পড়ি, লিখি ও গান শুনি, আড্ডা দেই..
নীলার শৈশব কেটেছে প্রচন্ড দুরন্তপনায়। সারাদিন প্রজাপতির পিছনে ঘুরে বেড়ানো , লাটাই হাতে লাল-নীল ঘুড়ি নিয়ে ছুটাছুটি,তপ্ত দুপুরে ধুলাবালি উড়িয়ে মেঠো পথে চলা, গাঁয়ের সবচেয়ে উঁচু গাছটির মগডালে কাক-চিলের বাসায় বসে ডিম গোনা আবার কখনো কলাই ফুলের কোছা নিয়ে সবুজ প্রান্তর দাবিয়ে চষে বেড়ানো। ক্লান্ত দুপুরে দলবেঁধে ধরলায় লাফিয়ে পড়ে গোসল করে ভেজা কাপরে বাড়ি ফিরে মায়ের হাতে মার খাওয়া ছিল নিয়মিত ব্যাপার। তার এ সব অপকর্মের বরাবর সাথী ছিল সাজি, আফরোজা , রাজা ও আজাদ। কিন্তু অপরাধ চরমে উঠলে দায়ভার নিজে নিয়ে বিচারের কাঠগড়ায় সেই গিয়ে দাঁড়াতো ।
তাই সাথীরা তাকে যেমন ভালবাসতো তেমন বিশ্বাসও করতো।
বয়সটা তখন তার চৌদ্দ ও পনেরোর মাঝামাঝি। পড়ালেখায় খুব ভালো না হলেও নেহায়ত মন্দ ছিল না নীলা । রেডিওতে গান শুনতে, বই পড়তে ও কল্পনা করতে তার খুব ভালো লাগতো তখন। কিন্তু বাড়িতে পাঠ্য পুস্তুকের বাইরে কোন বই পড়াকে অপরাধ হিসাবে গন্য করা হতো।
গল্পের বই পড়তে গিয়া ধরা পড়লে তো ছোটখাট বিচার বসিয়ে শাসন করা হতো। নীলা বিচারের কোন তোয়াক্কা করতো না। আগে ধরা পরে তো বিচার! সে বন্ধু, আত্নীয় স্বজনদের কাছ থেকে বই এনে শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ের ভিতরে লুকিয়ে নিয়ে বসে শুয়ে পড়তো। সে সময় গ্রামের প্রতি বছর শীতকালের পুরো সময়টায় ক্লাবের আয়োজনে নানা মেলা বসতো। মেলায় মঞ্চনাটক, যাত্রাপালা, গান-নাচের নিয়মিত আয়োজনও ছিল।
নীলার বাড়ির পুব পাশের খেলার মাঠটিতে মঞ্চ করা হলেও এ বাড়ির কোন মানুষের এসবের কোন অনুষ্ঠানে যাওয়ার কোন অমুমতি ছিল না পরিবার থেকে। বরং বাড়ির আঙ্গিনার পুব দিকটায় উচু টিনের বেড়াদিয়ে ঘিরে দেয়া হতো। যাতে কাকপঙ্খীও দেখতে না পায়। গভীর রাতে যখন নাটকের আবেদনময়ী কোন সংলাপ ,কিংবা নুপুরের ঝঙ্কার টিনের বেড়া ফুড়ে নীলার কানের পর্দায় টোকা দিত সে ঘরের জানালার শিক গলিয়ে বেড়ার পাশের সুপার গাছে উঠে লাফিয়ে পাড় হয়ে চলে যেত মঞ্চের কাছে। অবশ্য এ কাজে তাকে সহয়োগীতা করতো সাইদা ভাবী।
সাইদা ভাবী আয়োজক কমিটির সদস্য কাদের ভাই এর স্ত্রী। তিনি প্রতিদিন রাতে মেলায় আসতেন। উদ্দেশ্য নাটক বা যাত্রা দেখা নয়। কাদের ভাইকে চোখে চোখে রাখা। কাদের ভাই যাত্রা বা নাটকের অভিনেত্রীদের রূপের প্রশংসা করেন ঘরে ফিরে।
তাই ভাবীর সঙ্কা হতো ভাইয়ের চরিত্রে। একবার তো স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা চলছে। পরদিন সকালে ইতিহাস পরীক্ষা রাতে সে যাত্রা দেখতে মঞ্চের প্রথম সারিতে বসেছিল। রাজিয়া সুলতানা যাত্রাপালা দেখতে দেখতে প্রায় ভোর হয়ে গেল। তখনও পালা শেষ হয়নি।
ঘুমে দুরু দুরু চোখে ঢলে পড়ল পাশের দর্শকের গায়ে। চোখ খুলেই তো ছানাবড়া ! ইতিহাস শিক্ষক কাসেম স্যারের গায়েই পড়েছিল সে। পরদিন স্কুলে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রটাও তার ছানাবড়া দেখিয়েছে। কাসেম স্যার কিন্তু মশকরা করে রাজিয়া সুলতানার গল্পটাই লিখতে বলেছিলেন সেদিন।
নীলা এ বয়সেই বেশ কিছু ছড়া,কবিতা,গল্প লিখে বন্ধুদের শুনিয়ে দিয়েছে ।
খোলা আকাশটার দিকে তাকিয়েই সে শুরু করে দিতো সাহিত্য লেখা । সহপাঠিরা কেউ তাকে পাগল বলে তিরস্কার করতো, কেউ কেউ একটু আধটু প্রশংসাও করতো। বানিয়ে বানিয়ে বলতে পারতো বলে সবাই বিস্মিত হতো তার কথায়। জবাবে সে দোদর্পে বলতো `সত্য তো সর্বদাই নীরব, কল্পনাই মুখরিত' । `সত্য ভাবস্রোতকে কল্পনায় চাপিয়ে রাখে আর কল্পনাই তার পথ মুক্ত করে দেয়'।
আবার কোন কোন বন্ধু তাকে দিয়ে নিজের জন্য প্রেমপত্রও লিখিয়ে নিতো। রাসেদা তার এক বান্ধবী । প্রেম করে গৃহশিক্ষকের সাথে। তাদের মাঝে যে চিঠিগুলোর আদান প্রদান হয়। সব বান্ধবী মিলে তা পড়ে চিঠির ভাষা নিয়ে অনেক হাসাহাসি করে।
একদিন রাসেদা নীলাকে তার হয়ে একটা চিঠি লিখতে বলে। সে এক পৃষ্ঠায় সুন্দর করে আকাশ,ফুল ও নদীর সাথে প্রেমের উপমা দিয়ে একটা চিঠি লিখে তার হাতে দেয়। চিঠিটি রাসেদা গৃহশিক্ষক প্রেমিককে না দিয়ে পাশের বাড়ির বড় ভাই কাজলের হাতে দেয়। কাজল ছেলেটি গ্রামের ক্লাবের সদস্য । সুন্দর গান জানে, অভিনয় জানে।
নীলা গান ভালবাসে জন্য তাকে দেখলে গাইতে শুরু করে কোন চুটুল গান। কেন যেন কাজলের গান ভাল লাগে না নীলার। তার চাহুনিটাও অসহ্য মনে হয় তার। সেই কাজল রাসেদাকে নীলার সাথে প্রেমের ঘটাকালী করতে বলে। রাসেদা কৌশলে তার প্রেমিকের জন্য চিঠি লিখে নিয়ে কাজলকে দেয়।
খুশিতে আত্মহারা হয়ে কাজল জবাবে অনেক অশ্লীল কথায় ভরপুর একটা পূর্ণদৈর্ঘ্য চিঠি লিখে নীলাকে পাঠায়। নীলা সেই চিঠির প্রতিটি শব্দের অর্থ বুঝতে পারেনি। তবুও ভাল না লাগায় সে কাগজটি বড় বোন রূপার হাতে দেয়। বড় বোন মাকে , মা বাবাকে। রাগে ক্ষোভে সাথে সাথে বাবা কাজলের বাড়িতে চলে যায়।
বাবার চিৎকারে কাজল নীলার হাতের লেখা চিঠিটা তার বাবার হাতে দিয়ে ক্ষমা চায়।
নীলার বাবা কাজলকে ক্ষমা করলেও নীলাকে ক্ষমা করতে পারে নাই।
পরদিন সকালে ঘটকের বাড়িতে গিয়ে হাজির।
এক সপ্তাহ কাটেনি। স্কুলে ছুটির পর সহপাঠি ছেলেমেয়েদের সাথে দল বেঁধে বাড়ি ফিরছিল নীলা।
পথে এক বান্ধবী শেফালী র কাছ থেকে মাসুদরানা সিরিজের ২য় খন্ড বইটি নিয়ে বন্ধু শরিফের সাথে কাড়াকাড়ি থেকে মারামারি। শরিফ ক্লাসে ফাস্ট হয় বরাবরে। সব সময় অনেক অহংকার থাকে তার চোখে-মুখে। তবে নীলাকে সে একটু সমীহ করে চলে। কিন্তু গল্পের বই দেখলে তার কোন হুস থাকে না।
নীলা আজ কিছুতেই তাকে দেবে না তাকে বইটা। মাসুদরানা প্রথম খন্ড পড়েছে সে অনেকদিন আগে। খোঁজাখুঁজির পর ২য় খন্ডের দেখা। আর তর সইছিল না তার। শরিফও নাছোড়বান্দা কম নয়।
অবশেষে নীলাই জিতে নিয়েছিল বইটা। বাড়িতে গিয়েই সে বইটি নিয়ে বসবে। কয়েক লাফে যেন সে স্কুলের ২ কি.মি. পথ পেরিয়ে বাড়ির উঠানে। বাড়ির বাইরে অনেক লোকজন বসে আছে। বেশ কিছু চেয়ার পাতানো ।
ভিতর থেকেও কোলাহল শোনা যাচ্ছে । কিছুটা থতমত খেলেও সোজা নিজের ঘরে গিয়ে ঢোকে সে। স্কুলের বই খাতা গুলো গুছিয়ে রেখে মাসুদরানার ২য় খন্ড টি লুকিয়ে ফেলে বালিশের নীচে। এর মধ্যে ঘরে ঢুকে যায় প্রায় সমবয়সী আন্জুখালা। তিনি নীলাকে বুঝায় তাকে দেখতে এসেছে দুর থেকে কিছু লোক।
পছন্দ হলে আজই পাকা কথা দিয়ে যাবে তারা। বর বি এ পাশ। সরকারী চাকুরি আছে। শান্ত , ভদ্র । বয়সটা কিছুটা বেশী।
তবে ছেলেমানুষের বয়স আবার কোন সমস্যা না।
নীলার আর মাসুদরানা ২য় খন্ড টি পড়া হয় নি। কোথায় গেছে বইটি তার হদিসও জানে না সে। হঠাৎ বিয়ে নামের কালবৈশাখী তার জীবনের সব স্বপ্ন ওলটপালট করে দেয় । সমাপ্তি ঘটে পায়ে বিয়ের বেড়ী পড়িয়ে।
সে দিন স্কুল থেকে ফিরেই তাকে বসতে হয়েছে বিয়ের পিঁড়িতে। গ্রামের আর দশটা মেয়ের মতো সাধারন না হওয়ার শাস্তি হিসেবে তার বিয়ে। পরিবারের অত্যন্ত রণশীলতা তাকে সেদিন ফুল হয়ে ফুটতে দেয়নি । তার কুমারী স্বপ্ন গুলো ক্রমে পুষ্টি হীনতায় বর্নহীন হয়ে পড়ে। নীলার বিয়ে হয়েছিল বিয়ের অর্থ বোঝার আগেই।
তাই কুড়িতেই ঝড়ে গিয়েছিল নীলা। পারিবারিক চাপে কোন প্রতিবাদ করার সামর্থ্য হয় নি । আকাঙ্খাগুলো হতে থাকে মেরুদন্ডহীন।
স্বামী চাকুরীজিবী। বয়স ও আচার-আচরনে দুইয়ের ব্যবধান স্পষ্ট।
সংসারে বাস্তবতাবাদী স্বামীটি দায়িত্ব পালনে তেমন ত্র“টি করে না। কিন্তু বিয়ের পর ইট কাঠের খাঁচায় বন্দিত্ব মেনে নিলেও পড়ালেখা Ÿন্ধ হওয়ার প্রতিবাদে নীলা সংসার ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্ঠা করে। যদিও ধরা পরে ব্যর্থ হয় সে প্রচেষ্ঠা। সে দিন আপোষ করে স্বামী নামের পুরুষটি শিকল আলগা করতে বাধ্য হয় । মুক্ত চিন্তার মানুষ না হলেও তার সব চেয়ে বড় উদারতা স্ত্রীকে স্বাধীনতা দিয়ে সমঝোতা ।
হয়তো তা ছিল স্বামীটির নিজেকে অনেকখানি নিয়ন্ত্রন মুক্ত রাখার কৌশল। বাকী সব কিছুতেই তার হিসেব-নিকেশ সূদ কষে । আবেগ অনুভুতির যেন কোন স্থান নেই সেখানে। স্বামীর পরিবারে আর কেউ না থাকায় ছোট্ট জীবনে সংসারের সমস্ত দায় চাপিয়ে দিয়ে স্বামী চলে কর্মস্থলে। সংসারের রসায়ন নীলার কল্পনার জগতকে স্থিমিত করে দেয়।
সমাজ ,পরিবার, আত্মীয়-স্বজন সব কিছু সামলিয়ে যুদ্ধ চলে তার নিজেকে তৈরী করার। কিশোরী বধুর দু,চোখের সর্ষেফুলে রংধুনুর রং তখনো আলো ছড়ায়। তার আবেগী মন আনন্দ-বেদনায় অনেক বেশী আলোড়িত হতে থাকে। কাছের মানুষটির সাথে মানষিক দুরত্ব থাকায় প্রবল একাকিত্ব ছায়া ফেলে রাখে শনি গ্রহের মতো। আর এই একাকিত্ব যেমন মানুষকে বাড়িয়ে দেয় তার গন্তব্যের কাছে আবার নিয়ে যায় আত্মহননে।
নীলার অবস্থান অনেকটা মাঝামাঝি বলে মনে করে সে। জোয়ার ভাটার মতো সাফল্য ও ব্যর্থতার টান অনুভব করে সে প্রতিনিয়ত। আর এই নিঃসঙ্গতার সুযোগ বুঝে উঁকি দেয় সুসময়ের কোকিলেরা। তারা ইঙ্গিত দিয়ে রঙিন জীবনের স্বপ্ন দেখাতে । কোকিলের যে নিজেরই কোন ঠিকানা নেই।
তারা সর্বদাই সুযোগ সন্ধানী, ঘুরে বেড়ায় শত দুয়ারে। বিশ্বাসঘাতক প্রকৃতি নীলাকে শিখেয়েছে সে কোকিলদের চরিত্র। তাই হাজারো মানুষের ভীড়ে সে বড় একা। শত ব্যস্ততায় তা দুর হয় না। (আরো আছে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।