আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুক্তিযুদ্ধকে শান্তিতে থাকতে দিন, দয়া করে......

এইখানে শায়িত আছেন বাংলা ব্লগ ইতিহাসের কলঙ্ক...
সুদীর্ঘ প্রায় ৩৮ বছর হয়েছে আমরা স্বাধীন হয়েছি। ৩৮ বছরে কি পেয়েছি, কি পাইনি সে হিসেবে যাবো না তবে এটুকু বলতে পারি বুদ্ধিজীবি নামক কিছু বেঁচুবাবু আমরা ঠিকই পেয়েছি। এদের কেউ কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক, কেউ বা প্রবীণ সাংবাদিক আবার কেউ বা রিটায়ার্ড আর্মি অফিসিয়াল। সমস্যাটা হচ্ছে জীবনের কোন একটি ক্ষেত্রে ব্যপক সাফল্যকে আমরা একটা লাইসেন্স হিসেবে ধরে নেই। লাইসেন্সটা হলো দেশ নিয়ে কথা বলার, দেশের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎকে শিঁকেয় তুলে কফি খেতে খেতে ক্যামেরার সামনে বসে সরাসরি সম্প্রচারে দেশের ব্যবচ্ছেদ করার।

মানুষের জীবনের বাণিজ্যকরন হচ্ছে। জীবনের সবকিছুতেই লাগছে বাণিজ্যকরনের ছোঁয়া। তার ভালো দিক যেমন আছে, আছে সিভিয়ার কোয়েন্সিকোয়েন্সও। শিক্ষার জন্যে যেমন আছে কোচিং সেন্টার, তেমনি করে মুক্তিযুদ্ধের জন্যে আছে আমাদের কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান আর বুদ্ধিজীবিরা। পার্থক্য এটুকুই যে বুদ্ধিজীবিরা করছেন আপন স্বার্থে আর কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে।

যে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো দেশ গড়তে আজ তার ব্যবহার হচ্ছে বেশ ধরতে। কর্পোরেট কালচারের অঘোষিত গাইডলাইন বলে ব্যবসা করতে হলে মানুষের মনের সফটকর্ণারগুলোকে টার্গেট করতে হয় - অর্থাৎ এমন কোন কিছু যা নিয়ে আমরা অনেক অনুভূতিপ্রবন, যা আমাদের কাছে অনেক মূল্যবান কিছু। এমন এক সফটকর্ণার যাকে জড়িয়ে কিছু বললেই মানুষের মন গলে যাবে। আমরা যারা বাঙালি তাদের মনে এমনই কিছু সফটকর্ণার আছে। তার মধ্যে দু'টি অবশ্যই - মুক্তিযুদ্ধ আর ধর্ম।

একদিকে যেমন মুক্তিযুদ্ধের টেন্ডার নিয়েছে বুদ্ধিজীবি আর কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো অপরদিকে তেমনিভাবে ধর্মের টেন্ডার নিয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী একটি গোষ্ঠী। এদের হাব-ভাবে মনে হয় তারা বাদে আর কারো যেনো এগুলো নিয়ে কিছু বলার নেই। প্রতিযোগিতায় নেমেছে যেনো ওরা - কে কাকে পেছনে ফেলতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি বাংলাদেশের একটি মোবাইল কোম্পানীর কথা, যারা তাদের একটি প্যাকেজের বিজ্ঞাপণে মুক্তিযুদ্ধের আবেগকে কাজে লাগিয়ে সাধারন মানুষের মন টানার চেষ্টা করছে - নিজেদেরকে স্বাধীনতার ধারক-বাহক বলে দাবী করছে। আবার তারাই তাদের যে পণ্যটি অপেক্ষাকৃতভাবে তরুণ সমাজের কাছে জনপ্রিয় সেখানে তারা আমাদের তরুণদেরকে এক কিম্ভূতকিমাকার সংস্কৃতি ধারণে উৎসাহ দিচ্ছে, সেখানে আবার তাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই।

অবশ্য থাকা উচিৎও না, কারন কর্পোরেট কালচার তা করার নির্দেশ দেয় না - করলে পণ্যের চাহিদা কমে যাবে। হায়রে মুক্তিযুদ্ধ! তুমি এখন আমাদের চটকদার ঝলমলে Wrapping পেপার। অবশ্য এসব কথা বলা আমাদেরকে মানায় না। কারন দিনের পর দিন ধরে স্বাধীনতাকে আমরাই সস্তা করে ফেলেছি। আমরাই যাকে তাকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলার সুযোগ দিয়েছি।

ফলটা যা হবার তাই হয়েছে - আজ মুক্তিযুদ্ধের একটি ঘটনার ৪/৫ রকম বর্ণনা পাওয়া যায়। সত্য ইতিহাস অজানাই থেকে যায়। আমি বলছি না মুক্তিযুদ্ধ কোন পবিত্র কিতাব বা অছুঁত কিছু - যাকে নিয়ে কথা বলা যাবে না। কিন্তু এমন কোন কিছু যার সাথে আমার জাতীর অতীতই নয় শুধু - বর্তমান ও ভবিষ্যৎও জড়িত তাকে অন্ততঃ এর চাইতে বেশি সুরক্ষা আমি অবশ্যই দিতে চাইবো। আজ দেশে কোন ঘটনা ঘটলেই তা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রসঙ্গ মুক্তিযুদ্ধে নিয়ে আসা হয় হয় - তা সে বসুন্ধরা সিটিতে আগুনই লাগুক, বিডিআর বিদ্রোহই হোক আর হাডুডু তে বাংলাদেশ দলের জয়ই হোক।

আমার এখনও মনে আছে, ৯৯' এর ক্রিকেট বিশ্বকাপে আমাদের জাতীয় দল যখন পাকিস্তানকে হারিয়েছিলো তখন অনেককেই বলতে শুনেছি এই বিজয় নাকি ৭১' এর মুক্তিযুদ্ধের মতোই আমাদের আরেকটি বিজয়। তখন কথাটা কেবল শুনেছি, এখন উপলব্ধি করি কথাটা কতোটা অপমাণকর। কতোটা অপমাণকর কথাটা একজন মুক্তিযোদ্ধার কাছে যিনি মুক্তিযুদ্ধে দুই পা হারিয়ে পঙ্গু হয়েছেন। কতোটা অপমাণকর কথাটা সেই সন্তানটির কাছে যে সন্তানটি তার শহীদ পিতাকে দেখেনি কখনো। না! আমাদের কোন অধিকার নেই সামান্য ৯ ঘন্টার ক্রিকেট ম্যাচকে ৯ মাসব্যপী রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধের সাথে তুলনা করার।

কারন মুক্তিযুদ্ধ কোন খেলা নয়। আজকের প্রথম আলোতে শীঘ্রই কার্যক্রম শুরু করতে যাওয়া একটি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের একটি বিজ্ঞাপণ দেখে অত্যন্ত ব্যথীত হয়েছি। বিজ্ঞাপণটা না দেখে থাকলে দেখে নিন: বড় ও স্পষ্ট করে দেখতে: View this link বিজ্ঞাপণটিতে উক্ত স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের সংবাদকর্মীদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের তুলনা করা হয়েছে। অভাবনীয়! আমি জিজ্ঞেস করি আপনাদের টিভি চ্যানেল কি সাড়ে ৭ কোটি মানুষের আশা ভরসাকে বয়ে নিয়ে বেড়ায়? জীবনের ভয়কে বিসর্জন দিয়ে, সামনে কি বিপদ অপেক্ষা করছে তার তোয়াক্কা না করে, দেশমাতৃকার জন্য সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় নিয়ে যারা যুদ্ধ করে তাদের সাথে শুধুমাত্র বীরের তুলনা চলে - আর কারো নয়। টেলিভিশনে লাইভ শো তে বসে বিডিআরে গোলাগুলি দেখতে দেখতে সহজেই দেশ ও জাতির ব্যবচ্ছেদ করা যায়, ভাড়া করে বুদ্ধিজীবি ডেকে এনে শো শেষে তাদের হাতে ৫,০০০ টাকার খাম ধরিয়ে দিয়ে বিদায় করে প্রতিদানে মনগড়া চাঞ্চল্যকর সব তত্ত্ব আর বিস্ফোরক সব মন্তব্য হাজির করা যায় - কিন্তু এভাবে দেশ গড়া যায় না।

আমি বিজয় দেখিনি। বিজয়ের ১৭ বছর পর আমার জন্ম। কিন্তু এতোটুকু অন্ততঃ বুঝি ঐ লোকগুলো টানা ৯ মাস ধরে পুতুলখেলা খেলতে ঘর-বাড়ি, বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তান ছাড়েনি। আজ যখন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শুনি, বই পড়ি, লোকমুখে যখন শুনি ঐ লোকগুলোর বীরগাথা - এটুকু অন্ততঃ বুঝি তারা নিশ্চয়ই মহান কিছু করেছিলেন। এই উপলব্ধিটার জন্যে বুদ্ধিজীবি হওয়া লাগে না, টক-শোতে বসে গোঁফে তা দিতে দিতে দেশ-জাতির চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করতে হয় না - সামান্য কমন সেন্সই যথেষ্ট।


 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.