আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার বাবার দুটি অপারেশন ও আমার বেয়াদবি

আমি লিখতে চাই...................

আমার বাবার দুটি অপারেশন ও আমার বেয়াদবি ঘটনাটা ঘটেছিলো সুবহে সাদিকের কিছু পরে। খুব জরুরী কাজ না থাকলে যে ঐ সময় ঢাকা সহরে মানুষ যে বের হয় না তা আশা করি সবারই জানা। আশা ইউনি ভার্সিটির সামনে দিয়ে হাঁটছি আর রিক্সা খুঁজছি মনে মনে। গন্তব্য শংকর, ছায়া নট। দু’ঙ্গুলের মাঝখানে একটা বিষ।

কোন ফাঁকা থেকে জানিনা দুই ছোকড়া এসে আমাকে বলল -এই গায়ে ধোয়া ছাড়লি কেন? আমি একটু থতমত খেলাম। নিজেই ভাবছি কথাটা কি আমাকে বলা হয়েছে? আমাকে তো বলার কথা না। কারণ তাদের অভ্যুত্থান হয়েছে আমার পিছন দিক থেকে। আমার বিষের ধোঁয়া কি আসলেই তাদের গয়ে বা নাকে গিয়ে লেগেছে? আমি দিধায় পরে গেলাম। -ভাই আমারে কইতাছেন? -মনে হয় এহন কিছু জানেন না? এর মধ্যে আরো ৩/৪ জন এসে আমার চার পাশে দাড়ালো।

লিডার গোছের একজন বলে উঠলো -কিরে তগো লগে বেদুবি করছে? প্রথম দুই ছোকড়ার একজন আমার বেয়াদবির বৃত্তান্ত দলনেতার কাছে বর্ননা করল। ইতি মধ্যে একজন দাড়ি কাটার একটা নীরিহ ক্ষুদ্রাস্ত্র বের করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিল। দলনেতা আমাকে পরম যতেœ সকলে কাছ থেকে একটু দুরে নিয়ে গেল। -ভাইয়া আপনে কি করছেন? ওরা তো ভয়ংকর পোলাপান, আমি নিজেও ওগো ডরাই। আপনি ওগো লগে করছেন বেয়াদবি।

অরা তো এহন আপনেরে ছিরা খাইবো। -ভাই আমার ভুল হইয়া গেছে। -ভাই সব ভুলের কি মাপ আছে? এর মধ্যে এক জন হাক দিয়ে বলল -বড় ভাই খানকির পুতরে আমগো হাতে ছাইরা দেন। অরে শিখাইয়া দি বেদাদবির মজা কি.... আমি শিউরে উঠলাম। শিক্ষার উপকরণ যদি ক্ষুর হয়ে থাকে এই ভয়ে আমার কলজে শুকিয়ে গেল।

-শোনেন পোলাপানে কয় কি? ওরা তো বিশাল ক্ষ্যাপা ক্ষেইপ্যা গেছে। ওগো তো ঠান্ডা করতে হইবো, না কি? -ক্যামনে ঠান্ডা করোন যায় ভাই? -ওরা তো এহনও সকালের নাস্তা করে নাই। আপনে অগোর নাস্তার পয়সাডা দিয়া দেন, বাদবাকি আমি দেখতাছি। ওদিক থেকে আবার হাঁক আসে -বড় ভাই কি এতো কতা অর লগে। আপনে এই গ্যানজামে আইয়েন না, আমগো হাতে ছাইরা দেন।

আমি কাচুমাচু করে বললাম -ভাই কতো দিতে হবে? -আপনার লগে আছে কতো? -এই ধরেন শ’দুয়েক .... -এইডা দিয়া তো অগো ক্ষির খাওনের ট্যাকাও তো হইবো না। দেহি মানি ব্যাগটা দেন তো। আমার অপেক্ষা না করে আমার রক্ষা কর্তা নিজেই মানিব্যাগ উঠিয়ে নিল। খুলে দেখতেই এক চড় এসে পড়ল আমার চাপায়। -মিথ্যা কতা কস ক্যা খানকির পোলা।

আমার হেফাজত কারী আমার মানিব্যাগে থাকা আটশো টাকা পুরো টাই সকালের নাস্তার জন্য নিয়ে নিল। -আর নাই? -না ভাই। এর পর সে আমার সারা শরীর বার কয়েক তল্লাসি করলো। শেষে বলল -এই ট্যাকা তো লাগবো নাস্তা করতেই। আর আমি যে আপনারে বাচাইলাম আমারে কিছু দিবেন না? -আমরা কাছে আর কোন ট্যাকা পয়সা তো নাই ভাই।

-মোবইল? মোবাইল নাই? আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে নিজে মানি ব্যাগের মতো নিয়ে নিলো। হঠাৎ খেয়াল করলাম সকল ছোটভাইয়েরা আবার আমার চার পাশে ঘিরে আছে। তারা যখন আমাকে বেশ কয়েকটা কিল, ঘুসি আর চর থাপ্পর দিয়ে বিদায় নিচ্ছিল তখন আমি মাটিতে শুয়ে। এমন সময় একজন পুলিশ ভাইয়া এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল -কি ভাই মাটিতে শুয়ে আছেন কেন? আমার কাটা ঠোঁটের রক্ত আর জমে থাকা থুথু পুুলিশ ভাইয়ার চকচকে বুটের কাছে নিক্ষেপ করে বললাম -ভাইয়া বেয়াদবির ফল। সিগারেটের জন্য পকেটে হাত দিয়ে দেখলাম সকালে নাস্তার পরে খাওয়ার জন্য তাও নিয়ে গেছে।

পুলিশ ভাইয়া বললেন -তোরে তো ব্যাটা দেখলেই বেয়াব মনে হয়। সাইজ করছে ভালই হইছে। আমি বললাম -হু ঠিকই কইছেন, ভাই আমি আসি? -ফাজিল কোথাকার, যা ভাগ..........! আমি দ্রুত ভাগলাম, পুলিশ ভাইয়া যদি আরার বলে যে -আমার লগে বেয়াদবি করছস, আমার দুপুরের খাবার টাকা আর একটা ল্যাপটপ দিয়ে যা। পনেরো দিন পরের ঘটনা আমি মোবাইলের অভাবে যখন দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন তখন স্ক্রীপ্ট এনালাইসিসের জন্য গেলাম পরিচালক আশরাফ শিশির ভাইয়ের বাসায়। তিনি আমরা একটা সিনেমা বানাবো নামে একটা চল”িত্র তৈরি করতে যাচ্ছেন।

আমি আমন্ত্রন পেয়েছি সেটায় কাজ করার। আমাকে দেখে যথারীতি আক্রমন করে বসলেন -এই মিয়া আপনের মোবাইল বন্ধ কেন? আমি সব খুলে বললাম। সব শুনে তিনি যা বললেন তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। -আরে চলেন আমি আপনেরে একটা মোবাইল কিনা দিতাছি। -ভাই আমার কাছে তো এখন এতো গুলা টাকা নাই।

-আমি দিমু। -বুচ্ছি তো, আপনেরে তো আবার ফেরৎ দিতে হইবো। আমি কিন্তু এক সাথে দিতে পারমু না। -এক সাথে দেওয়া লগবে না, আস্তে আস্তে দিয়েন। আমি তার পিছনে পিছনে গেলাম।

গিয়ে দেখি সে যে মোবাইল কেনার জন্য দরদাম করছে তা আমার সাধের মধ্যে, সাধ্যের বাইরে। -ভাই আমি তো এই মোবাইল কিনতে পারুম না। -শোনেন, আপনে মিয়া মিডিয়ার লোক। আপনার দরকার একটা মাল্টিমিডিয়া ফোন, বেশী কথা কইয়েন না, এইডা লন। আস্তে আস্তে টাকা আমারে ফেরৎ দিয়েন।

আমি নিলাম। আমি ভাবতে পারছি না আসলেই আমি এরকম একটা ফোনের মালিক যে ফোন দিয়ে গান শুনতে পারবো, ছবি তুলতে পারবো, রেডিও শুনতে পারবো, আরো কতো কি? পারলে তো আমি আনন্দে কেঁদে ফেলি। কৃতজ্ঞতায় আমার চোখে জল এলো। সারা রাত ধরে কাজ করলাম। সকালে বাবা ফোন করলেন, তিনি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

এপ্রিলের ১৬ তারিখ তাঁর দুটি অপারেশন হবে। একটি গলব্লাডার আর একটি হারনিয়া। আমি আগেই জানতাম। অফিসের ফাঁকে ছুটে গেলাম বাবাকে দেখতে। বাবার চেহারা দেখে আমার চোখে জল এলো।

অনেক কথাবার্তা বলে মনে সাহস দিয়ে যখন ফিরবো তখন বাবা হাত ধরে একটা কথা বললেন যার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। -কোন দিন তো চাই নাই বাবা এখন অনেক বিপদে পইরা চাইতাছি, আমারে হাজার দশেক টাকা দে। আমি আর পারতেছি না। আমি জানি বাবার চিকিৎসার খরচ চালাতে কষ্ট হচ্ছে। সে তার প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা দিয়ে চিকিৎ চালাচ্ছে তা আমি জানি।

কিন্তু আমার যে সাধ্য নাই! আর এও সত্য যে বাবা আমার কাছে কোন দিন টাকা পয়সা চাননি। আমি অনেক আগে থেকেই আয় করি। মাঝে মধ্যে বাবার অর্থনৈতিক দুরাবস্থা দেখে যখন কিছু টাকা পয়সা দিতে চেয়েছি তখনই এক গাল হাসি দিয়ে বলেছেন -লাগবে নারে পাগল, তোর কাছে রাখ। তুই খরচ কর। তোকে তো কখনও তেমন কোন টাকা পয়সা দিতে পারিনি।

মনে কর আমি নিয়ে আবার তোকে দিলাম। তুই খরচ কর। আমার যখন লাগবে আমি চইবো। আজ মনে হয় বাবার সেই দিন এসেছে। কিন্তু এই মুহুর্তে আমার যে কি অবস্থা তা আমি কাকে বলবো? কি ভাবে বেঝাবো? আমার মনে হল আসলেই আমার মাথায় আকাস ভেঙে পরেছে।

আমি বাবাকে কিছুই বুঝতে দিলাম না। বিদায় নিয়ে চলে এলাম। অনেক প্রিয়ো একজনে কাছে বিষটি খুলে বললাম। তিনি আমাকে নববর্ষে দিন দেবেন বলে আশ্বাস দিলেন। কৃতজ্ঞতার আমার চোখ প্লাবিত হল।

পয়লা বৈশাখ সারাদিন আমরা একটা সিনেমা বানাবোর ক্যাম্পেইন করলাম। এর মধ্যে যে আমাকে টাকা দিবে সে একবার ফোন করে ধানমন্ডির একটা নির্দিষ্ট যায়গায় আসতে বললেন। বললেন রাত আটটার দিকে যেতে। আমি ভাবলাম ভালই হলো বাবাকেও দেখা হবে। সন্ধায় গেলাম বাবাকে দেখতে।

বাবা এক পর্যায়ে বললেন -যা বলছিলাম তা কি আনছো? কাল আমার সিটিস্ক্যান হইবো কিন্তু। -কাল কখন লাগবে? -তোর অফিসের পর নিয়া আসিস। অপারেশনের যে টাকা জমা দিছি সেইটা দিয়া সিটিস্ক্যান করামুনে আর তুই টাকাটা দিলে সেইটা আবার অপারেশনের জন্য জমা দিমু। অপারেশন তো পরশু। -আচ্ছা কোন সমস্যা নাই।

আমি চলে এলাম। ধানমন্ডির নির্দিষ্ট যায়গায় এসে তাকে ফোন দিলাম। সে এসে হাজির। একটু আড়ালে নিয়ে আমার হাতে দশটা একহাজার টাকার নোট দিয়ে বলল -ভাই আমিও তো বউ বাচ্চা নিয়া ঢাকায় থাকি....। তুমি কষ্ট কইরা হইলে সামনের মাসে পাচ আর পরের মাসে পাচ দিয়া দিও।

-ঠিক আছে ভাই, আপনে কোন চিন্তা কইরেন না। আমার এই চরম বিপদের সময় যেই উপকারটা করলেন তা কোন দিনও ভুলবনা........ ইত্যাদি ইত্যাদি বলে বিদায় নিলাম। পয়লা বৈশাখ বলে শ্যামলীর কোন গাড়ীই পাওয়া যাচ্ছে না। ভাবলাম রিক্সায় যাই। ধানমন্ডি ল্যাবএইডের সামনে থেকে শ্যামলি ওভার ব্রীজ পর্যন্ত ভাড়া চাচ্ছে ষাট টাকা।

এর কমে কেউই যাবে না। বাধ্য হয়ে হাটা শুরু করলাম। ধানমন্ডি থেকে শ্যামলী যাচ্ছি হেঁটে। এরকম আমি প্রায়ই যাই। আমি হাঁটছি হাতের ডানদিক দিয়ে।

নতুন কেনা মোবাইলে কথা বলছি আর হাঁটছি। হাঁটতে হাঁটতে যখন আমি শিশুমেলার কাছাকাছি, তখন আমার উল্টা দিক থেকে হেঁটে আসা এক কিশোর তার সর্ব শক্তি দিয়ে আমাকে একটা ধাক্কা মেরে নিজেই মাটিতে পরে কাতরাতে লাগল। আমি যথারীতি দাড়িয়ে পরলাম। আমার ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে আমি কেটে পরতে চাইছি, কারণ আমি তাদের চিনতে পেরেছি। কিন্তু ততক্ষনে সময় শেষ।

কোত্থেকে আরো আট থেকে দশ জন এসে এমাকে ঘিরে ফেলেছে। সবার সাথেই ধারালো চাকু ক্ষুর ইত্যাদি। কেউ কেউ আবার পিস্তলের গল্পও করছে। আমার কিছু করার নেই ্ওরার একে একে এমার মোবাইল, বাবার অপারেশনের জন্য ধার কারা টাকা সব নিয়ে নিচ্ছে। আমি পরে আছি।

আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে...। আসে পাসের রাস্তা ঘাট..... দোকান পাট..... সব এক সময় বিলিন হয়ে গেল আমার চেখের সামনে থেকে.......... আজ এপ্রিলের ষোল তারিখ...........

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.