আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আকাশটা বিক্রি দেবো (গল্পাকৃতির)

পাখি এক্সপ্রেস

একা থাকার অনেক সুবিধা। আমি একা থাকি। কেউ বিরক্ত করতে পারে না। পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করি। অনেকেই আমাকে অস্বাভাবিক মনে করে, আমিও।

তবে কখনোই স্বাভাবিক মানুষগুলোকে অশ্রদ্ধা করি না। তাদের জন্য আমার খুব কষ্ট হয়, যা অনেকটা করুণার মতো। চাইলেই তারা মুক্ত থাকতে পারে না। ধর্ম অথবা সমাজকে খুশি রেখে প্রতিনিয়ত একা না থাকার অভিনয় করা মানুষগুলো নিজের বলে কিছই পায় না। সব কিছুতেই ভাগ ছেড়ে দিতে হয়।

বইয়ের ভাষায় তাদের জীবন অবিঘিœতভাবে সামাজিক জীবের পরিচয় বহন করে। ‘মানুষ একটি সমাজিক জীব’ ‘মানুষ একা থাকতে পারে না’ ‘পরিবারই পরুষকে পিতা বানায়, নারীকে মাতৃত্বের স্বাদ দেয়’- এধরনের কথাগুলোকে ঐশী বাণী বা অবশ্যই মান্য করতে পুরুষ তাদের পেশিগুলোকে শক্ত বানায় আর নারী তাদের তুলতুলে চামড়া, নরম মাংসে যৌনতা সঞ্চয় করে। ধর্ম গ্রন্থে বিশ্বাস রেখে মায়ের পায়ের নিচে স্বর্গ খোঁজে, দেবতার সন্তুষ্টিতে অন্ন খোঁজে। ... ‘পিতার সমস্ত জৈবনিক সঞ্চয় সন্তানের জন্য’ অথবা ‘মাতা-পিতা কখনোই সন্তানের অমঙ্গল চায় না’ ইত্যাদি কথাগুলোর নেপথ্যে গভীর রাতে স্বর্গলাভের আশায় স্রষ্টার কাছে ধরনা দেয়ার সময় কামনায় থাকে একান্তই নিজের লভ্যাংশের হিসাব। সন্তান অথবা সংসার সাথী হয়তো তখন গভীর ঘুমে ডুবে থাকে।

মানুষ নিজেকে সবসময় ভালো হিসেবে উপস্থাপন করতে চায়। তাদের এই ভালো থাকার অনুশীলন বা মহড়ার সুযোগে কিছু মানুষ উপকৃত হয়। মানুষের অস্তিত্ত্ব পুরোটাই শারিরীক। শরীর মানুষকে বেঁচে থাকার তাগিদ দেয়। শরীর চুষে চুষে জৈবনিক রস বের করতে করতে মানুষ পূর্ণতা লাভ করার প্রয়াস পায়।

শারিরীক ভাষায় সম্পর্কের লেনদেন করতে করতেই তারা মন নিয়ে কিছু প্রলাপগাঁথার ভান করে। অধিকাংশ মানুষই মনের ওপর ভর করে চলতে চায়। মনকে হাতে তুলে এনে সে মনেরও একধরনের শারীরিক রূপ দেয়ার চেষ্টা করে। জোচ্চুরি আর বেহায়াপনার সর্বোচ্চ আসনে আরোহন করে প্রতিনিয়তই প্রেম নামক একটি প্রতারনার টনিক ব্যবহার করে স্ত্রী, সন্তান অথবা এ জাতীয় বন্ধন সৃষ্টি করে নিজস্ব ভালো লাগা, মন্দ লাগা চাপিয়ে দিয়ে বর্বর মানবতার চর্চা করতে থাকে। সবকিছুর আগে নিজের ভাবনার ব্যতিক্রমে কখনোই অন্যের মতামতের দাম দেয় না, যদি না তার কোন অপূর্ণতা না থাকে, ঘাটতি না থাকে।

জন্মের আগেই আমার মা বাবা আমার যাবতীয় বিশ্বাস, পছন্দ, অপছন্দ, কর্ম, বৌয়ের গায়ের রঙ অথবা পারিবারিক সম্ভ্রমতা ঠিক করে রেখেছিলো। জ্ঞান হবার পর থেকেই ঠিক করে রাখা বুলিগুলো শেখাতে শুরু করলো। প্রথম বিপত্তি ঘ্েট বর্ণমালার বইটি পড়তে গিয়ে। আমি মোটেও ‘অ’-তে অজগর আর ‘আ’-তে পোকা খাওয়া আম পড়তে রাজি ছিলাম না। রাতে পড়ে ঘুমোতে গেলেই অজগর স্বপ্নে দেখে ভয়ে চিৎকার করে উঠলে বড়বোনের বুঁকে মাথাগুঁজার সুযোগ পেতাম।

সেই ছোটবেলায় আমাকে অনেক কিছুতেই বাধ্য করা হতো। লাল রঙ আমি মোটেও পছন্দ করি না। তবুও বাবার পছন্দের রঙ বলেই আমাকে প্রতি ঈদসহ অন্যান্য সময়ে লাল রঙয়ের জামা পরতে হতো। অনেক অপছন্দের খাবার আমাকে খেতে হতো। শারীরিকভাবে ক্ষুদ্র হওয়ার কারণেই আমার কথার কোন গায়ে মাখামাখি চলতো না।

সময়গুলো আমার মতো ব্যয় করতে না পেরে সময়ের সদ্ব্যবহার শিখতে পারিনি। সব কিছুতেই আমাকে অভ্যস্ত করার অপারেশন চলতো। বিরক্তিতে চেপে আসা শ্বাস-প্রশ্বাসের নিম্নগামিতা দেখানোর পদ্দতি জানা ছিলো না। কান্নাকাটি করলে মার খেতে হতো, তাই কাঁদতেও পারতাম না। সবসময় বুকে একধরনের চাপ অনুভব করতাম।

এ চাপ আমি সবসময় পেতাম। সারাক্ষণ হাঁপিয়ে থাকতাম। ভাবতে ভালোই লাগে আমি কাউকে এরকম চাপে রাখি না। বয়স আমার গুনে গুনে ছেচল্লিশ বছর। পিতৃত্বের স্বাদ না নেওয়ার পণ ভাঙ্গিনি।

মানুষ ইচ্ছে করলে অনেক কিছুই পারে। অনিয়ন্ত্রত দু:খবোধে কখনোই উষ্ণতা খোঁজার প্রয়োজন হয় না। আমি শরীরকে একটি ইলেক্ট্রিক পিলার অথবা গাছ ভাবতে পারি। নিয়মতান্ত্রিক সংগম অথবা শিহরণ নির্ভরতায় বিপরীত লিংগের দ্বারস্থ হওয়ার কথা মাথায়ই আসে না। মানুষের পরিবর্তন হতে সময় লাগে না।

অনেক আগে মা’কে যখন বলতাম, মা কেবলই হাসতো। অবশ্য আমার পিতৃত্ব নিরোধক মনোভাব বা বিয়ের অমূল্যায়ন সম্পর্কে অন্য কারো সাথে তেমন একটা বিনিময় করা হয়নি। বেশি বিনিময়ের সূত্র ধরে এক সময়ের অস্তিত্ত্ব স্ব-দৃষ্টির সর্বজয়া টুসিকে জীবন থেকে কর্তনের পর বিনিময়ে কখনোই মানুষের প্রতি নির্ভতার সাহস হতো না। মানুষ সবময় নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে এবং বরাবরই নিজের দোষ নিয়ে অন্যের কথা বলাকে পছন্দ করে না। এক সময় পৃচুর বন্ধু ছিলো এবং বন্ধুদের মাঝে উজ্জ্বলও ছিলাম।

এখনও বন্ধু আছে, তবে আগের মতো নেই। উচ্ছলতা বা চঞ্চলতা নেই। একমাত্র বন্ধু বিণয়ভাষীকে দেখলে আমার ভালোই লাগে। বুড়োটার মাথাভর্তি সাদাচুল আমার শান্তনার কারণ। হয়তো আমি তার মতো ক্ষুড়ো নাও হতে পারি।

আর হলেও বা কি? মানুষ বুড়িয়ে গেলে জন্ম নেয়া বলি রেখার অধিকাংশই মৃত্যুভয় থেকে, বাঁকিটা পিছুটানের হ্যাঁছকানোতে। দু’টোর একটিও আমার মাঝে নেই। তবে বেঁচে থাকার অবিশ্বাস্য ইচ্ছা বরাবরই আছে। বিনয়ভাষীর কাছে গেলে যে আমার খুব ভালো লাগে তাও কিন্তু নয়। কারণ শালা একটি পরিণত দার্শনিক।

আমারও একধরনের দর্শন আছে এবং আমি সেটা খুবই ভালোবাসি। আমার পরিবার বা টুসির কাছে আমার মতামত অথবা ভালো লাগার মার খেতে খেতে এখন জন্ম নেয়া ভারী বোঝা স্বরূপ দর্শনকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করতে গিয়ে আমার কোন সমস্যা হয় না। কারণ এ নিয়ে কারো সাথেই দরকষাকষি করতে হয় না। একা থাকি বলে কারো সাথেই বিনিময় হয় না। বুড়োটার কাছে যাই শুনার জন্য, বলি কম।

বুড়াও বাঁচাল স্বভাবের বলে আমার শ্রবণ শক্তির ছোটখাট পরীক্ষা শেষ হলেই কেটে পড়ি। কয়েকদিন আগে সময় পিছলে পৈত্রিক গ্রামের এক বালকের সাথে দেখা। তাকে প্রচুর সময় দিয়েছিলাম। দু:সংবাদের কাছাকছি একটা সংবাদ দিয়ে শুরু করে আরো ভয়ানক একটি খবরের পর অনেক ভালো ভালো খবর আমাকে শুনিয়েছিলো সে। তার মুখের প্রথম খবর শুনে চোখ থেকে পানি পড়তে গিয়েও পড়েনি।

আমার প্রতি মায়ের অসম্ভব টান ছিলো। দেখতে ফুটফুটে ছিলাম বলেই হয়তো। আমি একবার ঢাকা থেকে একটি খরগোশ কিনে বাড়ি নেয়ার পর আমার তিন বছরের ভাগিনাও খরগোশটাকে আদর করেছিলো। খরগোশটা খুবই ফুটফুটে ছিলো। গ্রামের বালকের মুখ থেকে শুনলাম আমার মা নাকি মৃত্যুর আগে আমার নাম ধরে কয়েকবার ঢেকেছিলো।

ভাগ্যিস আমি তখন ছিলাম না, থাকলে আমাকে প্রচুর কাঁদতে হতো। কাঁদতে গেলেই বুকে খুব চাপ অনুভব করি। সহ্য করতে হাঁপিয়ে ওঠি। এখন তেমন একটা কষ্ট হয় না। ঐ ছেলের কাছে শুনা সময় ধরলে মা মারা গেছেন প্রায় দশবছর হলো।

বাবা নাকি তারও অনেক পর মারা গেছেন। অবশ্য বাবা মারা যাবার সময় কিছু বলেছিলেন কিনা- বিষয়টি এড়িয়ে গিয়েছিলাম। তারপর একে একে শুনলাম- আমাদের গ্রামে নাকি এখন কৃষকদের শক্ত সমিতি আছে, দিনমজুরদের ক্লাব আছে। এলাকার জোরদারদের পতন হয়েছে। পঞ্চায়েত বিলুপ্ত হয়েছে এবং মানুষরা ভোটের সময় প্রার্থীর কাছ থেকে টাকা নেয় না ও মিছিল মিটিংয়ে যায় না।

এতোটা ভালো খবর আমি আশা করিনি। তবে সবশেষে শুনলাম আমাদের বাড়ির আর কারো নাকি ফসলের জমি নেই, সব আমার বাবা কিনে নিয়েছেন। তারা এখন তাদেরই জমি বর্গা চাষ করে। অনেক আগে আমার বড়বোন মারা গিয়েছিলেন। তারপর মা ও বাবা।

পরিবারে তিনবোন বাদে আমার এক ছোটভাই আছে। বোনের কবরের পাশে মাকে কবর দিয়ে ঐ জায়গাটাতে বাবা কবরবাড়ি বাঁধিয়ে নিয়েছেন। আমার জন্যও নাকি সাড়ে তিনহাত বরাদ্দ রেখেছেন। কিন্তু এরই মাঝে আমি আমার লাশ অগ্রিম দান করে দিয়েছি গবেষনার জন্য। আমার কখনোই কবর হতে পারে না।

কারণ তার সাথে যদি আমার স্বপ্নের কবর হয়? আমি চাই না আমার স্বপ্নগুলো মাটিচাপা পড়–ক। গতকাল বিকেলে একবার বিনয়ভাষীর ঘরে গিয়েছিলাম। শালার বুড়াটা এখন লেখালেখি বাদ দিয়ে তেলরঙ নিয়ে জীবন আঁকে। কি ভীবৎস তার জীবনগুলোর প্রকাশ! ছোটবেলায় দেখা ভৌতিক ছবিগুলোর ভুতের মতো। কয়েকটা ছবি ছিড়ে ফেলেছিলাম।

সে কি না আমার আগে পৃথিবীতে এসেছে বলে আমার চাইতে জ্ঞানী হয়ে গেছে। আমাকে দর্শনের বারান্দা চেনায়! আচ্ছা, পরে সে দর্শন টর্শন নিয়ে আর কথা বলেনি। কিন্তু আমাকে স্বাভাবিক হবার আচ্ছা ধরনের খোঁচানি দিতে লাগলো। আট দশটা মানুষের মতো আমিও যেনো পেয়ালাগুলো ভর্তি করি, কারণে অকারণে ভায়োলিন বাজাই, বিলিয়ার্ডের বোর্ডে শিকার খুঁজি এবং সে আমাকে রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমোবার পরামর্শ দেয়। তবে তার সর্বশেষ দু’টো কথায়ই আমার যতো উত্তেজনার কারণ।

‘তুমি কি ভাবো টুসি সন্তান প্রসবের সময় ব্যাথায় কাতর থেকেই আক্ষেপ করেছিলো নবজাতকে তোমার ভাগ নেই বলে?’ এবং ‘তুমি কি মনে করো তোমার বাবা মৃত্যুর সময় বলেছিলো- স্রষ্টা, আমার ছেলে যেনো আমার সম্পত্তির ভোগ না পায়?’ কি বিশ্রী বিষয়গুলো নিয়ে সে আমার সাথে কথা বলতে গেলো! পারিবারিক বিষয়ে কি এমন বস্তু সাদৃশ্য বিষয় খুজে পেলো যে আমাকে পরিবর্তনে আসতেই হবে বা তা আমার পরিবর্তনে সহায়ক? আর আমাকে পরিবর্তনে আসতেই বা হবে কেন? আজ থেকে তেইশ চব্বিশ বছর আগে টুসি আমাকে ভালোবেসেছিলো। তারও আগে আমি অস্বাভাবিক হতে শুরু করি। ছোট ছোট চাওয়াগুলোর শুরুতেই শেষ হতে দেখে আমার চাহিদার অপ্রাপ্তিগুলো বড় হয়ে ঠেকতে লাগলো। বাবার সংসারের প্রতি অসম্ভব অনীহা আমাকে টুসির দিকে ঝুঁকে রেখেছিলো। সে কথা দিয়েছিলো আমাকে ভালোবাসবে, দু:খ দিবে না।

সুখ দুখের হিসেব সেই আমাকে শিখিয়েছিলো। প্রাণপন চেষ্টা করেছিলো আমার সর্বস্ব নিয়ে যেতে। যখন সে বুঝতে পারলো আমি পুরেপুরি তার হয়ে গেছি, তখন সেও পুরোপুরি নারী হয়ে গেলো। মানুষের মতো দেখতে প্রানীগুলো তিন ধরনের হয়- নারী, পুরুষ এবং মানুষ। নিজেকে মানুষ ভাবতে পছন্দ করতাম বলে টুসিকেও মানুষ হিসেবে দেখতে পেতাম।

নারীর অবয়ব কখনো অসহায় লাগতো, কখনো বর্বর লাগতো। রাজতন্ত্রের ঐতিহাসিক যুদ্ধগুলোর ইতিহাস শুনে শুনে মনে হলো পুরুষ যখনই বর্বরতা ত্যাগ করে সভ্য হতে শুরু করলে নারীও তখন দ্বিগুন উৎসাহে বর্বর হতে লাগলো। তবে প্রতিটি মানুষই কখনো কখনো ‘মানুষ’ থাকে। সম্পর্ক স্থাপনের সময় যখন সে যৌনতা এবং ধর্মকে দূরে রাখতে সক্ষম হয় তখনই সে মনুষ্যত্ত্বের স^াদ পায়। মানুষ ঘন ঘন তার সম্পর্ক ভাঙে ধর্মীয় ও সামাজিক বাধ্যতা এবং যৌন চাহিদার কারণে।

মানবিকতার অভিনয় করে ধর্ম ও সামাজিকতাকে সামনে রেখে। সমস্যাকূলে সাহায্য করে পূণ্যের আশায়। পূণ্য ব্যতিরেকে মানুষ করুণা করতেও শিখেনি। টুসি আমাকে করুণা করতে পারতো, কিন্তু করেনি। কারণ সেখানে পূণ্যলভের কোনো সম্ভাবনা ছিলো না।

অবশ্য আমি যদি তার ধর্মীয় বন্ধনের স্বামী হতাম তবে সে আমার আদেশের অপেক্ষায় রসুইটম্বুর শরীরটা নিয়ে অপেক্ষা করতো। ধর্মের বাধ্যতা ছিলো না বলেই সে আমার সামষ্টিক অনুভূতিকে চটকোনা মেরে নিজ ভালোলাগায় বান্ধবীদের সাথে সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে গিয়েছিলো। অথচ আমি চেয়েছি সমুদ্রের ঐ বিশালতার প্রথম অনুভূতি দু’জন একই সাথে নিতে। আমি কখনোই তার আগ্রহকে অপমান করছি না। কিন্তু আক্ষেপে আমি পুড়তেই পারি এই ভেবে ... ভালোবাসায় দাবির অস্তিত্ত্বে সে সৈকতে না গেলেও পারতো।

আমাকে নিয়ে তার অনুভূতির কথা ভাবতে গিয়ে অপমানে সরু হয়ে যেতাম। আমার কর্ম বা আর্থিক ঘাটতি কখনোই তার হতো না। তবে তার কাছে কেন জানি নিজেকে অসহায় হিসেবে উপস্থাপন করতাম এবং তার সহায় চাইতাম। টুসিও আমাকে ওপর তার অনেক কিছু চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলো। অথচ আমি বারবার বলেও কোনরকম ভালোলাগার স্বাদ পেতাম না।

বরং আমার চাওয়াগুলোকে অনর্থক এবং অহেতুক প্রমাণ করতে তার চেষ্টা খুব হাস্যকর লাগতো। আমার অনুভূতি তাকে কোনভাবেই স্পর্শ করতো না। তাকে ঘিরে আমার অনুভূতির কথা বললেই সে উপহাস করতো। সে আমাকে প্রায়ই বলতো - আমি কেন তার পছন্দমতো চলি না, তার মতো কেন হই না? তার মাঝে আমি জোর করে হলেও ভিন্ন কিছু আবিষ্কার করতাম। একজন ‘মানুষ’ ভেবে পুলক নিতাম।

অবশেষে একদিন আবিষ্কার করলাম তার বদলে যাওয়া। স্বপ্নের রঙ অতটা কটকটা ছিলো না। দোষ ছিলো কেবল নিজেকে নিয়ে ভাবতে না পারা। টুসির বাবাকে একদিন ওনার ধারনকৃত রাজনীতি ছাড়তে বলতেই তিনি আমাকে শুনালেন তার প্রিয় রাজনৈতিক নেত্রীর পা ছুঁয়ে সালাম করার মতো কৃতিত্ত্ব অর্জনের কথা। জীবনের এক অসাধ্য সাধনে চোখে মুখে তার নিয়নের পাইপের মতো সরু রক্তনালীগুলো নড়েছড়ে উঠেছিলো।

আমিও একধরনের নীতি লালন করতাম। তবে কোন মতবাদে বিশ্বাসী ছিলাম না। সময়ের চাহিদায় মতবাদের জন্ম হয় বলে বিশ্বাস করতাম। সব সময় এমন কিছু করার ভাবনায় থাকতাম, যাতে করে রাষ্ট্রের কালো শরীরে একটি তিল পরিমাণ সাদা দাগও যেন পড়ে। সে দাগ ফেলতে গিয়ে টুসি আমাকে রঙের কৌটাটি হলেও এগিয়ে দিবে বলে মনে করতাম।

স্বপ্নের বাস্তবায়নে তৈরি করা সময়ের মতবাদে ঠাঁসা কাগজগুলো ক’বছরআগে এক শীতে টোকাইদের দিয়ে দিয়েছিলাম আগুন পোহাবার জন্য। ছোটবেলায় গাছ থেকে জাম পাড়তে গিয়ে এক বন্ধুকে গাছে ওঠিয়ে অপর বন্ধুরা নিচে দাড়িয়ে থেকে আল্লাহকে ডাকতাম। যেন বন্ধুটি গছ থেকে পড়ে না যায় এবং ভালোই ভালোই গাছ থেকে নামতে পারে। বন্ধুটি গাছের ওপর থেকে বলতো, আরো জোরে জোরে আল্লাহকে ডাক। তখন তার গাছ থেকে না পড়া এবং গাছ থেকে নামার বিষয়টি নিয়ে নির্ভরতার পুরোটাই আমাদের ওপর ছিলো।

সে আমাদের ওপর নির্ভর করতো স্বাভাবিক বিশ্বাসে। আমার এগিয়ে যাওয়া নিয়েও টুসির প্রতি সম্যক নির্ভরতা ছিলো। আমি ভাগাভাগি করার প্রতি অসম্ভব জোর দিতাম। ভাগ হয়েছিলো ঠিকই কিন্তু আমি ভাগী হতে পারিনি। আমি কেনই বা পরিবারবদ্ধ থাকবো।

নির্লজ্জের মতো একা না থাকার অভিনয় অথবা সুখী হবার ভান ধরতে আমি পারি না। পারিবারিক সম্পর্কের ভিত্তি একধরনের ধর্মীয় বা সামাজিক অথবা কেবলই খামখেয়ালী ছাড়া অন্য কিছু নয়। আমি ততোদিন আমার পরিবারের একজন প্রয়োজনীয় মানুষ ছিলাম যখন আমি স্বৈরাচারে নিরব ছিলাম। সরব হতেই আমি প্রয়োজনীয়তা হারাতে লাগলাম। বড় বোনের মৃত্যু, ছোটবোনদের বিয়ে এবং আমার ভবিষ্যত নিয়ে দরকষাকষি করতে গিয়েই আমি পরিবারচ্যুত হতে থাকি।

বোনের মৃত্যু বা অনুজদের বিয়ের স্রষ্টার কাঁধে চাপলেও আমার বেঁকে যাওয়াটা একান্ত আমার বিশ্বাসের ওপর ছিলো বলে সংসারের কর্তা জানান দিলো। অন্যায় দোষারোপ থেকে স্রষ্টাকে মুক্তি দিতে গিয়ে আমি সরে দাড়ালাম। আমার দু:সময় আসতে লাগলো। মুদ্রার পিঠ ঘরতে লাগলো। জীবনের প্রথম চাকুরী করতে গিয়ে কাটানো দিনগুলো আমাকে ব্যর্থ হওয়ার অপবাদ থেকে রক্ষা করেছিলো।

পারিনি পরিবার থেকে সহানুভূতি বা সমাধান নিতে। টুসিও সুযোগ বুঝে সটকে গেলো। টুসির সটকে যাবার পর আমি একেবারেই ভেঙে পড়ি। সবকিছুতেই উৎসাহ হারিয়ে ফেলি। অবশেষে চাকুরী ছেড়ে দিলাম।

কয়েকজন বুদ্ধি দিয়েছিলো বাবার সাথে ভাব জমিয়ে সম্পত্তি ভাগিয়ে নিতে। বিষয়টি প্রেয়সী ব্যতীত অন্য কারো সাথে দৈহিক মিলনের মতো দুর্বোধ্য ছিলো। হ্যাঁ দু’য়ের একটিও আমার দ্বারা আজও সম্ভব হয়নি। আমি মোটেও প্রতারনা করতে পারি না। ভন্ডামি করে পরিবারভুক্ত হতে পারিনি।

আমি সেই সম্পর্কের পুজা করি যেখানে ধর্ম, সামাজিকতার বাধ্যতা নেই কপটতার আশ্রয় নেই। আমি খুব ভালো করেই জানি আমার জন্মের আগে কখনোই আমি পৃথিবীতে আসার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিনি। জন্ম নেয়ার পরও পারিবারিক পৃথিবীটা অতটা সুখকর হয়নি। আমার প্রয়োজনে আমার মা একটি রাতও ঘুম নষ্ট করেনি। বিয়ে নিয়ে মায়ের সাথে করা সর্বশেষ তর্কে মা বলেছিলেন-“বিয়ে না করলে তোকে শেষ বয়সে কে দেখবে?” কথাটি শুনে আমার কপালে স্বাভাবিকের চাইতে কয়েকটা ভাঁজ বেশি পড়েছিলো।

তাহলে আমার জন্মও কি কারো শেষ বয়সে দেখাশুনার জনই হয়েছে। তাই বুঝি বাবা আমাকে তার ক্লোন বানাতে চেয়েছিলেন? শেষবারের চলে যাবার আগেও একবার টুসি চলে গিয়েছিলো। যখন আমি সংকটে পড়তে থাকি। মাঝে মাঝে আমাকে মিসডকল দিতো। কল করলেই রহস্যজনক ব্যবহার করতো।

তার মিসড কল দেয়া দিনটি আমাকে নরকের কাছাকাছি নিয়ে যেতো। সহ্যসীমা ছাড়ানোর আগেই একদিন তাকে ইচ্ছা বিরুদ্ধ গালি দিই এবং আমার সাথে কোনপ্রকার সংযোগ রাখতে নিষেধ করি। তার কয়েক সপ্তাহ পর বান্ধবীকে সাথে নিয়ে আমার কাছে ফোন করে। আমার অভিমান বেশিক্ষণ টিকেনি। অনেকদিন পর টুসিকে আগের মতো পেয়ে আনন্দে কেঁদেছিলাম।

আনন্দ আর ক’দিন? ক’মাস পরই আবার বিষাক্ত জীবনের উন্নতরূপ দেখতে লাগলাম। নিজের জন্য আমার খুব কষ্ট হতো। একসময় নিজেকে সিনেমার নায়কের মতো জয়ী ভাবতে পছন্দ করতাম। তারপর থেকে ব্যর্থ মানুষগলোর জীবনকে সামনে এনে শান্তনা খঁ^ুজে নিতাম। কিছু মানুষ আছে যাদের পরিবার কেন্দ্রিক চাওয়াগুলো পূরণ হয় না।

আমি তাদের একজন। আমার সাথে করা টুসির সমস্ত অবহেলা মেনে নিয়ে সম্পর্কটার শেষ দেখবো বলে ঠিক করেও সেদিন নিজেকে চেপে রাখতে পারিনি। অভিনয়ে পটু নই বলেই পারা হয়নি। মনের যতো ক্ষোভ ছিলো তার কিছুটা সেদিন প্রকাশ করেছিলাম। অবশেষে আমাকে ঘৃনা করার সূত্র ধরাতে গিয়ে ‘অমানুষের বাচ্চা’ বলে গালি দিয়েছিলাম।

তারপর আর টুসিকে দেখাও হয়নি, টুসির কোন কথাও শোনা হয়নি। আমার সরে যাওয়াটা বোধ হয় তার কাংখিত মুক্তির কারণ হয়েছিলো। এমন একটি সুযোগের অপেক্ষায় সে ছিলো। সবকিছু মিলিয়ে কি আমি কেবলই শূণ্য? না তা হতে যাবে কেন। আমাকে ভালোবাসে এমন মানুষের সংখ্যাও ইর্ষনীয়।

অনেক বন্ধনে আমি আবদ্ধ। মমতা বা স্নেহের কোন কমতি নেই। ধর্ম, সমাজিকতা আর যৌনতার চাহিদা নেই বলে সেই সম্পর্কের কপালে আমি চুমু খাই, নিত্যানন্দে পুজো দিই। তবে এখন তাদেরও ছেড়ে অনেক দূরে অবস্থান করি। মাঝে মাঝে যোগাযোগ করি।

সেলফোনটা বেশিরভাগ সময়ই বন্ধ রাখি। অস্বীকার করবো না- আমি যে জীবন ধারনের জন্য কর্মোনিবেশ করি তা কিন্তু আমার এ পূজনীয় মানুষদের কাছ থেকে পাওয়া অদৃশ্য তাগিদ থেকে, শাসন থেকেই। প্রিয়দের কাছ থেকে শাসন পেতে খুব মন চায়। কোনো কোনো মাসে প্রয়োজনের চাইতে বেশি টাকা উপার্জন করি আবার কোনো মাসে একেবারেই না। প্রতি সপ্তাহে পত্রিকাতে লেখা জমাদেয়ার কথা থাকলেও নিয়মিত দিই না।

বাধ্য থাকতে ভালো লাগে না। ক’দিন একটি নিউজ এজেন্সির বিশেষ রিপোর্টিং করতাম। তখন প্রায়ই ঢাকার বাইরে থাকতাম। প্রথমবার ১০টি রিপোর্ট জমা দেয়ার পর যখন অবিশ্বাস্য অংকের সম্মানী চেক পাই, তখন ভাবনায় পড়ে গিয়েছিলাম কোন কোন খাতে টাকাগুলো ব্যয় করবো। রেললাইনের পাশে বাসা বলে গভীর রাতে ট্রেনের আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গে।

বালিশের পাশে রাখা বোতলটা হাতে নিয়ে কয়েক ঢোক গিলে সিঁড়ি পেরিয়ে শরীরটাকে টেনে নিই ছাদে। শরীরের কোনো কোনো অংশ তখন ভীষন ঘুম ধরে নেয়। বিশেষ করে বুক থেকে পায়ের হাঁটু পর্যন্ত। জাগ্রত অংশটাকে মাতলিয়ে রাখতে ভালো লাগে। বোতলের বাঁকি অংশে ঢুকে পড়ি।

পুরো ছাদে নিজের অধিকার বসিয়ে দিই। মাথার ভেতরটাতে তখন প্রচুর নির্ভরতার সৃষ্টি হয়। নিজেকে খুব ভালোবাসি, খুব। রাত, রাতের ছাদ, কাপড় শুকানোর তার, বাসার সামনের কতবেলের চারাগাছ আর হাতের খালি বোতলটাকে ভুতের মতো মনে হয়। ছমছমে হাতে বোতলটা ছুড়ে মারতেই গলির মোড়ের কুকুরটা ঘেউ করে করে বোতলের ভাঙ্গা কাচে গন্ধ শুঁকে চলে যায়।

এ বোতল খাওয়ার মতো সম্ভ্রান্ত নয় কুকুরটি। প্রতিদিনই বোতল ভাঙি প্রতিদিনই কুকরটা আসে, কিন্তু কিছুই সে পায় না। কাত হয়ে শুয়ে পড়তেই মনে হয় মনটা খুব বিশালতা খুঁজে পাচ্ছে। বড় হতে হতে আমার বাবার বড় ধানী জমিটার সমান হয়ে যায়। তারপর আরো বড় হয়ে গ্রামের জোরদারদের বিশাল দিঘীটার মতো হয়।

আমি শুয়ে পড়তে পড়তে সে আকাশকে ছাড়িয়ে যায়। শরীরটা তখন ভার হারাতে থাকে, বোধ হারাতে থাকে। চোখ আর মস্তিষ্ক ছাড়া পুরো দেহটায় ঘুম আয়েস পায়। চোখ জুড়ে তখন আকাশ, মস্তিষ্কের ভাঁজে ভাঁজে আকাশ। বিশালতায় মুগ্ধ হই না, তুষ্ট হই না।

আকাশের গায়ে স্রষ্টার নড়াছড়ায় চাঁদের বুড়ির হাত থেকে সুতোর বান্ডিল পড়ে যায়। আমি দেখি। দুই চোখ আর দু’এক বাটি মগজ তখন ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের শক্তি ধারণ করে। আমি জানি স্রষ্টা ওই আকাশে থাকে। আরো জানি টুসি আর টুসির গর্ভে যে শিশুর বেড়ে ওঠার কথা ছিলো তারাও ওই আকাশেই থাকে।

আমার হিউম্যানিজম, স্যোশালিজম, জ্যোৎস্নার বেড়ায় মাংসরঙা ঠোট, এক পায়ের নুপুর, শিশুর কান্না, স্বামী ও পিতার অবয়ব আরো আরো কি জানি সব ওই আকাশে চলে গেছে, মিশে গেছে। রাত কমতে থাকে, চোখ দু’টো ঝাপসা হয়ে আসে, মগজে তুষার জমে যায়। ব্যাংকে রাখা কচকচে কাগজগুলোর গুণন হতে থাকে। আরো ধনী হতে থাকি। মনের বিশালতা সৌরজগতকেও হার মানায়।

টাল হয়ে বুঁজে আসা চোখে নতুন স্বপ্ন জন্ম নেয়। আকাশের ওপর স্রষ্টা দেখি, চাঁদের গায়ে হেলান দিয়ে শিশুকে স্তন্যপায়ী প্রমান করছে টুসি। তার কাছেই জ্বলতে থাকে আমার ধর্ম, সামাজিক কপটতা আর অত্যাকৃষ্ট যৌনতার বাইরে জন্ম নেয়া সুকুমারবোধ আর আমার ওপর টুসির যত্তোসব বিরক্তি। সবকিছুর ওপর স্রষ্টার অবস্থান খুবই চড়াও। কোরবানের জবাইকৃত পশুর মতো শরীরটা আছড়ে ওঠে।

মায়া ফিরে পায় টুসি, আমার শিশু, একজন পিতা অথবা স্বামীর অবয়ব। ওই যে ওপরে, ওই দূরে.... আকাশ থাকার কোন প্রয়োজন নেই। বাবার কিনে নেয়া ধানী জমিগুলো এনে রাখবো এখানে। ফসলের দাবিতে জমির সঠিক মালিকানায় ব্যস্ততা দেখবো। টুসির জন্য কেনা সর্বশেষ জামাটি দিয়ে একটি ঘুড়ি বানাবো।

খেতের আইলে আইলে জুতার ফিতে ছিড়বে। আকাশ থাকবে না, মোটেই না। সেখানে কৃষানীর হাসি থাকবে, থাকবে কৃষকে তার অপেক্ষা। প্রতিরাতেই ছাদে ঘুম আসার আগে একবার মনস্থির করি, ‘আকাশটা বিক্রি দেবো’। আকাশটা বুঝি অহেতুক স্রষ্টার ভার বইছে।

স্রষ্টা সংকুচিত হয়ে যাক, স্রষ্টা নিষ্ক্রিয় হয়ে যাক। আকাশটা মুক্তি পাক। আকাশের বিশালতা আমি বুকে ধারণ করবো। অকর্মা নীলগুলো মেঘসমেত শূণ্যতা নিয়ে টুসির শূণ্যতা গিলে খেতে থাকুক, যে শূণ্যতা আমার অযোগ্যতায় সৃষ্টি হয়েছে। ================ সমাপ্তি কাল ৩০.০১.০৯ রাত ৩.৫০ মি.


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।