সামহয়ারইন ব্লগের উদ্যোক্তা বা মডারেটর কাউকেই আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। কেবল ব্লগারদের কারও কারও টুকরা মন্তব্যের ভিতর অসমর্থিত যেসব তথ্য দেখতে পাই তা থেকে তৈরী একটা ধারণা অবশ্য রাখি। এছাড়া ব্লগ চালাতে গিয়ে উদ্যোক্তা বা মডারেটররা যেসব নীতি বা সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন তা খুব মনোযোগের সাথে অনুসরণ করি। এটা অবশ্য অন্যান্য ব্লগের উত্থান পতনের বেলাতেও করি। এসব কিছুতে আমার আগ্রহের মূল বিষয় হলো, বাংলাদেশে ব্লগ দাঁড় করানোর সমস্যা ও সম্ভবনা সম্পর্কে একটা পরিস্কার ধারণা রাখা।
সাধারণভাবে বললে প্রকাশ প্রকাশনার জগতে যোগাযোগের একটা বাহন বা মাধ্যম মিডিয়া হিসাবে ব্লগ এক নতুন ধরণ, সংযোজন। এই মিডিয়া, নতুন হোক আর পুরনো মিডিয়ার প্রায় সব ধরণের সমস্যাই একে মুখোমুখি হতে হয়, হবে এটাই স্বাভাবিক। আবার এটা এমন এক মিডিয়া যার উদ্যোক্তাদের ভারকেন্দ্র এবং ব্যাকগ্রাউন্ড কমপিউটার-টেকনিক্যাল হতেই হয়। সম্ভবত এই অপরিহার্য শর্তের কারণে অপর গুরুত্ত্বপূর্ণ টেকনিক্যাল শর্ত মিডিয়াকে পেশাদারীভাবে বুঝা ও পরিচালনা করার মত যে পেশাদারি মিডিয়া-অভিজ্ঞতার দরকার হয় তাতে অনেক সময়ই ঘাটতি দেখা যায়। আবার সাধারণভাবে মিডিয়া মাত্রই এমনই এক ট্রেড যা নির্দিষ্ট দেশ বা রাষ্ট্রের মিডিয়া কালচার ও প্রাকটিসের সাথে সম্পর্কিত যেটা, মিডিয়া সম্পর্কে ইউনিভার্সাল ধারণা অভিজ্ঞতা দিয়ে সবটা পূরণযোগ্য নয়।
কারণ রাষ্ট্র ও তাঁর নাগরিক জনগণের রাজনৈতিকতার (polity) মাত্রার ভিতর দিয়ে ক্রমউত্থিত ও নির্ধারিত হয় স্হানীয় দেশে মিডিয়া কালচার ও প্রাকটিসটা ঐ সমাজে কেমন হবে, কোন পর্যায়ে থাকবে। এটা এমনকি দেশের বাইরের স্বার্থে আর্দিষ্ট হয়ে চাপিয়ে দেয়া ইনপুট - "তথ্য অধিকার আইনের" মত ব্যাপার নয় যে এতে আমাদের স্হানীয় মিডিয়া কালচার ও প্রাকটিসটার কোন লাভ হবে বা সুবিধা পাবে। কারণ আগ্রহটা এখানে বাইরের, আরোপিত। অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি, মিডিয়া কর্মী ও তার খাতক জনগণ মিডিয়ার কী স্বাধীনতা ও ধরণ চায় এটা তাদের চাহিদা আকাঙ্খার মাত্রা এবং একইসঙ্গে লড়াই করে তা আদায় করে নেবার ক্ষমতার উপর নির্ভর করে। এটা কারও দেবার বিষয় নয়।
এরপর সে ক্ষমতা চর্চার ভিতর দিয়ে স্হানীয় মিডিয়া কালচার ও প্রাকটিস একটা সুনির্দিষ্ট রূপ লাভ করে। আবার এটা স্হির কোন অবস্হা নয়। প্রতি মুহুর্তের লড়াই সেখানে জারি থাকে ও ফলাফলে ক্রমাগত নতুন নতুন রূপ-বৈশিষ্ট লাভ করে। কথাটাকে গুছিয়ে বললে দাঁড়ায়, দেশকালের আকাঙ্খা ও আগ্রহ এবং সমাজের রাজনৈতিক সত্ত্বার (polity) মাত্রাটাই স্হানীয় মিডিয়া কালচার ও প্রাকটিসের মূল নির্ধারক চালিকা শক্তি। ফলে বাইরের কোন স্বার্থ-উদ্যোগে আমাদের কাজে আসবে না বরং ক্ষতিগ্রস্হ হব নিঃসন্দেহে ।
একটা তুলনামূলক উদাহরণ পেশ করে কথাটা পরিস্কার করব। অনেকেই হয়তো খেয়াল করেননি আমাদের সমাজ মিডিয়া কেমন চায় তা একটা গণআকাঙ্খায় রাস্তায় সরব জানান দেবার ও আদায় করার প্রথম ঘটনাটা ঘটেছিল ১৯৯০ সালে। এরশাদের নয় বছর শাসনের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনের ভিতর দিয়ে সমাজের গণতন্ত্রায়নে পথে বলা যেতে পারে এটাই ছিল নীট অর্জন। যদি হিসাব করতে বসি ঐ আন্দোলনে সামাজিকভাবে আমরা কতটুকু আগিয়েছি তবে বলতে হয়, একটা গণতান্ত্রিক কনষ্টিটিউশন কনষ্টিটিউট বা গঠন করার দিক থেকে আমরা উল্লেখযোগ্য খুব বড় ধরণের কিছু আগিয়েছি বা অর্জন করতে পেরেছি বা নাগরিক জনগণের চেতনার রাজনৈতিকতার মাত্রায় বড় ধরণের উল্লফন ঘটাতে পেরেছি তা বলা যাবে না। তবুও এতে সবচেয়ে বড় অর্জনটা ঘটেছিল, মিডিয়ায়।
অর্থাৎ এর ফসল বা মাখনটা বাংলাদেশের মিডিয়া জগৎ ঘরে তুলে নিতে পেরেছিল। আর নাগরিক হিসাবে এর একটা সুফল অবশ্যই আমরা ভোগ করছি। বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের হাতে এরশাদ ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য হবার পর প্রেসিডেন্ট শাহাবুদ্দিন একটা কমিশন (এর হুবহু নাম আমি এখন বলতে পারছি না, পাঠকদের কেউ আমাকে সাহায্য করতে পারেন) গঠন করেন। মূলত পত্রিকা মালিক ও পেশাদার সাংবাদিকদের চাপে তাঁরা গণআকাঙ্খাকে ইতিবাচক ব্যবহার করে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও মিডিয়ার সম্পর্ক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ কেমন হবে তা কনষ্টিটিউশনের অঙ্গ করে ফেলতে পেরেছিল। ঐ কমিশনের কাজ ছিল রাষ্ট্রের কোন কোন আইন মিডিয়া ব্যবসা ও পেশাদারী মিডিয়ার অস্তিত্ত্ব ও বিকাশের অন্তরায় তা চিহ্নিত করে সেগুলো বাতিলের সুপারিশ করা এবং রাষ্ট্রীয় আইনের অপব্যবহার করে ক্ষমতাশীনদের মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাকে ছেঁটে দেওয়া।
এরশাদ আমলে কোন রিপোর্টের জন্য সাংবাদিক-মালিকের বিরুদ্ধে রাস্ট্রদ্রোহিতার ৫০১ ধারায় সরকারের মামলা ছিল খুবই স্বাভাবিক একটা ঘটনা। সামরিক গোয়েন্দা সংস্হা থেকে মিডিয়াকে টেলিফোন ব্রিফিং কালচার তখনই ব্যাপকতা পায়। আতাউস সামাদ, মিনার মাহমুদসহ বহু সাংবাদিককে এরশাদ জেলে পুরেছিলেন। এছাড়া, পত্রিকার ডিক্লারেশনের বাতিলের খড়্গ ইত্যাদি মিলিয়ে ব্যবসা হিসাবে মিডিয়া চালানোর হুমকির মুখে পড়ছিল। সামগ্রিক এই চরম পরিস্হিতিই শাহাবুদ্দিনকে দিয়ে কমিশন গঠন ও এর সুপারিশ আইনে পরিবর্তন করার পটভুমি তৈরি করতে পেরেছিল।
তবে লক্ষণীয়, এটা ঘটানো হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক প্রেসিডেন্ট শাহাবুদ্দিনের অধ্যাদেশ জারি করে। সংসদের মাধ্যমে নয়। কারণ ভয় ছিল নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসলে কোন পরিবর্তনই হয়ত আর হবে না। কিন্তু তবু ওটাই ছিল পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে বাংলাদেশ পর্যন্ত রাজত্ত্বকালে প্রথম গণআন্দোলনের প্রকাশিত গণআকাঙ্খা বাস্তবে রূপলাভের একটা সীমিত প্রচেষ্টা। তবে, মিডিয়া আইনে সংস্কার হয়ে গেলেও সব আশঙ্কা দূর হয়ে যায়নি।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসলে তথ্যমন্ত্রী হন আজকের "বিখ্যাত" অথবা কুখ্যাত ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা। সে আমলে প্রকাশনা প্রায় শতভাগ নির্ভরশীল ছিল খুলনা সরকারি নিউজপ্রিন্ট মিলের কাগজের উপর। হুদা কাগজ বরাদ্দ বা না-বরাদ্দের ক্ষমতাকে ব্যবহার করে মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার বানিয়েছিলেন। মিডিয়া আইনের বদলটা হুদাকে মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের নতুন উপায়ের উদ্ভাবক বানিয়েছিল। আমাদের দূর্ভাগ্য হলো ব্যারিষ্টারি পেশা প্রায় সবসময় কালো আইনের মুসাবিদা ও হাত পাকানোতে এবং রাষ্ট্রকে নিপীড়নমূলক করতেই ব্যবহার হয়েছে।
সমাজের গণতান্ত্রিক আকাঙ্খাকে তুলে ধরার কাজে এর ভুমিকা নেতিবাচক। এই ধারাবাহিকতায়, বিটিভি প্রসঙ্গে হুদার বক্তব্য ছিল আরও মারাত্মক। তিনি এক নতুন তত্ত্ব খাঁড়া করেছিলেন। বিটিভিকে বিবি-গোলামের বাক্স বানানোর সমালোচনার উত্তরে তিনি দুকান কাটা হয়ে গেলেন। জনসমক্ষে যুক্তি খাঁড়া করে বললেন, বিটিভি সরকারের পয়সায় চলে, তাই বিটিভি সরকারের অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে তাঁর দলের কথাই কেবল বলে যাবে।
এটাই নাকি স্বাভাবিক। হুদার এই নতুন তত্ত্ব দলে বাহবা পেয়েছিল নিঃসন্দেহে কিন্তু, কেউই একবার সাহস করে চিন্তা করতে পারে নাই কাল অন্য দল ক্ষমতায় আসলে একই যুক্তিতে বিএনপি নিজেই নিজেকে ক্ষতিগ্রস্হ করার রাস্তা খুড়েছে এতে। মিডিয়ায় দলবাজিরও একটা কালচার শুরু হয়েছিল এতে।
যাই হোক এভাবেই মিডিয়া জগতের একটা পর্যায় শেষ হয়ে নতুন পর্যায় শুরু হয়। এই পর্যায় হোল মিডিয়াকে স্রেফ দলবাজির হাতিয়ারে পরিণত করা।
যেন মিডিয়া মানেই দলের পক্ষে সত্যমিথ্যার প্রচারণা চালানো। টিভি প্রিন্ট মিডিয়া মালিক রিপোর্টার কিনে ফেলে একাজে যার যার দল ঝাপিয়ে পড়ে। সমাজের স্বার্থ দেখার মত কেউ আর থাকল না, দলবাজির স্বার্থ ওখানে সব কিছুর নির্ধারক। সমাজের বিভিন্ন চিন্তাকে সংগঠিত করা সামাজিক তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে কোন গণস্বার্থকে এক জায়গায় নিয়ে আনার কোন ভুমিকা যেন মিডিয়ার নাই। মিডিয়া মালিকের ব্যবসায়িক স্বার্থ ও মিডিয়া কর্মীর পেশাগত কাজের প্রতি জনগণের গণআকাঙ্খা যে সমর্থন যুগিয়েছিল তা এইভাবেই পায়ে দলা হয়েছিল এবং এখনও চলছে।
ভুমিদস্যু, কালো ব্যবসার মালিক ও সংকীর্ণ দলবাজির রাজনীতি এখন পরস্পরের পৃষ্ঠপোষক। আর এক নতুন ফেনোমেনা হলো, পরাশক্তির মিডিয়া সার্ভিস হয়ে খাঁড়া হয়ে দিন বদলের কথা বলা।
মিডিয়া নিয়ে সমাজের এই বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত লড়াই চলছে। দেশকালের আকাঙ্খা ও আগ্রহ এবং সমাজের রাজনৈতিক সত্ত্বার (polity) মাত্রাটা ক্রমাগত বিনির্মাণ করে চলছে এর ডায়নামিক্স। "তথ্য অধিকার আইন" এখনও এই ডায়নামিক্সের বাইরের বিষয় হয়ে আছে।
মূল চালিকা শক্তি স্হানীয় মিডিয়া কালচার ও প্রাকটিসের কাছে "তথ্য অধিকার আইন" এজন্য এখনও বিষয় নয়।
মিডিয়া নিয়ে সমাজের এই বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত লড়াইয়ের মাঝে নতুন উপায় হিসাবে ব্লগের আবির্ভাব। ব্লগের বিশেষত্ত্ব হলো এটা এখনও বাণিজ্যিক বিষয় নয়। বাণিজ্যিক সম্ভাবনা হিসাবে উঠে দাঁড়ানোর আগের লম্বা পর্যায় পার হচ্ছে সে। নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা তাই স্বভাবতই এর অনুষঙ্গ।
আবার ব্লগের কনষ্টিটিউয়েন্সি অর্থাৎ যারা এর খাতক বা সমাজের যে চাহিদা সে পূরণ করতে পারে সেটাও ইউনিক। ব্লগ হয়ে উঠতে পারে সামাজিক নেটওয়ার্কের মাধ্যম, যদিও কোন ব্লগ তা হতে চায় কিনা সে অন্য কথা। এটা ইন্টারএকটিভ ও তা সহজ। টিভি বা ছাপা প্রকাশ মিডিয়ার মত একমুখি প্রচার নয়। ফলে যে কাউকে সহজেই অংশগ্রহণকারী বানানো যায়, অবদান, ভুমিকা রাখার জায়গা করে দেয়া যায়।
যেই ইন্টারনেট একসেস যোগ্য তাকেই সম্ভাব্য খাতক মনে করা সম্ভব। ফলে সীমিত হলেও বর্তমান বাংলাদেশে এই উপস্হিত খাতক সুবিধা নিয়ে সমাজে যেসব ইস্যুতে ট্যাবু (taboo) বা সামাজিক সাংস্কৃতিক বাধা আছে তা কোন ধরণের বাধা এড়িয়ে, কোন ধরণের অহেতুক সামাজিক ঝড় না তুলে আলোচনার বিষয় বানানো সহজ। যদিও এর অপব্যবহারও আছে। যেমন, একজন ব্লগার ইসলাম ত্যাগ করে সকলকে অন্য যে কোন ধর্ম গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছে, কেউবা ইসলামের নবী-রসুলের বিরুদ্ধে কুৎসা গেয়ে খ্রীচান ধর্মের সেসব ধারা যারা ক্রসেডের লড়াই বাধাবার আকাঙ্খায় ওয়েবসাইট খুলেছে এবং ক্রসেডের লড়াইয়েই ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্ত্বের সমাধান চাইছে - সেখান থেকে উদ্ধৃতি টানছে। অবশ্য বাংলাদেশের যারা উদ্ধৃতি টানছেন তাঁদের র্যাশন্যালিটিটা ঠিক ক্রসেডের লড়াই নয়।
নিজের বদ্ধ সমাজের বিরুদ্ধে একটা ক্ষোভ, "অবাধ মুক্তবুদ্ধি চর্চার" একটা সুযোগ নেবার ধারণা এখানে কাজ করছে। যদিও এরা একাজের মাধ্যমে ক্রসেড লড়াইকে উস্কে দিল বা দাওয়াত দিবার বিপদ সম্পর্কে ওয়াকেবহাল কীনা তা আমরা নিশ্চিত নই। আমার বিশ্বাস ওয়াকেবহাল থাকলে তাঁরা তা করতো না। কারণ সচেতনে ক্রসেডের লড়াই বা ধর্মযুদ্ধ এঁদের কাছে ধর্মেই মতনই পরিত্যাজ্য।
আবার, যাদের চিন্তা গুছানো না বা সুনির্দিষ্ট আকার নেবার পর্যায়ে আছে সে ধরণের পাঠককেও ব্লগ নিজের সাথে লিপ্ত বা লেপটে ফেলতে পারে।
এদের কাছে ব্লগ এডুকেটিভ হতে পারে, ক্রমশ সে সাড়া, প্রত্যুত্তর বা সওয়াল-জবাবের মত যোগ্য করে নিজেকে গড়ে তুলতে পারে।
ব্লগ যেমন কেবল ভালো লেখকের জায়গা ঠিক তেমনি ব্যাপক পাঠকের জায়গাও। পাঠক না থাকলে লেখক মূল্যহীন, ঐ লেখার কোন মানে হয় না। এই দূরত্ত্ব কমানোর মধ্যেই লেখকের সফলতা লুকিয়ে আছে। সামহয়ার সম্পর্কে মাহবুব মোর্শেদ একটা অবজারভেটিভ মন্তব্য ছিল, সামহয়ারে প্লাস-মাইনাস রেটিং দেবার সুযোগ উঠিয়ে দিলে এই ব্লগের ৫০% নিক বেকার হয়ে যেত, তাঁরা আছে কীনা খোঁজ পাওয়া যেত না।
মাহবুবের কথার মধ্যে একপেশে একটা সত্যতা আছে আবার প্রতিদ্বন্দ্বিতার একটা শ্লেষও আছে। তবু বলবো একজন ভাল মডারেটর হিসাবে এটা মাহবুবের আধেক-দর্শন বা উপলব্দি। বুদ্ধিমান মডারেটরের কাছে পাঠকের প্রয়োজনটা খাটো করে দেখাটা বোকামি। কেবল রেটিং করতে হলেও তাকে ব্লগে আসতে হয়। এতে কোন না কোন বিষয়ে পোষ্টে সে আকৃষ্ট হয়ে যেতে পারে।
সবাইকে ভারী ভারী কঠিন প্রসঙ্গে আকৃষ্ট হতেই হবে - এমনটা না হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। আর মানুষের জীবনে এমন কিছু জায়গা নিশ্চয় থাকা দরকার যে জগতে আসলে কোন কিছুই তাকে বাধ্য হয়ে পড়তে বা মনোযোগ দিতে হয় না, পেশা নির্মাণের তাগিদ যেখানে তাকে তাড়া করবে না। যেকোন ভাবে তাকে প্রকাশিত হতে দিলে, লিপ্ত হতে সুযোগ দিলে তাঁর আরাম, সহজ বোধ করার কথা। আমাদের সামাজিক আড্ডায় রাজনৈতিক প্রসঙ্গ একটা অতি পরিচিত অনুসঙ্গ। আবার তার মানে এটাও নয় যে হাসি, তামাশা, ইয়ার্কি, খুনসুটি, পিছনে লাগা ওখানে চলে না।
একটা হাল্কা পরিবেশ তৈরি করে নিয়ে আমরা সবই করি। হাল্কা আড্ডা মারতে মারতে আলোচনা সিরিয়াস জায়গায় চলে গেলে আমরাই আবার সিরিয়াসলি ওখানে অংশগ্রহণ করি। আমাদের ব্লগ কালচারের মধ্যে এই ধরণের আড্ডার ছাপই দেখা যায়। আমার অনুমান বাংলা ব্লগের কালচার এরকমই একটা রূপ লাভ করবে হয়তো। সামহয়ারের সাফল্যের সাথে অন্য ব্লগ উদ্যোগের তুলনায় এটাই আমার কাছে একটা অন্যতম কারণ মনে হয়।
অন্যেরা সবকিছুকে সিরিয়াস বানিয়ে ফেলেছে। ফলে ব্লগারের ওখানে বেছে নেবার সুযোগ কমে গেছে। নিজের কোন এক মুডে কোন ধরণের ব্লগ পোষ্ট বেছে নিতে ব্লগারের সুযোগ যত কম থাকবে ঐ ব্লগে আসতে তাঁর আকর্ষণ ততই কমবে। কোন আড্ডায় যদি আড্ডার প্রসঙ্গ ঠিক করে দেয়া হয় তাহলে ওটা আর আড্ডা থাকে না, আলোচনা সভা হয়ে যায়। আমার ধারণা ব্লগে আড্ডার ভাব ধরে রাখাটা গুরুত্ত্বপূর্ণ।
এবার সুনির্দিষ্টভাবে সামহয়ারইন ব্লগ সম্পর্কে কিছু কথা বলব।
বিগত নির্বাচন ও রাজনৈতিক সরকার গঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাজ একটা নতুন রূপ নিতে যাচ্ছে। এর একটা প্রভাব মিডিয়া হিসাবে ব্লগে সা.ইনে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি সত্যি সত্যি শকড, বলতে বাধ্য হচ্ছি সামহয়ারইন এর ধাক্কা সামলাতে পারেনি, ব্যর্থ হয়েছে।
যুদ্ধাপরাধের বিচার গত প্রায় দেড় বছর ইস্যু হিসাবে দাঁড় করানোর চেষ্টা হচ্ছিল।
এর প্রভাব কমবেশি সা.ইনে পড়ছিল। তবে নির্বাচনের সামনে এসে ব্যানার টাঙানোকে কেন্দ্র করে চাপ বাড়তে থাকায় একপর্যায়ে সা.ইন ব্যানার করতে রাজি হয়। নির্বাচন শেষ হয়। তখনও পর্যন্ত সা.ইনের সিদ্ধান্তগুলোকে আমি অগোছাল অপ্রস্তুতের চাপ সামলানো হিসাবে দেখেছিলাম। সা.ইন ব্লগ কিন্তু তা প্রচার মাধ্যমও বটে।
অথচ এর এডিটোরিয়াল পলিসি ততটাই দূর্বল যতটা সে ব্লগ চালানোর কমপিউটার টেকনোলজিতে সবল। দূর্বল বলতে বুঝাচ্ছি, সমাজের রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্কের ঝড়-ঝাপটা সে তো আসবেই। এসে পড়লে কী করবে এটা আগে ভেবে রাখার বিষয় যেটা, তার নীতিতে প্রতিফলিত হয়ে থাকার কথা। ফলে তা মোকাবিলাও সহজ। প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ কী সে সম্পর্কে সচেতন ও হোম-ওয়ার্ক করে তৈরি না থাকার মানে নিজের ভাবনা অন্যকে ভাবতে দেয়া, তাঁর স্বার্থে নিজেকে পরিচালিত হতে দেয়া।
যদিও ওখানে অনেকের মনে হবে আমি তো প্রতিষ্ঠানের স্বার্থেই পরিচালিত হচ্ছি। এবং সত্যি সত্যি তা এক অর্থে প্রতিষ্ঠানের স্বার্থও বটে, তবে তা সাময়িক ধরণের, ছোট লাভে বড় ক্ষতি, চাই কি এতে প্রতিষ্ঠানের আগামী অস্তিত্ত্বকে কখন হুমকির মুখে দাঁড় করানো হয়ে গেছে তা খেয়াল না করে ঘটে।
সামহয়ারইন দুটো ইস্যুতে নিজের প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থ ক্ষুন্ন করেছে। প্রথমটা অমি রহমান পিয়ালের পর্ণসাইটে যুদ্ধাপরাধের ব্যানার টাঙানোকে সমর্থন করে শওকত হোসেন মাসুমের সমর্থন সূচক বক্তব্যের বিরুদ্ধে ব্লগ পোষ্ট আসতে শুরু করলে ব্লক করার সিদ্ধান্ত সংক্রান্ত।
কখনও কখনও এমন পরিস্হিতি আসে যখন ব্যক্তির স্বার্থ আর ব্যক্তির নিজেরই প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়।
তবে বুদ্ধিমান ব্যক্তি কখনই একে মুখোমুখি হতে দেয় না। যাই হোক, এমন পরিস্হিতিতে কোন লোক পেশাদার হতে পেরেছে কীনা বা কতটুকু পেশাদার হয়েছে তা এক পরীক্ষার মধ্যে পড়ে যায়। পেশাদারিত্ত্বের প্রমাণ দেখাতে গেলে ব্যক্তি স্বার্থ, বন্ধুকে বাঁচানোর স্বার্থকে পিছনে ফেলে প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের পক্ষে দাঁড়াতে হবে। সামহয়ারইন এখানে পেশাদারিত্ত্ব দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। ব্লগ এখনও কোন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নয় এই বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে থাকলেও এই সিদ্ধান্তও ভুল ও আত্মঘাতি।
প্রথমত যে ক্ষীণদৃষ্টির সমাধান ভাবা হয়েছে এটা ফলাফলে কাউকেই বা কারও ইমেজই রক্ষা করেনি, না বন্ধুকে না প্রতিষ্ঠানকে। ক্ষীণদৃষ্টির সমাধানে ভাবা হয়েছে এই দুই স্বার্থ বুঝিবা মুখোমুখি। মোটেও না। মাসুম যদি মনে করে পালটা জবাব দেওয়ার চেয়ে তাঁর ইমেজ রক্ষা করা গুরুত্ত্বপূর্ণ তো সে পুনর্ভাবনামূলক একটা বক্তব্য দিয়েই বিষয়টার ইতি টানা যেত। আমরা একটা ভুল চিন্তা করতেই পারি বা লিখে ফেলতেই পারি।
আমি যদি বুঝতে পারি ওটা ভুল তো সেই পুনর্ভাবনা বা সেকেন্ড থট প্রকাশ করতে পারাটাই তো সবচেয়ে সাহসের ও গঠনমূলক সমাধান। এটাকে যে আবার প্রশংসা জানাতে পারবে না তাকেই তো আমরা তখন দোষী ও দায়ীত্ত্বজ্ঞানহীন মনে করব। এরকম পুনর্ভাবনা বা সেকেন্ড থট প্রকাশের ঘটনা ব্লগে বহুবার ঘটেছে। এমনকি এই প্রসঙ্গে আমাদের পিয়ালের নেয়া পথের প্রশংসা করা যায়। পিয়ালের সারকথা আমার জবানিতে বলি।
ওর পোষ্টের প্রথম অংশ হলো ও কি পরিস্হিতিতে পড়ে কী কাজ করেছে। আর শেষ কথা হলো, ওর জীবনসঙ্গী যে সবচেয়ে কাছে থেকে তাঁর সবকিছু দেখেছে জানে ফলে তাঁর বিচার হলো সবচেয়ে বিবেচনা সম্পন্ন; তাঁর সম্মতি পিয়ালের পাথেয়। অর্থাৎ পিয়ালের বক্তব্য হলো নৈতিক বিচারই ঘটনার একমাত্র বিবেচনা বা বিচার্য বিষয় নয়, এর আরও বিবেচনার দিক, বিষয় আছে। লক্ষ্যণীয় পিয়াল নৈতিক বিচারটা ভুল তা সে বলছে না। এই পরিস্হিতিতে আমি মনে করি আমরা পাঠকদের এরপর আর তর্ক তোলা ঠিক নয়।
পিয়ালের জীবনসঙ্গীর উপর আমাদের ভরসা করতেই হবে। মাসুমের সাথে পিয়ালের এই এ্যাপ্রোচ তুলনায় শতগুণে বুদ্ধিমানের। পিয়াল নিজেকে সফলভাবে ব্যাখ্যা করতে পেরেছে। আমরাও মানবিকভাবে পিয়ালকে দেখার সুযোগ পেয়েছি।
সামহয়ারইন দ্বিতীয় যে ইস্যুতে নিজের প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থ ক্ষুন্ন করেছে তা হলো গাজা ইস্যুতে ব্লগারদের নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা, ব্লগ মুছে দেওয়ার ইত্যাদি।
ঘটনাটা হলো, গাজায় নির্মম বোমাবাজি, নৃশংসতার প্রতিক্রিয়া সারা দুনিয়ায় সবদেশে কমবেশি হয়েছে। বিশ্ববাসী এই নির্মমতা প্রত্যক্ষ করে কোন বিশ্বজনমত তৈরি করে ফেললে তার প্রথম শিকার হবে আমেরিকান নীতি ও বৈশ্বয়িক স্বার্থ। আর সেই সাথে আমেরিকান নীতি সমর্থনকারী কোন স্হানীয় রাষ্ট্র ও সরকার। এটাই ছিল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের আদি কারণ। ইউরোপকে প্রথম তিনদিন সময় নিতে হয়েছিল তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাবে কীনা।
মানবাধিকার লঙ্ঘন, নির্বিচারে বোমাবাজি, নিষিদ্ধ ফসফরাস ব্যবহারের দায়ে অভিযুক্ত করবে কীনা। কারণ, ইউরোপের স্বার্থ চিন্তাভাবনার দিক থেকে দেখলে, র্যাডিক্যাল ইসলামের সমস্যায় তার দিন কাটছে। এর মধ্যে হামাসের প্রতিরোধ কী "ইসলামি জঙ্গীবাদের" কাজকারবার? এই নিয়ে বিতর্কে ইউরোপ তিন দিন পার করেছে। এরপর দেরি হলেও তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে।
আমরা পারিনি।
আমেরিকা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোন প্রতিক্রিয়া যেন জনবিক্ষোভে সংগঠিত না হয় এজন্য প্রচার মাধ্যমকে সংযত নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের যে ব্রিফিং ছিল তা পালনের একমাত্র ও বেশিবেশি খেদমতগার হওয়ার দায়িত্ত্ব নিয়ে ফেলেছে সামহয়ারইন। অথচ সীমিত হলেও কোন টিভি বা প্রিন্ট মিডিয়া গাজার নৃশংসতা প্রচার বন্ধ করে নাই। কারণ, ব্রিফিং সত্ত্বেও সব মিডিয়া পরিচালকই জানে ও মানে, মিডিয়ার একটা নিজস্ব স্বার্থ আছে। যা ক্ষুন্ন করা আত্মঘাতি। আবার এরকম একটা ব্রিফিং চালু আছে যে গাজার প্রতিক্রিয়া ও জনবিক্ষোভে নিয়ন্ত্রণ না করলে যুদ্ধাপরাধের বিচারের আবহ নষ্ট হয়ে যাবে।
এর মানে কী? যুদ্ধাপরাধের বিচার চাওয়ার সাথে আমেরিকার ওয়ার অন টেররের সম্পর্ক কী? তাহলে যুদ্ধাপরাধের বিচারের কথা তুলে আমরা কী আসলে সরকারিভাবে বাংলাদেশকে আমেরিকা ইসরায়েলের যুদ্ধের পক্ষভূক্ত করছি, আমেরিকার 'ওয়ার অন টেরর' এর যুদ্ধের পক্ষভুক্ত হচ্ছি, যুদ্ধের দায়ে বাংলাদেশকে জড়িয়ে ফেলছি?
আমরা আসলেই যদি যুদ্ধাপরাধের বিচার চাই তাহলে তো আমাদেরকে অবশ্যই প্রশ্ন করতে হবে এর সাথে আমেরিকার ওয়ার অন টেররের সম্পর্ক কী? আমাদের নিশ্চিত হতে হবে আমরা যুদ্ধাপরাধের বিচার চাচ্ছি না আমেরিকার ওয়ার অন টেররের যুদ্ধে সামিল হতে চাচ্ছি।
সেসব রাজনৈতিক বিষয় থাক। সামহয়ারইন কী এসব জেনে শুনে মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ারে পরিণত হতে চাচ্ছে। এটা জেনে শুনে না না জেনে - আমরা স্পষ্ট জানি না। ১. যদি জেনে শুনে হয়: এর মানে প্রতিষ্ঠান হিসাবে সামহয়ারইনের ভবিষ্যত এখানে আর গুরুত্ত্বপূর্ণ নয়।
এছাড়া সামহয়ারইন প্রথম নিজেকে বিক্রিযোগ্য বাণিজ্যিক সম্ভাবনাময় হয়েছে বুঝতে হবে। ২. সিদ্ধান্ত যদি সুচিন্তিত না হয়: তবে সামহয়ারইনকে তার আগে নেয়া সিদ্ধান্তগুলো পর্যালোচনা করতে, ভেবে দেখতে বলব। সেক্ষেত্রে স্পষ্ট নীতিমালার উপর পেশাদারিত্ত্ব নিয়ে সামহয়ারইনকে দাঁড়াতে হবে।
প্রাসঙ্গিক একটা কথা বলে কথা শেষ করব।
পেশাদারী ও বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোন প্রতিষ্ঠানের কোন সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক অবস্হানের দিকে ঝুঁকে পড়াটা বুদ্ধিমানের কাজ না।
বরং রাজনৈতিক অবস্হানগুলোকে একপাত্রে নীতিমালার অধীনে দক্ষ হাতে বেঁধে রাখার ব্যবস্হা করাই তার কাজ। কোন রাজনৈতিক অবস্হানই তার নিজের হতে পারে না, বরং প্রত্যেকটা রাজনৈতিক অবস্হানই তার সম্ভাব্য ক্রেতা, গ্রাহক বা খাতক। এটা আবার বাণিজ্য-লক্ষীরও স্বার্থ।
সামহয়ারইন নিয়ে আমি শঙ্কিত। আমার ধারণা বদলে যাচ্ছে।
তবু কামনা করছি আমার ধারণা মিথ্যা হোক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।