মার্কিন-ঘনিষ্ঠতার বিরুদ্ধে লড়াই নতুন জমি দিয়েছে বামপন্থীদের
অজয় দাশগুপ্ত
মালাপ্পুরম, ১৫ই এপ্রিল- কোঝিকোড় থেকে মালাপ্পুরম যাওয়ার রাস্তায় গঞ্জ এলাকা এলেই সাইনবোর্ড পড়ার চেষ্টা করছিলাম। অন্যান্য দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্যগুলির মতোই কেরালাতেও প্রাদেশিক ভাষার আধিপত্য খুবই বেশি। তবু মাঝে মাঝে যেটুকু ইংরাজী চোখে পড়ছিল, তাতে দেখছিলাম ‘অ্যারাবিয়ান টাচ হোটেল’, ‘জেড্ডা মল’, ‘দুবাই ডিলাইটস’ ইত্যাদি নামের বিভিন্ন হোটেল বা দোকান। মালাপ্পুরম শহরের মাঞ্জেরি রোডে অনেকগুলি বিদেশী মুদ্রা বিনিময় কেন্দ্রও দেখলাম।
আসলে মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলির সঙ্গে মালাপ্পুরমের মানুষের নিবিড় সম্পর্কেরই এটা প্রতিফলন।
কথা হচ্ছিলো সদ্য যুব আন্দোলন থেকে অবসার নেওয়া সি পি আই (এম)-র মালাপ্পুরম জেলা কমিটির সদস্য কে পি অনিল-এর সঙ্গে। তিনি বলেন, এই জেলার প্রতিটি পরিবারেরই ১-২ জন আরব দেশে বিভিন্ন কাজে যুক্ত রয়েছেন। ‘গালফ মানি’ এখানকার অর্থনীতিকে পুষ্ট করছে। কেরালা প্রবাসী সঙ্ঘম-এর সভাপতি মনজুলাগুড়ি আলি-র হিসাব অনুযায়ী প্রায় ৫০ লক্ষ মালয়ালী বিদেশে কর্মরত রয়েছেন, যার ৯০ শতাংশই রয়েছেন জেড্ডা, রিয়াধ, আল-খোবার, দুবাই, মাস্কাট, কাতার, বাহরিনসহ বিভিন্ন আরব শহরে। বছরে কমবেশি ৩০ হাজার কোটি টাকার বিদেশী মুদ্রা দেশে পাঠান প্রবাসী মালয়ালীরা।
১৯৬৯ সালে ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ সরকারের আমলে গঠিত মালাপ্পুরম জেলার ৬৫ শতাংশ মানুষই মুসলিম। বরাবরই এখানে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউ ডি এফ-এর শরিক ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লিগের প্রার্থীরা জয়ী হন। ২০০৪ সালের নির্বাচনেই প্রথম ব্যতিক্রম ঘটে। এই জেলার মাঞ্জেরি ও পোন্নানি আসন দুটি-র মধ্যে মাঞ্জেরিতে সি পি আই (এম) প্রার্থী টি কে হামজা জয়ী হন। লিগের দীর্ঘদিনের আধিপত্য ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।
এবারেও এই কেন্দ্রে টি কে হামজাই এল ডি এফের প্রার্থী। ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও জেলার ১২টি আসনের মধ্যে এল ডি এফ ৫টি আসনে প্রথমবার জয়ী হয়। লিগের জনভিত্তিতে এই ভাঙনের মূলে রয়েছে এই দলের আপসকামী নীতি, বিশেষ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে, ইজরায়েলের সঙ্গে ভারতের ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক গড়ে তেলার প্রশ্নে।
কেন্দ্রে বি জে পি জোট সরকার থাকার সময় থেকেই ভারতের স্বাধীন বিদেশনীতিতে মোড় ঘুরতে শুরু করেছিল। ইউ পি এ সরকারও সেই একই মার্কিনমুখী নীতি নেওয়ার ফলে আরব দেশগুলির মধ্যে ভারত সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব তৈরি হচ্ছে।
ইজরায়েল যেভাবে প্যালেস্তাইনকে ধ্বংস করার লক্ষ্য নিয়ে এগচ্ছে, পাশাপাশি লেবানন, সিরিয়ার ওপর আক্রমণ হানছে, ইরানকে চোখ রাঙাচ্ছে, ভারত সরকার তার প্রতিবাদ করার বদলে ইজরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছে, অস্ত্র কিনছে তাদের কাছ থেকে। এই জেলার সি পি আই (এম) জেলা সম্পাদক উমের মাস্টার বললেন, কংগ্রেস সরকারের এই নীতিকে সম্পূর্ণ সমর্থন করে যাচ্ছে লিগ। আর যে ভারত জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের নেতা বলে আরব দেশগুলিতে গণ্য হতো, সেই ভারত সম্পর্কে এই ঘটনা ঘৃণার জন্ম দিচ্ছে। তিনি বললেন, ভারতীয়দের এখন দলে দলে ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে আরব দেশগুলি। অর্থনৈতিক মন্দার প্রথম কোপ চাপানো হচ্ছে ভারতীয় কর্মরতদের ওপরেই।
তাই কংগ্রেসের তো এখানে ঠাঁই নেই, লিগ নেতৃত্ব মানুষের প্রশ্নের মুখে।
উমের মাস্টার বললেন, সি পি আই (এম) এখানে লড়ছে সম্পূর্ণ ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে পার্টির আপসহীন ভূমিকা, প্যালেস্তাইনের মানুষের সংহতিতে বামপন্থীদের লড়াই এখানকার মানুষ প্রত্যক্ষ করছেন। স্বাধীন বিদেশনীতির জন্য বামপন্থীরাই একমাত্র সোচ্চার গোটা দেশে। কে পি অনি বললেন, গত দু’বছরে এই জেলায় পার্টির মিছিল, মিটিং, সমাবেশে অসংখ্য নতুন মানুষ যোগ দিয়েছেন।
ডি ওয়াই এফ আই-র এই প্রাক্তন জেলা সম্পাদক জানালেন, ২০০৮ সালেই শুধু যুব সংগঠনের সদস্য সংখ্যা ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এখানে। নির্বাচনের প্রচারে বহু সংগঠন স্বতঃস্ফূর্তভাবে বামপন্থীদের সমর্থনে ভোট দেওয়ার জন্য আবেদন জানিয়েছে। এইরকম রয়েছে আবদুল নাসের মাদানি-র নেতৃত্বাধীন পি ডি পি এবং কানথাপুরম এ পি আবু বক্কর মুসালিয়ার-এর নেতৃত্বাধীন আই এন এল।
এই জেলার দুটি আসনই এবার হাতছাড়া হওয়ার উপক্রম দেখে কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে শুরু করে সকলেই সি পি আই (এম)-র বিরুদ্ধে ‘সাম্প্রদায়িক’ শক্তির সঙ্গে ‘আতাঁত’-এর অভিযোগ তুলে অপপ্রচার শুরু করেছে। সি পি আই (এম)-র সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাত স্পষ্টভাষায় এর উত্তর দিয়েছেন কেরালায় প্রচারে এসে।
তিনি বলেছেন, ‘সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা ও ইজরায়েল প্রশ্নে সি পি আই (এম)-র ভূমিকা সবাই জানেন। তার জন্য কেউ যদি আমাদের সমর্থন করতে এগিয়ে আসে, তাতে আমরা কি বলতে পারি ? আমরা তো কারো সমর্থন চাইতে যাইনি’।
প্রশ্নটা উঠেছে পি ডি পি নেতা মাদানিকে নিয়ে। ১৯৯৮ সালে কোয়েম্বাটোর বিস্ফোরণ মামলায় তাঁকে তালিমনাডু সরকার গ্রেপ্তার করেছিল ‘সন্ত্রাসবাদী’ কাজে মদত দেওয়ার অভিযোগে। কংগ্রেস এবং প্রচারমাধ্যমগুলি এই ঘটনার উল্লেখ করে অপপ্রচার করলেও ২০০১ সালে পি ডি পি বিধানসভা নির্বাচনে ইউ ডি এফ-কে সমর্থন করেছিল, সে সম্পর্কে তারা নীরব।
কংগ্রেস নেতা ও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমেন চণ্ডী, ইউ ডি এফ-র বর্তমান আহ্বায়ক পি কে থাঙ্কাচ্চন, লিগ নেতা কুনহালিকুট্টি কোয়েম্বাটুর জেলে গিয়ে সমর্থনের জন্য মাদানির সঙ্গে দেখা করেন। মাদানিকে ১৯৯৮ সাল থেকে টানা ৬ বছর বিনা বিচারে আটক রাখার পর বছর দুয়েক বিচার চলে। বিচারপতি তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে মুক্তি দেওয়ার পর তিনি বাইরে এসে প্রকাশ্যে সমস্তরকম অতীত কার্যকলাপের জন্য ক্ষমা চেয়ে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিকে সমর্থন করার কথা বলেছেন।
মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফেরত আসা মানুষদের জন্য এল ডি এফ সরকারের অর্থনৈতিক প্যাকেজও সাড়া ফেলেছে এখানে। কেরালার কংগ্রেস নেতা ভায়লার রবি কেন্দ্রে প্রবাসী ভারতীয় দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও কোনো পদক্ষেপ নেননি এজন্য।
এল ডি এফ সরকারের ১০০ কোটি টাকার এই প্যাকেজে ফেরত আসা মালয়ালীদের জন্য প্রবাসী কেরালা দপ্তর (লোরকা)-এ পৃথক নথিভূক্তিকরণ এবং যারা ২ বছরের বেশি মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত ছিলেন তাদের এখানে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করার জন্য ব্যাঙ্কঋণের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। রাজ্য সরকার ও কেরালা ফিনান্সিয়াল কর্পোরেশন এই ঋণের গ্যারান্টার থাকছে। প্রবাসী ছাত্র-ছাত্রীদের এখানে ভর্তির নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। ৬০ বছর বয়সী মানুষ, যারা কমপক্ষে ৫ বছর আরব দেশে ছিলেন, তাদের পেনশন দেওয়া হবে এবং তারা মারা গেলে পরিবারও একই পেনশন পাবে। দুর্ঘটনায় আহত বা নিহত হলে বিশেষ অনুদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এসব কাজের ফলেই বামপন্থীদের সমর্থনে মানুষের ঢল নেমেছে।
কেরালায় মুসলিমরা ‘মোপলা’ নামে অভিহিত হন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ১৯২১ সালে খিলাফত আন্দোলনের অঙ্গ হিসাবে এই মালাপ্পুরম জেলাতেই সশস্ত্র সংগ্রামে নেমেছিলেন মুসলিমরা, যা ঐতিহাসিক ‘মোপলা বিদ্রোহ’ নামে চিহ্নিত হয়ে আছে। মালাপ্পুরমের রাস্তায় সেই লড়াইয়ের স্মারকও চোখে পড়েছে। কে পি অনিল হাসতে হাসতে বললেন, এখানে মুসলিমদের ৯৫ শতাংশই সুন্নী সম্প্রদায়ভুক্ত।
মুসলিমরা তাই এখানে পরিচিত হন হয় ‘লিগ সুন্নী’ অথবা ‘আরিভাল সুন্নী’ বলে। ‘লিগ সুন্নী’ মানে মুসলিম লিগের সমর্থক। ‘আরিভাল’ মানে মালয়ালম ভাষায় কাস্তে, তাই ‘আরিভাল সুন্নী’ মানে কাস্তে, হাতুড়ি, তারার সমর্থক। কংগ্রেসের এখানে কোনো জায়গাই নেই। ওরা মুসলিম লিগের লেজুড় হয়ে চলে এখানে।
দেশের প্রবাদপ্রতিম কমিউনিস্ট নেতা ই এম এস নাম্বুদিরিপাদের জন্মও এই জেলাতেই। এই জেলার পেরাত্থেলমান্নায় তাঁর নামে বিশাল সমবায় হাসপাতাল তৈরি হয়েছে পার্টির উদ্যোগে। অনেক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী মালাপ্পুরমের মানুষ আজ নতুন লড়াইয়ের সামনে। মার্কিনমুখী, ইজরায়েল তোষণের নীতি আজ এই জেলার মানুষের জীবন-জীবিকা ধ্বংস করতে উদ্যত। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইয়ের সামনের সারিতে থাকার কারণেই বামপন্থীরা আজ তাঁদের স্বাভাবিক মিত্রে পরিণত হয়েছেন।
কুৎসা আর অপপ্রচারে একেই চাপা দিতে চাইছে কংগ্রেস।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।