বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি দুবার মাত্র /সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
-----------------------------------------------------------------
আমি ‘পূর্ব পশ্চিম’ নামে উপন্যাসটি রচনা করার সময় স্বাধীনতা-পরবর্তী পূর্ব পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ-এর মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রহ করার জন্য অনেক বই সংগ্রহ করেছিলাম, প্রচুর পুরোনো পত্রপত্রিকাও ঘাঁটাঘাঁটি করতে হয়েছিল। সেই সব তথ্য থেকে গড়ে ওঠে আস্তে আস্তে এক ছাত্র নেতা থেকে গণনেতা, তারপর সব বাঙালির প্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের উজ্জ্বল চরিত্র। ঐ উপন্যাসে স্বাভাবিকভাবে তাঁর কথা আছে অনেকখানি জায়গা জুড়ে এবং লেখার আগেই আমি তাঁর ভক্ত হয়ে পড়ি। সমগ্র জাতিকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে এমন নেতা আর তখন দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে চাক্ষুষ দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে মাত্র দুবার।
ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর স্থান নিয়ে অনেক বই লেখা হয়েছে এবং আরো লেখা হবে।
আমি আর নতুন কী বলবো? ব্যক্তিগত কিছু কথাই মনে পড়ে।
ঊনিশশ একাত্তর সালের পঁচিশে মার্চের পর কী ঘটেছিল, তা আমরা এখন জানি, কিন্তু সেই সময় নিদারুণ উৎকণ্ঠা। তিনি বেঁচে আছেন কিনা না, তাও বোঝা যাচ্ছিল না। শেখ মুজিব ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’ বলে ডাক দিয়েছিলেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হলো, তখন তিনি অদৃশ্য কিন্তু তাঁর প্রেরণাতেই মুক্তিযোদ্ধারা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়েছে।
সেই একাত্তর সালের একেবারে শেষের দিকে শোনা গিয়েছিল তিনি আবদ্ধ আছেন পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে। তখন এদিকে স্লোগান উঠেছিল, ‘জেলের তালা ভাঙবো শেখ মুজিবকে আনবো। ’
স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের পর পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনী শেখ মুজিবকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল। ১৯৭২ সালের ফেব্র“য়ারি মাসে শেখ মুজিব এসেছিলেন কলকাতায়, ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে এক সঙ্গে দিয়েছিলেন ময়দানের বিশাল জনসভায়। সেই সভায় আমিও গিয়েছিলাম শ্রোতা হিসেবে, তাঁকে প্রথম দেখি দূর থেকে, আলাপ করার প্রশ্নই ছিল না।
মনে আছে, চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটক সব প্রটোকল ভেঙে মঞ্চে উঠে পড়েছিলেন নাটকীয়ভাবে।
কিছুদিন পরেই কলকাতা থেকে একটি লেখকের দল আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিল ঢাকায়, আমি সেই দলের কনিষ্ঠ সদস্য। আমার পূর্ববঙ্গে জন্ম হলেও বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে কখনো ঢাকায় যাওয়া হয়নি। ফরিদপুর থেকে চলে আসতাম কলকাতায়। ঢাকায় যাওয়া শুরু করার পর টের পেলাম, সেখানে এক বিষম বিপদে পড়তেই হয়।
তার নাম দাওয়াত। প্রতিদিনই দুবেলা কোনো না কোনো বাড়িতে আমন্ত্রণ, খাদ্যদ্রব্যের আয়োজন ভূরিভূরি, দুবেলা অতরকম পদ ভোজন করলে প্রাণ বাঁচানো দুষ্কর। কিন্তু আমন্ত্রণ এমনই আন্তরিক যে প্রত্যাখ্যান করাও যায় না। ঢাকায় গিয়েই আমি প্রথম শুঁটকি মাছ আস্বাদন এবং উপভোগ করি, ফরিদপুরে ও সবের চল ছিল না।
যাই হোক, সেবারে ঢাকায় পৌঁছে আমার প্রধান বাসনা ছিল শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করার।
সে সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ, তখন একটার পর একটা দেশ সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে দূতাবাস, প্রচুর দেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সাক্ষাৎকার দিতে হচ্ছে শেখ সাহেবকে। তিনি অতি ব্যস্ত। তবু তার কাছে লোকদের ধরাধরি করে এক সকালে মাত্র পনেরো মিনিটের জন্য সময় নির্ধারিত হলো।
আমরা সাত-আটজনের একটি দল গেলাম, বঙ্গভবনে নয়, তাঁর ধানমণ্ডির বাড়িতে। সেখানে বাড়ির মধ্যে ও বাইরে অজস্র ভিড়। কোনোক্রমে পৌঁছলাম শেখ সাহেবের সান্নিধ্যে, বেশি সময় নষ্ট করা যাবে না, কেউ একজন পরিচয় করিয়ে দিতে লাগলো আমাদের।
শেখ সাহেব আমাকে ও নরেন্দ্রনাথ মিত্রকে বেছে নিয়ে কাছে ডেকে নিলেন। আমাদের দুজনের অতিরিক্ত যোগ্যতা এই যে, আমাদের এই দুজনেরই দেশের বাড়ি ছিল ফরিদপুরে।
গোটা বাংলাদেশটাই তো শেখ মুজিবের নিজের বাড়ি, তবু নিজের জেলার প্রতি বোধহয় তাঁর কিছুটা বেশি টান ছিল।
‘আপনারা তো আমার দেশের লোক’ বলে তিনি দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন আমাদের। সেই উষ্ণ আলিঙ্গনে আমরা অভিভূত। তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, কোন গ্রামে আমাদের বাড়ি, এখনো কেউ আছে কিনা ইত্যাদি। আমার এক দাদামশাই অঙ্কের বিখ্যাত পণ্ডিত ছিলেন, তাঁর নাম শুনে তিনি চিনতে পারলেন।
হাসতে হাসতে বললেন, আমি অঙ্কে খুব কাঁচা ছিলাম তো। তাই সুরেন গাঙ্গুলিমশাইকে দেখলেই আমার ভয় লাগতো।
তিনি আমাদের সঙ্গে এমন সহজ-সরল ব্যবহার করলেন, যেন কতো দিনের চেনা। কোথায় গেলো সে পনেরো মিনিটের গণ্ডি, ছাড়িয়ে গেলো পঁয়তাল্লিশ মিনিটে।
নরেন্দ্রনাশ মিত্র বললেন, আমার খুব সাধ নিজের জন্মস্থানটা একবার দেখার।
সুনীল যদি আমার সঙ্গে যায়। শেখ সাহেব সঙ্গে সঙ্গে বললেন, যান না, যান না, আমি গাড়ির ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। সঙ্গে আর্মড গার্ড থাকবে। সেবারে অবশ্য আমাদের যাওয়া হয়নি। তখনো আইন-শৃঙ্খলার অবস্থা তেমন ভালো ছিল না।
বন্ধুরা নিষেধ করেছিল। নরেন্দ্রনাথ মিত্রর অবশ্য কোনোদিনই আর জন্মস্থানটা দেখা হয়নি।
শেখ সাহেবকে আমি আর দেখার সুযোগ পাইনি, পরের বছরই কাপুরুষেরা তাঁকে এবং তাঁর প্রায় পুরো পরিবারটিই নিশ্চিহ্ন করে দেয়। আট-নয় বছরের শিশু রাসেলকে পর্যন্ত রেহাই দেয়নি।
ঘটনাটি ঘটে শেষ রাতে, আমরা কলকাতায় খবর পেয়ে যাই দুপুরের আগেই।
প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারিনি, মনে হয়েছিল বাজে গুজব। বাংলাদেশের কোনো মানুষ কি জাতির মুক্তিদাতাকে খুন করতে পারে? অবশ্য ভারতের মানুষই তো খুন করেছিল মহাত্মা গান্ধীকে। পরবর্তীকালে আর একবার গিয়েছিলাম ধানমণ্ডির সেই বাড়িতে, শেখ হাসিনা দেখিয়েছিলেন সিঁড়ির কাছে কোথায় পড়েছিলেন শেখ সাহেব। তখনো আমার বুকের মধ্যে হাহাকার টের পেয়েছিলাম।
রাসেলকে নিয়ে আমি একটা কবিতা লিখেছিলাম সেই সময়ে :
রাসেল, অবোধ শিশু, তোর জন্য
আমিও কেঁদেছি
খোকা, তোর মরহুম পিতার নামে যারা
একদিন তুলেছিল আকাশ ফাটানো জয়ধ্বনি
তারাই দুদিন বাদে থুতু দেয়, আগুন ছড়ায়
বয়স্করা এমনই উন্মাদ!
তুই তো গল্পের বই, খেলনা নিয়ে
সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন বয়েসেতে ছিলি
তবুও পৃথিবী আজ এমনই পিশাচী হলো
শিশু রক্ত পানে গ্লানি নেই?
সর্বনাশী, আমার ধিক্কার নে!
যত নামহীন শিশু যেখানেই ঝরে যায়
আমি ক্ষমা চাই, আমি সভ্যতার নামে ক্ষমা চাই!
***********************************************************
ভোরের কাগজ/ ১৭ মার্চ ২০০৯
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।