ঘুরছে প্রশ্ন, কোন্ অক্ষের অঙ্কে শশী থারুর কংগ্রেস প্রার্থী!
অজয় দাশগুপ্ত
তিরুবনন্তপুরম, ১১ই এপ্রিল-কেরালার এল ডি এফ সরকারের সমালোচনা করতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারের প্রশংসা করে দলের মধ্যেই বেকায়দায় পড়ে গেছেন শশী থারুর। সদ্য কূটনীতিকের পেশা ছাড়ায় এখনও পেশাদার কংগ্রেসী রাজনীতিবিদদের মতো অনৃতভাষণ আয়ত্ত করতে পারেননি বলেই হয়তো বলে ফেলেছিলেন, কেরালায় এল ডি এফ সরকার কেন শিল্পবিকাশের প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারের মতো পদক্ষেপ নিচ্ছে না? যেখানে খোদ এ আই সি সি দপ্তর থেকে পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করা হচ্ছে, সেখানে এ কি কথা!
অতএব ফতোয়া শশী থারুরের মুখে। নির্বাচনী প্রচারে বের হয়ে তিনি আর রাজনীতির ধার-পাশ দিয়ে যাচ্ছেন না। তিনি যে কতটা মালয়ালী, তা ভাঙা ভাঙা মালয়ালম ভাষায় তিরুবনন্তপুরমের কৃষিজীবী, মৎস্যজীবী, ছোট দোকানদার, ব্যবসায়ী, সাধারণ পেশার মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন। রাষ্ট্রসঙ্ঘের প্রাক্তন উপ-মহাসচিব এখন বহুজাতিক পোশাক নির্মাতার স্যুট ছেড়ে মালয়ালী ধুতি ‘মুন্ডু’ আর তেরঙ্গা পাড় লাগানো উত্তরীয় সামলাচ্ছেন কোনো মতে।
শনিবার তামিলনাড়ুর কন্যাকুমারী লাগোয়া নেয়াট্টিনকারা বিধানসভা কেন্দ্রে তাঁর ‘রোড শো’ ছিল। রাস্তায় যেতে যেতে একটি বিলাসবহুল টয়োটো ইনোভা গাড়ির ছাদ খুলে বিশেষভাবে তৈরি পোডিয়াম থেকে তিনি হাত নাড়ছেন এবং পূর্ব নির্ধারিত জায়গায় দাঁড়িয়ে সংক্ষেপে দু’-চার কথা বলছেন। স্থানীয় যুব কংগ্রেস কর্মী পি অজিতকে প্রশ্ন করে জানলাম, শশী থারুর বলছেন, ‘‘আমি গত একবছর ধরে তিরুবনন্তপুরমে আসছি। আমার মা এখানে থাকেন। আমার রেশন কার্ডও এখানেই রয়েছে।
’’
গত লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রে কেরালার প্রবীণ সি পি আই নেতা পি কে বাসুদেবন নায়ার ৫৪,৬০৩ ভোটে জয়ী হয়েছিলেন। তাঁর জীবনাবসানের কারণে মাঝপথে উপনির্বাচনেও সি পি আই প্রার্থী পানিয়ান রবীন্দ্রন জয়ী হন। এবারে সি পি আই প্রার্থী হয়েছেন পি রামচন্দ্রন নায়ার। পেশায় আইনজীবী নায়ার এখন সি পি আই-র তিরবনন্তপুরম জেলা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। সাংগঠনিক দক্ষতার পাশাপাশি আইনীজীবী হিসাবে তাঁর সুনাম নির্বাচনী প্রচারেও ছাপ ফেলছে।
ব্যাপক সাড়া পাচ্ছেন সর্বত্র। এছাড়াও প্রার্থী রয়েছেন বি জে পি-র পি কে কৃষ্ণদাস, বি এস পি-র এ নীললোহিতদাসন নাদার। পি রামচন্দ্রন নায়ারের হয়ে শুক্রবার প্রচারে কেরালায় এসেছিলেন সি পি আই-র সাধারণ সম্পাদক এ বি বর্ধন। শনিবার কোভালম বিধানসভা কেন্দ্রের আদিবাসী এলাকায় প্রচারে গিয়েছিলেন পি রামচন্দ্রন নায়ার। সেখানে পিছিয়ে-থাকা আদিবাসী, মৎস্যজীবী মানুষের মধ্যে বামপন্থীদের প্রভাব ভালোই রয়েছে।
সকালে টেলিফোনে কথা হলো পি রামচন্দ্রন নায়ারের সঙ্গে। শশী থারুরের প্রচারের কথা তুলতেই তিনি বললেন, এখানে রেশন কার্ড থাকলেই কি স্থানীয় মানুষ হিসাবে নিজেকে জাহির করা যায়? উনি কি কোনোদিন রেশনের লাইনে দাঁড়িয়েছেন? বলতে পারবেন রেশনে চালের দাম কত? হাসতে হাসতে নায়ার বললেন, রেশন দোকানে গেলে নিদেনপক্ষে উনি জানতে পারতেন যে, এল ডি এফ সরকার বি পি এল এবং এ পি এল, উভয় অংশের মানুষকেই ২০০৬ সাল থেকে কম দামে চাল দিচ্ছে। একই সঙ্গে নায়ার জানালেন, বি পি এল কার্ড যাঁদের আছে, আর্থিক মন্দার কোপ থেকে রক্ষার জন্য তাঁদেরকে মাত্র ২টাকা কেজি দরে রেশনে চাল দেওয়ার কথা সরকার ঘোষণা করেছে।
শশী থারুর আরো বেকায়দায় পড়েছেন তাঁর ইজরায়েল-ঘনিষ্ঠতা নিয়ে। নিবন্ধ সরবরাহকারী আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা ‘প্রজেক্ট সিন্ডিকেট’-এর কলাম লেখক থারুরের ‘ইন্ডিয়াজ ইজরায়েল এনভি’ লেখাটি পৃথিবীর শতাধিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে।
এমনকি ইজরায়েলী সংবাদপত্র ‘হার্ৎজ’-এও এটি ছাপা হয়েছিল। প্যালেস্তাইনের গাজা ভূখন্ডে ইজরায়েলী আক্রমণের সমর্থনে লেখা ঐ নিবন্ধে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, একই শত্রু মুসলিম সন্ত্রাসবাদের দ্বারা ইজরায়েল ও ভারত একইভাবে আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও কেন ভারত ইজরায়েলের মতো পাকিস্তানে বিমান হানা চালাচ্ছে না? যে রাজ্যের জনসংখ্যার ২৭ শতাংশ মুসলিম, সেই কেরালায় এর জন্য প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ে শশী থারুর গত ৩১শে মার্চ ‘হিন্দু বিজনেস লাইন’ পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘‘আমি ভুলবশত ওরকম লিখে ফেলেছি এবং এর জন্য আমি ক্ষমা চাইতে প্রস্তুত। ’’
কেবল ব্যক্তি শশী থারুরের ইজরায়েল-ঘনিষ্ঠতা নিয়ে কেন সি পি আই (এম) বা এল ডি এফ প্রশ্ন তুলছে, এভাবে অনেকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে চাইলেও আসলে এই ঘটনা আরো অনেক বড় মাপের। কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইউ পি এ সরকার যেভাবে এই পাঁচ বছরে আমেরিকা-ভারত-ইজরায়েল অক্ষ তৈরির লক্ষ্যে সবরকম প্রচেষ্টা চালাচ্ছে এবং ইজরায়েলী অস্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্রেতায় পরিণত হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে শশী থারুরের আচমকা পেশা ছেড়ে কংগ্রেসের প্রার্থী হওয়াটাই তাৎপর্যপূর্ণ। তাও আবার কেরালা প্রদেশ কংগ্রেসকে এড়িয়ে।
তিরবনন্তপুরম জেলা কংগ্রেসের সম্পাদক এস কে অশোক কুমার বললেন, ‘‘প্রথমদিকে কিছুটা ক্ষোভ থাকলেও উনি হাইকম্যান্ডের প্রার্থী হওয়ায় সবাই মেনে নিয়েছেন। ’’
আর আশঙ্কা সেখানেই। ওয়াশিংটন-তেল আবিবের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি যখন ভায়া ১০ নম্বর জনপথ কংগ্রেসের টিকিটে সংসদে ঢোকার চেষ্টা করছেন, তখন আঁতাত আসলে কোথায়, তা বুঝতে কারো অসুবিধা হয় না। তিরুবনন্তপুরমের মানুষেরও তা বুঝতে মোটেই অসুবিধা হচ্ছে না। অতএব, ২০০৬ সালে রাষ্ট্রসঙ্ঘের মহাসচিব পদে লড়াইয়ে নেমে যে ফল পেয়েছিলেন থারুর, তারই কি পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে আগামী ১৬ই এপ্রিল? সেজন্য আপাতত ১৬ই মে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।