আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অদৃশ্য জঙ্গল...

সঞ্জয় মিঠু

ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে আমাদের চারপাশের দৃশ্যমান গাছপালার প্রাকৃতিক জঙ্গল। আর বেড়ে উঠছে প্লাষ্টিক, ষ্টীল কংক্রিটের জঙ্গল। এসব দৃশ্যমান কৃত্রিম জঙ্গলের আড়ালে বেড়ে উঠছে এক ভয়াবহ অদৃশ্য জঙ্গল। যে জঙ্গল সম্পর্কে আমরা অনেকে অবগত নই। প্রাকৃতিক গাছপালার জঙ্গল; পরিবেশ সহায়ক, প্রাণিকুলের জন্য অতি আবশ্যক।

সৌন্দর্য ও বৈচিত্রে ভরা। সর্বপরি পৃথিবীর অস্তিত্বতের জন্য অপরিহার্য উপাদান। ষ্টীল কংক্রীটের কাঠামো মানবকুলের জন্য অপরিহার্য নয়। এর আধিক্য পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে। জীবনযাপন ঝুকিপূর্ণ করে তোলে, পরিবেশের বৈচিত্র্য নষ্ট করে, অন্যান্য প্রাণিকুলের আবাসস্থল সংকীর্ণ করে, বিরূপ পরিবেশের সৃষ্টি করে।

আর এসবকে অতিক্রম করে, আমাদের দৃষ্টির বাইরে যে অদৃশ্য জঙ্গল বেড়ে উঠছে তা আরও ভয়াবহ, আরও আতঙ্কের। মানব সভ্যতার নাম করে যে কৃত্রিম পরিবেশ আমরা দিনকে দিন তৈরি করছি তারই পরো (by product) প্রভাবে গজিয়ে উঠছে এ অদৃশ্য জঙ্গল। এই জঙ্গল শহরে অধিক। ছোট শহর থেকে বড় আধুনিক শহরে অত্যাধিক। এই জঙ্গলের অবস্থান শহর বন্দরের সবর্ত্র।

অফিস, আদালত, হোটেল, রেস্তোঁরা, পার্ক, ঘর, বসারঘর, শোবারঘর, রান্নাঘর, ফ্রীজ এমনকি আপনার টুট ব্রাশে- কোথায় নেই ? প্রাকৃতিক জঙ্গলে গাছপালার সঙ্গে রয়েছে বিভিন্ন জীবজন্তু, তেমনি এ অদৃশ্য জঙ্গলে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের পদার্থের সাথে জীবন্ত বস্তু(living creature)। এতক্ষণে আপনারা হয়তো বুঝতে পেরেছেন কোন অদৃশ্য জঙ্গল আমাদের চারপাশে বেড়ে উঠছে। সূক্ষো ধুলাবালি, কৃত্রিম রাসায়নিক পদার্থ, কার্বন কণা, প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম ফাইবার, জানা-অজানা জীবানু, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ফাংগাস, ডাষ্টমাইট প্রভৃতি এ অদৃশ্য জঙ্গলের সক্রিয় সদস্য। এছাড়া বিভিন্ন তিকর গ্যাসীয় উপাদান। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণায় ১গ্রাম ভরের এ জঙ্গলে প্রায় ৬ বিলিয়ন বিভিন্ন বীজানু, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে; এছাড়া ডাষ্টমাইট, বিভিন্ন ধরনের কৃত্রিম তন্তু, ক্ষতিকর রাসায়নিক কণা, ধুলা ও অন্যান্য দ্রব্যাদি।

১গ্রাম সংগ্রহ করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের এক আবাসিক এলাকা থেকে। ভিজে স্যাঁত স্যাঁতে জায়গা, অর্দ্রতাপূর্ণ আবহাওয়ার অঞ্চল, শিল্প-কারখানার অস্বাভাবিক ঘনত্ব পূর্ণ এলাকা, অপরিকল্পিত নগর, অতিরিক্ত মটর চালিত যানবাহনপূর্ণ এলাকা, অস্বাভাবিক ঘনবসতি অঞ্চল, অপরিছন্ন পরিবেশ এ জঙ্গল বেড়ে উঠার আদর্শ জায়গা। গবেষণায় বিভিন্ন এলাকা ও বাসা থেকে সংগ্রহ করা এ সব জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসছে চমকপ্রদ সব তথ্য। প্রতিটি বাড়ির প্রত্যেক কক্ষে রয়েছে এসব জঙ্গল। বসারঘর, শোবারঘর, বাথরুম, রান্নাঘর, ফ্রিজ এমনকি আমাদের নিজেদের শরীরে ও।

শরীরের বহিবারণ অর্থ্যাৎ ত্বকের উপর এসব জঙ্গল বিদ্যমান। আমাদের শরীরে অভ্যন্তরে বিভিন্ন ধরনের উপকারি ব্যাকটেরিয়ার কথা আমরা কমবেশি জানি। তেমনি শরীরের বাইরের ত্বকে রয়েছে এসব জীবন্ত জঙ্গল। বাইরের ত্বকে রয়েছে মৃতত্বক এবং ঘাম থেকে নিঃসৃত প্রোটিন যা এ জঙ্গলের অধিবাসির উৎকৃষ্ট খাদ্য এবং সমস্ত শরীরে আবারণ এদের বিচরণক্ষেত্র। গবেষণায় দেখা গেছে, আমরা শোবার জন্য যে বালিশ ব্যবহার করি তার ৪৫% ডাষ্ট-ডাষ্টমাইটে পরিপূর্ণ এবং ডাষ্টমাইটের বিশাল বিশাল কলোনি।

বিছানার চাদর, খাট, গদি একেকটা ধুলোর রাজ্য। এ অদৃশ্য ভয়াবহ জঙ্গলের শিকার হচ্ছি আমরা সকলে প্রতিনিয়ত। কিন্তু আগামী প্রজম্মের উপর এর প্রভাব সুদূর প্রসারি। সকল শ্রেণীর নবজাতক এবং শিশু এর শিকারে অধিক পরিমাণে তিগ্রস্থ হচ্ছে। তাদের শারীরিক গঠন, মেধা ও মননের বিকাশ হচ্ছে সংকুচিত।

এখন প্রায়ই দেখতে পাওয়া যায় অস্বাভাবিক নবজাতকের জম্ম, মনোপ্রতিবন্দ্বী শিশু। আমাদের সমাজ, সভ্যতা এগিয়ে যাচ্ছে অবিকাশমান এক প্রজম্মের হাত ধরে। প্রতিদিন আমরা নিঃপ্রশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে এ জঙ্গলের একটা অংশ শরীরে মধ্যে প্রবেশ করাচ্ছি। আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশে অপরিশোধিত রাসায়নিক দ্রব্যের জঙ্গল আরও বেশী। প্রশ্বাসের সঙ্গে শরীরে যদি ধাতব সীসা প্রবেশ করে; তবে রক্তে সেই সীসার অস্তি¡ত প্রায় ২২বছর থাকে।

আমরা সকলেই এর মধ্যেই জেনেছি যে সীসা আমাদের জন্য কতটা ভয়ঙ্কর। এ সীসা বংশ পরম্পরায় বাহিত হয়। বদলে দেয় জেনেটিক গঠন, নষ্টকরে রক্তের বিশুদ্ধতা। অন্য এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, বিশ্বের সবথেকে বায়ু দূষিত নগরী মেক্সিকো সিটি থেকে ঢাকার বাতাসে সীসার পরিমান বহুগুন বেশী। ঢাকা শহরে রাস্তায় এখন অনেকেই মাস্ক পরে চলাচল করেন।

কিন্তু কর্মস্থল বা বাসায় ফিরে মাস্ক খুলে ফেলেন। কর্মস্থল বা বাসা ঢাকাতে হলে আপনি আবার সেই দূষিত বায়ু গ্রহণ করছেন। অর্থ্যাৎ ফলাফল প্রায় একই। প্রতিদিন আমাদের ঘরদোর পরিস্কার করা হয়। ঝাড়ু দেওয়ার সময় ধুলোময়লার বড় বড় অংশগুলো বেরিয়ে যায়।

কিন্তু রয়ে যায় তার থেকে হাজার গুণ ছোট সূক্ষো ধুলার কণা, ফাইবার। যে গুলো খালি চোখে দেখা যায় না। কল-কারখানা, যানবাহন, মটরগাড়ীর নির্গত ধোয়া থেকে সূক্ষো ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ বায়ু বাহিত হয়ে উপস্থিত সেই এলাকার সর্বত্র। অতি সূক্ষো কণাগুলো বায়ু মণ্ডলে অবস্থান করে। আর অপোকৃত ভারীগুলো নেমে আসে ভূ-পৃষ্ঠে, বাসা-বাড়ি, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, গবেষণাগার, মাঠ-ময়দান সর্বত্র।

বায়ুমণ্ডলের সূক্ষো কণাগুলো কুয়াশা এবং বৃষ্টির জলের সাথে মিশে জটিল রাসায়নিক পদার্থ হয়ে নেমে আসে মাটিতে। এজন্য আমরা প্রায়ই শুনতে পাই শিল্প প্রধান এলাকায় এসিড বৃষ্টির কথা। বাতাসের কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস বৃষ্টির জলের সাথে মিশে তৈরি হয় কার্বনিক এসিড, সালফার-ডাই-অক্সাইড>সালফিউরিক এসিড,নাইট্রোজেন অক্সাইড>নাইট্রিক এসিড হয়ে মাটিতে প্রবেশ করে। এছাড়া অন্যান্য বিষাক্ত জটিল পদার্থ তৈরি হয়। যা পরবর্তীতে নদী -নালা, খাল-বিলে বাহিত হয়ে ধ্বংস করছে আমাদের ইকো সিস্টেমস্ ।

বদলে ফেলছে আমাদের পরিবেশ, প্রতিবেশ পারিপার্শ্বিকতাকে। আর এক গবেষণায দেখা গেছে শিল্প প্রধান অঞ্চল এবং বড় বড় শহর এলাকায় মানুষের চর্মরোগের প্রকোপ দ্রুত বাড়ছে। দ্রুত পড়ে যাচ্ছে শরীরে চুল, লোম; পেকে যাচ্ছে চুল এবং মানুষের আয়ু সীমা কমে যাচ্ছে, এসব অদৃশ্য জঙ্গলের প্রত্য প্রভাবে। যা সত্যিই ভয়ংকর। খাবার সংরণের জন্য আমরা বিভিন্ন ধরনের কৌটা, হাড়ি-পাতিল ব্যবহার করি।

দেশে বিদেশে বহুল ব্যবহূত হয় রেফ্রিজারেটর। কিন্তু দেখা গেছে এ গুলো ও মুক্ত নয় এ জঙ্গলের কালো থাবা থেকে। একটি ব্যবহূত ফ্রিজের বিভিন্ন অংশ পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এসব ফ্রিজে বিভিন্ন ধরনের এস্টার, ফাংগাস, মস জম্মায় যা খাবারকে বিষাক্ত করে তোলে। আমাদের দাঁত পরিস্কারের জন্য যে ব্রাশ ব্যবহার করি, সে ব্রাশেও পাওয়া গেছে এস্টার, ফাংগাস। কমোডের ফ্যাশ বাটনে সবথেকে বেশি জীবানুর বসবাস।

আমাদের জলের কল, গ্লাস-জগ, চায়ের কাপ-প্লেট, ভাতের হাড়ি, চামচ, হাতের তালু, নখ কোথায় নেই এ অদৃশ্য জঙ্গল? তাই নিয়মিত পরিস্কার রাখতে হবে এসব ব্যবহারিক জিনিসপত্র। ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে অনিয়ন্ত্রিত শিল্পকারখানা, নগরায়নের বিরুদ্ধে। মটরযান, রাসায়নিক পদার্থের অবাধ ব্যবহার রোধ করতে হবে। আমাদের সকলকে সজাগ হতে হবে নিজ নিজ অবস্থান থেকে। আসুন বিস্তার রোধ করি এ অদৃশ্য জঙ্গলের।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।