munirshamim@gmail.com
প্রথম কিস্তি.......
পারিবারিক নির্যাতন: প্রত্যায় ও তত্ত্বগত ধারণা
আজ আরও একটি মেয়ের মৃত্যু হয়েছে
না, কোন ভিনদেশের মাটিতে নয়
না, কেউ বন্দুকও তার পিঠে তাক করে নি
না, কোন বৃহৎ সেনাবাহিনীর ট্যাংক এসে তাকে গুড়িয়ে দেয় নি
সিএনএন তার এ যুদ্ধের খবর প্রচার করে নি
বুদ্ধিজীবীর জমজমাট আড্ডায় সরব আলোচনা বা
প্রশিক্ষিত সেনার কৌশলগত লক্ষ্য ছাড়াই তার মৃত্যু হয়েছে
আক্রমনের লক্ষ্য বস্তু ছিল খুব সামান্য
তার মুখ, পিঠ এবং গর্ভের সন্তান সহ পেট
লক্ষ্য ছিল মেয়েটির শরীর
যা তার মায়ের গর্ভে সঙ্গীতের মূর্ছনার মতো একদা বিকশিত হয়েছিল
. . . . .
মেয়েটির মৃত্যু হয়েছে দূরে কোথাও নয়
বরং তোমার খুব খুব কাছে
অন্য ঘরে কিঙবা পাশের বাড়িতে...। '
(ক্যারল জিনিয়া ক্যাপলন এর এ্যনাদার উইম্যান কবিতার অংশবিশেষ ভাবানুবাদ)
পারিবারিক নির্যাতন আরও সুস্পষ্টভাবে বললে নারীর বিরুদ্ধে পারিবারিক নির্যাতন বা পারিবারিক সহিংসতা নিঃসন্দেহে একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রপঞ্চ/ঘটনা। খুব স্বাভাবিক কারণেই পারিবারিক নির্যাতনের একটি প্রমিত ধারণা বা সংজ্ঞা উপস্থাপন বেশ কঠিন। কেননা প্রতিটি সামাজিক ঘটনার থাকে একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিত। থাকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ।
আবার এ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণগুলো একটি সুনির্দিষ্ট ভৌগলিক সীমারেখার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সংশ্লিষ্ট উপাদান থেকেও মুক্ত নয়। ফলে ইতিহাস, সংস্কৃতি, আর্থনীতিক অবস্থা, ধর্ম, রাজনৈতিক মতাদর্শ, আইন, প্রথা এবং ভৌগলিক সীমারেখা এ সব উপাদান দ্বারা এ ধরনের সামাজিক ঘটনার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বা সংজ্ঞা প্রভাবিত হতে বাধ্য এবং বাস্তবে প্রভাবিত হয়েও থাকে। যেমন কোন আচরণ একটি সংস্কৃতিতে গ্রহণযোগ্য হলেও সে একই আচরণটিই অন্য সংস্কৃতি ও ভৌগলিক বাস্তবতায় একটি অপরাধ এবং গ্রহণযোগ্য নয়। আর এ কারণেই উপরোক্ত উপাদানগুলোর ভিন্নতা পারিবারিক নির্যাতন সম্পর্কিত ধারণার অবশ্যম্ভাবী ভিন্নতা তৈরি করে। আর বাংলাদেশের মতো সামাজিক বাস্তবতায় যেখানে পারিবারিক নির্যাতন সম্পর্কে এখন পর্যন্ত কোন সুনির্দিষ্ট আইনী কাঠামো তৈরি হয়নি সেখানে এর সংজ্ঞা উপস্থাপন আরও জটিল।
বর্ণিত জটিলতা ও ঝুকিগুলো মাথায় রেখেই এ অধ্যায়ের শুরুতেই পারিবারিক নির্যাতন সম্পর্কিত বিভিন্ন সংজ্ঞার একটি তুলনামূলক আলোচনা উপস্থাপনের চেষ্টা করা হবে। এ আলোচনাটি একান্তভাবেই বিদ্যাজাগতিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। ফলে আলোচিত বা উপস্থাপিত সংজ্ঞা/সংজ্ঞাসমূহ উপরোক্ত প্রেক্ষিতগুলোর সকল উপাদানকে স্পর্শ করতে যে পারবে না এ বিষয়ে আমরা নিজেরাও হলফ করে বলে দিতে পারি। তবুও পারিবারিক নির্যাতনমুক্ত একটি সমাজের কথা যারা ভাবেন, যারা নারী ও পুরুষের সম ও ভারসাম্যপূর্ণ মানবিক বিকাশের চলমান লড়াইটাকে আরেকটিু এগিয়ে নিতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন, নারী-পুরুষ সমতাভিত্তিক একটি সামগ্রিক উন্নয়নে যারা ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে আন্তরিক, আস্থাশীল এবং কর্মরত এ অধ্যায়টি পারিবারিক নির্যাতন সম্পর্কিত বিভিন্ন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে সহায়তা করবে। আর এ বিশ্বাস থেকেই নিচে পারিবারিক নির্যাতন সম্পর্কিত কিছু ধারণা ও সংজ্ঞা উপস্থানের চেষ্টা করা হয়েছে।
পারিবারিক নির্যাতন কী
পারিবারিক নির্যাতন হচ্ছে এমন ধরনের আচরণ যা কোন ব্যক্তি একটি সম্পর্ক কাঠামোয় অন্যকে নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহার করে। এ সম্পর্ক কাঠামোয় ব্যক্তি বা ব্যক্তি সমষ্টি বিবাহিত হতে পারে, আবার অবিবাহিতও হতে পারে ।
ইন্টারনেটে পারিবারিক নির্যাতনের ১৬টি সংজ্ঞা 'Definition of Domestic Violence on the Web শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে। এ সংজ্ঞাগুলো পারিবারিক নির্যাতনকে বিভিন্ন মাত্রা ও নানা দেশের অভিজ্ঞতার আলোকে ব্যাখ্যা করেছে। প্রথম সংজ্ঞাটিতে বলা হয়েছে পারিবারিক পরিসরে নারীর বিরুদ্ধে সঙ্ঘটিত নিপীড়নমূলক আচরণ অথবা ইচ্চেকৃত অবহেলা হচ্ছে পারিবারিক নির্যাতন।
এ সংজ্ঞাটিতে নিপীড়নমূলক আচরণ বা ইচ্ছেকৃত অবহেলার কোন ব্যাখ্যা উপস্থাপিত হয়নি। দ্বিতীয় সংজ্ঞাটি আরেকটু বিস্তৃত এবং ব্যাখ্যামূলক। এতে বলা হয়েছে কোন নিকট আত্বীয় বা কাছের কোন ব্যক্তি দ্বারা শারিরীক, মনস্তাত্ত্বিক এবং আবেগ সংশ্লিষ্ট নির্যাতন সহ যেকোন ধরনের কষ্টদায়ক এবং অপ্রত্যাশিত আচরণ । পরবর্তী সংজ্ঞায় আরেকটু বিস্তৃত করে আবেগগত, মনস্তাত্ত্বিক, শারিরীক, যৌন নির্যাতনের পাশাপাশি পারিবারিক পরিসরে নিকট আত্বীয় বা কাছের মানুষ দ্বারা অর্থনৈতিক বঞ্চনাকেও পারিবারিক নির্যাতন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, জোরপূর্বক সহবাস বা যৌন সম্পর্ক স্থাপন, যৌন হয়রানি, জোরপূর্বক প্রেমনিবেদন বা ভালবাসার সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা, সম্পদের লুট, শারিরীব বা মৌখিক নির্যাতন বা নির্যাতনমূলক শব্দ প্রয়োগ এ সব কিছুই পারিবারিক নির্যাতন হিসেবে বলা হয়েছে।
যদি নির্যাতনকারী ও নির্যাতিতের মধ্যকার সম্পর্কের ভিত্তিটি বিয়ে, পরিবার, প্রেম বা পূর্ববর্তী বিয়ে হয় । এসব সংজ্ঞায় পারিবারিক নির্যাতনকে নিপীড়ন ও নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণের একটি দীর্ঘ মেয়াদী প্রক্রিয়া হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে ।
আমেরিকাভিত্তিক ন্যাশনাল ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স হটলাইন পারিবারিক নির্যাতনকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বড় শিরোনামে ৬ ধরনের নির্যাতনের কথা বলেছে। নিচের ছকে নির্যাতনের প্রকরণ, তার ব্যাখ্যা এবং প্রধান প্রধান আচরণগুলো উপস্থাপন করা হলো:
শারিরীক: পরিবারিক পরিসরে সঙ্ঘটিত যেকোন ধরনের শারিরীক নির্যাতন যা আহত করে বা আহত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করে। যেমন ধাক্কা দেয়া, ছুঁড়ে ফেলা, লাথি মারা, আঘাত করা, চিমটি দেয়া, মারা বা প্রহার, কোন কিছু ছুঁড়ে মেরে বা অন্যকোন ভাবে গায়ের রঙ বিবর্ণ করে দেয়া, কোন কিছু দিয়ে আঘাত করা, বন্দী করে রাখা, খুন ইত্যাদি
আবেগগত: মানসিক, মনস্তাত্ত্বিক, অথবা আবেগত নির্যাতনগুলো শব্দ ও ভাষার ব্যবহারের মাধ্যমে হতে পারে আবার কোন ধরনের শব্দ বা ভাষা ব্যবহার না করেও হতে পারে।
ফলে এটি শারিরীক নির্যাতনের চেয়েও ভয়াভহ হয়ে উঠতে পারে। যেমন, সম্মতি আদায়ের জন্য ভীতি প্রদর্শন বা আতংক তৈরি করা
ব্যক্তিগত সম্পত্তির ক্ষতি বা ক্ষতি করার হুমকি প্রদান, ভয়ভীতি তৈরির জন্য বাসায় হাড়ি-পাতিল ছুড়ে ফেলা দেয়া, দেয়ালে আঘাত করা ইত্যাদি, অস্বাভাবিক উচ্চ শব্দে কথা বলা বা চিৎকার করা, গালাগাল দেয়া, কটু শব্দ ব্যবহার করা, একা, পরিবারের সদস্যদের সামনে অথবা অন্যকারও সামনে টিটকারী করা, হেয় করার উদ্দেশ্যে ঠাট্টা তামাসা করা, ভিটটিমের ব্যক্তিগত অর্জনগুলো নিয়ে হাসি-তামাসা করা, নেতিবাচক সমালোচনা করা, ভিকটিমের সিদ্ধান্তগ্রহণ ক্ষমতার প্রতি আস্থা না রাখা, পরিবার ও বন্ধু বান্ধবদের থেকে আলাদা করে সম্পর্কের মাত্রাতিরক্ত মালিকানা প্রতিষ্ঠা বা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা
যৌন: যেকোন ধরনের যৌন নির্যাতন বা যৌন হয়রানি, যেমন যৌন নিপীড়ন অর্থাৎ অনিচ্ছাকৃত, অনিরাপদ, অথবা অমর্যাদাপূর্ণ যৌন কাজে অংশগ্রহণে বাধ্য করা, যৌনতা বা পুনরূৎপাদনমূলক ক্রিয়াকান্ডকে ব্যক্তির ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রভাবিত করা বা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা, যৌন শোষণ যেমন কাউকে জোরপূর্বক বা চতুরতার সাথে পর্ণোগ্রাফী বা যৌনসংশ্লিষ্ট চিত্র/ছবি দেখানো বা দেখানোর চেষ্টা করা/ শারিরীক সৌন্দর্য্যসহ বিভিন্ন শারিরীক উপাদনসমূহ নিয়ে নানা কৌশলে কথা বলা ইত্যাদি
ভীতিমূলক: পরিবার বা পারিবারিক সম্পর্ক সংশিÍষ্ট ব্যক্তি নানা প্রক্রিয়ায় মনে ভীতি করার চেষ্টা করে যেমন, অনুমতি ছাড়া বারবার টেলিফোন করা বা টেলিফোনে কথা বলার চেষ্টা করা, ব্যর্থ হলে টেলিফোনে হুমকী দেয়া, টেলিফোন/ মোবাইল মনিটরিং করা, রাস্তা বা পথ অনুসরন করা, অযাচিতভাবে বিভিন্ন কার্ড, ম্যাসেজ, চিঠি ইত্যাদি প্রেরণ করা, অযাচিতভাবে দেখা করার চেষ্টা করা/সঙ্গ লাভের চেষ্টা করা
অর্থনৈতিক: অর্থনৈতিক সম্পদ থেকে বঞ্চনা, যেমন, অর্থনৈতিক সম্পদ থেকে ত্যাজ্য ঘোষণা বা সম্পদ বন্টনে কম বেশি দেয়া, নিজের স্বার্থ লাভের জন্য ভিকটিমের সম্পদের ব্যবহার যেমন অলংকার বিক্রি করে দেয়া, খাবার, বস্ত্র, প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র, বাসস্থান না দেয়া, চাকরি বা আয়মূলক কাজে যুক্ত হতে না দেয়া
আধ্যাত্বিক: এ প্রক্রিয়ায় সাধারণত সামাজিক প্রথা বা ধর্মীয় বিষয়গুলো ব্যবহার করা হয়, যেমন, ভিকটিমকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য তার ধর্মীয় ও আধ্যাত্বিক বিশ্বাসের উপাদানগুলো ব্যবহার করা, ভিকটিমকে তার নিজস্ব বিশ্বাস ও জীবানাচার চর্চা করতে না দেয়া, পরিবারের অন্য সদস্যদের আধ্যাত্বিক চর্চা বা বিশ্বাসে বাধা হয়ে দাড়ানো, ইত্যাদি
উপরোক্ত কাজগুলো যখন পারিবারিক গন্ডিতে, পরিবারের সদস্য বা নিকট আত্বীয়, বৈবাহিক সম্পর্ক বা কোন রোমান্টিক সম্পর্কের মধ্যে ঘটে তখান তাকে ন্যাশনাল ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স হটলাইন পারিবারিক নির্যাতন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
মানুষের সকল সামাজিক সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত আসলে কতগুলো ক্ষমতার সম্পর্ক ছাড়া আর কিছু নয়। যে ক্ষমতার সম্পর্ক কাঠামোতে সমাজের সদস্যরা অন্য কোন সদস্য দ্বারা কোন না কোনভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। পরিবারের ভেতরের সম্পর্ক কাঠামোটিও এ ক্ষমতা সম্পর্কের বাইরের কিছু নয়।
সম্ভবত এ কারণেই অস্ট্রেলিয়ান মেডিক্যাল এসোসিয়েশন পারিবারিক নির্যাতনকে ক্ষমতার অপব্যবহার হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এ ক্ষমতা সম্পর্কটি তৈরি হয় কতগুলো আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উপাদান দ্বারা। এ উপাদানের কারণে পারিবারিক সম্পর্ক কাঠামোয় যারা ক্ষমতাবান তারা ক্ষমতাহীনের বিপক্ষে ক্ষমতার ব্যবহার করেন।
উল্লেখ্য পারিবারিক নির্যাতন বলতে অনেকেই নারীর বিরুদ্ধে ঘটমান পুরুষের বিভিন্ন আচরণ কে বুঝে থাকেন। অনেকেই শুধু বৈবাহিক সম্পর্কের ভেতরে স্ত্রীর প্রতি স্বামীর নির্যাতনমূলক আচরণকে অন্তর্ভুক্ত করে থাকেন।
এর ফলে পারিবারিক নির্যাতন শব্দটি নারীর বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া অনেক বিষয় এবং পারিবারির নির্যাতনের অনেক রকমফের সংজ্ঞার বাইরে থেকে যায়। পাশাপাশি পারিবারিক নির্যাতন ইসুুতে পুরুষকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাড় করায়। একই সাথে পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ নারীর বিরুদ্ধে নারীর আচরণগুলো এড়িয়ে চলে। অথচ এগুলোর প্রত্যেকটি নারী নির্যাতনের পর্যায়ে পড়ে..............(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।