চলে যেতে যেতে বলে যাওয়া কিছু কথা
১৯১৫ সালে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী রোমেইন রোলান্ডের কাছে সি এফ এন্ড্রু (যিনি কিনা রবীন্দ্রনাথ এবং গান্ধী উভয়ের বন্ধু মানুষ ছিলেন। ) ভারতীয় এই দুই বিখ্যাত ব্যক্তিদ্বয়ের আলোচনার বিষয়বস্তু তুলে ধরেন, যে আলোচনায় তিনি নিজেরও উপস্থিত ছিলেন। তাদের আলোচনার প্রথম বিষয় ছিল মুর্তি কিংবা মুর্তি পুজা।
গান্ধী মুর্তি কিংবা মুর্তিপূজার পক্ষালম্বন করেন এবং তিনি বিস্বাস করতেন সাধারন জনগনের সেই মেধা নেই কিংবা নিজেদেরকে সে পর্যায়ে নিতে সক্ষম নয় যাতে করে তারা এবস্ট্রাক্ট চিন্তাধারাগুলো বুঝতে পারবে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের এটি সহ্য করতে পারতেন না সাধারন মানুষজন চিরকাল বাচ্চাদের মত আচরন করবে এবং তাদের সাথেও শিশুদের মত আচরন করা হবে।
গান্ধী তখন উল্লেখ করেন ইউরোপের মহত সব অর্জনগুলো পতাকার মাধ্যমে অর্জিত হয়েছিল, পতাকাগুলো ছিল জীবজন্তুর মুর্ত প্রতিকের মত।
রবীন্ধনাথ দ্বিমত পোষন করলে গান্ধী নিজের যুক্তি অটল থাকেন এবং বলেন ইউরোপীয় পতাকাগুলো যে ঈগল ইত্যাদির ছবি বহন করে তার বিপরীতে তিনি তার পতাকায় বেছে নিয়েছেন ঘুর্নায়মান চরকার ছবি।
পশ্চিম বাংলার এক ভদ্রলোকের একটি লেখাতে প্রাসংগিক আরো কিছু জানা যায়, যাতে করে এটি বুঝতে অসুবিধা হয় না রবি ঠাকুরের অন্ধভক্তিতে অনীহা ছিল, যাতে করে কিনা একজন মানুষ নিজের স্বকীয়তাকে ভুলতে বসে। শৈশবে তিনি রবীঠাকুরের একটি প্রবন্ধ পড়েছিলেন, যার নাম ছিল ভক্তিপুজা। রবীন্দ্রানাথ এই বলে দু:খ প্রকাশ করেছিলেন যে, ভারতীয়রা বিখ্যাত কোন মানুষ পেলেই তাকে বেদীতে চড়িয়ে তার পুজা অর্চনা করা শুরু করে।
ভারতীয়দের এই মানসিকতা তাকে পীড়া দেয়।
দুর্ভাগ্যবশত: পশ্চিম বংগে ঠিক এই কাজটি করা হয়েছে, রবীন্দ্রনাথকে ঈশ্বর বানিয়ে তার পূজা অর্চনা চালিয়েছে বাংগালীরা। বিশ্বভারতী কিংবা শান্তি নিকেতন রবীন্দ্রনাথকে ঈশ্বর বানিয়ে ফেলেছে ক্ষুদ্রগন্ডিতে আকড়ে ফেলে।
(তাইত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী রিজওয়ানা বন্যাকে একবার বলতে শুনেছিলাম, ওনি ওনার সন্তানকে এমন একটি জায়গায় নিয়ে যেতে চান যেখানে আকাশে বাতাসে, পাতায়, ডালে কেবলি রবীন্দ্রনাথই থাকবে)।
উক্ত পশ্চিম বংগীয় ভদ্রলোকের ধারনা এসব কারনেই রবীন্দ্রসাহিত্যের চর্চা এখন কষ্টসাধ্য, কেননা পশ্চিম বাংলা তার পুজাতেই ব্যস্ত, চর্চার সুযোগ কই।
শুনতে খারাপ লাগলেও এটিও সত্য বিস্বসাহিত্যের অংগনে রবীন্দ্রনাথ নামটি উচ্চারিত হয় না বললেই চলে। এমনকি খোদ ভারতে আরেক বাংগালী সত্যজিত রয় ভারতীয়দের কাছে রবীন্দ্রনাথের চাইতেও বেশি জনপ্রিয় একটি নাম।
বাংগালীরা যত না রবীঠাকুরকে বুঝতে চেয়েছে তার চাইতে বেশি রবীবন্দনায় ব্যস্ত থেকেছে।
এবার দুযোগের আগে পড়া আমাদের বাংলাদেশের এক কবির কবিতার কথা উল্লেখ না করলেই নয়। তার কবিতায় তিনি রবীঠাকুরের বন্দনা করতে করতে আবেগাক্রান্ত হয়ে লিখেছিলেন তুমি আমার শিরায় শিরায়, তুমি আমার রক্ত কণিকায়, তুমি আমার ঈশ্বর।
ব্যক্তিপূজার এই রোগটি কিংবা হীনমন্যতাটি আমাদের বাংলাদেশীদের মধ্যেও চোখে পড়ে। কোন কোন বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের সাথে নিজের আবেগ উচ্ছাসকে অনেকে এত বেশিই জড়িয়ে ফেলেন যে, তা রীতিমত দৃষ্টিকটু হয়ে পড়ে।
আমরা সৃষ্টির সেরা জীব এইজন্যেই যে আমরা সকলেই নিজের মত, অন্যের মত নই, অন্যের অস্তিত্ব আমার অস্তিত্বের জন্য আবশ্যকীয় নয়। নিজের অস্তিত্বে সমুজ্জল।
রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, আমরা সবাই রাজা আমাদেরই রাজার রাজত্বে।
(লালন মুর্তি কিংবা ভাস্কর্যটি নিয়ে কুটতর্কের সাথে লেখাটির কোন যোগসূত্র খুজে পেলেও অনেকে পেতে পারেন)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।