আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

'চক্ষু তো এই দুইখান, আর কতো দেখাইবা...'



[উৎসর্গ : প্রিয় শওকত হোসেন মাসুমকে, যার চলে যাবার সুরটি একদমই ভালো লাগেনি আমার। ] 'হৈরব' নামে এক অসামান্য চরিত্র সৃষ্টি করেছিলেন মাহমুদুল হক, তাঁর 'হৈরব ও ভৈরব' গল্পে। বংশানুক্রমে ঢাকী সে; ঢাকঢোল তার জীবন ও জীবীকা। কিন্তু জীবনটা প্রায় অচল হয়ে পড়েছে, জীবীকাও হুমকির মুখে। একদিকে বয়সের ভার, অন্যদিকে সীমাহীন দারিদ্র।

যেন এক ব্যর্থ, ম্রিয়মাণ, নুইয়ে পড়া, জীবনের কাছে পরাজিত মানুষ সে। এবং স্মৃতিভারাক্রান্ত একসময় তাদের জীবনে ঔজ্জ্বল্য ছিলো- অন্তত সে তাই-ই মনে করে; তখন 'বাবু'রা ছিলেন, নানান পালাপার্বনে তাদের বাড়িতে হৈরবদের মতো আরও অনেক ঢাকীদের ডাক পড়তো- 'কয়কীর্তনের ঢাকীদের কি দাপটটাই না ছিলো একসময়, পালাপার্বনের আগে সারাদেশ থেকে বায়না করতে আসতো মানুষজন। বনেদি বাবুদের বাড়ি না হলে তারা বায়না ফিরিয়ে দিয়েছে কতোবার, সেই তারাই এখন ঋষিদাশদের সঙ্গে বাঁশ আর বেতের ঝুড়ি বুনে কোনোমতে নিজেদের পেট চালায়, চুরি ডাকাতি করে বেড়ায়। সময়ে কি না হয়; মাটিতে পড়া ডুমুর ,তার আবার গোমর কিসের। ' এখন আর সেই দিন নেই, বাবুরা দেশগাঁ ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছে ওই পাড়ে, সবকিছু ছেয়ে গেছে অভাব, দারিদ্র আর বেলেল্লাপনায়- এখন নবমীর রাতে পূজাকমিটির ছেলেছোকরারা 'খানকি' নাচাতে চায়।

হৈরব তাই পা বিছিয়ে কাঁদে, একা একা। স্মৃতির জাবর কাটে, কষ্ট সইতে না পেরে কখনো কখনো নিজের মৃত্যু কামনা করে। এই যখন জীবন- অভাব, দারিদ্রই যখন সার, অন্যের দয়া-দাক্ষিণ্যের ওপর ভরসা করে বেঁচে থাকা, চারদিকে কেবল ভাঙনের সুর, অতীতের সুখস্মৃতিচারণ ছাড়া আর কিছু নেই- তখন গনি মিয়ার কাছ থেকে ধার করা টাকা হৈরব শোধ করে কিভাবে? গনি মিয়া এসে টাকার জন্য চোটপাট করে, ভিটেবাড়ি বিক্রি করতে বলে, তার বিধবা বোন 'দয়া'র দিকে কুনজর ফেলে- যেন সবকিছু গিলে ফেলতে এসেছে। এ তার কঠোর বাস্তব জীবন বটে, কিন্তু সে যেন বাস করে বাস্তবাতিরিক্ত কোনো উচ্চতার জগতে। জনজীবনের মধ্যে যে প্রবহমান দার্শনিকতা, মাহমুদুল হক যেন এই দার্শনিক ঢাকির মধ্যে দিয়ে ধরতে চেয়েছেন।

যেমন, দারিদ্রক্লিষ্ট সংসারে বিধাব পিসি আর মায়ের কলহ দেখতে দেখতে ত্যক্ত-বিরক্ত ভৈরব ( হৈরবের ছেলে) যখন চেঁচায়, তখন ভৈরবের উক্তি : 'তরা যে কি হইলি, বুঝি না তগো। ঘর হইলো গিয়া তর বাগান, বাগানে পাখিরা তো চিক্কুর পারবই' শুধু জীবনযাপনেই নয়, 'বাজনা' নিয়েও তার আছে এক গভীর দার্শনিক ভাবনা- 'ঢাক বইলা কথা, ঢাকী বইলা কথা; যে নিকি নিজেরে বাজাইয়া থুইছে হ্যার কাছে যা দিবা হ্যা তাই বাজায়া দ্যাখাইবো। ... তরা বুঝছ না, হাত কি বাজাইব, বাজায় গিয়া মন; পেরথম নিজেরে বাজান শিখ, শ্যাষম্যাষ যা ধরছ হেই বাইজা উঠব'। ... 'যহন মনিষ্যি আছিলো না, তহন বাজনা আছিলো; পর্বত বাইজা উঠছে, জল বাইজা উঠছে, মাটি বাইজা উঠছে, ধরিত্রি বাইজা উঠছে, বাইজা উঠছে আকাশ। তারপর স্যান বাইজা উঠলো মনুষ্যজন্ম, বাইজা উঠলো মনুষ্যধর্ম, মানবজীবন...।

' যেন এক দারিদ্রপীড়িত ঢাকি নয়, এক দার্শনিকের কথা শুনছি আমরা। (ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেও এমন এক ঢাকির দেখা পেয়েছিলাম, যে বিশ্বাস করে- তার মৃদঙ্গ কথা বলে! একদিন আমাদেরকে সেই অভাবিত কথাবলা মৃদঙ্গ বাজিয়ে শুনিয়েছিল সে, আর আমরা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম!) শুধু কি তাই? ভাষাহীন-মূক প্রাকৃতিক অনুষঙ্গেরও ভাষা বোঝে হৈরব। যখন নিজের কাছে কাঁদতে বসে, এমন সব ভাবনায় সে আমাদের চমকিত করে, যে মনে হয়- কিছুই আর ভাষাহীন নয়, সবই যেন কথা বলে ওঠে তার কাছে। তার কান্নাটিও তাই হয়ে ওঠে ভীষণ তাৎপর্যময়- 'ঈশ্বর, ঈশ্বর আমারে তুইলা নাও-' হৈরব নিজের কাছে কাঁদবে বলে পা বিছিয়ে বসে। কতো কথা মনে পড়ে, মরে পড়ে সিরাজদিখাঁর সেই পাতক্ষীরের কথা, জিভে স্বাদ লেগে আছে এখনো।

মনে পড়ে রামপালের কলামুলোর কথা, গাদি ঘাটের কুমড়ো, আড়িয়লবিলের কই মাছ, কত কিছু। আতরপাড়ার সেই দই, আহারে সব গেল কোথায়। ...গোটাগ্রাম জুড়ে ছিল কদমের বন, বর্ষার নদী ধীরে মন্থর গতিতে ফেঁপে ফেঁপে উঠে শেষে কদমের বনে গিয়ে ইচ্ছে করে পথ হারিযে 'এ আমার কি হল গো' ভান ধরে ছেলেমানুষিতে মেতে উঠতো। এখন গ্রাম কি গ্রাম উজার; দেশলাইয়ের কারখানা গিলে ফেলেছে সবকিছু। কদমের সে বনও নেই, নদীর সেই ছেলেমানুষিও নেই; এখন ইচ্ছে হলো তো এক ধারসে সব ভাসিয়ে দিলো, সবকিছু ধ্বংস করে দিলো, 'আমি তোমাদের কে, আমার যা ইচ্ছে তাই করবো' ভাবখানা এমন।

কিন্তু এসব ভেবেই কি বসে থাকলে চলে? গনিমিয়া তার পাওনা টাকার তাগাদা দিতে আসে নিয়মিতই। 'দয়া'র জন্য সুবিধা করতে পারে না অবশ্য। অবশেষে 'দয়া'র রংঢংয়ের কাছে হেরে গিয়ে 'বাজনা' শুনতে চায়। হৈরবের ছেলে ভৈরব এবার বাপের মতো করেই ঢাকে আওয়াজ তোলে- 'যহন মনিষ্যি আছিলো না, তহন বাজনা আছিলো, পর্বত বাইজা উঠছে, জল বাইজা উঠছে, মাটি বাইজা উঠছে, ধরিত্রি বাইজা উঠছে, বাইজা উঠছে আকাশ বাইজা উঠছে মনুষ্যজন্ম, বাইজা উঠছে মনুষ্যধর্ম, বাইজা উঠছে মানবজীবন, ...বাবু হুনতাছেন? ঢাকে কেমনে কথা কইতাছে হুইনা দ্যাহেন। দশখুশি বাবু, চৌদ্দমাত্রা, মানবজীবন কথা কইতাছে বাবু! দশখুশি বাবু, চৌদ্দমাত্রা, মনুষ্যধর্ম বোল তুলতাছে, আখিজলে আখিজলে, টলমল টলমল, ধরাতর ধরাতল, রসাতল, হা' ঢাকের বাজনা নিছক বাজনা তো নয় ঢাকীদের কাছে, তাদের হাতে মানবজীবন বেজে ওঠে, বেজে ওঠে মনুষ্যধর্ম।

পাহাড় বাজে, ধরিত্রি বাজে, জল-মাটি-আকাশ বাজে। ভৈরবের এমনতর বাজনাতে গনি মিয়া ভয় পেয়ে যায়, কারণ ভৈরব যেন এখন আর ঢাক বাজাচ্ছে না, বাজাচ্ছে অন্য কিছু- 'ফিরান দিয়া বহেন,..দশখুশি বাজাই দ্যাহেন ক্যামনে, মাইনষের চামড়ার ছানিতে দ্যাহেন কেমুন বাজে...'- যেন স্বয়ং মানুষকেই বাজিয়ে চলেছে সে তার সমস্ত আক্রোশ মিটিয়ে। কিন্তু একসময়- 'গনি মিয়ার পিঠ নয়, পরিশ্রান্ত ভৈরব একসময় অবাক বিস্ময়ে দেখে এতোক্ষণ সে তার নিজের ঢাকের গায়েই সর্বশক্তি দিয়ে আঘাত হেনেছে; চামড়ার দেয়াল আর ছানি ফেঁসে গেছে, চুরচুর হয়ে ছিটকে পড়েছে টনটনে আমকাঠ, বেঘোরে নিজের ঢাকটাকেই চুরমার করেছে এতোক্ষণ। ' গল্পের মুখ ঘুরে যায় আবার। নিপীড়িত হৈরব বা ভৈরবদের হাতে ওই গনি মিয়াদের পিঠের চামড়ার দুরবস্থা দেখে যখন একটু খুশি হওয়ার কথা ভাববেন পাঠক তখনই লেখক দেখিয়ে দেন- গনি মিয়ার পিঠ নয়, ভৈরব নিজের ঢাকটারই বারোটা বাজিয়েছে এতোক্ষণ।

ইচ্ছে করলেই তো নিপীড়কদের পিঠের চামড়া তুলে নেওয়া সম্ভব নয়, ওটা শ্লোগানে সম্ভব, কিংবা সম্ভব তথাকথিত বিপ্লবী লেকখদের ইচ্ছেপূরণের গল্পে। মাহমুদুল হক শ্লোগানে বিশ্বাসী নন, বিপ্লবীও নন, তিনি কেবল মানুষের প্রকৃত রূপটি আবিষ্কার করতে চান। সমাজ-বাস্তবতার রূপ যারা খুঁজতে চান শিল্প-সাহিত্যে, তাদের জন্য সব ধরনের উপকরণ রেখে দিয়েও এই গল্পকে তিনি নিয়ে গেছেন শিল্পসফলতার তুঙ্গে। সকল বাস্তবতা বুঝেও আমাদের মন পড়ে থাকে হৈরবের অসামান্য দার্শনিকতার কাছে, মাহমুদুল হকের অপ্রতিদ্বন্দ্বী বর্ণনা আমাদেরকে ঘোরগ্রস্থ করে রাখে দিনের পর দিন- 'এক একবার বিস্তীর্ণ দুপুর ঝনঝন করে বেজে ওঠে। ঝলসানো গাছপালা মুখ নিচু করে আচ্ছন্নপ্রায় দাঁড়িয়ে থাকে।

এরই মাঝে এক একটি গন্ধ নেশার মতো জড়িয়ে ধরে হৈরবকে, সে বুঝতে পারে বৌনার ডালে ডালে এখন মঞ্জরি, কী আনন্দ, কী আনন্দ, ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি নামে। এক একটা গন্ধ এমন এক একটা স্মৃতি, যাতে নখের কোনো আঁচড় নেই, দাঁতের কোনো দাগ নেই, ছিমছাম, নির্ভার, অবিরল। কাঠালের মুচির গন্ধে হৈরবের বুক গুমরে ওঠে। টুনটুনি পাখি চিরকালই তার চোখে একটা আশ্চর্য প্রাণী, যেমন কাচকি মাছ; এই তো একফোঁটা অথচ এরাও কী স্বচ্ছন্দে বেঁচে থাকে, তাল মিলিয়ে বংশ বৃদ্ধি করে চলে। একটা টুনটুনি, যার ঠোঁটে তুলো, চোখে রাজ্যের বিস্ময়, আকন্দগাছের শাখায় দোল খেয়ে ফরফর করে একদিকে উড়ে যায়; হৈরবের মনে শিশিরের ছোঁয়ায় পদ্মকোরক শিরশির করে ওঠে, ঐ যে তিনি, তিনি নিরভিমান, তিনি নম্র, তিনি ব্যাকুল, তিনি বলেন আমি একফোঁটা, আমি তুচ্ছ, অতিতুচ্ছ।

... ঈশ্বর, ঈশ্বর আমারে তুইলা নাও- হৈরব নিজের কাছে কাঁদবে বলে পা বিছিয়ে বসে। কতো কথা মনে পড়ে... সবকিছু দেখে, সব কথা ভেবে হৈরব এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছায়, অনেক কিছু তার দেখা হয়ে গেছে, অনেক, অনেক, আর দরকার নেই তার দেখার- চক্ষু তো এই দুইখান, আর কতো দেখাইবা, ঈশ্বর, আমারে তুইল্লা নাও। ... জীবনের কি খাঁই, কতো কিছু তার চাই, আজ আর তার কোথাও বাঁশপাতার কোনো গন্ধ লেগে নেই, উইঢিপির গন্ধ নেই, এ্যাওলাশ্যাওলার গন্ধেও কতো আত্নীয়স্বজন, কতো পালাপার্বণ, কতো জন্মমৃতু্যর স্মৃতি ভুরভুর করেছে একসময়। জীবনের এখন গণ্ডা গণ্ডা মাথা, গণ্ডা গণ্ডা চোখ, হাত, নখ, দাঁত; রাবণ কোন ছার; জীবনের এখন সবকিছু চাই, কেবল ভালোবাসা ছাড়া, যতো কিছু আছে সব...। ঈশ্বর আমারে তুইলা নাও- গলায় আকন্দের মালা পরে 'হে বিরিক্ষ এ অধমের পেন্নাম লইবেননি, হে হনুমানসকল, আপনেরা খুশি থাকিলেই বিশ্ব সংসার লীলাময় হয়, 'আহা সরলতার কিবা দিব্যকান্তি, মরি মরি' আপন মনে এইসব বলে আর কেউ একা একা কেঁদে ফিরবো না দেবদারু বনে, আর কেউ চৌতালে, একতালায়, টেওটে, ত্রিতালে, ঝাঁপতালে, ঠুমরি ঠেকায় ঢাকে বর্ষাভর ডাহুকের ডাক বাজাবে না, ঈশ্বর হৈরবরে তুমি তুইলা নাও-' নিজেকে মাঝে মাঝে হৈরবের মতো মনে হয় আমার।

মনে হয়- 'আহা সরলতার কিবা দিব্যকান্তি'... মনে হয়, মাটিতে পা বিছিয়ে বসি, বলি- চক্ষু তো এই দুইখান, আর কতো দেখাইবা, ঈশ্বর...

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।