আত্মবিশ্বাসহীনতায় প্রকট হচ্ছে আত্মার দেউলিয়াত্ব, তবুও বিশ্বাস আগের মতই নিশ্চল..
গতকাল টিভিরুমে খেলা দেখার সময় আমাদের হলের এক সিনিয়র ভাই বলছিল_"বাংলাদেশ এই সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হলে খুশি হই। আশরাফুলরে ঘাড়ধাক্কা দেয়ার একটা মওকা পাওয়া যাইব। " পাশে বসা অপর সিনিয়রের মন্তব্য "তাইলে তখন খেলা দেখতে আসুম কার, জুনায়েদ সিদ্দিক আর ইমরুল কায়েসের? এখনো আশরাফুল আছে বলেই বাংলাদেশের ব্যাটিং দেখি। নইলে বাকিগুলো ব্যাটসম্যান নাকি!"
আমি আশরাফুলের খেলার একজন বিশাল ভক্ত, তবুও আমার হিউমারাস মন্তব্যটা সেসময় বেশ সাড়া ফেলেছিল। আমি বলেছিলাম" আচ্ছা , যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে যেমন গণস্বাক্ষর অভিযান চলছে, অত ব্যাপক পরিসরে না হলেও মোটামুটি আমরা যারা ক্রিকেট পাগল আছি, সবাই যদি অনুরূপভাবে আশরাফুলের পদত্যাগ ও দল থেকে বহিষ্কারের দাবিতে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করে বিসিবিতে জমা দেই, কেমন হয়?কারণ, খেলাটা শুধু ওই ১১জন খেলোয়াড়ের নয়, আমাদের ১৪কোটি মানুষের আবেগও বটে।
সেই আবেগ নিয়ে ছিনিমিনি খেলার লাইসেন্স আশরাফুল যদি টেন্ডুলকারও হয় তবুও তাকে কেউ দেয়নি, দেবেনা। "
গতকাল রাতে নাফিস বাংলাদেশ দল নিয়ে চমৎকার একটা পোস্ট দিয়েছে। ওর যুক্তি এবং বিশ্লেষণগুলো চমৎকার, তবে একটি বিষয় ওর দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে_ পর্যাপ্ত বিকল্প খেলোয়াড়ের অভাব। এমনিতেই আইসিএল ঝড়ে বেশ কয়েকজন নিয়মিত খেলোয়াড় দলে নেই, তারসঙ্গে ঘরোয়া-বয়সভিত্তিক দলগুলোতে এমন কোন খেলোয়াড়ের নাম শোনা যাচ্ছেনা যারা দলে আসার মত। হাবিবুল-পাইলটরা যখন জাতীয় দলের খেলোয়াড়, শাহরিয়ার নাফিস-সাকিব-আফতাবরা তখন বয়সভিত্তিক দলগুলোতে দুর্দান্ত পারফরমেন্স দেখাচ্ছিল।
কিন্তু মাত্রই কয়েকবছরের ব্যবধানে সেরকম কারও নামই শোনা যাচ্ছেনা। কিছুদিন সোহরাওয়ার্দী শুভ, মার্শাল আইয়ুব, ইসরাক সনেটের নাম শোনা গেলেও জাতীয় লীগগুলোতেই তাদের পারফরমেন্স নেই, অন্য কথা নাহয় না-ই তুললাম। আইসিএল+ বিকল্প খেলোয়াড়, এই দুটি বিষয়ই মূলত খেলোয়াড়দের এতটা নির্ভার করে রেখেছে, কারণ যা-ই খেলুক ঘুরেফিরে তাদের কাছেই ফিরে আসতে হবে। বলা যায় ক্রিকেট এখন এই কয়েকজন খেলোয়াড়ের হাতেই জিম্মি হয়ে পড়েছে।
আফতাব আহম্মেদ একবার এক ইন্টারভিউয়ে বলেছিল_ আমি পএকম্যাচে সেঞ্চুরীর বদলে প্রতিম্যাচে ৩০-৪০ করতে চাই।
" আশরাফুলের মনস্তত্ত্বটা সবচেয়ে সুন্দরভাবে বিশ্লেষণ করেছিল আমার বুয়েটের এক বন্ধু (ব্লগার "শিট সুজি")। তার ভাষায় -" আশরাফুল নিজেকে এই গ্যালাক্সির সবচেয়ে প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান ভাবে। আর বোলারদের ভাবে ডোবা-নালায় মাছ ধরা জেলে। যেজন্য উল্টা-পাল্টা সব শট খেলে, আর আউট হওয়ার পর এমনভাবে মাথা নাড়ায় যা দেখলে মনে হয়
"আমার মত ব্যাটসম্যান এইবলে কিভাবে আউট হয়!এই বলে তো ছয় না হলেও ২ রান অবশ্যই হয়। " সম্ভবত বাংলাদেশ বলেই ৮ বছরে ২০ এর সমান্য বেশি গড়ের একজন খেলোয়াড় একটা দলের টপঅর্ডার ব্যাটসম্যান
হিসেবে খেলতে পারে।
এবার একটি অপ্রিয় সত্য কথা বলি। আশরাফুলের এই "গায়ে হাওয়া" লাগিয়ে ঘুরার নেপথ্যে ক্রীড়া সাংবাদিকদের ভূমিকাও কম নয়। বিশেষ করে, প্রথম আলোতে উৎপল শুভ্র আর তারেক মাহমুদ নামে দুজন সাংবাদিক আছেন যারা সময়-সুযোগ পেলেই আশরাফুলকে বিরল প্রজাতির ব্যাটসম্যান হিসেবে প্রমাণে তৎপর হয়ে পড়েন। সেই ২০০১ এর পর থেকেই দেখছি এরা আশরাফুলের একটা ইনিংসের পর ভাষার যেরকম ফোয়াড়া ফোটান , তার নির্লজ্জ ব্যর্থতা নিয়ে কখনই সেভাবে কাটাছেড়া করেননা, যতটা করে থাকেন অন্য ব্যাটসম্যানদের ক্ষেত্রে। প্রতিভায় প্রায় কাছাকাছি হওয়া সত্ত্বেও আফতাবকে নিয়ে কখনই কোন মাতামাতি দেখা যায়নি এদের মধ্যে।
কারণ হতে পারে একটাই, আফতাবের ইনিংসগুলো সেভাবে নজরে আসেনা। অষ্ট্রেলিয়ার সাথে সেই ছক্কা, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বিশ্বকাপে জাস্টিন কেম্পকে মারা বিশাল ২ ছক্কা.........সবগুলোই ঢাকা পড়ে গেছে একইম্যাচে আশরাফুলের কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙ্গায়।
আমি উক্ত সাংবাদিকদ্বয়কে দোষারোপ করছিনা, তবে সমালোচনা অবশ্যই
করছি। আশরাফুলকে এই "over-rated" খেলোয়াড়ে পরিণত করেছে। হঠাৎ ২-১টা ম্যাচে ম্যাজিক দেখার জন্য একটা খেলোয়াড়কে বছরের পর বছর বয়ে বেড়ানোর বিলাসিতা দেখানোর মানেটা আমার কাছে পরিষ্কার নয়।
আমি ্কজন খেলোয়াড়ই দলে দেখতে চাই, ম্যাজিশিয়ান নয়।
আমি যদি বলি আশরাফুলকে আর একদিনও দলে দেখতে চাইনা, আমি জানি অধিকাংশ মানুষই আমার সাথে সহমত পোষণ করবেন। তবে এই মতামতে সুচিন্তার চেয়ে ক্রোধই বেশি প্রাধান্য পাবে। তাই বিষয়টি নিয়ে ভাবনার অবকাশ আছে। অধিনায়ক হিসেবে আশরাফুলকে কোনভাবেই আর চাইনা, এ ব্যাপারে কোন ২য় ভাবনার সুযোগ নেই।
তাহলে, প্রশ্ন হচ্ছে অধিনায়ক হিসেবে কাকে চাই?
মাশরাফি দলের নিয়মিত পারফরমার। বাংলাদেশের যে কোন জয়ে তার শুরুর স্পেলটাই নিয়ামক হয়ে উঠে। তবুও পুরো ক্যারিয়ারজুড়ে ইনজুরির সাথে লড়াই করা বোলারটিকে অধিনায়ক হিসেবে সবচেয়ে উপযুক্ত মনে হয়না। তাকে সবসময়ই মাথাগরম খেলোয়াড় মনে হয়। এটা কোন কারণ হতে পারেনা।
তাই তাকে বিবেচনায় রাখা যেতে পারে।
সাকিব এই মুহূর্তে দলের প্রধান খেলোয়াড়। একটা সময ছিল হাবিবুল বাশার টেস্ট খেললেই ২ ইনিংসের একটিতে ফিফটি নিশ্চিত। সাকিবেরও এখন সুসময চলছৈ। সাকিবকে অধিনায়ক হিসেবে দেখতে না চাওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে এটা তার পারফরম্যান্সে প্রভাব ফেলতে পারে।
এটা অবশ্য সবার ক্ষেত্রে সত্য নয়। গ্রায়েম স্মিথ, পণ্টিংরা অধিনায়ক হয়ে বরং পারফরম্যাসের উন্নতি ঘটিয়েছে, তবে উল্টো ফলাফলের দৃষ্টান্তই বেশি। তাছাড়া স্মিথ-পণ্টিং দলের একমাত্র পারফরমার নয়, তাদের অনেক সাপোর্টিং পারফরমার আছে। কিন্তু আমাদের দলে সাকিবই সবেধন নীলমণি। তাই কোনভাবেই ঝুকির মধ্যে যাওয়া উচিৎ হবেনা।
মুশফিকুর রহিমের দলে জায়গা নিশ্চিত। সে একজন ভালো ব্যাটসম্যান। ওয়ানডাউনে ব্যর্থ হলেও ৬-৭ নম্বরে নেমে টেল এণ্ডারদের সাথে সে ভালোই খেলতে পারে। টেস্টেও তার ব্যাটিং দেখে আশাণ্বিত হওয়া যায়। ইংল্যাণ্ড সফরে অভিষেকের আগেই প্রস্ত্ততি ম্যাচগুলোতে তার প্রতিভা ছিদ্রান্বেষী ইংলিশ মিডিয়াকেও তার প্রশংসা করতে বাধ্য করেছিল।
সমস্যা তার কিপিংয়ে। প্রতিম্যাচেই তার কিপিং খুবই হতাশাজনক মনে হয়। কিপিংয়ে উন্নতি একটু সময দিলেই হয়ত হয়ে যাবে, অন্যদিকে ব্যাটিংয়ে পরিপক্কতার ছাপ স্পষ্ট। তাই তাকে ভাবা যেতে পারে। বয়সটা একটু কম।
আশা করছি, এটা কোন বিরাট ইস্যু নয় বাংলাদেশ দলের প্রেক্ষাপট বিবেচনায়। আর হলে, আপাতত মাশরাফিকে অধিনায়ক করে মুশফিককে তার সহকারী করা যেতেই পারে।
সর্বশেষ পছন্দ রকিবুল হাসান। এই মুহূর্তে ফর্ম ভালো যাচ্ছেনা। তবে তার খেলার সুন্দর দিক হচ্ছে লফটেড শট কম খেলে সিঙ্গেলস এর উপর বেশি নজর দেয়া।
তাছাড়া সে দলের প্রধান পারফরমারও নয়, দর্শকরাও তাকে নিয়ে মাতামাতি করেনা। সাধারণত এরকম খেলোয়াড়রাই ভালো অধিনায়ক হয়। রানাতুঙ্গা, স্টিভ ওয়াহ, হ্যান্সি ক্রনিয়ে কখনই আলোচিত পারফরমার বা দর্শকপ্রিয় খেলোয়াড় ছিলনা, কিন্তু খেলার কাজটা ঠিকই করে যেত নিভৃতে। তবুও তার অভিজ্ঞতা যেহেতু কম, আরেকটু সময় নেয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে আবারও সেই মাশরাফিই সাময়িক ভরসাস্থল।
আশরাফুলকে দল থেকে এখনই বাদ দেয়ার পরিবর্তে, কয়েকটা ম্যাচ খেলার সুযোগ দেয়া উচিৎ। তবে সেসব ম্যাচে যদি সে আবার কোন ম্যাজিক দেখায়, তখন তাকে প্রশংসার বৃষ্টিতে ভজিয়ে যেন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত করা না হয় সেটিও খেয়াল রাখা দরকার। আশরাফুলের ম্যাজিক ইনিংসকে আমার এক বন্ধু বলে "ঝড়ে বক মরা। "...আমি তেমন না বললেও বলব সেসব ইনিংসকে একটি "ইনিংস " হিসেবেই দেখা উচিৎ; এর বেশি কিছু নয়।
কাল বাংলাদেশের খেলা আছে ।
দেখবো কিনা ভাবছি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।