ধন্যবাদ
যেসব সাধারণ সৈনিক বা জওয়ান আমাদের সীমান্ত গৌরব ও বীরতে¦র সঙ্গে রক্ষা করে এযাবৎকাল আমাদের প্রশংসা অর্জন করেছেন, আজ তাঁরাই দেশের মানুষের কাছে অপরাধী, অনেকের চোখে ‘ক্রিমিনাল’। যেসব প্রতিষ্ঠান জাতীয় প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত¦পূর্ণ তথ্য, বিশে¬ষণ ও পরামর্শ দিয়ে দেশের সার্বভৌমত¦ রক্ষা করবার কথা, আজ তাঁরা বিকল। অকার্যকর। কেন তাঁরা পিলখানার ঘটনাবলীর আগাম আভাস পান নি বা পেলেও ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় পৌঁছাতে পারেন নি সেটা আমাদের মতো সাধারণ নাগরিকদের কাছে এখনো অ¯পষ্ট। বিপজ্জনক যে এটা চিরকাল অ¯পষ্টই থেকে যাবে।
কথায় কথায় বিদেশ থেকে এফবিআই, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড ও ভিনদেশের নানাবিধ গোয়েন্দা সংস্থার কাছে ‘সাহায্য’ পাওয়া ও নেবার জন্য ক্রমাগত ডাক আমরা শুনে আসছি, তারা সঙ্গে সঙ্গে এই উদার আহ্বানে আনন্দচিত্তে সাড়া দিয়েছেন, কখনো নিজের গরজে বলা নাই কওয়া নাই হাজির হয়েও গিয়েছেন এবং যাচ্ছেন। অবস্থাদৃষ্টে এই আন্দাজ ক্রমশ পরি®কার হয়ে উঠছে যে আমাদের রক্ষা করবার জন্য কোন জাতীয় সংস্থা নাই। বিজাতীয় হয়ে গিয়েছে সব কিছুই। জাতীয় প্রতিরক্ষাব্যবস্থার এই ভয়াবহ বিপর্যয় ও সামগ্রিক বিকট পরিস্থিতিতে কফিনের ওপর শেষ পেরেকটি মারা হয়েছে আরো কায়দা করে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে সারা পৃথিবীর মানুষকে শোনানো হোল কিভাবে আমাদের সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা একটি নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে ডেকে নিয়ে কী ভাষায় তাঁদের কাছে জবাবদিহি করবার জন্য পীড়াপীড়ি করছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী সেনাবাহিনীর সঙ্গে যে সভা করেছেন তা রেকর্ড করা হয়েছে এবং ইন্টারনেটে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এক দিকে যেসব প্রশ্ন করা হয়েছিল তার সব ক’টি প্রশ্ন জাতীয় সংসদেই তোলার কথা। তার উত্তরও প্রধানমন্ত্রীকে জাতীয় সংসদেই দিতে হোত। জাতীয় সংসদই গণতন্ত্রে জবাবদিহিতার জায়গা। অথচ জাতীয় সংসদের বিরোধী দল বলতে কার্যকর কিছুই নাই।
দুই বছরের সেনাশাসনের কারিগরি, সুশীলসমাজের বদান্যতা এবং ক্ষমতাসীনদের আয়োজনে নির্বাচনে বিপুল ভোটে আমরা শেখ হাসিনার একনায়কতন্ত্র কায়েম করেছি। জাতীয় সংসদ নামে যা গঠিত হয়ে রয়েছে তা এই একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতাকে বৈধতা দেবার জন্য মাত্র। এর বাইরে এই সংসদের ভূমিকা শূন্য। আমাদের যেমন প্রতিরক্ষা বলে এখন আর কিছুই নাই, ঠিক তেমনি ‘জাতীয় সংসদ’ নামে যা রয়েছে তাকে আর যা-ই হোক জাতীয় সমস্যা মোকাবিলার জন্য সর্বোচ্চ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান গণ্য করা যায় না। আমরা ভয়াবহ বিপদে পড়েছি।
আজ সেনাবাহিনীসহ সমাজের সকলকেই প্রশ্ন করতে হবে সমাজ, রাষ্ট্র ও সংসদে এই যে ভারসাম্যহীন অবস্থা তাকে কিভাবে আমরা মূল্যায়ন করব? এই ক্ষেত্রে কার কী ভূমিকা? রাজনীতিবিদদের দুর্নীতি ও রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন তো আমরা জানি। কিন্ত– সুশীলসমাজের ভূমিকাটা কী? গণমাধ্যমের? সৈনিকের মর্যাদা রক্ষা করে যাঁরা মেরুদণ্ড সোজা করে হাঁটেন তাঁকেও সততার সঙ্গে প্রশ্ন করতে হবে সেনাবাহিনীরই বা ভূমিকা কী ছিল? দেশের এই ভয়াবহ বিপর্যয়ের জন্য দায়ী কে? কারা? কিভাবে? অন্যকে নয়, নিজের ভুল নিজেরা যতো তাড়াতাড়ি আমরা ধরতে পারব ততো তাড়াতাড়ি আমরা এই বিপর্যয় থেকে নি®ক্রান্ত হবার সমাধানও খুঁজে পাব। মানতেই হবে যে সার্বভৌমত¦ ও রাষ্ট্রের টিকে থাকার ক্ষেত্রে বড়ো ধরনের ক্ষতি ঘটে গিয়েছে। সেটা আবার মীমাংসার অতীত হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। যে ক্ষতি হয়ে গিয়েছে তার মূল্য আজ সকলকেই খুবই কঠিনভাবে দিতে হবে।
অথচ এখনো আমরা উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা আদায়ের নোংরা কৌশল চর্চা করে যাচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রীও সেনাবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে সভা করেছেন। সেই সভার শ্র“তিকথন এমপিথ্রি ও অন্যান্য ফর্মেটে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এই ছড়িয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যে ধারণা প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়েছে সেটা হোল্ল (ক) সেনাবাহিনীর মধ্যে শৃড়খলার মারাত্মক অবনতি ঘটেছে এবং যেকোন মুহূর্তে রাজনৈতিক ও সামরিক অঘটন ঘটে যেতে পারে; (খ) রাষ্ট্র ও সংবিধানের সঙ্গে সেনাবাহিনীর স¤পর্ক এবং তার অধীনস্থতা মেনে নেওয়ার সামরিক ও রাজনৈতিক গুরুত¦ উচ্চ পর্যায়ের সেনাকর্মকর্তাদের মধ্যে কতোটুকু আছে সেই বিষয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে; (গ) সেনাকর্মকর্তারা পুরো ঘটনটায় প্রচণ্ড ভাবে বিচলিত, ক্রুদ্ধ, আবেগসর্ব¯¦ হয়ে গিয়েছেন; সেনাবাহিনীকে সুশৃড়খলভাবে পরিচালনার জন্য বিপদের সময় যে স্থিরতা, বিচক্ষণতা ও দূরদৃষ্টির প্রয়োজন তার মারাত্মক অবনতি ঘটেছে; মনে হচ্ছে সেনাকর্মকর্তারা এই ঘটনার মানসিক চাপ সহ্য করতে পারছেন না, সৈনিকের মনোবল ও দৃঢ়তা বিচারের দিক থেকে এই সব ভাল লক্ষণ নয়; (ঘ) সেনাবাহিনী পুরো ব্যাপারটাকে সেনাবাহিনী ও বিডিআরের বিরোধ আকারে শুধু দেখছে এবং জাতীয় প্রতিরক্ষার সংকট আকারে ভাবতে চাইছে না বরং তাঁরা কেবল অবিলম্বে তাঁদের সহকর্মীদের হƒদয়বিদারক হত্যাকাণ্ডের বিচার চান; (ঙ) সেনাবাহিনী স¤পর্কে যে অভিযোগ উঠেছে এবং যে সকল দাবিদাওয়া তুলে বিডিআর জওয়ানদের বিদ্রোহ সংঘটিত করা হয়েছে হত্যাকাণ্ডের নারকীয়তা ও নির্মমতার কারণে সেই সকল বিষয় স¤পূর্ণ গৌণ হয়ে গিয়েছে; (চ) সেনাবাহিনী ও বিডিআরের মধ্যে দূরত¦ কমিয়ে আনাই এখনকার বড় কাজ সেই ক্ষেত্রেও উপলব্ধির অভাব রয়েছে শ্র“তিকথন প্রচারের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পরাশক্তির কাছে প্রমাণ করা সহজ হয়েছে যে, একটা পেশাদার সেনাবাহিনীর চরিত্র, চারিত্রিক দৃঢ়তা ও মানসিক বলের অভাব ঘটেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে। কারা এই সভা রেকর্ড ও প্রচার করল সেটা যেমন একটা প্রশ্ন, তেমনি এতো সহজে এটা রেকর্ড ও প্রচার করতে পারার অর্থ প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় একটা ধস নেমেছে যা আমাদের আশংকিত না করে পারে না।
যেকোন মুহূর্তে একটি অঘটন আসন্ন এবং নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে দেওয়া হতে পারে বিশেষত যে সরকার ধর্মনিরপেক্ষ, পাশ্চাত্যমুখী ও ভারতের বšধু আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ভাবে এই আশংকা প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করা সহজ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সেনাবাহিনীর সভায় যাঁরা আবেগের বশবর্তী হয়ে প্রধানমন্ত্রীকে নানা প্রশ্ন করেছেন, তাঁরা ‘ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সরকার’কে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারেন বলে চিহিপ্তত হয়েছেন।
এই পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনার সরকারকে যেকোন মূল্যে রক্ষা করবার পক্ষে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়া ভারতের শাসক ও শোষক শ্রেণীর পক্ষে সহজ হয়েছে। তাঁরা এখন বলছেন ভারত শেখ হাসিনার সরকারের কিছু হলে বসে থাকবে না। বাংলাদেশে হস্তক্ষেপের জন্য ভারতের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় করে নেওয়া এখন মোটেও কঠিন হবে না।
ভারত প্রাণপণ প্রচার করছে এটা জেএমবি বা সন্ত্রাসী ইসলামপন্থিদের কাজ। ভারতীয় প্রচারমাধ্যমগুলো ক্রমাগত ইসলামি জঙ্গি বিভীষিকা সৃষ্টি করে যাচ্ছে। ফলে আন্তর্জাতিক ভাবে ইসলামি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যেকোন ব্যবস্থা নেবার পক্ষে ভারত আন্তর্জাতিক সমর্থন পাবার ব্যবস্থা পাকা করে ফেলেছে।
ভারতের শাসক ও শোষক শ্রেণীর পক্ষের গণমাধ্যমগুলো শুরু থেকেই প্রচার করছে এটা জেএমবি-জামায়াত-বিএনপি চক্রের কাজ। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারও একই ধারায় অভিযোগ করে চলেছে।
বাণিজ্যমন্ত্রী সরকারের পক্ষ থেকে তদন্ত সমš¦য়ের ভার পেয়েছেন। কিন্ত– তিনি তদন্ত-টদন্ত না করেই বলে দিয়েছেন, এটা জেএমবির কাজ। সেটা হতেও পারে। তবে সেটা তদন্ত শেষে সিদ্ধান্তের বিষয়। তদন্তের আগে নয়।
তবে যদি তিনি এতোই নিশ্চিত হয়ে থাকেন তাহলে আর তদন্তেরই বা কী দরকার! অন্য দিকে এটা যে ভারতের হিন্দুত¦বাদী সন্ত্রাসীদের কাজ নয় সেটাই বা তাঁকে নিশ্চিত করল কে? আমরাও বা নিশ্চিত হই কী করে? ভারতে নির্বাচন আসন্ন। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও ভারতের বিভিন্ন ঘটনাবলীকে ভারতের শাসক ও শোষক শ্রেণী ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধে’-র কাঠামোর মধ্যে সাজাতে চাইছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটা এখন পরি®কার যে, যখনই তারা প্রয়োজন মনে করে তখনই ‘ইসলামি সন্ত্রাস’ দমনের জন্য বাংলাদেশে ঢুকে পড়তে পারে।
এতে ভারতের শাসক ও শোষক শ্রেণীর জন্য আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারে যেমন সুবিধা, একইভাবে আগামি নির্বাচনে ভারতের হিন্দুত¦বাদী দলগুলোর পক্ষে জনমত তৈরির জন্যও সুবিধা। যদি বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলংকায় ভারতের বšধু সরকারগুলো অস্থিতিশীল হয় তাহলে সামগ্রিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় যে পরিস্থিতি তৈরি হবে তা একমাত্র হিন্দুত¦বাদী সরকারের পক্ষেই সামাল দেওয়া সম্ভব।
১৬ মার্চ ২০০৯ তারিখে ভারতীয় পত্রিকা আউটলুক প্রণয় শর্মার যে প্রতিবেদন ছেপেছে ((Hidden Emirates of Anachistan) তার মূল সুরটাও ঠিক এখানেই। প্রণয় শর্মা বলতে চাইছেন, মুম্বাই হামলা, পাকিস্তানে শ্রীলংকার ক্রিকেটারদের ওপর আক্রমণ এবং বাংলাদেশের বিডিআর বিদ্রোহ একই সূত্রে গাঁথা। ভারতের বিশেষত ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার এই প্রচারণা আমাদের গুরুতে¦র সঙ্গেই নেওয়া উচিত এই কারণে যে, এই প্রচারণার সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের রাজনৈতিক মতলব বুঝতে আমাদের সুবিধা। এই প্রচারণার ব্যবচ্ছেদ করলে আমরা বিডিআর হত্যাযজ্ঞের পরিকল্পনা কী ছকে সাজানো হয়েছিল তার নকশাটাও ধরতে পারব। ভারতীয়রা যখন এতোটাই জানে তাহলে পরিকল্পনা আঁটার সঙ্গে তাদের যোগ ছিল না এটা বলা যাবে না।
তারা বলছে, বিডিআর বিদ্রোহের অর্থনৈতিক দাবিদাওয়া কারণ হিশাবে ছিল, কিন্ত– এর আসল উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার থামিয়ে দেওয়া। আউটলুকের দাবি, যদি এই বিচার হোত তাহলে বিএনপি-জামায়াত ও পাকিস্তান বিপুলভাবে জনপ্রিয়তা হারাতো (ঐঁমবষু ঁহঢ়ড়ঢ়ঁষধৎ)। অতএব যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাবার জন্যই নাকি এই কাণ্ডটি ঘটানো হয়েছে।
গুড। ঠিক এই কথাগুলোই কোন প্রকার তদন্তের আগেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের লোকজনের কাছেই আমরা শুনেছি।
তবে আউটলুকের প্রতিবেদন পড়ে আমরা বুঝতে পারছি যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রশ্নটার মধ্যে বিচার বা ইনসাফের কোন ব্যাপার নাই। বাংলাদেশের জনগণ ইনসাফ চায়। অবশ্যই। আওয়ামী লীগের পক্ষে দাঁড়িয়ে বিএনপি, জামায়াত পাকিস্তানকে নিন্দা জানিয়ে রাজনৈতিক ¯¦ার্থ হাসিল আর ইনসাফ কায়েম এক কথা নয়। অথচ আউটলুকের প্রতিবেদন পড়লে মনে হয় যুদ্ধাপরাধের বিচার নিছকই রাজনৈতিক ব্যাপার, শুধু বুঝি বিএনপি, জামায়াত ও পাকিস্তানকে নিন্দার মধ্যে ফেলে দেওয়ার জন্যই এই রাজনৈতিক কৌশল।
আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ-সংক্রান্ত বিধিবিধানের কাঠামোয় যারাই অপরাধ করেছে, তাদের বিচার হোক। একাত্তরে যারা নির্যাতিত ও নিপীড়িত হয়েছিল এবং যাদের প্রতি ইনসাফ হয় নি, বাংলাদেশের জনগণ চায় তারা ইনসাফ পাক। কিন্ত– আউটলুকের আউটলুক অন্যত্র। তারা চায় এর মাধ্যমে ভারতের মিত্র আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ শক্তিকে নিন্দিত করবার রাজনীতি। বিচার নয়, রাজনীতিই এখানে মুখ্য।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তো ভারতই হতে দেয়নি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যে সকল সদস্যকে যুদ্ধাপরাধের জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছিল, তাদের পাকিস্তানে ফিরিয়ে দেবার ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকার কথা ভুলে গেলে চলবে না। একাত্তরে পাকিস্তান একটি পরাজিত শক্তি। ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হয়েছে। বিজয়ী শক্তির উচিত ছিল যুদ্ধাপরাধীর বিচার করা।
কিন্ত– ভারত সেটা করেনি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে গেলে এই প্রশ্নগুলো উঠবে। নিন্দা পাকিস্তানের যতো হবে তার চেয়ে শতগুণ হবে যুদ্ধে জয়ী ভারতের, যারা যুদ্ধাপরাধীদের পাকিস্তানে ফেরত পাঠিয়েছিল। তাহলে তো দেখা যাচ্ছে বিডিআর হত্যাযজ্ঞে ভারতের স¤পৃক্ত থাকার সম্ভাবনাই বেশি। যদি তদন্ত ও তথ্য ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার সামগ্রিক রাজনীতির বিশে¬ষণ আমরা করি তাহলে পিলখানায় সেনাকর্মকর্তাদের হত্যাযজ্ঞে ভারতের যুক্ত থাকার পক্ষেই সবচেয়ে বেশি যুক্তি দেওয়া সম্ভব।
তর্কে তর্কই শুধু বাড়ে।
নজির হিশাবে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার এককালের জাঁদরেল কর্মকর্তার লেখা থেকে উদ্ধৃতি দেব। বি. র্যামন এখন বাংলাদেশে যথেষ্ট পরিচিত। তিনি ১৯৮৮-১৯৯৪ সাল পর্যন্ত ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ এন্ড এনালাইসিস উইংয়ের কাউন্টার ইনটেলিজে›স বিভাগের প্রধান ছিলেন। তিনি রসায়ন শাস্ত্রে পড়াশোনা করেছেন, সাংবাদিকতায়ও পাঠ নিয়েছেন।
তাঁর ২০০১ সালে লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি। র্যামন নিজেই ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ স¤পর্কে একটি মূল্যায়ন করেছিলেন। সেই মূল্যায়ন থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে তাঁর ২০০১ সালের লেখা শুরু করেছেন। বলছেন ঃ There are individual officers in the Bangladesh intelligence community and in its security forces, who feel positively towards Sheikh Hasina (Prime Minister) and her father, but one con not say the same thing of these organisations as institutions. Institutionally, they may not share with her the same enthusiasm for closer relations with India and for assisting it in dealing with the insurgency (in the North-East). It would take her and her party considerable time to understand and assess the intricacies of their working and the labyrinthine relationships which they have built up with their Pakistani counterparts during the last 21 years. She, therefore, has to move with caution শেখ হাসিনার পক্ষে বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থার কেউ কেউ সেনাবাহিনীর অনেকে ইতিবাচক মনোভঙ্গি পোষণ করতে পারেন তবে প্রতিষ্ঠান হিশাবে সেনাবাহিনী তাঁর পক্ষে নয়। কারণ র্যামনের দাবি সেনাবাহিনীর মধ্যে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই কাজ করেছে।
সেনাবাহিনীর মধ্যে ‘ ইসলামীকরণ’ ঘটেছে।
The savage manner in which 15 members of India’s Border Security Force (BSF) were reportedly abducted, tortured, killed and their bodies mutilated beyond recognition last week shows that even after almost five years in power, Sheikh Hasina is apparently not in total command of her military and intelligence establishment, which like its counterpart in Pakistan, has been infected by the fundamentalist virus of Afghan vintage and is probably developing an agenda of its own vis-a-vis India. র্যামন পদুয়া-রৌমারী যুদ্ধের উদাহরণ টেনে প্রমাণ করছিলেন যেভাবে বিডিআর ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে মেরেছে তাতে প্রমাণিত হয় সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার ওপর শেখ হাসিনার পুরাপুরি নিয়ন্ত্রণ নাই। তবে যেভাবে ভারতীয় সৈন্যদের মারা হয়েছে তার জন্য তাঁর আক্রোশ প্রচণ্ড। সেই ১৯৯৭ সাল থেকেই র্যামন প্রমাণ করে আসছেন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে ‘ইসলামীকরণ’ ঘটছে এবং ‘আফগান’ ভাইরাস দ্বারা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আক্রান্ত। বি¯¥য়কর যে একই উদ্ধৃতি তিনি আবারও পিলখানার বিদ্রোহ ও হত্যাযজ্ঞের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন।
বারবারই তিনি একই কথা বলছেন। তিনি বারবারই জোর দিচ্ছেন ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে যেভাবে মারা হয়েছে সেটা পাকিস্তানি জেনারেলদের নির্মমতার সঙ্গেই তুলনীয়। একই ভাবে তিনি বিডিআর জওয়ানদের নৃশংসতার বয়ানও তুলে ধরেছেন। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের প্যাটার্নের সঙ্গে তিনি পাকিস্তানি কায়দায় নৃশংসতার তুলনা করে বোঝাতে চেয়েছেন এটা পাকিস্তানিদেরই কাজ। এখন বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থা ও সেনাবাহিনীকে পরিশুদ্ধ করা ভারতীয়দের একটি প্রধান কাজ হয়ে উঠেছে।
বলাবাহুল্য এই কর্তব্য শেখ হাসিনার ঘাড়েই এসে পড়েছে। র্যামনের লেখালিখির কারণে অনেকে দাবি করছেন, বিডিআরের ঘটনা ভারতীয় প্রতিশোধের অংশ এবং একই সঙ্গে বিডিআর ও সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ বাধিয়ে উভয়কেই ধ্বংস করার পরিকল্পনা। এর প্রতিক্রিয়ায় শেখ হাসিনাকে যদি সরিয়ে দেবার চেষ্টা হয় তবে ভারত যে হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না সেটা আউটলুক পত্রিকায় প্রণব মুখার্জির বরাতে বলে দেওয়া হয়েছে।
ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা তাদের ¯¦ার্থে নানান ধরনের প্রচার ও প্রপাগান্ডা চালাতেই পারে। কিন্ত– একই সঙ্গে সেটা যখন আওয়ামী লীগের ভাষ্য হয়ে ওঠে তখনই তার মানে ভিন্ন হয়ে দাঁড়ায়।
আমরা চাই শেখ হাসিনা জাতীয় ¯¦ার্থের জায়গায় দাঁড়িয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রচারণার ফাঁদে পা দেবেন না। আমরা একটি জাতীয় বিপর্যয়ের মধ্যে আছি। এর সমাধান আমাদেরকেই খুঁজে বের করতে হবে। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার যে সকল সস্তা ভাষ্য অনায়াসেই ইন্টারনেটে পাওয়া যায়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কর্তাব্যক্তিদের কথার সঙ্গে তার বি¯¥য়কর মিল আমাদের শুধু আশংকিত নয়, আতংকিতও করে।
বাংলাদেশের জনগণ, সেনাবাহিনী, বিডিআর জওয়ানসহ সকল রাজনৈতিক দলের প্রতি আমাদের বিনীত অনুরোধ হব্লে ধৈর্য ও সামগ্রিক পরিস্থিতি অনুধাবনের জন্য প্রজ্ঞার চর্চা।
একই সঙ্গে আমরা মনে করিয়ে দিতে চাই ভারতের জনগণ আর ভারতের শাসক ও শোষক শ্রেণী এক নয়। বিডিআরের বিদ্রোহ ও সেনাকর্মকর্তাসহ বিডিআর জওয়ান ও সাধারণ মানুষের করুণ ও হƒদয়বিদারক মৃত্যুতে ভারতের গণতান্ত্রিক জনগণ যেমন ব্যথিত তেমনি বাংলাদেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ে তাঁরা উদ্বিগ্নও বটে। কারণ এই অস্থিতিশীলতা পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় দাবানলের মতো ছড়িয়ে যাবে। নেভানো অসম্ভব হবে।
পরিশেষে বলে রাখি বিডিআরের নাম বদলানো এবং তার সাংগঠনিক কাঠামোর পরিবর্তনের কথা চলছে।
বি. র্যামনসহ অন্য ভারতীয়দের লেখালিখিতে ¯পষ্ট বিডিআর বা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর খোলনলচে বদলে দেওয়া ভারতীয় পরিকল্পনার অংশ। যদি সেটা ঘটে তাহলে আমরা বুঝব ১৯৯৭ সাল থেকে বি. র্যামন ও তাঁর সহকর্মীরা যে উদ্দেশ্যে কাজ করে আসছিলেন ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার আমলে তার পূর্ণ বাস্তবায়ন ঘটল। বিডিআরের নাম পরিবর্তন এবং তার কাঠামোর সংস্কার মাত্রই সেই সব বিশে¬ষকের দাবিকেই সত্য প্রমাণ করবে যে পদুয়া-রৌমারীর প্রতিশোধ নেওয়া এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করে তাকে নতুনভাবে ‘সেক্যুলার প¬ান’ অনুযায়ী সাজানোর জন্যই পিলখানা হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত করা হয়েছে।
এক ঢিলে দুটো পাখি হত্যা করা যায়। বাংলাদেশের করুণ ইতিহাস সেটাই কি তাহলে প্রমাণ করতে চলেছে ?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।