আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চিন্তা ও কর্মে বাস্তবতার অনুশীলন



আলোচনার শুরুতে 'বাস্তবতা' অভিধার মর্ম উদ্ঘাটন আবশ্যক বলে মনে করি৷ কারণ, কিছু পরিভাষা রয়েছে যার বিপরীতমুখী অনেক অর্থ বিদ্যমান৷ কিছু মানুষ নিজ স্বার্থ উদ্ধারের জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অর্থ প্রয়োগ করে থাকে৷ যেমন, কোনো ইসলামি লেখক যদি বলে, 'ইসলাম বাস্তবতার ধর্ম' এর দ্বারা তার উদ্দেশ্য, ইসলাম মানুষের স্বভাবের ধর্ম এবং তার প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যশীল একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান৷ পার্থিব জগতের সকল ক্ষেত্রে ও সকল বিষয়ে ভারসাম্য রক্ষা করে মানব জাতিকে ভারসাম্যপূর্ণ ও উত্তম পন্থায় পরিচালনাকারী একমাত্র ধর্ম ইসলাম৷ কারো কারো নিকট বাস্তবতার অনুবর্তনের অর্থ চিন্তা ও আচরণের সমকালীন ধারা মেনে নেয়া এবং তাতেই সন্তুষ্ট থাকা, হোক না তা গ্রহণযোগ্য কিংবা পরিত্যাজ্য৷ অথবা পরস্পরের মাঝে অর্ধার্ধি সমঝোতা বা আদর্শ থেকে পিছু হটার নামই হচ্ছে বাস্তবতা৷ মূলত তারা নিজ দুর্বলতা ও অক্ষমতার বৈধতা দেয়ার জন্যই বাস্তবতার এ সংজ্ঞা পেশ করে৷ তারা অহর্নিশ বলে বেড়ায়, 'আমাদের বাস্তবধর্মী হওয়া একান্ত প্রয়োজন' যার অর্থ তুচ্ছ ও সামান্যে তুষ্ট থাকা৷ বস্তুত এ হচ্ছে ওই সব লোকের বাস্তবতা, যাদের ব্যাপারে কোরআনুল করিমে এরশাদ হয়েছে : "এবং তারা বলল, 'তোমরা গরমের মধ্যে বের হয়ো না'৷" অথবা এটা সে সব লোকের বাস্তবতা, যারা কোরআনের আয়াত- "তোমরা নিজ হাতে নিজদেরকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করো না" - এর মনগড়া ব্যাখ্যা করে৷ বর্তমান সময়ে কিছু ইসলামি দল বা মুসলিম রাষ্ট্র অন্য দল বা রাষ্ট্রের সঙ্গে বাস্তবতার দোহাই দিয়ে যেসব চুক্তিতে আবদ্ধ হচ্ছে এবং যে ধরনের বশ্যতা মেনে নিচ্ছে, তা বাস্তবতার ভুল ব্যাখ্যার ফলেই সম্ভব হয়েছে৷ আমাদের আলোচ্য বিষয় তা নয়৷ আমাদের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে 'চিন্তা প্রসূত কাল্পনিক নকশার সামনে অবনত মস্তক না হওয়া৷ বা এমন কোন পরিকল্পনার জন্য জেদ না ধরা, যা বাস্তবায়ন করা প্রায় অসম্ভব কিংবা খুব কঠিন৷' যদিও তা বাস্তবতার নিরিখে সঠিক বলে বিবেচিত হয়৷ তার কারণ, আমাদের চারপাশের পরিবেশ৷ এ পরিবেশ আমাদের লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য সামান্য সহযোগিতা করবে না৷ আরেকটি কারণ, আমাদের শিক্ষা-দীক্ষা ও উপায়-উপকরণ সীমিত, রয়েছে লোকবলের অভাব৷ তাই আমরা আমাদের উদ্দেশ্য বা উদ্দেশ্যের কাছাকাছি বিষয় বস্তু নিয়েই সন্তুষ্ট থাকি৷ আর শক্তি ও সামর্থ্য অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে আরো পরিপূর্ণ ও উত্তম বস্তুর জন্য আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রাখি৷ যারা দিবাস্বপ্নে মোহগ্রস্ত, যারা ঐতিহাসিক বিরোধগুলো বারবার চর্চা করে, যারা তথাকথিত বাস্তবতা ও আধুনিকতার রক্ষক ও ধ্বজাধারী, আমরা তাদের সামনে নত হব না, মেনে নিব না কখনো তাদের বশ্যতা৷ ইমাম যাহাবী রহ. 'খোলাফায়ে রাশেদিনের গুণাবলি বিশিষ্ট শাসকের প্রসঙ্গ' অধ্যায়ে এ বিষয়ের ওপর একটি সুন্দর কথা উল্লেখ করেছেন৷ তিনি লিখেছেন, "বর্তমান যুগে এমন একজন ইমাম প্রায় অসম্ভব, যিনি সর্ব ক্ষেত্রে ও সব বিষয়ে সঠিক পথে পরিচালিত হবেন৷ আল্লাহ যদি এ জাতির জন্য এমন একজন ইমামের ব্যবস্থা করে দেন, যার মধ্যে অনেক ভালো দিক থাকবে এবং সামান্য খারাপ দিকও থাকবে, সে-ই এ জাতির জন্য যোগ্য ইমাম, তার চেয়ে যোগ্য ইমাম আমাদের জন্য আর কে হবে?!" এ বাক্যের মাধ্যমে তিনি প্রকৃত বাস্তবতা মেনে নেয়ার একটি সুন্দর উদাহরণ পেশ করেছেন৷ তিনি এমন একজন ইমামের প্রত্যাশা করেছেন, যার মধ্যে খারাপও থাকবে, তবে কম৷ তিনি এ কথা বলেননি, 'ইমামকে খোলাফায়ে রাশেদিনের মতই হতে হবে৷' আবার এ কথাও বলেননি যে, 'আমরা এমন ইমাম কামনা করি না, যার মধ্যে খারাপের কোন অংশ থাকবে৷' তিনি ছিলেন সত্যিকারার্থে বাস্তব-দ্রষ্টা, সময়ের চাক্ষুষ সাক্ষী, পরিবেশের ওপর গভীর দৃষ্টি প্রদানকারী ও অতীত ইতিহাস সম্পর্কে বিজ্ঞ ব্যক্তি৷ একটি ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ রহ. খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করে প্রথম খুতবায় বলেছিলেন, "জেনে রাখ! আমি এমন কিছু কাজ সম্পাদন করি, যার ওপর আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ সাহায্য করতে পারে না৷ যা করতে করতে বৃদ্ধরা শেষ হয়ে গেছে, বাচ্চারা বার্ধক্যে পেঁৗছেছে৷ তারা সবাই একে দীন মনে করেছে, অন্য কিছু মনে করেনি৷" একদা ছেলে আব্দুল মালেক তাকে বলল, "হে আমীরুল মোমেনীন! আপনি আল্লাহর কিতাব এবং তার নবির সুন্নত বাস্তবায়ন করুন৷ এ কারণে যদি আপনাকে-আমাকে তেলের কড়াইতে ভাজাও হয় তাতে পরওয়া কীসের?! তিনি উত্তর দিলেন, "উটকে পোষ মানানোর ন্যায় আমি মানুষদের আস্তে আস্তে পোষ মানাতে চেষ্টা চালাচ্ছি৷ সুন্নতের একটি দরজা উন্মুক্ত করলে, লোভেরও একটি দরজা উন্মুক্ত করি৷ ফলে, তারা সুন্নত থেকে পলায়ন করতে চাইলে, লোভের আকর্ষণে ঠাঁই দাঁড়াবে৷ আমি যদি তাদেরকে পঞ্চাশ বছর তরবিয়ত করি, তবুও আমার ধারণা, আমি তাদের দ্বারা যা ইচ্ছে তা বাস্তবায়ন করাতে পরব না৷" ইমাম শাতেবীর 'মোয়াফাকাত' গ্রন্থে কথাটি এভাবে আছে, "আমার আশঙ্কা, আমি যদি মানুষের ওপর হকের দণ্ড এক সাথে রেখে দেই, তবে তারা এক সাথে সব প্রত্যাখ্যান করবে, তখন এ ফিতনার কারণ কে হবে?" খলিফা আব্দুল আজিজ রহ. হিজরির প্রথম শতাব্দীর শেষ দিকে খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন৷ তিনি সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার কঠিন বাস্তবতা চরমভাবে উপলব্ধি করেছেন৷ তাই তিনি 'ধীরে কর' নীতি গ্রহণ করেন৷ বর্তমান যুগের বিজ্ঞজনেরা যেমন বলে থাকেন৷ তিনি এক সময় মানুষের সামনে সুমিষ্ট লোভনীয় বস্তু পেশ করেন, অন্য সময় তিক্ত সত্যকে মেনে নিতে বাধ্য করেন৷ সালাউদ্দিন আইয়ূবী রহ. যখন ফাতেমী সাম্রাজ্য রহিত করার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করেন, তখন তিনি হঠাত্‍ করেই মিশরবাসীদের কাছে এ ঘোষণা দেননি৷ তিনি ছিলেন সে সময় মিশরের মন্ত্রী এবং নুরুদ্দিন মাহমুদের প্রেরিত সৈন্যবাহিনীর সেনা প্রধান৷ তিনিও 'ধীরে চল' নীতি গ্রহণ করেন৷ প্রথমে চার মাজহাবের আদর্শে বিশ্বাসী সুনি্ন মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন৷ হিজরি ৫৬৬ সনে একটি পরিত্যক্ত জেলখানায় শাফেয়ি মাজহাবের মতাদর্শের একটি মাদরাসার ভিত্তি রাখেন৷ এরপর ফাতেমীদের জারিকৃত আজানের মধ্যে অতিরিক্ত বাক্য রহিত করেন৷ অতপর খুতবার মধ্যে খোলাফায়ে রাশেদিনের নাম উল্লেখ করার নির্দেশ জারি করেন৷ এক পর্যায়ে ফাতেমীদের খুতবা বাতিল ঘোষণা করেন৷ এ পরিকল্পনার জন্য তাকে সহযোগিতা করেছে তার মন্ত্রী ও পরামর্শদাতা কাজী ফাজেল৷ সে ছিল মিশরের অধিবাসী এবং সরকারী ও দাফতরিক কাজে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত৷ একদা আলী রা. খলিফা ওমর রা. কে দেখেন, তিনি জাকাত খাতে উশুলকৃত সরকারী উটগুলোর চিকিত্‍সা নিজ হাতে প্রদান করছেন৷ তিনি উটগুলোর চর্মরোগের চিকিত্‍সা দিচ্ছিলেন৷ তাও ছিল গ্রীষ্মের কোন এক উত্তপ্ত দিনে৷ আলী রা. ওমরের শক্তি ও আমানতদারি দেখে আশ্চর্যান্বিত হলেন৷ অতপর তিনি বলেন, "আপনার পরবর্তী খলিফাদের আপনি অক্ষম করে দিয়েছেন!" এটা একটা বাস্তব ঘটনা, যার প্রেক্ষিতে মানুষ বলাবলি করত : অমুক ব্যক্তি কেন ওমরের মত হয়নি? অমুক ব্যক্তি কেন ওমরের মত কর্ম সম্পাদন করে না? অসম্ভব! এমনটি আর কখনো বাস্তবতার মুখ দেখবে না৷ ওমর ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্যপ্রাপ্ত, যার ব্যাপারে রাসূল সা. বলেছেন, "আমি ওমরের ন্যায় এমন বিচক্ষণ ব্যক্তি দেখিনি, যে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে নিখুঁতভাবে পেঁৗছতে পারে৷" তবে এর অর্থ এ নয় যে, আমরা বসে থাকব কিংবা এর চেয়ে উত্তম বস্তুর জন্য চেষ্টা করব না৷ বরং উত্তরোত্তর উন্নতির জন্য সর্বদা চেষ্টা তদবির অব্যাহত রাখাই হবে বাস্তবতার দাবি৷ রাসূলের আদর্শ থেকে হাদিসে এসেছে রাসূল সা. বলেছেন, "আমি যখন তোমাদেরকে কোন জিনিস থেকে বারণ করি, তোমরা তা পরিত্যাগ কর৷ আর আমি যখন তোমাদেরকে কোন জিনিসের ব্যাপারে নির্দেশ দেই, তোমরা তা সাধ্যানুসারে বাস্তবায়ন কর৷" আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেছেন, "দীন সহজ৷ যে কেউ দ্বীনের ব্যাপারে কঠোর নীতি অবলম্বন করবে, দীন তাকে কাবু করে ফেলবে৷ অতএব তোমরা সঠিক পন্থা অবলম্বন কর, তার কাছাকাছি থাক এবং এতেই তোমরা প্রসন্ন থাক ও তৃপ্তি বোধ কর৷ সকাল-সন্ধ্যা ও শেষ রাতে এবাদত করে আরো অগ্রসর হও৷" অর্থাত্‍ ধারাবাহিক সামান্য আমল ও তার প্রতিদানের ওপর সন্তুষ্ট থাক এবং এবাদতের উত্তম সময় ও শরীরের প্রাণবন্তকর মুহূর্তগুলোতে সাধ্যানুসারে এবাদত সম্পাদন কর, যেমন সকাল-সন্ধ্যা ও রাতের শেষ ভাগে৷ ইমাম নববি রহ. এর ব্যাখ্যায় বলেন, "তোমরা উত্তম পন্থাটি অন্বেষণ কর এবং সে অনুসারে এবাদত কর৷ যদি তোমরা এর ওপর আমল করতে অক্ষম হও, তবে উত্তম পন্থার কাছাকাছি থাক৷" ইমাম কাসতাল্লানি রহ. বলেন, "যদি তোমরা উত্তম আমল করতে অপারগ হও, তবে তার কাছাকাছি আমল কর৷" মুসনাদে আহমদে আব্দুল্লাহ ইবনে সাদি থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : "ওমর রা. আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, আমার কাছে তোমার ব্যাপারে একটি সংবাদ পেঁৗছেছে, সংবাদটি কি সত্য? তুমি জনগণের অনেক দায়িত্ব পালন কর, কিন্তু যখন তোমাকে তার পারিশ্রমিক দেয়া হয়, তুমি তা গ্রহণ কর না? আমি বললাম, হঁ্যা৷ তিনি বললেন, এর দ্বারা তোমার উদ্দেশ্য কী? বললাম, আমি বিত্তবান৷ আমার অনেক গোলাম ও ঘোড়া রয়েছে৷ আমি চাই, আমার খেদমতগুলো মুসলমানদের জন্য সাদকা হিসেবে গণ্য হোক৷ ওমর বললেন, এমনটি কর না৷ তুমি যেরূপ কর, আমিও সে-রূপ করতাম৷ রাসূল সা. আমাকে হাদিয়া তোহফা দিতেন, আমি বলতাম, আমার চেয়ে যে বেশি গরিব তাকে দান করুন৷ তখন রাসূল সা. বলেছেন, তুমি এটা গ্রহণ কর৷ এবার তোমার ইচ্ছে, তা বিনিয়োগ করে এর দ্বারা সম্পদ বৃদ্ধি করতে পার, আবার তা সাদকাও করতে পার৷ আল্লাহ তাআলা যে সব সম্পদ তোমাকে দান করেন, তোমার প্রার্থনা কিংবা আগ্রহ ছাড়াই, তা তুমি গ্রহণ কর৷ আর যা থেকে তিনি তোমাকে বিরত রাখেন, তার পিছনে তুমি নিজকে ব্যাপৃত কর না৷" এটা হচ্ছে ইসলামের আদর্শ, যা মানুষের স্বভাবের সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যশীল৷ এটাই হচ্ছে মধ্যম পন্থা, এর মাধ্যমে মানুষের স্বভাবগত প্রয়োজন, আবেদন ও চাহিদার সুরক্ষা হয়৷ অর্থাত্‍ তুমি সম্পদ গ্রহণ কর, অতপর তা বিনিয়োগ কর বা সদকা করে দাও৷ কারণ, মানুষ দুনিয়ার জীবনে সম্পদের মুখাপেক্ষী, যদি সে সম্পদ ত্যাগ করে, এমন পরিস্থিতির শিকার হতে পারে, যেখানে তাকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হতে হবে, যা ইসলামের আদর্শের পরিপন্থী৷ ওলামাদের চিরন্তন বাণী থেকে ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, "যখন উত্তম বস্তু গ্রহণ করা সম্ভব না হয়, তখন তার চেয়ে কম উত্তম বস্তু গ্রহণ করা বৈধ৷ তিনি উদাহরণস্বরূপ কতক শাসকদের ব্যাপারে বলেন, যারা জিহাদ কায়েম করে এবং শরিয়তের বিধি-বিধানও বাস্তবায়ন করে৷ তবে অন্য ক্ষেত্রে কিছুটা স্বেচ্ছাচার করে৷ যেমন তাদের একজন আছে, যাকে কিছু বিষয়ে স্বেচ্ছাচার করতে না দিলে, সে শরিয়তের বিধান বাস্তবায়ন করবে না, জনগনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে না, শত্রুর মোকাবিলায় জিহাদেও প্রস্তুত হবে না৷ তাদেরকেও ভাল কাজের আদেশ দিতে হবে এবং তার জন্য তাদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে, যদিও এ সব বিষয়ে তাদের স্বেচ্ছাচারিতা নিশ্চিত থাকে কিংবা তাদের স্বেচ্ছাচারিতা হয় হারাম ও অবৈধ ক্ষেত্রে৷ যেমন কিছু সম্পদ নিজের জন্য বাছাই করা, মানুষের ওপর অতিরিক্ত প্রভাব খাটানো, গনিমতের মাল নিজ ইচ্ছায় বন্টন করা ইত্যাদি৷ তবে এটা ঠিক যে, এ সব স্বেচ্ছাচারিতার জন্য তাদের কোন অজুহাত গ্রহণযোগ্য হবে না৷ " ইবনুল কাইয়্যিম রহ. বলেন, "এর আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে, বাজার যখন হারাম বা সন্দেহযুক্ত জিনিসে এমনভাবে সয়লাব হয়ে যায় যে, হালাল বস্তু পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে, তখন তুলনামূলক ভাল জিনিস গ্রহণ করা যাবে৷" আরো বলা হয়, কতক খারাপ কতক খারাপের তুলনায় ভাল ও সহনীয়৷ যেমন বড় বেদআতে লিপ্ত ব্যক্তি যদি বড় বেদআত ছেড়ে ছোট বেদআতে লিপ্ত হয়, এটা তার জন্য ভাল৷ মনুষ্য স্বভাব বাস্তবতা বলতে আমরা যা বুঝাই, তা হচ্ছে সঠিক পন্থার কাছাকাছি বা তার কাছের কিছু৷ আমরা প্রতিটি বস্তু পুরোপুরি বাস্তবায়ন করার স্বপ্ন দেখি না যে, সম্পূর্ণ রূপে বাস্তবায়ন না করতে পারলে বসে থাকব, কোন চেষ্টা-তদবির কিছুই করব না৷ যদি আমাদের বোধ এরূপ হয়ে থাকে, তবে জ্ঞান করতে হবে, আমরা বিষয়টি অনুধাবন করতে সক্ষম হয়নি৷ যার ফলশ্রুতিতে আমরা ময়দান থেকে ছিটকে পড়ব, উদ্যম-আগ্রহ হারিয়ে ফেলব এবং উদ্দেশ্যহীন জীবন যাপনে বাধ্য হব৷ অথবা আমরা নিজদের সামর্থ্যবান জ্ঞান করে, বাস্তবতা যদিও তার বিপরীত, এমন অভিযানে নেমে যাব, যেখানে নিজদের ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই হবে না৷ ইসলাম এমন কোন জিনিস উপস্থাপন করেনি, যা মানুষের সাধ্যের বাইরে বা তার সুস্থ ও প্রকৃত স্বভাবের সঙ্গে সাংঘর্ষিক৷ খ্রিস্টীয় ধর্ম এক সময় বলত, "তোমরা নিজ দুশমনদের মহব্বত কর; যারা তোমাদের অভিসম্পাত করে, তাদের তোমরা মোবারকবাদ দাও; যারা তোমাদের সাথে বিদ্বেষ পোষণ করে, তাদের প্রতি তোমরা সদয় হও৷" অথচ এ নীতিই হচ্ছে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির মূল উপাদান৷ এর মাধ্যমে শক্তিশালী অপরাধীদের দুর্বল অত্যাচারিতদের মোকাবিলায় উদ্বুদ্ধ করা হয়৷ এ জন্যই আমরা লক্ষ্য করি যে, যারা নিজদের খ্রিস্টান বলে পরিচয় দেয়, তারাই এ নীতির সব চেয়ে বেশি বিরুদ্ধাচরণ করে৷ মানুষের স্বভাবের সাথে সংগতিপূর্ণ কোন ধর্মেই এ ধরনের নীতি গৃহীত হতে পারে না৷ পবিত্র কোরআনে এরশাদ হচ্ছে : "আল্লাহ কোন ব্যক্তিকে তার সামর্থ্যের বাইরে দায়িত্ব দেন না৷" মূলত কোরআন ইনসাফ, অনুগ্রহ ও স্বার্থের মাঝে যথাযথ সমন্বয় সাধন করেছে৷ এরশাদ হচ্ছে : "আর মন্দের প্রতিফল অনুরূপ মন্দ৷ অতপর যে ক্ষমা করে দেয় এবং আপোশ নিষ্পত্তি করে, তার পুরস্কার আল্লাহর নিকট রয়েছে৷ নিশ্চয় আল্লাহ জালিমদের পছন্দ করেন না৷ তবে অত্যাচারিত হবার পর যারা প্রতিবিধান করে, তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না৷ কেবল তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, যারা মানুষের ওপর জুলুম করে এবং জমিনে অন্যায়ভাবে সীমা লঙ্ঘন করে বেড়ায়৷ তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব৷ আর যে ধৈর্যধারণ করে আর ক্ষমা করে, তা নিশ্চয় দৃঢ় সংকল্পের কাজ৷" আবার যারা 'অহিংসা নীতি' প্রচার করে তারাও কল্যাণকর কোন আদর্শ উপহার দিচ্ছে না৷ এটাও একটা সাধারণ বুলি, যা ধারণা ও অলীক ভিত্তির ওপর নির্ভরশীল৷ হিন্দুস্থানের মহাত্মা গান্ধী এ চিন্তার উদ্ভাবক৷ বিকৃত ইঞ্জিলেও এর উল্লেখ পাওয়া যায়৷ পক্ষান্তরে কোরআন অনিষ্ট ও জুলুমের বিপরীতে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে৷ এরশাদ হচ্ছে : "আর যাদের ওপর অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করা হলে, তারা তার প্রতিবিধান করে৷" ইসলাম যুলম ও নির্যাতনের নিকট আত্মসমর্পণ করার বিপরীতে লড়াইয়ের বিধান দিয়েছে৷ এরশাদ হচ্ছে : "যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হল তাদেরকে, যাদেরকে আক্রমণ করা হচ্ছে৷ কারণ তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়েছে৷ নিশ্চয় আল্লাহ তাদেরকে বিজয় দানে সক্ষম৷" মানুষ নিজ প্রশংসা পছন্দ করে৷ যদি এ প্রশংসার কারণে সে অহংকার বা দম্ভে লিপ্ত না হয়, তবে ইসলাম প্রশংসা করাকে নিষেধ করে না৷ এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে : "আর যারা বলে, 'হে আমাদের রব, আপনি আমাদেরকে এমন স্ত্রী ও সন্তানাদি দান করুন যারা আমাদের চক্ষু শীতল করবে৷ আর আপনি আমাদেরকে মুত্তাকিদের নেতা বানিয়ে দিন৷" আমরা ইবরাহিম আ.-কে দেখি, তিনি বলেছেন : "এবং পরবর্তীদের মধ্যে আমার সুনাম-সুখ্যাতি অব্যাহত রাখুন৷" প্রথম আয়াতের মধ্যে সত্‍ ও নেককার তথা মুত্তাকিদের অনুসরণীয় ইমাম ও নেতা বানিয়ে দেয়ার দোয়া করা হয়েছে৷ মানুষ ভাল কাজ আঞ্জাম দেয়, ফলশ্রুতিতে আমরা তার প্রশংসা করি, যা শুনে সে আনন্দিত হয়৷ এটা রিয়া বা লোক দেখানো আমল গণ্য হবে না৷ এটা মনুষ্য তবিয়ত বা স্বভাব৷ হাদিসে এসেছে, রাসূল সা. সাহাবাদের ভরা মজলিসে একটি মোবারক গাছ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছেন৷ আব্দুল্লাহ ইবনে ওমরের অন্তরে যার সঠিক উত্তর উদয় হয়েছিল৷ কিন্তু তিনি তা ভরা মজলিসে ব্যক্ত করেননি৷ পিতা ওমর এ কথা শুনে বলেন, সে মজলিসে তোমার এর উত্তর দেয়াটা আমার নিকট অনেক অনেক সম্পদ থেকেও পছন্দনীয় ছিল৷ আল্লাহ তাআলার বাণী "তোমরা তার ফল থেকে আহার কর, যখন তা ফল দান করে এবং ফল কাটার দিনেই তার হক দিয়ে দাও৷" এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, তোমরা প্রথমে খাও, অতপর তার হক দান কর৷ মানুষ সামাজিক সংস্থা বা রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত হতে পছন্দ করে৷ এ জন্য ইসলাম বংশ বা গোত্র প্রথা বাতিল ঘোষণা করেনি৷ যেমনটি অনেকের ধারণা৷ হঁ্যা, পক্ষপাত ও স্বজনপ্রীতিকে প্রত্যাখ্যান করেছে৷ কবিলা বা বংশকে একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা দান করেছে৷ এর মাধ্যমে মানুষ একে অপরের সাথে পরিচিত হয়, আত্মীয়তার সম্পর্ক গভীর হয় ও বৃদ্ধি পায়৷ তবে শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হচ্ছে 'তাকওয়া'৷ আল্লাহ তাআলা বলেন, "তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সে-ই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়া সম্পন্ন৷" দাওয়াতের ক্ষেত্রে বাস্তবতা পরিকল্পিত ও সুনিশ্চিত ধাপে ধাপে মুসলমানদের মান ও অবস্থান উন্নত করাই হচ্ছে সব চেয়ে নিরাপদ ও কার্যকরী পদক্ষেপ৷ এ প্রক্রিয়ার ফলে মুসলমান উন্নীত স্তরে মজবুত ও দৃঢ়চেতা থাকবে এবং সামনের অভীষ্ট লক্ষ্যের জন্য আরো উদ্যমী হবে৷ একটি প্রশ্ন: কোন ব্যক্তি সবেমাত্র ইসলামে দীক্ষিত হয়েছে, তার ব্যাপারে এখন আমাদের করণীয় কি? মৌলিক ও খুঁটিনাটি বিষয়সহ এক সাথে সমগ্র ইসলাম তার সামনে পেশ করব? না, প্রথমে তার সামনে ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো উপস্থাপন করব, যাতে প্রাথমিক পর্যায়ে ইসলাম তার অন্তরে বদ্ধমূল হয়ে যায়৷ অতপর আস্তে আস্তে আনুষঙ্গিক ও ইসলামের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ তুলে ধরব? তাকে ইসলামের ওপর প্রতিষ্ঠিত ও মজবুত রাখার জন্য কোনটি সবচেয়ে কার্যকর ও যথোপযুক্ত পদ্ধতি? আরেকটি প্রশ্ন : কোন একটি দেশ বা ভূ-খণ্ড, যা শতাব্দী ধরে কুফর ও মানব রচিত শাসনে পরিচালিত হচ্ছে, অন্ধকারে রয়েছে ইসলামের যৌক্তিক বিধান ও সৌন্দর্যমণ্ডিত আদর্শ থেকে, তা যদি মুসলমানদের অধীনে চলে আসে, প্রতিষ্ঠিত হয় সেখানে মুসলমানদের কর্তৃত্ব, সে ক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কি? প্রথম ধাপে ও একসঙ্গে সবার ওপর সমগ্র ইসলাম চাপিয়ে দেব; না, প্রথমে ইসলামের মৌলিক ও প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো জারি করব, যেমন ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস ও রুকনসমূহ, শরিয়তের আরেকটি মূল লক্ষ্য যথা মানুষের জান, মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ইত্যাদি৷ অতপর ধাপে ধাপে ইলমে দীন শিক্ষা দেয়া ও শিক্ষা করার ব্যবস্থা করব এবং নতুন রাষ্ট্রের রক্ষণা-বেক্ষণ ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার জন্য বিধান রচনা করব? কোনটি যৌক্তিক ও ফলপ্রসূ, প্রথম প্রস্তাব না দ্বিতীয় প্রস্তাব? আরো একটি প্রশ্ন : যদি কোন মুসলমানকে স্বাধীনভাবে ধর্ম পালন ও ধর্ম প্রচারের সুযোগ দেয়া হয়, সে কি এ প্রস্তাব গ্রহণ করবে?-এ অর্থে যে সীমিত পরিসরে হলেও ইসলাম কায়েম করার সুযোগ পেয়েছি; না প্রত্যাখ্যান করবে?-এ বলে যে, সমগ্র ইসলাম যেহেতু কায়েম করা যাচ্ছে না, তাই এ সামান্য সুযোগ গ্রহণের প্রয়োজন নেই৷ কোন প্রস্তাব বিজ্ঞোচিত? অবশ্যই প্রথমটি৷ শায়খ রশিদ রেজা বলেন : "এমন স্বাধীনতা, যেখানে কতক নিষিদ্ধ কাজের বৈধতা রয়েছে, তবে কোন ভাল কাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা নেই, সে দাসত্ব থেকে উত্তম, যেখানে ভাল কাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, আর মন্দ কাজের জন্য রয়েছে পূর্ণ স্বাধীনতা৷ কারণ, দাসত্ব মানুষের অন্তর থেকে মজ্জাগত বু্যত্‍পত্তি বিলুপ্ত করে দেয়, বাধাগ্রস্ত করে তার প্রকৃতিগত বিকাশকে৷ পক্ষান্তরে স্বাধীনতা মানুষের সামর্থ্যের সবটুকু বিকাশের জন্য উন্মুক্ত পরিবেশ উপহার দেয়৷" লক্ষ্য ও লক্ষ্যে পেঁৗছার উপায় যে লক্ষ্যের যে বিধান, তার উপায়েরও সে বিধান৷ লক্ষ্য যতটুকু গুরুত্ব বহন করে, তার উপায়ও ততটুকু গুরুত্ব বহন করে৷ এটাই সর্ব সম্মত বিধি ও নীতিমালা এবং সবার নিকট সমানভাবে গ্রহণীয় বিধান৷ যে উপায়ের মাধ্যমে ওয়াজিব সম্পাদন করা হয়, সে উপায় গ্রহণ করাও ওয়াজিব৷ যে উপায়ের মাধ্যমে অবৈধ কর্ম সংগঠিত হয়, সে উপায় গ্রহণ করাও অবৈধ৷ বৈধ লক্ষ্যের জন্য অবৈধ উপায় গ্রহণ করা যাবে না৷ এটাই হচ্ছে মূলনীতি৷ এ নীতির বাইরে কিছু নেই৷ এমন কোনও বৈধ লক্ষ্য নেই, যার জন্য অবৈধ উপায় সিদ্ধ৷ 'লক্ষ্য যে কোন উপায়কে বৈধতা দেয়' এ বাক্যটি আমাদের সামনে বিরাট জিজ্ঞাসার জন্ম দিয়েছে৷ এটি একটি পরিত্যাজ্য নীতি৷ ইতালিয়ান রাষ্ট্র বিজ্ঞানী 'ম্যাকিয়াভিলী' তার লিখিত 'দি লিডারস' নামক গ্রন্থে এ নীতির প্রতিই আহ্বান জানিয়েছেন৷ রাষ্ট্রকে মজবুত ও পাকাপোক্ত করার নিমিত্তে সব ধরনের উপায় গ্রহণ করা সিদ্ধ ঘোষণা করেছেন৷ যে কারণে মানুষ এ বাণীকে তার স্লোগান হিসেবে গণ্য করে এবং সুবিধাবাদী রাজনৈতিক দর্শনকে ম্যাকিয়াভিলী দর্শন বলে, কেউ কেউ এটাকে পৈশাচিক রাজনৈতিক দর্শন বলেও আখ্যায়িত করেছে৷ ম্যাকিয়াভিলী তার অনুগতদের সেসব শাসকদের থেকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন, যারা সত্যবাদী ও দয়াপরবশ৷ আর যেসব শাসক প্রতারণা ও কঠোর নীতির মাধ্যমে নিজ শাসন ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করেছে, প্রতিপক্ষের ওপর বিজয় লাভ করেছে ও রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলে সক্ষম হয়েছে, তাদের তিনি প্রশংসা করেছেন৷ অতপর তিনি বলেছেন, 'লক্ষ্য সব ধরনের উপায়কে বৈধতা দান করে৷' অনেক ইসলামি কলামিস্টদের সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়েছে, এ নীতির সম্পূর্ণ বিরোধিতা করা ও একে অস্বীকার করা৷ কারণ, ইসলাম তার লক্ষ্য অর্জনের জন্য একমাত্র শালীন ও ভদ্রোচিত উপায়কেই বৈধতা দান করে৷ হ্যা, নীতিগত দিক থেকে এ অবস্থান ঠিক আছে৷ তবে একে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা ও এর কোন অংশে আমল না করার ফলে অনেক বৈধ ও গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ হাত ছাড়া হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে৷ ইসলামি কর্মতত্‍পরতার মধ্যে এক ধরনের স্থবিরতা আসারও রয়েছে সমূহ সম্ভাবনা৷ ম্যাকিয়াভিলী ও তার অনুসারীদের লক্ষ্য হচ্ছে দুনিয়া অর্জন করা ও শাসকের মর্যাদা বৃদ্ধি করা৷ পক্ষান্তরে মুসলমানদের লক্ষ্য হচ্ছে এর বিপরীত, তথা আল্লাহর কালিমা বুলন্দ করা ও তার সন্তুষ্টি অর্জন করা৷ ইসলামি শরিয়তেও জরুরতের ভিত্তিতে কতক অবৈধ উপায়কে বৈধতার বিধান দিয়েছে৷ লক্ষ্য যেহেতু বৈধ, তাই উপায়কেও বৈধতার হুকুম প্রদান করেছে৷ তবে একেবারে নিঃশর্ত ছেড়ে দেয়নি, এর জন্য রয়েছে কিছু বিধান ও নিয়ম৷ বনি নজিরের সঙ্গে মুসলমানদের যুদ্ধের ব্যাপারে সূরায়ে হাশরে আল্লাহ তাআলা বলেন, "তোমরা যেসব নতুন খেজুর গাছ কেটে ফেলছ অথবা সেগুলোকে তাদের মূলের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে দিয়েছ৷ তা তো ছিল আল্লাহর অনুমতিক্রমে এবং যাতে তিনি ফাসেকদের লাঞ্ছিত করতে পারেন৷" অর্থাত্‍ বনি নাজিরের খেজুর বাগান কাটার অনুমতি আল্লাহ দিয়েছেন, যাতে শত্রুপক্ষ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়৷ আর যা অবশিষ্ট থাকবে তা মুসলমানদের অংশেই প্রত্যাবর্তন করবে, যা মূলত আল্লাহর অনুগ্রহ৷ ইবনে আশুর রহ. বলেন, এ আয়াতের ওপর ভিত্তি করে ফিকাহবিদগণ বলেছেন, "শত্রুপক্ষের বাড়িঘর ধ্বংস করা ও তাদের গাছপালার ক্ষতিসাধন করার মধ্যে যদি কোন হিকমত ও ইসলামি স্বার্থ বিদ্যমান থাকে, তবে তা করা যাবে, যদিও ধ্বংসাত্মক কর্মের অর্থ হচ্ছে দুনিয়ার মধ্যে ফাসাদ সৃষ্টি করা, তবুও শত্রুপক্ষের মোনবল ভেঙে দেয়া ও তাদের আতঙ্কিত করার জন্য ইসলামে তার বৈধতা রয়েছে৷ কোনো কোনো সময় মিথ্যা বলাও বৈধ, বরং মিথ্যা বলা ওয়াজিব হয়ে যায়৷ শায়খ ইজ ইবনে আব্দুসসালাম বলেছেন, "যদি এমন হয়, নির্দোষ কোন ব্যক্তি কারো নিকট আত্মগোপন করে আছে, অন্য কোন ব্যক্তি তাকে হত্যা করতে চায়, তবে ওই ব্যক্তির জন্য মিথ্যা বলা ওয়াজিব, কোনভাবেই সে তার সন্ধান দেবে না৷ অথবা কারো নিকট আমানত রয়েছে, কোন দুরাচার ব্যক্তি ওই আমানত নেয়ার জন্য সন্ধান চাইলে, তাকে সন্ধান না দেয়া ওয়াজিব৷ যেহেতু আমানত হেফাজত করাও ওয়াজিব৷ সিরাতের গ্রন্থে আছে, সাহাবি হাজ্জাজ বিন আলাত রাসূল সা. এর নিকট নিজ স্ত্রী ও গোত্রের কাছে এ মর্মে মিথ্যা বলার অনুমতি চেয়েছেন যে, তিনি ইসলামের সাথে শত্রুতা পোষণ করেন, যাতে তিনি মক্কা থেকে মাল-সামান নিয়ে নিরাপদে বের হয়ে যেতে পারেন, রাসূল সা.ও তাকে সে অনুমতি দিয়েছেন৷ ইবনুল কায়্যিম রহ. এ ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, অন্যের ক্ষতি ব্যতীত নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য, নিজের ব্যাপারে বা অন্যের ব্যাপারে মিথ্যা বলা জায়েজ৷ উক্ত সাহাবির মিথ্যার পিছনে একটি স্বার্থ ছিল, যা মিথ্যা বলার মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে৷" কোন ব্যক্তি স্বীয় নিশ্চিত হক যদি ঘুষ ব্যতীত উশুল করতে সক্ষম না হয়, তবে তার জন্য ঘুষ দেয়া বৈধ৷ তদ্রুপ কেউ যদি জুলুমের শিকার হয়, যা ঘুষ ব্যতীত দূর করা সম্ভব নয়, তার পক্ষেও ঘুষ দেয়া বৈধ৷ তবে, যে গ্রহণ করবে, সে সর্বদাই গুনাহ্গার হবে৷ মালেকী ফকিহ ইমাম কুরাফি রহ. বলেছেন, "হারামের উপায় অনেক সময় বৈধ হয়ে যায়, যদি তার পিছনে সুনির্দিষ্ট কোন বৈধ লক্ষ্য থাকে৷ যেমন সম্পদের বিনিময়ে কাফেরদের থেকে মুসলমান বন্দিদের মুক্ত করা, তদ্রুপ সম্পদের বিনিময়ে ডাকাতদের থেকে নিজের জানকে হেফাজত করা ইত্যাদি৷ যে সব ক্ষেত্রে হারাম বা অবৈধ উপায় গ্রহণ করা যাবে, সেখানে নিম্নের শর্তগুলো মেনে চলতে হবে : ১. বৈধ উপায় না থাকা৷ ২. শুধু প্রয়োজন মোতাবেক নিষিদ্ধ উপায় ব্যবহার করা৷ ৩. কারো ওপর জুলুম করার জন্য ব্যবহার না করা৷ ৪. যার জন্য হারাম উপায় ব্যবহার করা হচ্ছে, সেখানে লাভের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণ কম থাকা৷ বড় আশার কথা 'এটা প্রয়োজন, ওটা প্রয়োজন, এমন হওয়া উচিত ছিল, তেমন হওয়া উচিত ছিল৷' এ ধরনের কিছু উক্তি প্রচলিত রয়েছে৷ অথচ যা আমাদের সামনে ও সাধ্যের মধ্যে বিদ্যমান এবং হাতের নাগালে রয়েছে তা বাস্তবায়ন করার কোন পদক্ষেপ নেই, তার মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত একটি স্তরে উন্নীত হওয়ার পরিকল্পনা নেই, যেখান থেকে আরো উন্নত স্তর এবং অধিক ফললাভের জন্য সামনে অগ্রসর হওয়া যাবে৷ তবে এসব উক্তিও সম্পূর্ণ রূপে পরিত্যাজ্য বা অবজ্ঞার জিনিস নয়৷ হঁ্যা, মানুষের বাস্তব জীবন যাত্রার প্রতি দৃষ্টি না দিয়ে সর্ব ক্ষেত্রে এসব উক্তি করা প্রলাপ বৈ কিছু নয়৷ মানুষের ভেতর এক শ্রেণি আছে দুর্বল, আরেক শ্রেণি আছে কল্যাণের ব্যাপারে প্রচুর আগ্রহী, আরেক শ্রেণি আছে যারা অপরাধ করে আবার অনুশোচনাও করে, তওবা করে৷ অতএব সবাইকে এক স্তরে উন্নীত হতে বলা যায় না, সবার পক্ষে তা সম্ভবও নয়৷ বর্তমান সমাজের কতক ইসলামপন্থী এ বাস্তবতা পরিহার করে খুব লম্ফঝম্প আরম্ভ করে দিয়েছে৷ অথচ তারা ইসলামি সমাজের রূপরেখা এবং বর্তমান সমাজের স্বভাব ও প্রকৃতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ, তার সাথে চলার অভিজ্ঞতা শূন্য৷ এমনকি সেসব কারণের ব্যাপারেও অজ্ঞ, যার কারণে সমাজের বর্তমান দুরাবস্থা৷ অথচ ব্যক্তি ও সমাজ পরিবর্তনের নীতি ও বিধান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া আবশ্যক৷ তারা এ বাস্তবতা থেকে সরে গিয়ে শূন্যে ঝাঁপ দিয়েছে৷ সেখান থেকেই তারা এমন লক্ষ্যের জন্য পরিকল্পনা করছে, যার সামনে রয়েছে পাহাড় সম বাধা; কিংবা তার জন্য এমন সংঘর্ষের মুখোমুখি হচ্ছে, যা ছিল ধারণারও বাইরে৷ কারণ, ইতোপূর্বে তারা কাল্পনিক জগত্‍ বা কেতাবি দুনিয়াতে বাস করেছে, যুগের চাহিদা অনুধাবন করেনি, গভীর দৃষ্টি দেয়নি দেশ, জাতি ও স্থান-কাল-পাত্রের ওপর৷ যার ফলে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছে৷ এ বক্তব্যের মাধ্যমে তাদের হতোদ্যম বা তাদের চেতনাকে স্তিমিত করা উদ্দেশ্য নয়, বরং উদ্দেশ্য হচ্ছে বাস্তবতাকে জানার জন্য আহ্বান করা এবং রাসূলের বাণী "তোমরা সঠিক পন্থা অবলম্বন কর এবং তার কাছাকাছি থাক৷" এর প্রতি দাওয়াত দেয়া৷ বাস্তবতা ও আমাদের বড় বড় আশার সাথে সমন্বয় করা৷ সবাইকে সালাম৷ সমাপ্ত

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।