত্বাবধানে আসেন। সিরাজ শাহের বাড়ি ছিল হরিশপুর গ্রামেই, বাটিকামারিয়া বিলের ধারে। তিনি ছিলেন পালকী বাহক বা বেহারা।

তিনি লালনকে পালক পুত্র হিসাবে গ্রহণ করেন। সিরাজ শাহ কোনো তত্ত্বজ্ঞ সাধক ছিলেন না, তবে গানের আসরে তাঁর যাতায়াত ছিল। লালন তাঁকেই গুরুরূপে বরণ করে নেন। কারো মতে, প্রথমে ভাই কলম ও পরে সিরাজ শাহের কাছে লালিত-পালিত হওয়ায় তাঁর নাম হয় লালন। ১৭৯৮ সালে সিরাজ শাহের মৃত্যু হলে লালন হরিশপুর ছেড়ে চলে যান।

পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গেও তাঁর আর কোনো যোগাযোগ রইল না। কিছু দিন তিনি নানা দিকে ভ্রমণ করে বেড়ান। এক সময় তিনি নবদ্বীপে গিয়ে পদ্মাবতী নামের এক বিধবা বৈষ্ণবীর আশ্রয় লাভ করেন। পদ্মাবতীকে তিনি মা ডাকতেন। এখানেই তিনি বেশ কিছুদিন অতিবাহিত করেন।

এক সময় নবদ্বীপ থেকে লালন যান রাজশাহীর প্রেমতলীতে খেতুরীর বৈষ্ণব মেলায় যোগ দিতে। মেলা থেকে ফেরার পথে নৌকায় তিনি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। নৌকার মাঝিরা তাঁকে কুষ্টিয়া শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত কালীগঙ্গা নদীর চরে ছেউড়িয়া গ্রামের নিকট ফেলে যায়। ছেউড়িয়া গ্রামের মলম কারিকর তাঁকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে সেবাযতœ করে সুস্থ করে তোলেন। কোনো কোনো গবেষকের মতে লালনের জন্ম কুষ্টিয়ার ভাড়ারা গ্রামে এক হিন্দু কায়স্থ পরিবারে।

খেতুরীর মেলা থেকে ফেরার পথে লালন বসন্ত রোগে আক্রান্ত হলে তাঁর সঙ্গীরা তাঁকে ফেলে চলে যান। মলম কারিকরের সেবা-শুশ্রƒষায় সুস্থ লালন বাড়ি ফিরে গেলে বাড়ির লোকজন এবং গ্রামের হিন্দুসমাজ তাঁকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায় এই বলে যে সে মুসলমানের হাতে জল খেয়েছে। এ ঘটনা লালনকে ব্যথিত এবং ক্ষুব্ধ করে তোলে। তনি সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী হয়ে যান। যাই হোক, লালনের ভাবগানে মুগ্ধ মলম লালনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।

নিজের বাড়ির ষোল বিঘা জমি তিনি লালনকে দান করেন। এখানেই গড়ে ওঠে লালন ফকিরের আস্তানা। তাঁর সাধক জীবনের পূর্ণতা ঘটে এই ছেউড়িয়ার আস্তানায়। গান রচনা ও পরিবেশন, শিষ্যদের দীক্ষাদান, ওই অঞ্চলের বিভিন্ন সাধকদের নিয়ে সাধুসেবা বা ফকিরী মজলিশ ইত্যাদির মাধ্যমে লালনের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তিনি ‘ছেউড়িয়ার সাঁইজী’ নামে পরিচিত হন।

ছেউড়িয়ার আশেপাশে যশোর, কুষ্টিয়া থেকে শুরু করে নদীয়া অঞ্চলে বহু আস্তানা বা আখড়া গড়ে ওঠেছিল। বিভিন্ন সাধক ফকির-বৈষ্ণবের নামে বা অঞ্চলের নামে এ আখড়াগুলো পরিচিত ছিল। যেমন লালন শাহের শিষ্যদের নিয়ে গড়ে ওঠেছিল ‘লালন শাহের ঘর’ বা ‘ছেউড়ের ঘর’, পাঞ্জু শাহের শিষ্যদের নিয়ে গড়ে ওঠেছিল ‘পাঞ্জু শাহের ঘর’ বা ‘হরিশপুরের ঘর’ ইত্যাদি। লালন এসব ফকির-সাধকদের দাওয়াত দিতেন। লালনের শিষ্যদের মধ্যে মলম কারিকর, ভোলাই শাহ, শীতল শাহ, মনিরুদ্দীন শাহ, মানিক শাহ, দুদ্দু শাহ প্রমুখ ছিলেন প্রধান।

মনিরুদ্দীন ও মানিক ছিলেন লালনের গানের লিপিকার। লালন গানের কথা বলে যেতেন আর এঁরা দুজন লিখে রাখতেন। এখানে লালন মতিজান বিবি নামের এক নারীকে বিয়ে করেন। তবে তাঁদের কোনো সন্তান হয়নি। তিনি একটি পোষ্যকন্যা গ্রহণ করেছিলেন।

শিষ্যদের তিনি সন্তানের মতো ভালবাসতেন, লালন করতেন। লালনের হরিশপুর জীবনেও একটি বিবাহের কথা শোনা যায়, যদিও এ সম্পর্কে প্রামাণিক তথ্য তেমন পাওয়া যায় না। জীবনের শেষ দিকে তিনি ঝিনাইদহের শৈলকূপার আলমডাঙ্গায় পরমান্দপুর গ্রামে জমি কিনে আখড়া স্থাপন করেছিলেন। ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর (বাংলা ১২৯৭ সালের ১ কার্তিক) ১১৮ বছর বয়সে সাধক লালনের জীবনাবসান ঘটে। লালন শাহের গান তাঁর জীবদ্দশাতেই জনপ্রিয়তা লাভ করে।

এ গানকে তখন বলা হত ‘ফকরের গান’ বা ‘শব্দগান’, যাকে পরিশীলিত ভাষায় ‘ভাবগান’ বলা হয়। লালনের দেখাদেখি তাঁর শিষ্যদের মধ্যেও গান রচনার আগ্রহ জাগে। শিষ্যদের মধ্যে দুদ্দু শাহ ছিলেন অগ্রণী। পাঞ্জু শাহ লালনের সরাসরি শিষ্য না হলেও তাকে লালনের ভাবশিষ্য বলা যায়। তিনিও গান রচনায় এগিয়ে আসেন।

লালনের গান ওই সময়ের বড় বড় কবি-সাহিত্যিক-চিন্তাবিদদের আকৃষ্ট করেছিল। শোনা যায়, শিলাইদহের কুঠিবাড়ীতে জমিদারির কাজকর্ম দেখাশোনা করতে গিয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথ দুই ভাইই লালনের গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন। ১৮৮৯ সালের ৫ মে (বাংলা ১২৯৬ সালের ২৩ বৈশাখ) শিলাইদহের বোটে বসে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ লালনের একটি স্কেচ বা ছবি আঁকেন। পরবর্তীকালে এটিই লালনের প্রতিকৃতি হিসাবে প্রচারিত হয়। লালন এবং রবীন্দ্রনাথ এই দুই মনীষীর কখনো সাক্ষাৎ হয়েছিল কিনা তা নিয়ে বিতর্ক আছে।

তবে কারো কারো মতে শৈশবে দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সাথে শিলাইদহে বেড়াতে যেয়ে রবীন্দ্রনাথ লালনের গান শুনেছিলেন। পরবর্তীকালে লালনের শিষ্যদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের আলাপ-পরিচয় হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে তাঁদের গান এবং তত্ত্বকথা শুনতেন। রবীন্দ্রনাথ লালনের গান সংগ্রহ করেন এবং লালনের মৃত্যুর প্রায় পঁচিশ বছর পর প্রবাসী পত্রিকায় ‘হারামণি’ নাম দিয়ে লালনের বিশটি গান প্রকাশ করেন। এর আগে লালনের মৃত্যুর ৫ বছর পর সরলা দেবী ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়র সহায়তায় ‘লালন ফকির ও গগন’ নামের একটি প্রবন্ধে লালনের সংক্ষিপ্ত জীবনী এবং ১১টি গান প্রকাশ করেন।

এছাড়া সতীশচন্দ্র দাস ও করুণাময় গোস্বামী প্রমুখ প্রবাসী পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের আগেই লালনের বেশ কিছু গান প্রকাশ করেছিলেন। এভাবেই লালনের গান বিশেষভাবে শিক্ষিত মহলের দৃষ্টিগোচরে আসে। প্রবাসী পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক প্রকাশিত লালনের গান দেখে মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন বিশেষভাবে আকৃষ্ট হন এবং বাউল গান বিশেষত লালনের গান সংগ্রহ ও প্রকাশে উদ্যোগী হন। ‘হারামণি’ নাম দিয়ে ১১টি খ-ের মধ্যে লালনের সহস্রাধিক গান তিনি সংকলিত করেন। আজকে যেভাবে কবিতা ও গানকে আলাদা করা হয় একদিন কিন্তু তা করা হত না।

তখন কবিতা-গান সবই সমার্থক ছিল। গান রচনাকারী বা গায়ক সবাইকেই কবি হিসাবে অভিহিত করা হত। কবিগান বা কবিয়াল শব্দগুলো তারই উদাহরণ। ইতিহাস থেকে দেখা যায় প্রাচীনকালে বিভিন্ন জাতিতে, জনগোষ্ঠীতে সমাজচিন্তা ও র্শনচিন্তা বিকশিত এবং প্রকাশিত হয়েছে মূলত কবিতায় ও গানে। আর সে কারণে কবি বা সঙ্গীতকারদের সমাজে আলাদা মূল্য দেওয়া হত।

তারপর ক্রমে সমাজচিন্তা বা দর্শনচিন্তা মূর্তরূপ লাভ করতে থাকে, কবিতা বা গান থেকে পৃথক ধারায় প্রাতিষ্ঠানিক রূপে বিকশিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশে বহুদিন পর্যন্ত দর্শনচিন্তা এবং সমাজচিন্তার আশ্রয় ছিল কবিতা ও গান। আধুনিক সময়ের ফসল রবীন্দ্রনাথের কবিতা এবং গানেও দর্শনচিন্তা প্রকাশিত হয়েছে। আর তাই রবীন্দ্রনাথকে বলা হয় কবি-দার্শনিক। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের চেয়ে সময়ে প্রাচীন এবং আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শন কোনো কিছুর সাথে যার পরিচয় ছিল না, সেই লালনের গানে দর্শনচিন্তা প্রভাব ও প্রকাশ এত প্রবল যে লালনকে তাই দার্শনিক-কবি বলা মোটেই ভুল হবে না।

রবীন্দ্রনাথ নিজেও বাউল গানে প্রভাবিত হয়েছিলেন। বিভিন্ন সময় তিনি বাউল গান বিশেষত লালনের গানের সুর-ছন্দ, ভাবসম্পদ এবং তত্ত্বদর্শন নিয়ে আলোচনা করেছেন, প্রবন্ধ লিখেছেন। একদিক থেকে বলা যায়, রবীন্দ্রনাথের হাত দিয়েই লালন দর্শন, সঙ্গীতসাধনা এবং মানবচিন্তা বাংলার সীমা ছাড়িয়ে ভারত ও বিশ্বের দরবারে প্রসার লাভ করে। আবার রবীন্দ্রনাথ নিজেও লালনের গান থেকে সুর-ছন্দ এবং ভাবসম্পদ আত্মস্থ করে সমৃদ্ধ হয়েছেন। এ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, “আমার অনেক গানেই আমি বাউলের সুর গ্রহণ করেছি।

এবং অনেক গানে অন্য রাগ-রাগিনীর সঙ্গে আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাউল সুরের মিল ঘটেছে। এর থেকে বোঝা যাবে বাউলের সুর ও বাণী কোনো এক সময়ে আমার মনের মধ্যে সহজ হয়ে মিশে গেছে। ” বাউল গানে রবীন্দ্রনাথ কতটা প্রভাবিত ছিলেন তার উদাহরণ রবীন্দ্রনাথের বহু গানে বাউল-ভাব এবং সুরে ছড়িয়ে আছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমাদের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’ রচিত হয়েছে বাউল গগন হরকরার “আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে” গানটির অনুসরণে। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ বহু বার এ কথা স্বীকার করেছেনে যে তাঁর ‘জীবন-দেবতা’ তত্ত্ব আসলে বাউলদের ‘মনের মানুষ’ তত্ত্বেরই ভিন্ন রূপ।

“আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে, তাই হেরি তায় সকল খানে” কিংবা “আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি” প্রভৃতি গানগুলো আসলে লালনের “কি সন্ধানে আমি যাই সেখানে/ মনের মানুষ যেখানে”, “মিলন হবে কত দিনে আমার মনের মানুষের সনে”, কিংবা “বাড়ির পাশে আরশি নগর/ সেথা একঘর পড়শি বসত করে/ আমি একদিনও না দেখিলাম তারে” প্রভৃ তি গানে বিধৃত তত্ত্বেরই ভিন্ন উপস্থাপনা। লালনের গান রচনায় প্রভাবিত হয়ে তাঁর শিষ্যদের গান রচনার কথা আগেই বলা হয়েছে। শিষ্যম-লী ছাড়িয়ে তাঁর প্রভাব সমকালে বহু দূর বিস্তৃত হয়েছিল। জানা যায়, লালনের গানে প্রভাবিত হয়ে কাঙাল হরিণাথ মজুমদার, ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, জলধর সেন, মীর মশাররফ হোসেন প্রমুখ মিলে একটি বাউল গানের দল গঠন করেছিলেন। তাঁরা এ দলের নাম রেখেছিলেন ‘ফিকির চাঁদ ফকির’।

হরিণাথ মজুমদার ‘কাঙাল’ ভনিতায় গান লিখে ‘কাঙাল’ নামে খ্যাত হয়েছেন। মীর মশাররফ হোসেনও ‘মশা’ নামভনিতায় বেশ কিছু বাউল গান রচনা করেছিলেন। কবি নজরুল পর্যন্ত বাউল গানের প্রভাবে আন্দোলিত হয়েছে লিখেছেন, ‘আমি ভাই খ্যাপা বাউল,/ আমার দেউল আমার এই আপন দেহ। ’ এখানে প্রসঙ্গত, বাউলতত্ত্ব সম্পর্কে দু-একটি কথা বলে রাখা দরকার। যদিও কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম মত নয়, তারপরও বাউলদের একটি নিজস্ব ধর্ম আছে।

তাঁদের নিজস্ব তত্ত্ব, সাধন পদ্ধতি অর্থাৎ জীবনাচরণ পদ্ধতি আছে। বাউল ধর্মের মূল ভাবটি ছিল সমন্বয়বাদী। উপমহাদেশে মুসলিম বিজয়ের পর ভারতীয় হিন্দু ও বৌদ্ধ এবং মুসলমান Ñ এই তিন বিপরীতমুখী ধর্ম ও সংস্কৃতির সংঘর্ষে প্রথমে দক্ষিণ ভারতে ও পরে উত্তর ভারত এবং বাংলাদেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। এ আলোড়নের বাহ্যরূপ ধর্ম ও সংস্কৃতির সমন্বয় প্রচেষ্টা। উদ্ভব হয়েছিল সন্ত-ধর্ম, ভক্তি-ধর্ম, শিখ-ধর্ম, বৈষ্ণব-ধর্ম ও শৈব-ধর্ম।

বাংলার বাউল মতবাদের বীজ নিহিত ছিল এসব ধর্মের মধ্যেই। ডক্টর আহমদ শরীফের মতে, উত্তর ভারতের ভক্তি-ধর্ম, দক্ষিণ ভারতের সন্ত-ধর্ম (সন্ন্যাস-ধর্ম) আর বাংলার বৈষ্ণব ও বাউল মতবাদ সূফী মতবাদের প্রত্যক্ষ ফল। কোনো কোনো গবেষক শ্রী চৈতন্যদেবকেই বাংলার বাউল সমাজের আদি গুরু বলে অভিহিত করেছেন। কারো মতে, বাউল মতবাদের ভ্রƒণ জন্মেছিল বাংলার বৌদ্ধ জনসমাজে। ব্রজযানী বৌদ্ধসহজিয়ারাই বাংলার আদি বাউল।

যাই হোক, নানা পথে নানা ভাব-বিশ্বাসের সংঘাতে ও সমন্বয়ে সতের শতকের দ্বিতীয় পাদ থেকে শুরু করে চলতে চলতে উনবিংশ শতাব্দীতে বাউল মত একটি আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র্য নিয়ে আবির্ভ ূত হয়। বাউল শব্দের উৎস নিয়ে বহু মত থাকলেও অধিকাংশ গবেষকের মত, সংস্কৃত ‘বাতুল’ শব্দ থেকেই বাউল কথাটি এসেছে যার অর্থ উন্মাদ, পাগল বা সমাজ-বিচ্যুত। অর্থাৎ তৎকালীণ হিন্দু সম্প্রদায়ের চোখে বাউলরা ছিলেন সমাজ-পরিত্যক্ত। আর মুসলমান সমাজে আঠার শতকের শেষ দিকে ওয়াহাবী ও ফারায়েজী আন্দোলনের প্রাবল্য তৈরি হয়, যার মূল কথা ছিল মুসলমানরা ধর্মের মূল থেকে বিচ্যুত হয়েছে, ফলে তাদের ধর্মমূলে স্থাপন করতে হবে। এই উভয় সম্প্রদায়সহ কট্টর মুসলমানদের বিশেষত কাঠমোল্লাদের চোখে বাউলরা ছিলেন ‘বে-শরা ফকির’।

অর্থাৎ শরিয়ত অনুযায়ী বিশ্বাস ও ধর্মাচার এরা করেন না। এ থেকে বোঝা যায়, প্রচলিত সমাজব্যবস্থা ও ধর্মমতের উপেক্ষা এবং বিরুদ্ধতার মাঝেই বাউল মতবাদ তার রসদ সংগ্রহ করে বিকশিত হয়েছে। আর বিকশিত হতে পেরেছে এ কারণে যে প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অত্যন্ত নীরবে হলেও এ ছিল এক ধরনের বিদ্রোহ। বাউল মতবাদের বিশ্বাসগত ও সাধন পদ্ধতিগত দুটি দিক রয়েছে। একেশ্বরবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত বাউল মতবাদে স্রষ্টা বা আল্লাহকে সৃষ্টি থেকে পৃথক কোনো অস্তিত্ব হিসাবে ভাবা হয় না।

সূফী মতবাদে বলা হয়, ‘সবই আল্লাহ’ এবং ‘আল্লাহই সব’। বাউলরা এ ভাবটিকে গ্রহণ করে মানুষ ও সৃষ্টিকর্তাকে অভেদ এবং অবিচ্ছিন্ন বলে বিশ্বাস করেন, অনেকটা মনসুর হাল্লাজের ‘আনাল হক’ বা ’আমিই খোদা’-তত্ত্বের কাছাকাছি। বাউলরা গুরুবাদী। তারা মনে করেন আনুষ্ঠানিক ধর্মাচারের মধ্যে প্রকৃত সত্য লাভ করা যায় না। মানবদেহকে বাউলরা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।

তাদের মতে, যা আছে ব্রহ্মান্ডে তা আছে দেহভান্ডে তাদের বিশ্বাস, দেহের এই খাঁচার ভিতরেই পরম-পুরুষ বাস করেন। দেহস্থিত আত্মা পরমাত্মারই খ-িত অংশ, আর আত্মাকেই বাউলরা ‘মনের মানুষ’ বলে মনে করেন। দেহের মধ্য দিয়ে আত্মার সাথে পরমাত্মার মিলনের লক্ষ্যেই বাউলদের সাধনা। আর তাই সাধনার দিক থেকে বাউলরা সম্পূর্ণভাবে দেহাত্মবাদী। এই দেহবাদীতার কারণেও বাউলরা অধিকতর মানবতাবাদী।

একদিক থেকে বাউলদের সাধনা নারী-পুরুষের যৌথ সাধনা। বাউলদের সাধনসঙ্গী রাখার বিধানটি এখান থেকেই এসেছে। এছাড়া বাউলরা অগৃহী এবং ভিক্ষাজীবী। লালনের সমসাময়িক অসংখ্য বাউল-সাধক-বৈষ্ণব গান রচনা করেছেন। কিন্তু তাঁদের অধিকাংশের গানই ইতিহাসের স্রোতে টিকে থাকতে পারেনি।

এর কারণ হল, অপরাপর বাউল-বৈষ্ণবদের অধিকাংশ গানই ছিল দুর্বোধ্য। বিপরীতে লালনের গানের বাণী ছিল সহজবোধ্য, সাহিত্য গুণযুক্ত এবং তার গানের সুরও ছিল সহজ-সরল। এক অপূর্ব সাঙ্গীতিক বৈশিষ্ট্য লালন রচনায় বিদ্যমান। তাঁর গানের সুর-মাধুর্য, গায়ন-রীতি, উপস্থাপন পদ্ধতি এবং মর্মস্পর্শী আবেদন সকল শ্রেণীর শ্রোতার হৃদয় ছুঁয়ে যায়। বাউল সুর, পদাবলী ভাব, শাক্তগীতির ব্যঞ্জনা, ধূয়াগানের আমেজ এবং অন্যান্য লোকগীতির মূর্ছনা লালন সঙ্গীতে প্রাণ-সঞ্চার করে তাকে অমরত্বের বর দিয়েছে।

সুর ও বাণীর সমন্বয়ে লালনের গানের ক্ষুরধার আবেদন শ্রোতার কানের ভিতর দিয়ে মর্মে প্রবেশ করে। সাঙ্গীতিক বৈশিষ্ট্যে মূল্যবান বিধায় সুরের মাধুর্যে, বাণীর আকর্ষণে, ভাবের অভিব্যঞ্জনায় লালন-সঙ্গীত কৃষক-শ্রমিক, মাঝি-মাল্লা, ফকির-বৈষ্ণব, শিল্পী-সাহিত্যিক, সুরকার-গীতিকার নির্বিশেষে সব শ্রেণীর শ্রোতাকে একইভাবে আকৃষ্ট করতে পেরেছে। এখন গানের বহু শাখা ্রশাখা ছড়িয়েছে। কিন্তু লালনের গান যেমন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের শ্রোতাকেও আকৃষ্ট করে, তেমনি করে আধুনিক গানের শ্রোতাকেও। বাউল গবেষক উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের ভাষায়, “সবদিক দিয়ে বিবেচনা করিলে বাউল গান রচয়িতা হিসাবে মুসলমান বাউল লালন ফকিরই সর্বশ্রেষ্ঠ।

মূল তত্ত্বজ্ঞতা, সাধনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতালব্ধ দিব্যদৃষ্টি, বৈষ্ণবশাস্ত্র ও সূফীতত্ত্ব সম্বন্ধীয় জ্ঞান, বক্তব্য ও ইঙ্গিত ব্যঞ্জনাময় করিয়া বলিবার কৌশল, সহজ কবিত্ব শক্তি প্রভৃতিতে তাঁহার গানগুলি বাংলা সাহিত্যের একটি সম্পদ। ... ... সুর-সংযোগে অভিব্যক্ত তাঁহার গানের অকৃত্রিম আবেগের মধ্যে একটা অনির্বচনীয়ত্বের বিদ্যুৎ খেলিয়া গিয়া আমাদের চিত্তকে অপূর্ব ভাবলোকে যেন উত্তীর্ণ করিয়া দেয়। ... এক একটি ভাব যেন ফুলের মতো ফুটিয়া উঠিয়াছে। ” লালনের গানের সুর মূলত ঢপ কীর্তনের সুর। তাঁর গানে পূর্বসুরী বৈষ্ণব পদাবলী ও শাক্তগীতির প্রভাব বেশ প্রবল।

লালনের ঠিক অব্যবহিত পূর্বে চৈতন্যদেব ভক্তিরসের আবেগে নদীয়া তথা গোটা বাংলায় ভাবের জোয়ার বইয়ে দিয়েছিলেন। চৈতন্যদেবের ভক্তিবাদ আসলে হিন্দু সমাজে জাতিভেদ প্রথা এবং উচ্চবর্ণের যথেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে একটি তীব্র সামাজিক আন্দোলন। তাঁর এই আন্দোলন প্রেম ও ভক্তির শক্তিতে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ বিলুপ্ত করার কথা ঘোষণা করেছিল। ধারণা করা হয়, দেশ ভ্রমণকালে লালন শ্রী চৈতন্যদেবের কর্মক্ষেত্র নবদ্বীপ বা নদীয়া এবং অন্যান্য তীর্থস্থান দর্শন করেছিলেন এবং পদাবলী কীর্তন ও শাক্তগীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাই পরবর্তীকালে লালন শ্রদ্ধার সাথে তাঁকে স্মরণ করছেন, “গৌর কি আইন আনিলে নদীয়ায়/ ... ধর্মাধর্ম বলিতে/ কিছু মাত্র নাই তাতে/ প্রেমের গান গায়।

/ জাতের বোল রাখলে না সে তো/ করলে একাকারময়। ” একইভাবে উত্তর ভারতের ভক্ত-সাধক কবীর ও রামদাস সম্পর্কে লালন তাঁর শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন গানে, “ভক্ত কবীর জেতে জালা,/ প্রেম ভক্তিতে মাতোয়ারা,/ ধরেছে সেই ব্রজের কালা/ দিয়ে সর্বস্ব ধন তার। / রামদাস মুচি এই ভবের পরে/ পেলো রতন ভক্তির জোরে,/ তার স্বর্গে সদাই ঘণ্টা পড়ে,/ সাধুর মুখে শুনতে পাই। ” শুধু সুর নয়, লালনের গান ছন্দের শক্তিতেও ছিল অনন্য। সাহিত্যবিজ্ঞানে একে মাত্রাবৃত্ত ছন্দ বলা হয়।

এ ছন্দ বাংলার লৌকিক ছন্দ। লালনের গানে বাংলার লৌকিক এ ছন্দের খেলা দেখে রবীন্দ্রনাথ বিমোহিত হয়েছেন। বলাকাকাব্যে তিনি এ ছন্দের ব্যবহার করেছেন। এ ছন্দের বৈশিষ্ট্য হল এর চরণগুলো ছোট-বড় করে ঝরণাধারার সাবলিল বেগে বয়ে চলে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ছন্দ’ গ্রন্থে বাংলা ছন্দের প্রকৃতি বোঝাতে গিয়ে একটি মাত্র উদাহরণ টেনেছেন নিজের কবিতা থেকে, আর সবগুলি উদাহরণ দিয়েছেন লালনের গান থেকে।

রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “এ ছন্দের ভঙ্গী একঘেয়ে নয়, নানাভাবে বাঁকে বাঁকে চলেছে। সাধু প্রসাধনে মেজেঘষে এর শোভা বাড়ানো চলে, আশা করি এমন কথা বলবার সাহস হবে না কারো। ” বাউলদের গানে সূফীতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব, আত্মতত্ত্ব, মনতত্ত্ব, সাধনতত্ত্ব, পরমাত্মা, রূপ-স্বরূপ-তত্ত্ব ইত্যাদি বহু তত্ত্বকথা ও কথার মার-প্যাঁচ ছড়িয়ে থাকে। এসব কথা সাধারণ শ্রোতার বোঝার কথা নয়। দেড়-দুইশ বছর আগে রচিত লালনের গানেও এসব আছে।

কিন্তু তারপরও কেন লালনের গান আমাদের মনকে দোলা দেয়? এর একটি কারণ তাঁর গানের সাঙ্গীতিক শক্তি, এ সম্পর্কে আগেই বলা হয়েছে। কিন্তু শুধু সুরের-ছন্দের গুণেই লালন কালের সীমা অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছেন তা নয়। তার বাইরে আরো একটি শক্তি লালনের গানকে আমাদের কালের উপযোগিতা দিয়েছে। তা হল লালনের জীবন-জিজ্ঞাসা, সমাজ-জিজ্ঞাসা যা আজও প্রাসঙ্গিক। সমাজের ভেদাভেদ, গর্ব-অহঙ্কার, বর্ণ-বৈষম্য, হীনমন্যতা, অমানবিক আচরণ লালন-মানসে দারুণ ক্ষোভের সঞ্চার করেছিল।

আর সেটাই তিনি প্রকাশ করেছেন তাঁর গানে। লালন সেদিন সমাজের যে সব ত্রুটির দিকে, মানব চরিত্রের যে সব অসঙ্গতির দিকে আঙ্গুলি নির্দেশ করেছিলেন তা আজও বিদ্যমান। আর তাই আজকের দিনে সমাজমনষ্ক যে কোনো মানুষকে লালনের গান আকৃষ্ট করে, শক্তি দেয়। ধর্মের নামে ভ-ামীর দিকে আঙুল তুলে লালন বলছেন, “ভিতরে লালসার থলি/ উপরে জল ঢালাঢালি/ লালন কয় মন-মুসল্লি/ আসল তোর হয় না মনে। ” অন্যত্র বলছেন, “গাঁজায় দম চড়িয়ে মনা/ বোমকালী আর বলিও না রে।

” আবার তিনি বলছেন, “এসব দেখি কানার হাটবাজার/ বেদ বিধির পর শাস্ত্র কানা/ আরেক কানা মন আমার/ ... প-িত কানা অহঙ্কারে/ সাধু কানা অনবিচারে/ মোড়ল কানা চুকলখোরে/ আন্দাজী এক খুঁটি গেড়ে/ চেনে না সীমানা কার। ” বোঝাই যায়, ধর্ম-ব্যবসায়ী, বিদ্যা-ব্যবসায়ী এবং সমাজপতিদের কী প্রবল ঘৃণায় তিনি আক্রমণ করেছেন এ গানে। প্রত্যক্ষ শ্রেণী-শোষণের ইঙ্গিতও তাঁর গানে পাওয়া যায় Ñ “রাজ্যেশ্বর রাজা যিনি/ চোরেরও সে শিরোমণি,/ নালিশ করিব আমি/ কোনখানে কার নিকটে। / গেল গেল ধন, মালও নামায়,/ খালি ঘর দেখি জমায়,/ লালন কয়, খাজনার দায়/ তাও কবে যায় লাটে। ” শোনা যায়, কাঙাল হরিণাথ মজুমদার তাঁর ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ পত্রিকায় জমিদারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে খবর প্রকাশ করায় স্থানীয় জমিদার হরিণাথকে শায়েস্তা করতে লাঠিয়াল বাহিনী পাঠিয়েছিল।

ওই সময় লালন তাঁর ভক্ত-শিষ্যদের নিয়ে জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনীর মুখোমুখী দাঁড়িয়ে কাঙাল হরিণাথকে নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। লালনের বিচার শক্তি কতটা তীব্র এবং প্রখর ছিল তা বোঝা যায় যখন তিনি বলেন, “পাপ-পুণ্যের কথা আমি কারে বা সুধাই/ এক দেশে যা পাপ গণ্য, অন্য দেশে পুণ্য তাই। / ... দেশ-সমস্যা অনুসারে/ ভিন্ন বিধান হতে পারে/ লালন বলে বিচার করলে/ পাপ-পুণ্যের নাহি বালাই। ” পাপ-পুণ্য, ভাল-মন্দ বিষয়গুলো যে সমাজের বিশেষ অবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত এ জ্ঞান ইতিহাসের বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর নমুনা। লালনের অন্য একটি গানে আছে, “বাংলা কেতাব দশজনে পড়ে/ আরবী পারসী নাগরী বুলি/ কে বুঝতে পারে?/ যদি শিখতে চাও ইংরেজি বুলি/ আগে বাংলাখান লও পাশ করে।

” এখানেও তাঁর বাস্তবতাবোধ তীব্রভাবে ফুটে উঠেছে। ভক্তদের উদ্দেশে লালনের আকুল আহ্বান Ñ “সময় গেলে সাধন হবে না”। সময়ের কাজ সময়ে করতে হবে এটাই লালনের দীক্ষা। সাধনার পথে প্রধান অন্তরায় মনের দোদুল্যমানতা ও দুর্বলতা Ñ “আপন মনের বাঘে যারে খায়/ বল কোনখানে পালালে বাঁচা যায়?” এই সাধনে কোনো ফাঁকির কারবারও চলবে না, নিষ্ঠা ও একাগ্রতা লাগবে Ñ “ভাবলিনে মন কোথা সে ধন/ ভাজলি বেগুণ পরের তেলে/ গুণে পড়ে সারলি দফা/ করলি রফা গোলেমালে। / করলি বহু পড়াশোনা/ কামে কাজে ঝলসে কানা/ কথায় তো চিড়ে ভেজে না/ জল কিংবা দুধ না দিলে।

” তিনি সুবিধাবাদী মনোভাবের প্রতি কটাক্ষ করছেন, “মন সহজে কি সই হবা/ চিরদিন ইচ্ছা মনের আল ডেঙায়ে ঘাস খাবা”। আর তাই ফাঁকি দিয়ে “আল ডেঙায়ে খাস না খেয়ে” নিতে বলছেন “আপন ঘরের খবর”। কারণ “আপনারে চিনলে যাবে অচেনারে চেনা”। বাউল-তত্ত্বে আপন ঘর বলতে মানবদেহকে বুঝায়। কিন্তু আজকের দিনের নিজের দেহের খবরের জন্য মানুষের ব্যাকুল হওয়ার আর প্রয়োজন নেই, তার প্রয়োজন নিজের সমাজ, দেশ ও রাষ্ট্রের খবর নেওয়া এবং তার মাধ্যমে নিজেকে চেনা।

বিষয় পাল্টে গেলেও অনুসন্ধানের যে আকুলতা লালন জাগিয়েছেন তা আজও বিদ্যমান। সমাজের জাতপাতের বিভেদ তাঁকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। আর তাই তিনি প্রবলভাবে আক্রমণ করেছেন সেই বিভেদকে Ñ “সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে/ লালন বলে জাতের কি রূপ দেখলাম না দুই নজরে। ” জাতিভেদের বিষয়টি তিনি বিচার করেছেন বাস্তবজ্ঞান দিয়ে, কা-জ্ঞান দিয়ে Ñ “আসবার কালে কি জাত ছিলে/ এসে তুমি কি জাত নিলে/ কি জাত হবা যাবার কালে/ সে কথা ভেবে বল না। ” অন্যত্র প্রশ্ন তুলেছেন, “কেউ মালা কেউ তসবী গলে/ তাইতে কি জাত ভিন্ন বলে/আসা কিংবা যাওয়ার কালে/ জাতির চিহ্ন রয় কারে।

” অথবা “যদি সুন্নত দিলে হয় মুসলমান/ নারী লোকের কি হয় বিধান/ বামন চিনি পৈতায় প্রমাণ/ বামনী চিনি কিসে রে। ” এবং এই জাত নিয়ে ঘটে চলা কু-আচার মানুষকেও নিচে নামিয়ে দিচ্ছে, “জাত গেল জাত গেল বলে একি আজব কারখানা/ সত্য কাজে কেউ নয় রাজি সবই দেখি তানা না না। ” আর তাই সক্ষোভে লালন বলছেন, “লালন কয় জাত হাতে পেলে/ পুড়াতাম তা আগুন দিয়ে। ” তাঁর ঐকান্তিক আকাক্সক্ষা, “এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে/ যেদিন হিন্দু-মুসলমান বৌদ্ধ-খ্রীস্টান/ জাতি গোত্র নাহি রবে। / শোনায়ে লোভের বুলি/ নেবে না কাঁধের ঝুলি/ ইতর আতরাফ বলি/ দুরে ঠেলে না দেবে।

” এই মানবতাবাদী আকাক্সক্ষাই পরবর্তীকালে কবি নজরুলের কণ্ঠে ‘সাম্যের গান’ হয়ে ধ্বনিত হয়েছে, “জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াত খেলছ জুয়া/ ... যাক না সে জাত জাহান্নামে/ রইবে মানুষ নেই পরোয়া। ” ধর্মের বাড়াবাড়ি আর শাস্ত্রবিচারের কড়াকড়িকে লালন মোটেই মেনে নেননি। আর তাইতো ধর্মান্ধদের উদ্দেশে তাঁর উক্তি, “পড়গা নামাজ জেনে শুনে/ নিয়ত বাধগে মানুষ-মক্কা পানে। ” শাস্ত্র যে অন্ধ এবং মানুষের তৈরি এমন কথাও তিনি বলেছেন অবলীলায়, “আল্লা হরি ভজন-পূজন/ সকলি মানুষের সৃজন। ” আরেকটি গানে আছে, “মাটির ঢিবি, কাঠের ছবি/ ভূত ভাবে সব দেবাদেবী/ ভোলে না সে এসব রূপি/ ও যে মানুষ-রতন পেলে।

” স্রষ্টার অস্তিত্বও লালন-মানসে মানুষের সাথে একাকার Ñ “যে যা ভাবে সেই রূপ সে হয়/ রাম রহিম করিম কালা এক আজ্ঞা জগৎময়। ” স্রষ্টা যেহেতু সৃষ্টির বাইরে অন্য কোথাও অবস্থান করেন না, তাই অপার্থিব অলৌকিক শক্তির অনুসন্ধান বাউলরা করতেন না। মানুষই জগতের সার, লালনের ভাষায় Ñ “কলি যুগে হয় মানুষ অবতার। ” ধর্মের বিধান বা বেহেস্ত-স্বর্গের লোভ যে একরকম প্রতারণার শামিল তিনি সে কথাও বলছেন Ñ “থাকে ভেস্তের আশায় মমিনগণ,/ হিন্দুরা দেয় স্বর্গেতে মন,/ ভেস্ত-স্বর্গ ফাটক সমাজ/ কার বা ভাল লাগে। ” আর পরকালের বেহেস্তের লোভে কি ধর্মবিশ্বাসীরা জগতের ভোগ-বিলাস থেকে দূরে সরে থাকে? লালন বলছেন, “শুনি মলে পাবে বেহেস্তখানা/ আসলে তো মন মানে না/ বাকির লোভে নগদ পাওনা/ কে ছাড়ে ভুবনে?” পরকালে কি হবে তা লালনের বিচারের বিষয় নয়, তাঁর মতে এই পৃথিবীই মানুষের কর্ম এবং সাধনার ফল Ñ “এমন মানব জনম আর কি হবে/ মন যা কর ত্বরায় কর এই ভবে।

” কারণ “মরিলে সব হবে মাটি”। কিন্তু তাই বলে জীবন যথেচ্ছ ভোগের বা যা খুশি তাই করার জন্য নয়, তাঁর আকুতি, “সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন। ” ধর্মশাস্ত্র দিয়ে লালন জীবন পরিচালনা না করলেও হিন্দু-মুসলমানের বিশ্বাস-ভক্তি-ভালবাসা সবই তাঁর গানে উঠে এসেছে। একদিকে বলছেন, “এ গোকুলে শ্যামের প্রেমে/ কে বা না মজেছে সখী। / কারো কথা কেউ বলে না/ আমি একা হয় কলঙ্কী”, “সেই কালাচাঁদ নদেয় এসেছে/ ওসে বাজিয়ে বাঁশি ফিরছে সদায়/ কূলবতীর কুলনাশে।

” আবার অন্যদিকে বলছেন, “নবী না মানে যারা/ মোয়াহেদ কাফের তারা”, অথবা “নবী না চিনলে সেকি খোদার ভেদ পায়। ” তাঁর গান যেন হিন্দু-মুসলমানের এক মিলন-তীর্থ। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “বাউল সাহিত্যে বাউল সম্প্রদায়ের সত্যের মধ্যে মিলনের সাধনা দেখি, এ জিনিস হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই, একত্র হয়েছে অথচ কেউ কাউকে আঘাত করেনি। এই মিলনে সভাসমিতির প্রতিষ্ঠা হয় নি, এই মিলনে গান জেগেছে, সেই গানের ভাষা ও সুর অশিক্ষিত মাধুর্যে সরস। এই গানের ভাষায় ও সুরে হিন্দু-মুসলমানের কণ্ঠ মিলেছে, কোরান-পুরাণে ঝগড়া বাঁধেনি।

এই মিলনেই ভারতের সভ্যতার সত্য পরিচয়, বিবাদে বিরোধে বর্বরতা। বাংলাদেশের গ্রামের গভীরচিত্তে উচ্চ সভ্যতার প্রেরণা স্কুল-কলেজের অগোচরে আপনি-আপনি কি রকম কাজ করে এসেছে Ñ হিন্দু-মুসলমানের জন্য এক আসন রচনার চেষ্টা করেছে, এই বাউল-গানে তারই পরিচয় পাওয়া যায়। ” বাউল গবেষক বিশ্বভারতীর উপাচার্য ক্ষিতিমোহন সেনের ভাষায়, “লালনের বিশাল প্রতিভা ছিল, ... তাঁহার সাধনাতে দুই ধর্মেরই যোগ দেখা যায় ...। ” লালন কোন্ ধর্মে জন্মেছিলেন, কোন্ ধর্মে লালিত-পালিত হয়েছেন, তার চেয়ে বড় কথা তিনি ধর্মের সীমা ডিঙিয়ে মানবতার রসে নিজে সিক্ত হয়েছেন, তাঁর গানের শ্রোতাদেরও সিক্ত করেছেন। সমকালে লালনের ধর্ম পরিচয় নিয়ে বিতর্ক হয়েছে, কিন্তু তিনি নিজে সে বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকার চেষ্টা করেছেন।

লালন এবং তাঁর উদার প্রেমের বাণীকে সমকালের আলেমসমাজ সহজভাবে নিতে পারেনি। তাঁকে নাড়ার ফকির, তান্ত্রিক ইত্যাদি অভিহিত করা হয়েছে। বিশ শতকের গোড়ার দিকে ‘বাউল ধ্বংস ফতোয়া’ নামক এক বইতে বলা হয়েছে, “লালন সাহা আসলেই মুসলমান সমাজের কেউ নয়। সে মুসলমান নামের অন্তরালে হিন্দু সমাজের গুপ্তচর হিসেবে স্বল্পশিক্ষিত ও নিরক্ষর ধর্মপ্রাণ মুসলমানদেরকে বে-শরা গান-বাজনাও দ্বারা প্রতারিত করছে। ” কাঙাল হরিণাথের লেখা থেকে জানা যায়, ওই সময় কুষ্টিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের শরিয়তপন্থী আলেমদের সঙ্গে তাঁকে বাহাসে লিপ্ত হতে হয়েছে।

এক অখ- বিভেদহীন মানবসমাজের প্রতিচ্ছবি তাঁর হৃদয়ে লালিত ছিল। তাঁর সাধনার কেন্দ্রে ছিল মানুষ, বাউল সাধকদের ভাষায় এ হল ‘মানুষ-তত্ত্ব’। মনুষ্যত্বের শাশ্বত বাণী তুলে ধরে এক কবি বলেছিলেন Ñ “শুনহ মানু ষ ভাই/ সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই। ” সেই বাণীর প্রতিধ্বনী তুলে লালন বলছেন, “এই মানুষে আছে রে মন/ যারে বলে মানুষ রতন” কিংবা “মানুষ-তত্ত্ব সত্য হয় যার মনে/ সে কি অন্য তত্ত্ব মানে। ” আর তাই লালনের সিদ্ধান্ত : মানুষের সাধনাই আসল সাধনা Ñ “ভবে মানুষ-গুরু নিষ্ঠা যার/ সর্বসাধন সিদ্ধ হয় তার”, কিংবা “ভজ মানুষের চরণ দুটি/ নিত্য বস্তু পাবে খাঁটি/ মলে হবে সকল মাটি/ ত্বরায় লও সে ভেদ জেনে”।

আর এই সাধনার মাধ্যমেই পাওয়া যাবে খাঁটি মানুষ Ñ “সহজ মানুষ ভজে দেখনা রে মন দিব্য-জ্ঞানে/ পাবি রে অমূল্য-নিধি বর্তমানে। ” অনেকের মতে, লালনের কণ্ঠে উচ্চারিত এই মানবতাবাদ ঠিক সেক্যুলার বা ইহজাগতিক নয়, স্পিরিচুয়াল মানবতাবাদ। কথাটা তর্ক-সাপেক্ষ। তবে মানবতাবাদ-সংক্রান্ত এ বিতর্ক বুঝতে হলে ইতিহাসের ওই বিশেষ সন্ধিক্ষণের দিকে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে যে সময়টাতে লালন তাঁর সঙ্গীত সাধনা করেছেন। লালনের জন্মের অব্যবহিত পূর্বে সংঘটিত হয়েছে সিপাহী বিদ্রোহ।

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ভারতবর্ষের শাসনভার চলে গেছে রানী ভিক্টোরিয়ার হাতে। ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এবং ১৮২০ সালে রায়তারী বন্দোবস্তের মধ্য দিয়ে ভূমির ওপর গ্রামের যৌথ মালিকানার ভিত্তি ধ্বংস করে ভূমিকে ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করেছে। জমি পরিণত হয়েছে ক্রয়-বিক্রয় এবং বন্ধকী পণ্যে। সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় শিল্পপণ্যের প্রসার ঘটছে। সব মিলে তখন বাংলায় তথা ভারতের সমাজে একটা ভাঙনের কাল চলছে।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কুফল, জমিদারী শোষণ ও অত্যাচার, জাতিভেদ-বর্ণপ্রথা, বর্ণহিন্দুর স্বেচ্ছাচারিতা সব মিলে গ্রামাঞ্চলে এক অরাজক প।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.