বিদর্ভ যা পারেনি, পেরেছে ওয়াইনাড
অজয় দাশগুপ্ত
কালপেট্টা, ১৪ই এপ্রিল-কৃষ্ণপ্রসাদের সঙ্গে দেখা হতেই হাত বাড়িয়ে বললো, ‘কেমন আছো কমরেড ? বিশু আশামসকল’। মঙ্গলবার সকাল থেকে এখানে এসে যার সঙ্গেই দেখা হয়েছে, সেই বলেছে, ‘বিশু আশামসকল’। মানে ‘নববর্ষের শুভেচ্ছা’। বাংলার পয়লা বৈশাখ, পাঞ্জাবের ‘বৈশাখী’র মতো ‘বিশু’-ও নতুন বছর শুরুর উৎসব। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে মালয়ালম বছরের সূচনা আগস্টের মাঝামাঝি মালয়ালী মাস চিঙ্গাম থেকে, তবুও মেদাম মাসের প্রথম দিনটিকেই প্রথাগতভাবে নতুন বছরের প্রথম দিন হিসাবে ধরা হয় কেরালায়।
‘ওনাম’-এর পর ‘বিশু’-ই মালয়ালীদের সবচেয়ে বড়ো উৎসব, বিশেষ করে মালাবার অঞ্চলে ‘বিশু’ উৎসবে ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষই মেতে ওঠেন।
তাই আনুষ্ঠানিকভাবে এদিন বিকাল ৫টায় নির্বাচনী প্রচার শেষ হলেও কার্যত সোমবারই এই অঞ্চলে প্রচারপর্ব সমাধা হয়ে গিয়েছে। রাস্তাঘাটে গাড়ি কম, দোকান-পাট বন্ধ, চারিদিকে ছোটো ছেলে-মেয়েরা বাজি ফাটাচ্ছে, বাড়িতে বাড়িতে নানা রকম প্রথাগত অনুষ্ঠান হচ্ছে, রাজনৈতিক নেতারাও মিছিল, মিটিং-এর বদলে ভোটারদের সঙ্গে ‘বিশু আশামসকল’ বিনিময় করছেন। কথা হচ্ছিলো কৃষ্ণপ্রসাদের সঙ্গে। পি কৃষ্ণপ্রসাদ, এস এফ আই-র প্রাক্তন সর্বভারতীয় সভাপতি , এখন ওয়াইনাড জেলায় সি পি আই (এম)-র নেতা এবং সুলতান বাথেরি কেন্দ্রের বিধায়ক।
কৃষ্ণপ্রসাদ বললো, এই যে এরকম উৎসব দেখছো,বছর দুয়েক আগেও এত মাতামাতি ছিল না। ইউ ডি এফ আমলে ওয়াইনাড অঞ্চলে উৎসবের আনন্দ বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল কৃষক আত্মহত্যার কারণে। এল ডি এফ সরকার ‘বিশু’ উৎসবে প্রাণ সঞ্চার করেছে। উৎসবের জলুস ফিরে এসেছে। ২০০৮ সালে একজন কৃষককেও ঋণের জ্বালায় আত্মহত্যা করতে হয়নি ওয়াইনাডে।
বিদর্ভ যা পারেনি, ওয়াইনাড তা পেরেছে।
সত্যিই তাই। সরকারী হিসাব বলছে গোটা দেশে ১৯৯৭ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে ১লক্ষ ৮২ হাজার ৯৩৬ জন কৃষক ঋণের জ্বালায় আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন, এর মধ্যে ১১,৫১৬জন কেরালার। কৃষক আত্মহত্যার এই খতিয়ানে সবার ওপরে নাম রয়েছে মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ অঞ্চলের। তারপরেই জায়গা করে নিয়েছিল কেরালার ওয়াইনাড, এই রাজ্যের মোট কৃষক আত্মহত্যার ঘটনার ৯০ শতাংশই এখানে।
অথচ পশ্চিমঘাট পর্বতমালার পূর্বঢালে এই ওয়াইনাডের চাষীরাই তৈরি করেন বিশ্বের সেরা গোল মরিচ, এলাচ, আদা, সুপারি। সেই ১৪৯৮ সালে সুদূর পর্তুগাল থেকে ভাস্কো-ডা-গামা এসে যে কালিকট (এখনকার কোঝিকোড়) শহরে পা রেখেছিলেন, তাও তো এই সুগন্ধী মশলার আকর্ষণেই। এছাড়া চা, কফি তো আছেই। কোঝিকোড়ে থেকে উঁচু-নিচু পাহাড়ী টিলার মধ্যে দিয়ে রাস্তায় বাসে যেতে যেতেও চোখে পড়ছিল বিস্তীর্ণ চা ও কফি বাগিচা। সৌজন্য ‘মনমোহনী’ উদার অর্থনীতি।
বিশ্বের পণ্য ফাটকা বাজার (কমোডিটি স্টক এক্সচেঞ্জ)-এ দামের ওঠানামার দৌলতে সর্বস্বান্ত হয়ে প্রাণবলী দিয়েছেন ওয়াইনাডের কৃষকরা। শুধু গত ইউ ডি এফ সরকারের সময়েই এভাবে প্রায় ১৫০০জন কৃষক প্রাণ হারিয়েছেন। এই সময়ে ওয়াইনাডের কৃষকরা প্রায় ৫হাজার কোটি টাকা ক্ষতির শিকার হয়েছেন। কিন্তু সরকার ফিরেও তাকায়নি।
তারপর কী হলো ?
২০০৬ সালের মে মাসে এল ডি এফ সরকার গঠিত হওয়ার পরে প্রথমেই সমস্ত ব্যাঙ্কে কৃষিঋণ আদায়ে দু’বছরের নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
কৃষক আত্মহত্যা হয়েছে এমন বিপর্যস্ত পরিবারগুলিকে ৫০ হাজার টাকা করে এককালীন অনুদান দেওয়া হয়। বিচারপতি কে এ আবদুল গফুরকে চেয়ারম্যান করে ঋণ মকুব কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনের সুপারিশে ২০০১ সাল থেকে নেওয়া সমস্ত কৃষিঋণের সুদ মকুব করে দেওয়া হয়, এমনকি এক একরের কম জমির মালিক ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীদের নেওয়া ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া সব ঋণ মকুব করে দেওয়া হয়। এর জন্য রাজ্য সরকারকে ১৬৩ কোটি ব্যয় করতে হয়। এছাড়া গ্রিন কার্ডের মাধ্যমে ফসল শুরুর ১৮০দিন পর্যন্ত বিনাসুদে ঋণ, খাদ্য নিরাপত্তা প্রকল্প, শস্যবীমা, কিষাণশ্রী প্রকল্পে ৫লক্ষ ২৫হাজার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষককে বিনা প্রিমিয়ামে ১লক্ষ টাকা বীমা আওতায় আনা, ফসলের নূন্যতম সহায়ক মূল্য বাড়ানো ইত্যাদি একগুচ্ছ কর্মসূচী।
এসব হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর বিদর্ভ সফরে গিয়ে ব্যাপক ঢাক-ঢোল পিটিয়ে মডেল প্যাকেজ ঘোষণার অনেক আগেই। এর ফলে কৃষকরা মনোবল ফিরে পেয়েছেন, বুঝেছেন বিপদে সরকার তাদের পাশে আছে। আর তাই মাত্র একবছরের মধ্যে কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা শূন্যে পৌঁছে গেছে। এল ডি এফ সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকে ২০০৭ সালের মে-জুন অবধি ৬৪ জন কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। তারপর আর একটি ঘটনাও ঘটেনি।
কেন্দ্রের প্যাকেজের পরেও বিদর্ভে কৃষক আত্মহত্যার মিছিল থামছে না, অথচ এখানে থামলো কী করে ? সি পি আই (এম) নেতা এবং ওয়াইনাড লোকসভা কেন্দ্রে এল ডি এফ-এর নির্বাচনী কমিটির আহ্বায়ক পি এ মহম্মদ বললেন, কারণ এখানে এল ডি এফ সরকার আছে, বামপন্থী কৃষক আন্দোলন আছে। আমরা প্রতিটি অঞ্চলে কৃষক সংগঠনগুলির মাধ্যমে প্রকৃত বিপর্যস্তদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করে সরকারের হাতে তুলে দিয়েছি। এন আর ই জি এস-এর সঠিক রূপায়ণও এই জেলায় কৃষিসঙ্কটে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য করেছে ব্যাপকভাবে, জানালেন সি ভি জয়, এই প্রকল্পের জেলা সঞ্চালক। দেশের মধ্যে কেরালাতেই এই প্রকল্পে সর্বোচ্চ মজুরি দেওয়া হচ্ছে, দৈনিক ১২৫টাকা করে। জেলায় নথিভুক্তির পরিমাণ প্রায় ১লক্ষ ২০ হাজার জন, যার প্রায় ৪০ শতাংশ মহিলা।
তবে কৃষ্ণপ্রসাদের বক্তব্য হলো, এন আর ই জি এস-এর মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী সাফল্য আসবে না, যদি না সম্পদ সৃষ্টির কাজে একে লাগানো যায়। খেতমজুরদেরও এই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যার ফলে কৃষকদের ফসল তৈরি করতে এজন্য অতিরিক্ত ব্যয় আরো কমে যাবে।
ডি-লিমিটেশনের ফলে নবগঠিত ওয়াইনাড লোকসভা কেন্দ্রে এবারে ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে। এল ডি এফ মনোনীত সি পি আই প্রার্থী এম রহমতুল্লা, ইউ ডি এফ-এর কংগ্রেস প্রার্থী প্রদেশ কমিটির সাধারণ সম্পাদক এম আই শাহনওয়াজ ছাড়াও এন সি পি-র রাজ্য সভাপতি ও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কে করুণাকরণের ছেলে কে মুরলীধরন। সি পি আই (এম)-র জেলা সম্পাদক সি কে শশীধরন বললেন, এই অঞ্চলে কৃষক আত্মহত্যাকে শূন্যে নামিয়ে আনার এই একটি কারণই মানুষের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে, যা এল ডি এফ-কে আবার তাদের বেছে নেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।
এছাড়া অন্যান্য কারণ তো আছেই। তিনি বললেন, শুধু ওয়াইনাড না, লাগোয়া আলাত্তুরসহ পাল্লাক্কাদ, আল্লাপুঝাতেও এর প্রভাব পড়েছে।
এদিকে, কংগ্রেসও মালাবার অঞ্চলে হালে পানি না পাওয়া টের পেয়েছে। এতদিন জোর গলায় সারাদেশে ১৭ হাজার কোটি টাকার কৃষকস্বার্থে প্যাকেজের কথা শোনালেও তা যে অশ্বডিম্ব প্রসব করেছে তা তাদের আর বুঝতে বাকি নেই। তাই গত রবিবার প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনি পুল্লাপল্লি ও কালপেট্টায় বলতে বাধ্য হয়েছেন যে ইউ পি এ সরকার আবার ক্ষমতায় এলে কৃষকদের জন্য নতুন প্যাকেজ নেওয়া হবে।
তাহলে পুরানো প্যাকেজের হলোটা কী, তোড়-জোড় করে ঘোষণাই সার, এই প্রশ্ন তুলে হাসাহাসি করছেন ওয়াইনাডের কৃষকরা।
শশীধরন আরো জানালেন, এই জেলার ১৭ শতাংশ মানুষ আদিবাসী। ব্রিটিশ আমলে চা ও কফি বাগিচা তৈরির জন্য এই আদিবাসীদেরই জমি কেড়ে নিয়ে তাদের জঙ্গলমহলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এল ডি এফ সরকার ভূমিসংস্কারের মাধ্যমে এদের জমি দেওয়ার কাজ শুরু করেছে। প্রত্যেক পরিবারকে পাকা ঘর তৈরি এবং ২টাকা কেজি দরে চাল দেওয়ার কাজও শুরু হয়েছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।