আমি চাই শক্তিশালী স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ
দেশের প্রথম মাওবাদী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পুষ্প কমল দহল ওরফে প্রচণ্ড দায়িত্ব নিয়েছিলেন মাত্র আট মাস আগে। গণপরিষদে সংহত অবস্থান, বিপুল জনসমর্থন সত্ত্বেও তাঁকে পদত্যাগ করতে হলো। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, এটা নেপালকে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে আবার দুর্বল করে দেওয়ার আয়োজন। অনেকে এর জন্য প্রতিবেশী ভারতকে দায়ী করছেন। শেষ পর্যন্ত এই রাজনৈতিক সংকট কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, তাই এখন দেখার।
ঘটনা শুরু সেনাপ্রধান রুকমানগাদ কাতওয়ালকে বরখাস্ত করা নিয়ে। গত শনিবার আক্নিকভাবে তাঁকে বরখাস্ত করেন প্রধানমন্ত্রী প্রচণ্ড। এই বরখাস্তের আট ঘণ্টার মধ্যে প্রেসিডেন্ট রামবরণ যাদব প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে সেনাপ্রধানকে ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দেন এবং তাঁকে স্বাভাবিকভাবে কাজ চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। প্রেসিডেন্টের এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে সোমবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে পদত্যাগের ঘোষণা দেন প্রচণ্ড।
অর্থাৎ নেপালে খুব অল্প সময়ের মধ্যে বড় কয়েকটি ঘটনা ঘটল।
সরকার কেন সেনাপ্রধানকে বরখাস্ত করল? আবার কেনই বা বরখাস্ত করার ১০ ঘণ্টার মধ্যে প্রেসিডেন্ট তাঁকে স্বপদে পুনর্বহালের ঘোষণা দিলেন। প্রশ্ন হলো, কোন শক্তির বলে মাওবাদী প্রধানমন্ত্রী সেনাপ্রধানকে বরখাস্ত করলেন? আর প্রেসিডেন্ট কোন শক্তির বলে নির্বাচিত সরকারের এই বরখাস্তের আদেশ বাতিল করলেন?
এ ঘটনা নেপালের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব ও কর্তব্যকে নতুন করে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে।
বিশ্লেষকেরা প্রশ্ন তুলেছেন, নির্বাচিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী কি একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করার এখতিয়ার রাখেন না? অবশ্যই তিনি এ ক্ষমতা রাখেন, যেহেতু তিনি দেশের নির্বাহী প্রধান। আর প্রেসিডেন্ট কি সংবিধানসম্মতভাবে দায়িত্ব পালন করছেন? যেহেতু প্রেসিডেন্টের পদটি সাংবিধানিক। মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্টকে কাজ করতে হবে-অন্তর্বর্তী সংবিধানে এ রকমই বিধান রয়েছে।
এ ঘটনায় প্রেসিডেন্ট তাঁর এখতিয়ারকে ছাড়িয়ে গেছেন।
নেপথ্যে ভারত?ঃ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন, নেপালের প্রেসিডেন্টকে শক্তি জুগিয়েছেন কাঠমান্ডুতে ভারতের রাষ্ট্রদূত রাকেশ সুদ। তিনিই সেনাপ্রধানের বরখাস্ত করার আদেশ প্রত্যাখ্যান করতে প্রেসিডেন্টকে উৎসাহিত করেন। অনেকেই জানেন, নেপালের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক বিষয়গুলোতে ভারতের অবস্থান জোরালো। এক অর্থে নয়াদিল্লিই ঠিক করে দেয় নেপাল কীভাবে চলবে।
কিন্তু মাওবাদীরা গত বছর সাধারণ নির্বাচনে বিপুল জয়ী হওয়ায় অনেকে মনে করেছিলেন, ভারতের প্রভাব এবার ধীরে ধীরে হ্রাস পাবে। কারণ মাওবাদী নেতা প্রচণ্ড স্বাধীনভাবে কাজ করায় বিশ্বাসী। ভারতের প্রভাব কমাতে তিনি চীনের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় জোর দেন, যদিও সফল হতে পারেননি।
এতদিন গিরিজাশঙ্কর কৈরালার নেতৃত্বাধীন নেপালি কংগ্রেসের মাধ্যমে ভারত হিমালয়ের এ দেশটিতে প্রভাব বিস্তার করত। একই সঙ্গে সেনাবাহিনী ও রাজার ওপরও তাদের যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ ছিল।
পরে তারা কমিউনিস্ট দলগুলোতেও অবস্থান জোরদার করে। ২০০৬ সালে সাতটি রাজনৈতিক দল ও মাওবাদীরা ১২ দফা শাস্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এ চুক্তি হয় ভারতের মধ্যস্থতায়। মজার বিষয় হলো, এ চুক্তি প্রথমে লেখা হয় ভারতের অন্যতম প্রধান ভাষা হিন্দিতে, পরে এটা নেপালি ভাষায় অনুবাদ করা হয়। যদিও এ শান্তিচুক্তি অকালেই মরে গেছে।
আর প্রধানমন্ত্রী প্রচণ্ডর পদত্যাগের পর এ চুক্তির এক প্রকার কবর রচিত হলো বলা চলে।
নেপালের রাজনীতিতে ভারতের অবস্থানের একটা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আছে। পঞ্চাশের দশকে চীনের তিব্বত দখলের পরপরই ‘ভারত-নেপাল মৈত্রী চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তি অনুযায়ী, নেপালে যেকোনো সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে ভারতীয়দের প্রাধান্য দিতে হবে। ভারতের অনুমতি ছাড়া নেপাল কোনো দেশ থেকে অস্ত্র কিনতে পারবে না।
ভারতীয়রা নেপালে গিয়ে জমিজমা কিনতে পারবে, ব্যবসা করতে পারবে। একই ভাবে নেপালিরাও সে সুযোগ ভোগ করবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ভারতীয়রা যেভাবে নেপালের ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে, নেপালিরা ভারতে তার এক কণাও পারেনি।
সাম্প্রতিক সময়ে সেনাপ্রধানকে বরখাস্ত করার আদেশ প্রত্যাখ্যানে প্রেসিডেন্টকে উৎসাহ দিয়ে ভারত কার্যত মাওবাদীদের একহাত নিয়েছে। যেহেতু ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খন্ড ও ছত্তিশগড়ে মাওবাদীদের তৎপরতা বিদ্যমান, তাই নয়াদিল্লি নেপালে মাওবাদীদের উত্থানে স্বস্তিতে থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক।
ভারতের অস্বস্তির আরেকটা কারণ, দুই দেশের মাওবাদীদের মধ্যে অস্ত্র, অর্থ আদান-প্রদানসহ নানা বিষয়ে তথ্য বিনিময় হয়। নেপালের মাওবাদী নেতাদের অনেকে ভারতে ছিলেন ও আছেন। একই সঙ্গে ভারতের অনেক মাওবাদী নেতা বিভিন্ন সময় নেপালে আশ্রয় নেন।
সব মিলিয়ে সেনাপ্রধানকে পুনর্বহাল ও প্রচণ্ডর পদত্যাগের মধ্য দিয়ে ভারতের প্রভাবেরই জয় হয়েছে বলে পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন।
বিরোধ ও পদত্যাগঃ নেপালে স্বাভাবিক নিয়মেই সেনাবাহিনী ও মাওবাদীরা ছিল পরস্পরবিরোধী।
সেনাবাহিনী প্রায় ১০ বছর মাওবাদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। সেই মাওবাদীরা ক্ষমতায় আসায় সেনাবাহিনীর মধ্যে অস্বস্তি তো ছিলই। আর প্রধানমন্ত্রী প্রচণ্ড ক্রমাগত চাপ দিয়ে যাচ্ছিলেন, শান্তিচুক্তির শর্ত অনুযায়ী ১৯ হাজার সাবেক মাওবাদী যোদ্ধাকে সেনাবাহিনীতে অন্তভুêক্ত করে নিতে, যারা বর্তমানে অস্ত্র ছেড়ে জাতিসংঘ পরিচালিত কয়েকটি শিবিরে আছে। কিন্তু সেনাপ্রধান সরকারপ্রধানের এ নির্দেশ অমান্য করেন। শুধু তাই নয়, তিনি সরকারের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই সেনাবাহিনীতে দুই হাজার ৮০০ নতুন সদস্য নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেন।
শেষ পর্যন্ত মন্ত্রিপরিষদের বিশেষ বৈঠকে প্রস্তাব এনে সর্বসম্মতিক্রমে সেনাপ্রধানকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্তে স্বাক্ষর করেন প্রধানমন্ত্রী। অবশ্য আর চার মাস পরই সেনাপ্রধানের অবসরে যাওয়ার কথা ছিল। ৯৩ হাজার সদস্যের শক্তিশালী নেপালি সেনাবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয় জেনারেল কুল বাহাদুর খাড়কাকে।
সরকারের অন্যতম প্রধান শরিক ইউএমএল সেনাপ্রধানকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। ৬১০ সদস্যবিশিষ্ট গণপরিষদে ইউএমএলের সদস্যসংখ্যা ১০৮।
মাওবাদীদের আসন ২৩৮টি। এ ছাড়া মাধেসি জনঅধিকার মোর্চাসহ ক্ষুদ্র কয়েকটি দল সরকারের সঙ্গে আছে।
শনিবার প্রেসিডেন্টের ‘অসাংবিধানিক’ হস্তক্ষেপ, রোববার ইউএমএলের সমর্থন প্রত্যাহার, সবদিক চিন্তা করে পরদিন সোমবারই পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন প্রচণ্ড।
নেপালে মাওবাদী সরকারের পতন এই মুহূর্তে হচ্ছে না। এখনো গণপরিষদে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় রেখেছে।
তবে আরও দু-একটি দল সমর্থন প্রত্যাহার করলেই সরকারের পতন হবে। তখন নির্বাচন ছাড়া আর কোনো পথ থাকবে না।
পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে নেপালি সেনাবাহিনীর সঙ্গে মাওবাদীদের সম্পর্ক দীর্ঘ মেয়াদে আরও খারাপের দিকে গেল। এরই মধ্যে হাজার হাজার মাওবাদী কাঠমান্ডুতে বিক্ষোভ করেছে। তবে বিভিন্ন শিবিরে যে মাওবাদী ক্যাডাররা রয়েছে, তারা সরাসরি বিক্ষোভে নামবে, এমন আশঙ্কা এ মুহূর্তে নেই।
প্রচণ্ডর আট মাসঃ বড় ধরনের জনপ্রত্যাশা নিয়ে মাওবাদীরা ক্ষমতায় এসেছিল। কিন্তু শহুরে ধনিকশ্রেণী, পুঁজিপতি-ব্যবসায়ী, বিদেশি বিনিয়োগকারী-কারোরই একনিষ্ঠ সমর্থন পায়নি সরকার। তার ওপর প্রতিদিনের বিদ্যুৎসংকট (দেশটির ৬০ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎসুবিধার বাইরে), উচ্চ মূল্যস্কীতি, ব্যাপক জ্বালানিসংকট বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র এই দেশটিকে উন্নয়নের পথে এগোতে বাধা সৃষ্টি করে। যদিও আট মাস কোনো একটি সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা মূল্যায়নের যথেষ্ট সময় নয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, এ মুহূর্তে মাওবাদী সরকারের পতনই বেশি করে কামনা করা হচ্ছে।
মাওবাদীদের বাদ দিয়ে ইউএমএলের নেতৃত্বে জাতীয় সরকার গঠনের কথা বলা হচ্ছে। এ ব্যাপারে একটা সমঝোতাও হয়ে গেছে। এসব আয়োজনে পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে নেপালি কংগ্রেস। তারা উৎসাহ পাচ্ছে রাজতন্ত্রপন্থী লোকজন, সেনাবাহিনী ও ভারতীয় স্টাবলিশমেন্টের কাছ থেকে।
মাওবাদীবিরোধী এ পক্ষটি এখন বেশি সক্রিয়।
জাতীয় সরকার গঠনের ‘স্বার্থে’ খুব শিগগির যদি ছোট দু-একটি দল সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়, তবে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সে ক্ষেত্রে পিছিয়ে যাবে ২০১০ সালের মধ্যে নতুন সংবিধান লেখার কাজ। মাওবাদীরা আবার অস্ত্র তুলেও নিতে পারে। দীর্ঘ অনিশ্চতার মুখে পড়বে নেপাল।
লেখকঃ কাজী আলিম-উজ-জামান
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।