http://joyodrath.blogspot.com/
"দুইরকম তারুণ্য" নামে একটা লেখায় আমি এভাবে লিখেছিলাম:
তারুণ্যের রাজনীতি শুধু সংজ্ঞাতেই নয়, পরিবেশনায়ও।
এই পরিবেশনাটুকু কারা করে? প্রতিষ্ঠান করে, আবার প্রতিষ্ঠানবিরোধীরাও করে। অদ্ভূত এক দশা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানবিরোধী শিল্পসাহিত্যচর্চার। একদা তারা পথ দেখিয়েছিল মুক্তকচ্ছ তারুণ্যকে, কিন্তু আজ দালির ঘড়ির মত তাদেরও সময় যেন গলে গেছে, আবহমানের পিঠে উঠে ফ্রিজ হয়ে গেছে! অতীতবিহারী তারা, নিজেদের স্যানাটরিয়ামকে তারুণ্যের সূতিকাগার ভেবে ভেবে সেই কবেকার জীবন একবিংশ শতাব্দীতে বয়ে বেড়াচ্ছে! আদতে তারাও প্রতিষ্ঠান। বিরোধিতার প্রতিষ্ঠান।
এই অংশটি উদ্ধৃত করে ব্লগার মাঠশালা লিখেছেন:
আপনার এই লেখাটি পত্রিকায় পড়েছিলাম। আজ এখানে ঘুরতে ঘুরতে পেয়ে যাওয়ায় সুবিধা হলো। আপনার লেখার যে অংশটা আমি উদ্ধৃত করলাম তা ঠিক ক্লিয়ার না আমার কাছে। কারন প্রতিষ্ঠান বিরোধীতা সম্পর্কে এরকম মতামত একদা এই বিরোধীতায় ঘোষনা দিয়ে সামীল ছিলেন বর্তমানে নেই এরকম অনেকের বক্তব্য ও লেখায় নানন ভাবে পেয়ে আসছি। আপনার কাছে জীজ্ঞাস্য যে, যদি ব্যাক্তি বা ব্যাক্তিগনের কাছে বিরোধীতার একটা পর্যায় পর্যন্ত অবস্থান করে পরে তাতে আর অবস্থান করা সম্ভব না হয় তবে যে যে ইস্যুতে বিরোধীতা তা খারিজ হয় কিনা?
আবার আপনি এ লেখায় বলছেন "অতীতবিহারী তারা, নিজেদের স্যানাটরিয়ামকে তারুণ্যের সূতিকাগার ভেবে ভেবে সেই কবেকার জীবন একবিংশ শতাব্দীতে বয়ে বেড়াচ্ছে!"
অনেক কিছুইতো পুরানা সুমন ভাই, তা সবই কি ছেড়ে আসতে হবে?
মাঠশালার এই প্রশ্নগুলোকে সামনে রেখে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা বিষয়ে স্বতন্ত্র একটা আলাপ দাঁড় করানো জরুরি।
প্রশ্ন করা দরকার, প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা কি জিনিস?
মাঠশালা একটু খেয়াল করলে দেখবেন আমি সমালোচনাটি করেছি প্রতিষ্ঠানবিরোধীদের নিয়ে, প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা নিয়ে নয়। এখানে আমার বলবার বিষয় হল, প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা জিনিসটা বাংলাদেশে গুটিকয় "প্রতিষ্ঠানবিরোধী"র মনোপলিতে পরিণত হওয়ার কারণে গত দুদশকে এর মর্ম পাল্টে গেছে। আমরা এসব ব্যক্তিবর্গের কার্যক্রমকেই আনক্রিটিক্যালি প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা হিসেবে মেনে নিয়েছি। আদতে ঐ সব প্রতিষ্ঠানবিরোধীরা কি করেছেন?
"গান্ডীব" নামক প্রতিষ্ঠানবিরোধী লিটলম্যাগের দৃষ্টান্ত দেয়া যাক। এই লিটলম্যাগটি মধ্য আশি থেকে অদ্যাবধি চলমান আছে এবং সাহিত্য অঙ্গনে এই কাগজটিকে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার ম্যানিফেস্টেশন হিসেবে অনেকেই মান্য করে থাকেন।
প্রথমে স্বীকার করে নেয়া উচিৎ হবে যে, মধ্য আশি থেকে বাংলা কবিতার বাঁক বদলের যে যাত্রা সূচিত হয়েছিল, গান্ডীব ছিল তার উজ্জ্বলতম সারথী। নতুন কবিতার ইশতেহার লিখেছিল তারা, "কৃত্তিবাস" ছাড়া বাংলাভাষায় আর কেউ এই কাজটি করেছে কিনা জানি না। তপন বড়ুয়া সম্পাদিত এই পত্রিকার অর্জুনগোষ্ঠীর অন্যতম ছিলেন সাজ্জাদ শরিফ, শোয়েব শাদাব এবং শান্তনু চৌধুরী। পরবর্তীতে সাজ্জাদ শরিফ গান্ডীব ছেড়ে যান, শোয়েব শাদাব মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। ভগ্ন গান্ডীব নতুন সদস্য জোগাড় করার মাধ্যমে শরসন্ধান করার চেষ্টা করতে থাকে।
এ পর্যায়ে কাজল শাহনেওয়াজ, বিষ্ণু বিশ্বাস এবং আহমেদ নকীব গান্ডীবে বিভিন্ন পর্যায়ে যোগদান করেন। এদের মধ্যে কেবল আহমেদ নকীব অনেক দিন টিকে ছিলেন। মজনু শাহর কথা শুনেছিলাম, গান্ডীব তাকে লিখতে ডেকেছিল। পরবর্তীতে গান্ডীব-এ তিনি লেখেন নাই। মজনু আমার বন্ধু, তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তার এই গান্ডীবরহিত হওয়ার কারণ কি।
তো, যে কারণটি জানা গেল সেটি বড় বিচিত্র। মজনু শাহ অমায়িক মানুষ, নানান সার্কেলে তার বিচরণ। সেই সুবাদে তিনি যেমন গান্ডীবগোষ্ঠীর সাথে মেশেন, আবার একই সময়ে "প্রতিষ্ঠানের কবি" মাসুদ খানের সাথেও আড্ডা দেন। শোনা যায়, এই "অবাধ" বিচরণ পছন্দ হয় নি গান্ডীব-এর কর্তাব্যক্তিদের। কনফাইন করতে চেয়েছিলেন তারা মজনুকে, আর মজনুর সেটা পছন্দ হয় নি বলেই তিনি গান্ডীবে শেষমেষ যান নি।
লম্বা কাহিনী অনেক সংক্ষেপে বললাম। মোদ্দাকথা হল, সাহিত্যে যারা প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা করতে গিয়ে লিটলম্যাগ আন্দোলন করেন, কমবেশি এই চেহারাটাই তাদের। অমুক পত্রিকার লেখক অমুক পত্রিকাতেই লিখবে, অমুক আর অমুকের সাথেই মিশবে, এর বাইরে সে যেতে পারবে না। তাইলে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা হবে না! দৈনিকে লেখে এমন কোনো লোকের জানাজাতেও যাওয়া হয়ত বারণ তাদের, অনুমান করি।
আশির দশকের শেষ দিকে আমি "দামোদর", "পূর্ণদৈর্ঘ", "ফৃ" ইত্যাদি কাগজের সাথে যুক্ত ছিলাম।
এসব কাগজেই আমার লেখালেখির সূত্রপাত। অপরাপর "প্রতিষ্ঠানবিরোধী" লিটলম্যাগের মত মিলিট্যান্ট বৈশিষ্ট্য ছিল না এসব কাগজের। দৈনিকের লেখকদের সাথে আমাদের কোনো শত্রুতা ছিল না, এমন কি এসব কাগজের অনেক লেখকই একই সাথে দৈনিক সাপ্তাহিকে লিখেছেন। সেই অর্থে, প্রথাগত লিটলম্যাগ ছিল না ওগুলো। আমরা নতুন নন্দনতত্ত্ব খোঁজার দিকে মনোনিবেশ করেছিলাম, নতুন শত্রুতা উদঘাটনের দিকে নয়।
ফলে, আমার লিটলম্যাগে লেখার ইতিহাস কোনো আদর্শিক ইতিহাস নয়। প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার নামে বাজারে যে জিনিস চালু ছিল (এখনো আছে অনুমান করি) আমি সেই স্টাইলের গ্রাহক হই নি। আমি প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা বলতে প্রতিষ্ঠানের সাথে আপামর সম্পর্কহীনতাকে বুঝি না। অর্জুন আপ্পাদুরাই এর উদ্ধৃতি দিয়েছিলাম কয়দিন আগে এক লেখায়, তাঁর মতে, এন্টিকলোনিয়ালিজম হচ্ছে উপনিবেশী শক্তির সাথে একটা সংলাপ প্রক্রিয়া। একইভাবে, প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা বলতে আমি বুঝি প্রতিষ্ঠানের সাথে একটা বিশেষ ধরনের সংলাপ।
বিরোধিতা একটা সম্পর্কের নাম। কিন্তু আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠানবিরোধীরা প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পর্কহীনতাকেই প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা হিসেবে বুঝেছেন। এই সম্পর্কহীনতা প্রকারান্তরে তাদের বৃহত্তর সমাজের এমনকি বৃহত্তর রাজনীতির সাথেও সম্পর্কহীন করে ফেলে। ফলে, এই অদ্ভূত ধরনের শত্রুতার মোড়ক উন্মোচনের ফলে আমাদের সাহিত্যে আজো প্রতিষ্ঠানের সাথে প্রতিষ্ঠানবিরোধীদের কোনো সংলাপ সংঘটিত হল না। কেউ কারো এজেন্ডা শুনল না জানল না।
শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়ে রেষারেষিই এই বিরোধিতার ইশতেহার হয়ে রইল।
মাঠশালা, আমি কিছু লিটলম্যাগ প্রসঙ্গে লিখেছিলাম যে এরা প্রতিষ্ঠানবিরোধী নয়, বরং বিরোধিতার প্রতিষ্ঠান। রেটরিক্যালি লিখেছিলাম। এখন ভেবে দেখছি যে, আসলে বিরোধিতাও করতে ব্যর্থ হয়েছে তারা। সম্পর্কহীন হয়ে থাকাটাকেই চরম মোক্ষ ভেবেছে।
অন্যত্র আমি লিখেছিলাম, বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠান তৈরি হওয়ার আগেই "প্রতিষ্ঠানবিরোধী"রা তৈরি হয়েছে। কাঠমোল্লাদের মতই নিজেদের বিরাগভাজনদের তারা প্রতিষ্ঠানের "দালাল" ঠাউরে একহাত নেয়ার রাজনীতি করে আসছে। মামলাটা সাহিত্যের, কিন্তু গত দুদশকে একটাও নন্দনতাত্ত্বিক ইস্যু আমি দেখি নি যার ওপর এই বিরোধিতার রাজনীতি সক্রিয় আছে।
চিন্তাকে এগিয়ে নেয়ার জন্য প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার দরকার। কিন্তু দেখুন প্রতিষ্ঠানবিরোধী লিটলম্যাগের দিকে।
মধ্য আশিতে শুরু হওয়া কোনো কাগজের সাম্প্রতিকতম ইস্যুটি দেখুন। প্রতিনিধিত্ব করে?
করে না। কারণ ইতোমধ্যে এরাই প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে গেছে। বনসাঁইকরণ হয়ে গেছে এদের।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।