আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আয়নাতে নিজের মুখটা...



কবে কোথায় যেন তুমি শুনেছিলে এরকম আয়নাও আছে যেটার সামনে দাঁড়ালে এমনকি নিজের মুখটাও দেখতে পাওয়া যায় না। পাশে-থাকা লোকটিকেও অবিকল দেখা যায় তার ভিতরে। কেবল তোমাকেই দেখা যায় না। তুমি শুনেছিলে, কিন্তু সেরকম একটা আয়না তোমার নেই। এমনকি তুমি তা দেখনি কখনো।

কখনো দেখবে সেই আকাঙ্ক্ষাও স্বতন্ত্র লিপিবদ্ধ হয়নি কোথাও। কখনো একান্ত কোনো লিপ্সার গহ্বরে বসে তুমি যে পত্রগুলো লিখেছিলে, হয়তো প্রেমপত্রই বলে, সেখানেও জাদুকরী সেই একটা আয়নার আব্দার কখনোই তুমি করনি। কারো কাছেই। করনি; হয়তো নিজেকে আয়নায় না-দেখতে তোমার ভাল লাগবে না এই ভেবে। কিংবা আরও সরল কারণ হয়তো।

হয়তো একারণে যে নিজেকে দেখতে পাওয়া যায় এমন সকল আয়নাই তোমার পছন্দ ছিল। তারপরও এখন তুমি তোমার নিজেকে দেখছ না। আয়নায় তোমার নিজের মুখটা দেখতে হলে আরও খানিকটা এগিয়ে এসে আয়নার সম্মুখটাতে দাঁড়াতে হবে। তা তুমি করছ না। আরও খানিকটা এগিয়ে এলে আসলে আমারও আরো খানিক কাছে-আসা হয় তোমার।

তাও তুমি এগিয়ে আসছ না। তুমি তোমাকেও দেখছ না আয়নাতে। ...তুমি দেখছ আমাকে। আয়নার এ এক খেলা যে তুমি তোমাকে নয়, দেখতে পার কেবল আমাকেই। সত্যি কথা বললে আমিও দেখতে পাই তোমাকে।

বাইরে একটা জ্যান্ত আমাকে রেখেও আয়নাতে আমাকে দেখতে-থাকা উত্তেজনাকর এক অনুশীলন। তুমি দেখতে দেখতে টের পেতে থাকো। এক প্রগাঢ় উত্তেজনা। তখন আমরা আয়নাটাকে উছিলা করে তীব্র কাঙ্ক্ষার সেতুবন্ধ গড়ি। সেতুটা নিয়মমাফিক সরলপথে চলে না, বরং কৌণিক হতে বাধ্য হয়ে পড়ে।

আয়নাটা নিছক নিমিত্ত হয়েও উদ্ভাসিত হয়ে বিরাজমান থাকে। ঝুলন্ত, কিন্তু ভয়ানক নিশ্চিত। ফলে আমরা--যদিও তুমি আবিষ্কারক, প্রস্তাবক কিংবা রূপকার--কাঙ্ক্ষার অনুশীলন করে চলি। কাঙ্ক্ষায় লিপ্ত হই। লিপ্সার কাঙ্ক্ষা করি।

আমরা অপাঙ্গ হানি, ভ্রুকূটি করি। উন্মূল হই, আবার লিপ্ত হই, প্রোথিত হই। টৈটম্বুর স্নাত হই। আবারও উন্মূল ও চূর্ণ হই। আয়না আমাদের কৌণিক সেতু হলেও স্বাধীন ও সার্বভৌম থাকে।

আমরা... উন্মূল হই। লিপ্ত হই। প্রোথিত হই। স্নাত হই। চূর্ণ হই।

কামনাভারে আমাদের শরীর ও আত্মা, কিংবা হয়তো মস্তিষ্কের কোষরাজি, টনটন করতে থাকে। আয়নাতে পরস্পর দ্রবীভূত হয়ে গেলে, তোমার মনে পড়ে বাইরে একটা জীবন্ত আমি আছি, কিংবা ছিলাম। তোমার মনে পড়ে আয়নারা প্রচ্ছায়া আর প্রতিবিম্বের রাজ্য। তোমার এই জ্ঞানও পর্যালোচিত হয় যে প্রচ্ছায়ারা কখনোই বস্তুরাজি নয়। এই স্মৃতিও তোমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে যে এইসব আয়নাবাজি-কাঙ্ক্ষার ক্রীড়া শুরু হয়েছিল কোনো এক আদিকালে।

আর তুমি এর আবিষ্কারক। তোমার নিমন্ত্রণ হেতু আমি এই আয়নারাজ্যে। দ্রবীভূত যদিও, আমি আহ্বান করিনি। কিংবা করেছিলাম কিনা সেই স্মৃতি কোনোখানে নাই। ফলে তুমি আয়নার দ্রবণ থেকে চকিত চোখ সরালে।

তুমি, আমি যেখানটাতে জীবন্ত স্থাপিত ছিলাম, সেখানটাতে তাকালে। তোমার কামনা-ভ্রুকূটি অপসৃত। কিন্তু আমাকে আর দেখতে পেলে না। যে বাসটা ঠিক তার আগের মুহূর্তেই সৌর-প্রদক্ষিণে বেরিয়েছে, আমি তাতে অনিচ্ছুক সওয়ার হয়ে গেছি। কিংবা হয়তো ইচ্ছুক সওয়ার।

এমনও হতে পারে যে ইচ্ছুক বা অনিচ্ছুক কিছুই না। আমি ইচ্ছা এবং অনিচ্ছা-নিরপেক্ষ সওয়ার। কিন্তু বাসটা ততক্ষণে সৌর-প্রদক্ষিণে বেরিয়েছে। আর আমার দিকে তাকানোর, মানে আমি যেখানটাতে স্থাপিত কিংবা অধিষ্ঠিত ছিলাম, সেইখানটাতে আমায় দেখবে বলে তোমার তাকানোর ঠিক সেই মুহূর্তেই বাসটা পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ডিঙিয়ে গেল। এ কথাটাও তোমার নিছক শোনা-কথাই যে মাধ্যাকর্ষণের বাইরে গেলে এমনকি তার প্রচ্ছায়া আর প্রতিবিম্বও থাকে না।

হয়তো তাই। হতেও তো পারে যে আলোকরশ্মিরও ওজন আছে। শুধু মানুষ সেটা জানে না। ফলে, তুমি আবারও আয়নায় তাকালে। এদফা সন্ত্রস্ত, আর পারলৌকিক উৎকণ্ঠা সমেত।

তাকালে, আবার তাকানোর আগে এক মহাকাল অপেক্ষা করলে। তাকালে, অন্তত এই ভরসাতেও যে আয়নাতে আমার মুখটা দেখা যাবে। আর আমি তখন সপ্তম আকাশের ঠিক সামনের দরজায়। সপ্তম আকাশে কি প্রতিবিম্বলুপ্ত সেই আয়না পাওয়া যাবে? য়্যাডাব গেইস্ট হাউজ, লালমাটিয়া; মোহাম্মদপুর॥ ২৭শে নভেম্বর ২০০৮ সারারাত্রি; ৩০শে নভেম্বর ২০০৮

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।