এডিট করুন
জীবনের লক্ষ্য-১
জীবনের লক্ষ্য-২
আমি যখন থ্রি বা ফোরে পড়তাম তখন যদি কেঊ আমাকে জিজ্ঞাসা করত যে তোমার কখন সবচেয়ে ভাল লাগে? আমি নির্দ্বিধায় উত্তর দিতাম বৃহস্পতিবার। কারন ঐদিন ছিল আমাদের হাফ ক্লাস এবং তার পরদিনই ছুটি। আমি যে স্কুলটায় পড়তাম সেটা ছিল একটা কিন্ডারগার্ডেন। পড়াশোনা যাই হোক দৈনিকের পড়া দৈনিক আদায় করে নিতে সেই স্কুলটাতে শিক্ষক-শিক্ষিকারা কখনই কার্পন্য করতেন না। ছাত্র-ছাত্রীরা যাতে নিয়মিত পড়া শিখে আসে সে জন্য তারা অমনযোগী ছাত্র ছাত্রীদের কঠিন শাস্তি দিতেন।
সেই ছোটবেলাতেই আমরা বড় চাকরিজীবিদের থেকে কম চাপ সামলাতাম না। কোনদিন কোন পড়া তৈরী না হলে নিশ্চিত মারের সম্ভাবনা মাথায় নিয়ে আর খোদার কাছে দোয়া করতে করতে যেন "আপা" আজকে না আসেন, স্কুলে যেতাম। অনেকটা নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের মত। তাই বৃহস্পতিবার ছিল আমার আনন্দের দিন। কারন পরের দিন আমাকে কোন মৃত্যুর মুখোমুখি হতে না।
স্কুল ছুটির পর বন্ধু মুকুল, কামরুল বা বান্ধবী লতা বা সুমির সাথে কথা বলতে বলতে বড় রাস্তা পর্যন্ত যেতাম। বেশীরভাগ আলোচনাই হত বাংলা সিনেমা নিয়ে। রুবেল, মান্না কিভাবে ভিলেনকে শায়েস্তা করেছে তার বর্ণনা। বড় রাস্তা পার হয়ে যে যার বাসার দিকে চলে যেতাম। বাসায় গিয়ে সবার আগে ইত্তেফাকের "কড়চা" পাতাটা খুলতাম।
সব ছবিগুলি মনযোগ দিয়ে দেখতাম। ক্যাম্পাস পাতাটাও পড়তাম। নতুন মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলা সিনামার বিজ্ঞাপনগুলি দেখতাম। ভিতরের পাতাগুলোর খবর পড়তাম একটু একটু। তবে ভুলেও প্রথম পাতার খবর পড়তাম না।
ওগুলি কেন যেন আমাকে বিকর্ষন করত। ( আমি এই লেখাটা লিখছি আর আমার ছোটবেলার খন্ড খন্ড দৃশ্য ভেসে আসছে মাথায়। মস্তিস্ক আসলে কোন স্মৃতিই নষ্ট করে না। ) আর পড়তাম টারজান। সকালে বাসায় পত্রিকা আসার সাথে সাথেই বাবা প্রথম পাতাটা নিয়ে আমাকে ভেতরের সব পাতাগুলো দিয়ে দিত।
একবার ক্লাস টুতে পড়ার সময় আমার এক শিক্ষক আমাকে বলেছিলেন নিয়মিত পত্রিকা পড়তে। এতে নাকি জ্ঞান বাড়ে। তার উপদেশ মেনে আমি পরদিন সকালে স্কুলে যাবার আগে পত্রিকা পড়তে লাগলাম। ক্লাসে রিডিং পড়ার জন্য যেভাবে পড়তে হয় সেভাবে জোরে জোরে পড়ছি। পড়তেছিলাম স্বাস্থ পরিচর্যা পাতার একটা লেখা যা কিনা আমার মত শিশুর পক্ষে একেবারেই অনুপযোগী।
মা এসে আমার পড়া বন্ধ করে দিলেন আর জিজ্ঞাসা করলেন তুই হঠাৎ পেপার পড়ছিস কেন? আমি বললাম, স্যার পড়তে বলছে। মা বললেন পড়া লাগবে না, নাস্তা খা। আমি অবাক হলাম এই ভেবে যে স্যারেরা কিছু পড়তে দিলে যেখানে মা পারলে পিটিয়ে আমাকে সেটা পড়ায় সেখানে আমাকে পড়তে নিষেধ করছে। আজব দুনিয়া! পড়তে আবার কেঊ নিষেধ করে নাকি? সবাই বরং বলে পড় ,পড়। যে যত বেশী পড়ে সে তত ভাল ছেলে, সবাই তার তত বেশী প্রশংসা করে।
যাই হোক পড়ে কোন লাভ নেই। স্যার বলেছিলেন তাই পড়েছি। এখন যেহেতু মা নিষেধ করেছেন আর পড়া লাগবে না। স্যার জিজ্ঞাসা করলে মা'র কথা বলে দেব। প্রকৃতপক্ষে আমার পড়তে মোটেও ভাল লাগত না।
কারন আমার শিশুজীবনে পড়া ছিল এক ধরনের বিভীষিকা। পড়া মানেই কিছু প্রশ্নের উত্তর মুখস্ত করা। শুধু মুখস্ত করলেই হবে না বরং বইয়ে যেভাবে লেখা আছে সেভাবে মুখস্ত করতে হবে। যে যত বইয়ের মত করে হুবুহু লিখতে পারবে সে তত বেশী নাম্বার পাবে। ছিল অসুস্থ ফার্ষ্ট হওয়ার প্রতিযোগিতা।
আমাদের ক্লাসে সর্বনিম্ন নাম্বার ছিল ষাটের ঘরের নাম্বারগুলি। ৬৫/৬৬ এর নিচে কেঊ নাম্বার পেত না। ভাবতে পারেন যে শিক্ষকরা বেশী নাম্বার দিত। না তারা দিত না। তারা খাতার প্রতিটা শব্দ পড়ে পড়ে নাম্বার দিত।
প্রতি তিনটা বানান ভুলের জন্য এক নাম্বার কাটত। "এ জার্নি বাই বোট" রচনাটি "দ্যা নিউ ফাংশনাল ইংলিশ গ্রামার এন্ড কম্পোজিশন" বইটাতে যেভাবে লেখা আছে হুবুহু সেভাবে একটাও বানান ভুল না করে সুন্দর হাতের লেখা দিয়ে যে লিখতে পারবে সে ১৫/১৫ পাবে। যত লাইন কমবে আর বানান ভুল যাবে নাম্বার তত কমবে। আমাকে যদি এখনো টু, থ্রি বা ফোরের কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন আমি মনে করি আমি তার উত্তর দিতে পারব। চারদিকে শুধু মুখস্ত আর মুখস্ত।
এমনকি গনিতটাও মুখস্ত করতে হত। বোর্ড কর্তৃক পাঠ্য বই ছাড়াও আরো অতিরিক্ত কিছু বই ছিল। তার মধ্যে ছিল "ইংলিশ ওয়ার্ড বুক" (এখান থেকে প্রতিদিন ৫ টা বা ১০ টা ইংরেজী শব্দ শিখতে হত), "সাধারন জ্ঞানের ডায়েরী" ( এইটি একটি চরম বিভীষিকা, কারন এটার প্রশ্নের উত্তর মুখস্ত করার মত কঠিন আর কিছু নেই), জাপানী ভাষা শিক্ষার একটা বই ( আমাদের স্কুলটা ছিল একটা জাপানী স্বেচ্ছাসেবক সংস্থার অন্তর্ভুক্ত )। এর মধ্যে একদিন যুক্ত হল গনিত বিষয়ক কিছু ক্লাস নোট। বৃত্ত সম্পর্কিত বিভিন্ন সংজ্ঞা।
আচ্ছা আমরা ক্লাস থ্রির পোলাপান যাদের আপনারা বৃত্ত একে পর্যন্ত দেখাননি তারা ব্যস ব্যসার্ধ, জ্যা এইসব মুখস্ত করে কি করবে? দুইদিন পর ভুলে যাবে নয়ত বহুদিন পর তার ব্লগে লেখার খোরাক হিসেবে আপনাদের এই কাহিনী ব্যবহার হবে। মুখস্ত করতে আমার ভাল লাগত না। গনিত ভাল লাগত না, ইংরেজী ভাল লাগত না, পরিবেশ পরিচিতি সমাজ বা বিজ্ঞান কোনটাই ভাল লাগত না। ভাল লাগত শুধু বাংলা। কারন ঐটাই কিছু বুঝতাম।
নতুন বছরের বাংলা বই পাওয়া মাত্র প্রথম দুই দিনেই সব গল্প কবিতা পড়ে শেষ করে ফেলতাম। ক্লাসে "শব্দার্থ" পড়া দিত। এইখানেই লাগত ভেজাল। কারন আমি নিজের মত করে ব্যাখ্যা দিলে হবে না। বইয়ে যেটা লেখা আছে সেটা বলতে হবে।
এই যদি হয় অবস্থা একটা শিশুর শৈশবের তাহলে সৃজনশীল পদ্ধতি করে কোন লাভ নেই। কারন মরা গরু দিয়ে হাল চাষ হয় না। একটা শিশুর সৃজনশীলতা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ছোট থাকতেই গলা টিপে মেরে ফেলে। আমাদের শিশুদের আইনষ্টাইনের মত কোন আত্মীয় নেই যে কিনা তার হাতে কম্পাস তুলে দেবে, সমীকরনের সৌন্দর্য দেখাবে। সব বাবা মা ব্যাস্ত ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানাতে কিন্তু আইনষ্টাইন বানাতে কোন বাবা মাকে আমি আজ পর্যন্ত ব্যস্ত হতে দেখি নাই।
আমাদের বাবা মারা একগাদা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানাবেন, পত্রিকা পড়বেন আর বলবেন দেশটা রসাতলে গেল। আরে বোকার দল দেশ রসাতলে যাবে না তো কোথায় যাবে? একটা দেশের জন্য ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারদের মত দক্ষ কারিগরের সাথে সাথে কিছু সুপার পাওয়ার লাগে যারা রকেটের বুস্টারের মত কাজ করে। আর বুস্টার ছাড়া রকেট পক্ষে মুক্তিবেগ অর্জন করা সম্ভব না। তাই আমাদেরও মুক্তি নেই। যাই হোক আমি পড়াশোনা না করে ঘুরে বেড়ানোই বেশী পছন্দ করতাম।
গরু রচনা পড়ার থেকে মাঠে চরে বেড়ানো গরু আমার কাছে বেশী আকর্ষনীয় লাগত। একটা ছেলে যে গরু সম্পর্কে জানে, বাস্তবে সেটার গায়ে হাত দিয়েছে, গরুটার গলায় যখন সে চুলকিয়ে দিয়েছে গরুটা তখন আরামে চোখ বুজেছে, গরুকে নিজের হাতে খড় খাইয়েছে সে যদি তার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে রচনা লেখে সেটা বেশী ভাল নাকি ঐ "সোনামনিদের বাংলা ব্যাকরন ও রচনা" থেকে লেখা ভাল। ঘুরতে ঘুরতে আমি প্রতিদিন বাড়ি থেকে অনেক দূরে চলে যেতাম। পথেও ভয় পেতাম যদি কোন শিক্ষকের সাথে দেখা হয়ে যায়। কারন পরেরদিন স্কুলে পড়া না পারলে পেট ব্যাথার অজুহাত দেয়া যাবে না।
বলবে যে বিকেলে না পড়ে ঘুরেছ কেন? তবে হাটতে হাটতে একটা নির্দিষ্ট সীমার বাইরে চলে গেলে আর কোন ভয় থাকত না। মাটির রাস্তা দিয়ে হাটতে হাটতে কখনো কোন বাশের সাকোর কাছে চলে যেতাম। সাকো পার হয়ে আবার হাটতে থাকতাম উদ্দেশ্যহীন ভাবে। কোথায় যাচ্ছি জানিনা। প্রকৃতির সৌন্দর্যের মাঝে হারিয়ে যেতাম।
কখনো একটা খোলা প্রান্তরে বসে সীমানায় উদ্ভুত গাছের সারির উপর রৌদ্রের খেলা দেখতাম। সবুজের উপর যখন রোদ পড়ে চিক চিক করে সেটা হয়ে উঠে এক স্বর্গীয় সৌন্দর্য। হালকা বাতাস যখন দুরের বাশবনে এক শিরি শিরি শব্দ বুনে দিয়ে যায় তখন মনে হয় আর ঘরে ফিরে না গেলেও চলবে। ঝোপ ঝাড় জঙ্গলই বেশী আপন লাগে আমার কাছে। মনে হয় জীবনের জটিলতা থেকে মুক্তি পেলাম।
সেই বয়সেই আমি মুক্তি খুজতে থাকি। ভাল লাগে না লিলি আপা , ফরিদা আপা, শাহানাজ আপা। ভাল লাগে না সকালের ডিম রুটি, দুপুরের মায়ের জোর করে খাওয়ানো লাল শাকের ভিটামিন। ভাল লাগে না বাংলা, ইংরেজী, অংক, সমাজ, বিজ্ঞান, ধর্ম, সাধারন জ্ঞান। ভাল লাগে না সাদা সার্ট আর লাল প্যান্টের স্কুল ড্রেস, সাদা জুতা, সাদা মোজার আষ্টপৃষ্ঠে বাধা শৃংখলিত দুটি পা।
ভাল লাগে না হোম ওয়ার্ক, বাংলা হাতের লেখা, ইংরেজী হাতের লেখা, অংকের সমাধান। আমি মুক্তি চাই মুক্তি। আমি বাস করতে চাই কাঠাল গাছের ডালে। আমি আমার জগতে কোন দুশ্চিন্তা রাখব না। এখানে কোন হোম ওয়ার্কের অস্তিত্ত থাকবে না।
থাকবে না কোন স্কুল, পড়াশোনা। থাকবে শুধু অবিরাম ঝোপ জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো। থাকবে শুধু হাটতে হাটতে বিলের প্রায় শেষ মাথায় পৌছে যাবার পর যে কাঠের ব্রীজটা আছে সেখানে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দুপুর দেখা। আপনারা সে দুপুর দেখেননি। তবে আমি যাদেরই সেখানে দুপুর বেলা নিয়ে গিয়েছি তারাই হা করে সৌন্দর্য দেখেছে।
প্রকৃতি এক কোনায় তার এক ঝোপ জঙ্গলের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া বিলের কাঠের ব্রীজের চারপাশে একটা ছোটখাট স্বর্গ বানিয়ে রেখেছে। আমি সেই স্বর্গে বাস করতে চাই। আমি আমার দুপুরটা কাটাতে চাই ঐ কাঠের ব্রীজে। মুক্তি চাই মুক্তি। আমার লক্ষ্য এখন মুক্ত হওয়া।
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মুক্ত হওয়া। আমার আত্মা পচে যাচ্ছে, আমার শরীর মার খাচ্ছে প্রতিদিন। আমি প্রতিদিন কান ধরে বেঞ্চে দাঁড়িয়ে থাকছি। আমি এ অবস্থার অবসান চাই। আমার একমাত্র লক্ষ্য এখন মুক্তি।
জংলী বেলীর সৌন্দর্যে আমি জীবনের আসল মানে খুজে পেয়েছি। কদম ফুলে আমি পাচ্ছি সুস্থতার ঘ্রাণ। শিমুল ফুলে আমি দেখছি উচ্ছাস। আমাকে এখন আমার আসল জায়গায়, আমার খোলা প্রান্তরে যেতে হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।