তোমার অস্তিত্বে সন্দিহান, তবু্ও সদাই তোমায় খুঁজি
বাঙ্গালীর বিজয়ের ইতিহাস খুব অল্প নয়। তবে তার কোনটাই চূড়ান্ত নয়। আমরা কোন বিজয়কেই চূড়ান্ত রূপ দিতে পারিনি। অনেক আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের অর্জনগুলো কোন এক সময় হাহাকারে মিলিয়ে যায়। পলাশীর যুদ্ধে আমরা প্রাথমিক অবস্থায় জয়ী হচ্ছিলাম।
কিন্তু শেষ পরিনতি ছিল পরাজয়। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবে সাময়িক সাফল্য অর্জন করলেও তা স্থায়ী হয়নি। দুশ বছরের পরাধীনতার শৃংখল পেরিয়ে ১৯৪৭ সালে আমরা একটি স্বাধীন দেশের স্বপ্নপূরণের কাছাকাছি ছিলাম। তবে ঠিক এই সময়ে ধর্মীয় শক্তি ধর্মনামের আফিম খাইয়ে আমাদেরকে পাকিস্তান নামের নতুন শৃংখলে আবদ্ধ করে, পুনরায় পরাজিত করে। তারা আমাদের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিল।
আমরা তা প্রতিরোধ করেছি সত্য। কিন্তু, সে ভাষার মূল্য আমরা কতোটা রাখতে পেরেছি? নিজের দেশেইতো এ ভাষা পরবাসীর মতো বাস করছে। তেমনি ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৭০ এর পর্যায়ক্রমিক ধাপগুলো পেরিয়ে ১৯৭১ সালে আমরা যখন একটি সার্বভৌম দেশ পেলাম, বিজয় পেলাম তখনও বিজয়কে চূড়ান্ত রূপ দিতে পারিনি। ৪ বৎসরের মাথায় সেই পুরনো পরাজিত শক্তি আবার স্ব-মহিমায় প্রতিষ্ঠিত হয়।
এ ভাবনাগুলো প্রায়ই আমাকে বিধ্বঃস্ত করে।
আমরা কি কোনদিনও চূড়ান্ত বিজয়ী হতে পারব না?
যখন মনটা খুব বেশি খারাপ হয় তখন মহাভারতের কাহিনীগুলো পড়ে নিজেকে প্রবোধ দেয়ার চেষ্টা করি। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে কর্ণের নিকট পরাস্ত, বিপর্যস্ত যুধিষ্ঠিরকে প্রবোধ দিতে গিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন, আপনি শুধুমাত্র একটা যুদ্ধে পরাজিত হয়েছেন। তবে এটা কোন চূড়ান্ত যুদ্ধ নয়। আপনার হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আপনের ধর্মের পথে আছেন।
চূড়ান্ত যুদ্ধে আপনিই জয়ী হবেন। সে মোতাবেক চূড়ান্ত যুদ্ধে যুধিষ্ঠির অর্থাৎ পান্ডবরাই জয়ী হয়েছিলেন। অর্জুন, কর্ণকে পরাজিত ও হত্যার মাধ্যমে এ যুদ্ধের পরিনতি নির্ধারণ করেছিলেন।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে ইশ্বর পান্ডবদের জয়ী করেছিলেন কারণ তারা ধর্মের পথে ছিল। আমরা কেন বিজয়ী হতে পারছিনা? তবে কি আমরা ধর্মের পথে নেই? যারা মানুষ হত্যা করেছে, যারা নিজের মা-বোন হানাদারদের হাতে তুলে দিয়েছে তারাই কেন বারবার জয়ী হচ্ছে? তবে কি তারাই ধর্মের পক্ষ্যে ছিল? মানুষ হত্যা করা, স্বদেশের সম্পদ অন্যের হাতে তুলে দেয়া, নিজের মা-বোনদের গণিমতের মাল হিসাবে ব্যবহারের ব্যবস্থা করাটাই ধর্মের গন্তব্য? এটাই কি ইশ্বরের চাহিত?
এই ভাবনাগুলো সত্যি সত্যি নিজেকে সংশয়বাদী করে তুলে।
নিজের অবস্থান অথবা যোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তবে আমি কি আমি সত্যের পথে নই?
উপরের কথাগুলো হয়ত অদৃষ্টবাদে বিশ্বাসী একজন নতজানু মানুষের ভাবনা হতে পারে, যে ইশ্বরকে দোষারূপ করে নিজের সমস্ত অযোগ্যতাকে আড়াল করতে চায়। তবে একজন বস্তুবাদী মানুষ হিসেবে উল্লেখিত বিজয়কে চূড়ান্তরূপ দিতে ব্যর্থতার দায়ভার থেকে আমি/আমরা কখনই মুক্তি পেতে পারিনা। আমাদের উদাসীনতা, সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারা কিংবা আমাদের তথাকথিত 'উদারতা' এই ব্যর্থতার প্রধান কারণ।
১৯৭১ সালের বিজয়ের পর আমরা ভাবলাম, পরাজিত শক্তি নিশ্চিহ্ন হয়েছে।
এদের বিচারের বিষয়টাকে ততো গুরুত্বপূর্ণ ভাবলাম না। বেশিরভাগকেই ক্ষমা করে দেয়া হল। যাদেরকে বিচারের জন্য নির্বাচিত করা হল তাদের বিচার নিয়েও গড়িমসি শুরু হল। এরই মাঝে জাতির জনকের হত্যার মাধ্যমে ক্ষমতায় আসলেন সেই পাকিস্তানি ঘরানার এক সামরিক শাসক। পরাজিত শক্তি খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এলেন।
সামরিক শাসকও নিজের অবস্থানকে শক্তিশালী করতে তাদের বরণ করে নিলেন। একজন স্বীকৃত রাজাকার শাহ আজিজুর রহমানকে তিনি প্রধানমন্ত্রী করলেন। আরো কয়েকজনকে মন্ত্রীসভায় স্থান করে দিলেন। পরাজিত শক্তি আমাদের মতো উদাসীন নন। তারা প্রাপ্ত সুযোগকে ঠিকই ব্যবহার করলেন।
স্কুল, কলেজের পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের ইচ্ছাকৃত বিকৃতি ঘটাতে শুরু করলেন। তাদের জাত ভাইদের ক্ষমতার বিভিন্ন স্তরে প্রতিষ্ঠিত করলেন। জাতির জনকের খুনীদের শাস্তির বদলে পদোন্নতি দিলেন, রাষ্ট্রদূত বানালেন। কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে তাদের বিচার হতে নিস্কৃতির চেষ্টা করলেন। মু্ক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সম্বলিত স্থানগুলোকে ভিন্ন রূপ দিয়ে জনগণকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের স্পর্শ থেকে দূরে রাখতে প্রবৃত্ত হলেন।
এরই প্রক্রিয়ায় সেই রেসকোর্স ময়দানে (পরিবর্তিত নাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) যেখানে দেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হয়েছিল এবং যেখানে দখলদার বাহিনী আত্মসমর্পন করেছিল তাকে উদ্যান বানানো হল। সর্বোপরি,যেসব সামরিক অফিসার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং অসাম্প্রদায়িক দেশের স্বপ্ন দেখতেন তাদের বিভিন্ন বিদ্রোহে জড়িত থাকার অভিযোগ একরকম বিনা বিচারে হত্যা করা হল।
তবে বেশিরভাগ সামরিক শাসককে যে পরিনতি ভোগ করতে হয় আমাদের সেই শাসককেও একই পরিনতি ভোগ করতে হয়। তিনি তার বিক্ষুব্ধ জাতভাইদের হাতেই নিহত হলেন। ক্ষমতায় এলেন তারই আরেক জ্ঞাতিভাই।
তিনি পূর্ববর্তী জনের চাইতেও এক ডিগ্রী উপরে। জাতির জনকের হত্যাকারীদের রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করলেন। তার সময়েই একাত্তরের প্রতিক্রিয়াশীল পরাজিত, মৌলবাদী জামায়াতী ইসলামী রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং তার আনুকূল্যে পার্লমেন্টে দশটি আসন লাভ করে রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
পরবর্তী ইতিহাস সবার জানা। জনরোষে স্বৈরাচারের বিদায়ের পর একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
জনগণের আশা ছিল, এই সরকার যুদ্ধপরাধীদের বিচার করবে। এই দাবিতে জনগণ শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে সংগঠিত হয়। কিন্তু শাসকগোষ্ঠী খুনীদের বিচারতো দূরের কথা, বরং যারা তাদের বিচার চেয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলা দায়ের করেন। এই মামলা মাথায় নিয়েই শহীদ জননী পরলোকে গমন করেন। অপরদিকে জল্লাদের সর্দার গোলাম আজম দেশের মানুষকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে জামায়াতের আমির নিযুক্ত হন এবং তার নাগরিকত্ব ফিরত পান।
অনেক ত্যাগ তিতিক্ষার পরে ১৯৯৬ সালে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ্যের শ্লোগানধারী আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। আমাদের আশা ছিল খুনীদের বিচার হবে। কিন্তু বরাবরের মতোই আমরা উদাসীন, উদার। ভাবলাম নির্বাচনে বিপর্যস্থ জামায়াত বোধ হয় আর মাথা তুলে দাড়াতে পারবে না। ভাবনাটা ছিল এ রকম- 'তারা যেহেতু বাংলাদেশের রাজনীতিতে আর ফ্যাক্টর হবে না তাই তাদের বিচারের মাধ্যমে তাদেরকে লাইম লাইটে আনার প্রয়োজন নেই'।
কিন্তু পরাজিত শক্তি ঠিকই ফিরে আসল। বরং আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তি সঞ্চয় করে। তারা প্রতিক্রিয়াশীল সামরিক শক্তির সঙ্গে জোট গঠন করে ক্ষমতায় আসল। শহীদের রক্তস্নাত লাল পতাকা তার গাড়িতে উড়াল।
ক্ষমতার স্বাদ পাওয়ার পরে তারা জানোয়ারের মতো হিংস্র হয়ে ওঠল।
একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে সারাদেশে একসাথে বোমা ফাটাল। একাত্তরের মতোই হুমায়ুন আজাদ, শামসুর রাহমান, হাসান আজিজুল হকের মতো প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের হত্যায় প্রবৃত্ত হল। দেশের বিচারালয়গুলো ধ্বঃস করার জন্য বিচারকার্যে নিযুক্তদের হত্যা করার চেষ্টা চালাল। শুধু তাই নয়, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের হত্যা করে দেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিবুদ্ধির চেতনাধারীদের চিরতরে নির্বাসনে পাঠানোর প্রয়াস নিল। আমরা বরাবরের মতোই অসহায়, কিছুই করার নেই।
১/১১ এর পর বর্তমান সরকার আসার পর আবার দাবী ওঠল এই ঘাতকদের বিচারের। কিন্তু, এই সরকারের কাছে ঘাতকরাই প্রিয় হয়ে ওঠলেন। ক্ষমতার বাইরে থাকা আওয়ামী লীগের নেতা, কর্মীদের নামে মামলা হলেও, জেল জুলুম হলেও, পাঁচ বছর ক্ষমতায় থেকে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়া এই ঘাতকদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ আনা হল না। সরকার প্রধানের সাথে মিটিংরত ঘাতককে দেশের পুলিশ কোথাও খুঁজে পেলনা। গণদাবীর মুখে শুধুমাত্র লোক দেখানোর জন্য দু'দিনের জন্য জেলখানায় নিয়ে জামাই আদরে রাখা হল।
পরবর্তীতে আবার মুক্ত করে দেয়া হল।
আমি সত্যিকার অর্থেই বিশ্বাস করতে চাই, উপরের হাহাকারগুলো বিগত সময়ের কথা। আমি বিশ্বাস করতে চাই বহুদিন আজ সময় এসেছে। ব্যালটের মাধ্যমে এই ঘাতকদের পরাজিত করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সরকারকে ক্ষমতায় আনতে হবে।
ক্ষমতায় আসার পর ঘাতকদের বিচারের তারা যদি আবার গড়িমসি করে তবে তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হবে এবং বিচারের জন্য তাদের বাধ্য করতে হবে।
কিন্তু অতীত ইতিহাসের অভিজ্ঞতার কারণে এই বিপ্লবীভাবটা পরক্ষণেই চুপসে যায়। মনটা সংশয়বাদী হয়ে ওঠে। বারবার পরাজয়ে অভ্যস্ত, বাঙ্গালীর পক্ষ্যে কি সত্যিই চূড়ান্ত জয় সম্ভব? নাকি আগের মতোই আবার ঘাতকের গাড়িতে শোভা পাবে শহীদের রক্তস্নাত লাল পতাকা?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।