আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছোটো গল্প- প্রায়শ্চিত্ত

আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত আপনাকে মানসিক ভাবে নির্যাতন করার জন্য। কারন আমার লেখা পড়ে আপনি বিরক্ত হতেই পারেন। । আরেকটু বিরক্ত হতে চাইলে ঘুরে আসতে পারেন আমার ওয়েবসাইট http://gmshovo.info থেকে

বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে নিশাত। বৃষ্টি পড়ছে অঝোরে,আকাশটা যেনো মায়াকান্না শুরু করেছে।

এই থেমে যায়, এই আবার শুরু হয়। কিছুক্ষন পর পর বাতাসের ঝাপটা এসে উড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে নিশাতের শাড়ির আচল আর চুলগুলো,ছোটো ছোটো বৃষ্টির কনাগুলো মুখের উপর জমছে। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ভীতুর ডিম পাপনটা বাসায় থাকলে হয়তোবা এতোক্ষনে টেনে ভেতরে নিয়ে যেতো, শুয়ে থাকত কাথামুড়ি দিয়ে। মোবাইল,ইলেকট্রিসিটি সবকিছু বন্ধ করে রাখে ভীতুটা।

কবে যে কার কাছ থেকে এগুলো শুনেছে তা ভেবে পায় না নিশাত। ভীতুটা যে কেনো এতো ভয় পায় তাও বুঝে না নিশাত। মাঝে মাঝে ভাবে, দা এর মাথায় লবন নিয়ে তা খাওয়াবে পাপনকে। কারন ছোটোবেলা ভয় পেলে দাদি-নানীরা এরকমটাই তো করত। তবে ভীতু হলেও পাপন বেশ রোমান্টিক বলা যায়, টেবিলের উপর মোমের নিভু নিভু আলোর সামনে যখন পাপন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তখন নিশাতের অসম্ভব ভালো লাগে, মোমবাতির ক্ষীন আলোর মতো তার জীবনের দুঃখ আর অপ্রাপ্তিগুলোর বেদনা কিছুটা হলেও কমে যায় তখন।

হাসছে নিশাত, অন্ধকারেও হাসিটা বুঝা যাচ্ছে। অফিস থেকে এসে যদি পাপন দেখে নিশাত এভাবে দাঁড়িয়ে আছে তাহলে আকাশ ভেঙ্গে পড়বে তার মাথায়। হাজার হলেও একটাই তো মাত্র বউ তার, শরীর খারাপ হয়ে গেলো তখন কী হবে? আহ বেচারা! নিশাত হাতটা বাড়িয়ে রেখেছে সামনের দিকে, বৃষ্টির ফোটাগুলো হাতে এসে পড়ছে। হাত বাড়ালেই বৃষ্টির ফোটা ধরতে পারছে নিশাত এতেই তার আনন্দ, কারন কতো কিছুই তো সে হাত বাড়িয়ে ধরতে চেয়েছিল, চেয়েছিল দু-হাত বাড়িয়ে ঝাপটে ধরতে। কিন্তু সেই চাওয়াগুলো কখনোই নিশাতের হাতে ধরা দেয়নি।

দূর থেকে দূরে সরে গেছে চাওয়াগুলো, কখনো কখনো স্ফুট থেকে অস্ফুট হয়ে গেছে। কী করার! ভাগ্য যে নিশাত কে দু-হাত ভরে অপ্রাপ্তি দিয়েছে আর দিয়েছে জাবর কাটার মতো কিছু সুখ-স্মৃতি। বৃষ্টি খুব প্রিয় নিশাতের। খুব খুব বেশি প্রিয়। প্রিয়’র আদর্শ পরিমাপকের সর্বোচ্চ যেই পরিমান আছে সেই পরিমান প্রিয়।

বৃষ্টির সাথেই যেনো তার জীবন জড়িয়ে আছে। আসলেই জীবনের প্রতিটি মোড়ে বৃষ্টি জড়িয়ে আছে তার জীবনে। তখন মাত্র ক্লাশ সিক্সে নিশাত, অন্যরা যখন প্রেম জিনিশটা কি তা বুঝে উঠতে পারে নি তখন সে মনস্থির করল প্রেমপত্র লিখবে। তাও সমবয়সী একটা ছেলেকে। সহজ বাংলায় লেখা প্রেমপত্রটা স্কুল ছুটির পর যখন পৌঁছে দিতে যাবে তখনি নামল বৃষ্টি।

হাতে নিয়ে রাখা কভার বিহীন প্রেমপত্রটা সেদিন বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হয়ে গিয়েছিল,কিছুই বুঝা যাচ্ছিল না। প্রেমপত্র কী আগের অবস্থায় বহাল আছে নাকি, বৃষ্টিতে ভিজে নাজেহাল হয়ে আছে তা খেয়াল না করেই অয়নের হাতে কাচা হাতে পাকা লেখায় ভরা কাগজটা ধরিয়ে দিয়েছিল। ধরিয়ে দিয়েই পেছন ফিরে দৌড় দিয়েছিল, অয়ন ও দৌড়াচ্ছিল তার পিছু পিছু কারন পত্রের এমন অবস্থা যে তা লেখক ব্যাতীত আর কেউই পড়ার মতো অবস্থায় ছিল না। নিশাত দৌড়াচ্ছিল আর মনে মনে হাসছিল, হয়তোবা এই প্রথম রোমান্টিকতার ছোয়া লেগেছিল। কিন্তু সব রোমান্টিকতা মাটির সামনে মিশে গিয়েছিল যখন অয়নের সামনে পিছলে পড়ে গিয়েছিল।

দৌড়ে এসে অয়ন হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছিল। নিশাত লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিল, হাজার হলেও অন্তত আজকের দিনে এমন একটা ঘটনা মেনে নিতে পারছিল না সে। নিশাত উঠে যখন আবারও দৌড় দিয়েছিল তখন অয়ন পেছন থেকে পত্রটাকে হাতে ঝুলিয়ে ডাক দিয়ে জিজ্ঞেশ করেছিল, নিশাত এখানে কী লেখা রে?? নিশাত ফিরে এসে অয়নের হাত থেকে টান দিয়ে পত্রটা নিজের হাতে নিয়ে এসেছিলো,তবে পুরোটা আসে নি,এসেছিল অর্ধেকটা। আর দৌড়ে চলে যাওয়ার সময় বলেছিল “আই লাভ ইউ”। সেদিন অনেক কিছুই হয়েছিল, চিঠিটা যেমন দুই ভাগ হয়ে গিয়েছিল তেমনিভাবে নিশাত আর অয়নের জীবনও দুই ভাগ হয়ে গিয়েছিল।

নিশাতের জীবনের এক ভাগে অয়ন আর অন্য ভাগে সে নিজে, অয়নেরও একই অবস্থা হয়েছিল। তারপর কচ্ছপ গতিতেই চলছিল তাদের ভালোবাসার ট্রাম। ভালোবাসার ট্রামে গতি এলো যখন দুজনই স্কুল পেরিয়ে কলেজে পা দিল। খুনসুটি,অভিমান,ঝগড়া এই নিয়েই বেশ চলছিল। সাথে দুজনের হাতেই তখন মোবাইল জুটে গিয়েছিল।

মোবাইল পেয়ে ভালোবাসার ট্রামে দুর্ঘটনার সংখ্যা ও বেড়ে গিয়েছিল। অবশ্য ভালোবাসাকে উপভোগ্যও করে তুলেছিল ছোট্ট এই যন্ত্রটা। শীতের রাতে কাথামুড়ি দিয়ে অয়নের সাথে কথা বলা অথবা বৃষ্টির দিনে গুনগুনিয়ে অয়নকে গান শুনানো সবই চলত এই ছোট্ট যন্ত্রটা দিয়ে। নিশাতের গানের গলা খুব ভালো না হলেও খারাপ ছিল না। নিশাত অয়নকে বেশিরভাগ সময় জগজিৎ সিং এর একটা গান শোনাতে পছন্দ করত, “আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুব তারা, আমি আর কতকাল রব দিশেহারা।

জবাব কিছুই তার দিতে পারি নাই শুধু, পথ খুজে কেটে গেলো এ জীবন সারা...” মাঝে অয়ন কলেজ লেভেলের ধাক্কা সামলাতে না পেরে বৃষ্টি নামের মেয়ের পেছনে ঘুরেছিল। জীবনে এই একটা সময় মাত্র বৃষ্টি শব্দটাকে শুনতে পারত না নিশাত। অয়ন পারে নি কলেজ লেভেলের ধাক্কা সামলাতে আর নিশাত পারে নি কলেজ লেভেলের আবেগ সামলাতে। ফল স্বরুপ নিশাত আবেগের বশে এক পাতা ঘুমের ওষুধ খেয়ে ফেলেছিল। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, ওষুধের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায় নি তার মধ্যে।

আস্তে আস্তে আগের মতো তাদের ভালোবাসার ট্রাম দূর্ঘটনা এড়িয়ে সুষম গতিতে চলছিল। কিন্তু ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর প্রায় সবকিছু উলটপালট হয়ে গিয়েছিল। নিশাত ভর্তি হয়েছিল ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে আর অয়ন এক বছর বিফল হয়ে দ্বিতীয় বছর ন্যাশনালে ভর্তি হলো। এক বছর পিছিয়ে পড়ার পরও নিশাত তাকে ধরে রেখেছিল। কিন্তু আস্তে আস্তে অয়ন আর সেই অয়ন রইল না।

কিছুটা এডিক্টেড হয়ে গিয়েছিল। পড়ালেখার প্রতি অনীহা আর ভবিষ্যতের প্রতি নির্দয় তাচ্ছিল্য নিশাতকে অনেকটাই শঙ্কিত করে তুলেছিল। নিশাতের যখন মাষ্টার্স শেষ তখন অয়ন অনার্স তৃতীয় বর্ষে। পড়ালেখায় দু বছরের ছোটো অয়নকে তখনও ধরে রেখেছিল নিশাত। কিন্তু আর পারছিল না নিশাত, সে তো ভেবেছিল অয়ন ভালো একটা চাকরি করবে।

অথবা এমন ভাবে পড়ালেখা করবে যেনো নিশাত কে চাওয়ার জন্য নিশাতের বাবার সামনে এসে দাড়াতে পারে। কর্পোরেট চাকুরে পাপনের সাথে যেদিন নিশাতের বিয়ে হয়েছিল সেদিনও তুমুল বৃষ্টি নেমেছিল। প্রজাপতির দুই পক্ষের কান্নার সাথে বৃষ্টিও যেনো তাল মিলিয়েছিল। পাপনের হাতে যখন নিশাতকে তুলে দিয়েছিল নিশাতের বাবা, তখন নিশাত পাপনের হাতের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল... হয়তো বা ভাবছিল কী এমন হতো যদি ভাগ্যের ফেরে অয়নের হাতটাই এখানে থাকত। যখন বরের গাড়িতে উঠার জন্য এগুচ্ছিল নিশাত,তখন মাথার উপর পাপনের ধরে রাখা ছাতাটা সরিয়ে দিয়েছিল... বুক ফেটে আসা কান্নাগুলোকে যে বৃষ্টির সাথে মিশে যেতে হবে তাই... কাদছে নিশাত... সাড়ে তিন বছর হলো অয়নের সাথে দেখা নেই।

শুনেছে কোন এক কোম্পানিতে ছোটোখাটো চাকরি করছে... মাঝে মাঝে নিশাত নিজেকেই দায়ী করে... কী হতো যদি অয়নের সাথে পালিয়ে যেতো, অথবা কী হতো একটিবারের জন্য বাবা-মা’র মন ভেঙ্গে দিলে... কী হতো একটিবারের জন্য স্বার্থপর হলে?? বৃষ্টির দিকে হাত বাড়িয়ে চোখ বন্ধ করে কল্পনা করছে নিশাত...... অয়ন তার পাশে এসে দাড়িয়েছে, অয়ন তার ভেজা হাত দিয়ে নিশাতের হাতটা ধরেছে... আর বলছে “চোখ খোলো নিশাত, এই বৃষ্টি ভেজা পৃথীবিটা আজ তোমার আর আমার... ভীতুর ডিম পাপনটা আসতে এখনো অনেক দেরী!!” ভাবছে নিশাত... এখনো চোখ বন্ধ তার...... কারন চোখ খুললেই যে অয়ন আবার হারিয়ে যাবে...এভাবেই হয়তো ভাবনায় অয়নের ছবি একে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিবে নিশাত। এটাকে নিশাত প্রায়শ্চিত্ত হিসেবেই নিয়েছে... বাবা-মা’র মন ভেঙ্গে দিতে না পারার প্রায়শ্চিত্ত... স্বার্থপর না হতে পারার প্রায়শ্চিত্ত... বৃষ্টি অনেকটাই কমে গেছে... তখনও চোখ বন্ধ নিশাতের... যদি অয়ন হারিয়ে যায়!!! মূহুর্তটা যদি কোনো ছবি হতো, তাহলে নিশ্চিতভাবেই আবহ সঙ্গীত হিসেবে বেজে উঠত, “আমায় প্রশ্ন নীল ধ্রুব তারা, আমি আর কতকাল রব দিশেহারা। জবাব কিছুই তার দিতে পারি নাই শুধু, পথ খুজে কেটে গেলো এ জীবন সারা, এ জীবন সারা। কারা যেনো ভালোবেসে আলো জ্বেলেছিল, সূর্যের আলো তাই নিভে গিয়েছিল। নিজের ছায়ার পিছে ঘুরে ঘুরে মরি মিছে, একদিন চেয়ে দেখি আমি তুমি হারা, আমি তুমি হারা।

আমি পথ খুঁজি নাকো পথ মোরে খোঁজে, মন যা বোঝে না বোঝে,না বোঝে তা বোঝে। আমার চতুরপাশে সব কিছু যায় আসে, আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা। এ জীবন সারা। ”

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.