আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মণিপুরীদের মহারাস উৎসবে সবাইকে আমন্ত্রন। কবে কখন কি অনুষ্ঠান, কিভাবে যাবেন বা কোথায় থাকবেন ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য।

প্রান্তিক জনগোষ্ঠিগুলোর ভাষা ও জাতিগত অস্তিত্বের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও সমমর্যাদা দাবী করছি
বছর ঘুরে আসছে বাংলাদেশের মণিপুরী সম্প্রদায়ের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক উৎসব মণিপুরী মহারাসলীলা। মণিপুরী মহারাসোৎসব সিলেট বিভাগের অন্যতম প্রধান ও বৃহত্তম লোক-নৃতাত্ত্বিক উৎসব। বিপুল আনন্দ উদ্দীপনার এই দিনটির জন্য শুধু মণিপুরীরাই নয়, স্থানীয় বাঙালীসহ জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অন্যান্য সকল সম্প্রদায়ের লোকজন বছরব্যাপী প্রতীক্ষায় থাকে। এ বছর মহারাসলীলার ১৬৬তম বর্ষপুর্তি উৎযাপিত হচ্ছে। ১৩ নভেম্বর, ২০০৮ সিলেটের মৌলবীবাজার জেলার কমলগঞ্জ থানার মাধবপুর জোড়ামন্ডপ এবং আদমপুর সানাঠাকুর মন্ডব হয়ে উঠবে লাখো মানুষের মিলনমেলা।

সাদা কাগজ দিয়ে কারুকার্যময় নকশায় সাজানো মণ্ডপগুলোতে দূর-দূরান্ত থেকে জড়ো হওয়া মণিপুরী নৃত্যশিল্পীদের সুনিপুণ নৃত্যগীতি মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখবে দর্শনার্থীদের। বৈষ্ণব সাহিত্যের রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলার এক নৃত্যগীতাভিনয় অনুষ্ঠান হচ্ছে রাসলীলা। রাস শব্দটি রস শব্দের বিবর্তিত রূপ বলে অনুমান করা হয়। মণিপুরীদের প্রথম রাসলীলা বা রাসলীলানুসরণ অনুষ্ঠান হয় মণিপুরীদের আদিভূমি মণিপুরে ১৭৬৯ খৃস্টাব্দে রাজা ভাগ্যচন্দ্র সিংহের আয়োজনে। বর্তমান যুগের ভারত ও বঙ্গে যে রাসলীলা কেন্দ্রিক রাস উৎসব হয়ে আসছে–তার প্রচারক হচ্ছেন প্রখ্যাত এই মণিপুরী রাজা।

গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মমতে মোহবিষ্ট রাজা স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে কন্যা লাইরোবিকে রাধার ভূমিকায় অবতীর্ণ করে রাস অনুষ্ঠানটির আয়োজন করেছিলেন। মৈথিলী ও ব্রজবুলি ভাষার বিভিন্ন পদের মণিপুরী সঙ্গীতের নিজস্ব গায়কী ও মুদ্রা-পদবিক্ষেপে জটিল এবং ধ্রুপদী ধারার এই গীতিনৃত্যধারা মণিপুরীদেরকে ভারতীয় উপমহাদেশের তথা সমগ্র বিশ্বের নৃত্যকলার মধ্যে একটি বিশেষ স্থান করে দিয়েছে। বাংলাদেশে মণিপুরী রাসলীলা উৎযাপনের ইতিহাস অষ্টাদশ শতকের প্রথম পাদে বাংলাদেশের সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ জেলায় বসতি স্থাপনকারী মণিপুরীরা আজ থেকে প্রায় দেড় শতাধিক বছর পূর্বে প্রথম এই দেশে তাদের ধর্ম-সংস্কৃতির প্রধান উৎসব রাসলীলার সূচনা করে। বাংলা ১২৮৯ সন নাগাদ ১৮৪২ খ্রীষ্টাব্দের শারদীয় পুর্ণিমা তিথিতে তৎকালীন মৌলবীবাজার মহকুমার মাধবপুর জোড়ামন্ডপে মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া সম্প্রদায়ের আয়োজনে এবং মণিপুরী মৈতৈ সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত হয় রাসলীলা। জোড়ামন্ডপের প্রথম সেই রাসলীলানুকরনে বৃন্দার ভুমিকায় ছিলেন রাণী চ্যাটার্জ্জী, রাধা ও কৃষ্ণের ভুমিকায় ছিলেন থাম্পাল সিনহা ও বাবুল সিংহ, রাসধারী বা রাসের পরিচালনাকারী ছিলেন বকসাল সিংহ ও সহযোগী সাংকয় সিংহ।

প্রাথমিক অবস্থায় কেবল রাত্রিতে শারদীয় রাস অনুষ্ঠিত হলেও পরবর্তীতে দিবাভাগে গোষ্ঠলীলা যোগ করা হয়। ১৯১৯ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সিলেট ভ্রমনে এলে সিলেট শহরের অদুরে মাছিমপুর পল্লীতে মণিপুরী মেয়েদের পরিবেশিত রাস নৃত্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। পরে কবিগুরু কমলগঞ্জের নৃত্য শিক্ষক গুরু নীলেশ্বর মুখার্জীকে শান্তি নিকেতনে নিয়ে গিয়ে প্রবর্তন করেছিলেন মণিপুরী নৃত্য শিক্ষা । ১৮৪২ সাল থেকে প্রতি বৎসরই জোড়ামন্ডপে মণিপুরী রাসলীলা উৎযাপিত হয়ে আসছে। শুধুমাত্র ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মণিপুরীরা রাসলীলানুকরন বন্ধ রাখে।

একই এলাকার আদমপুর বাজারের সানাঠাকুর মন্ডপে ১৯৮৬ সাল থেকে মণিপুরী মৈতৈ সম্প্রদায়ের উদ্যোগে রাসলীলা উৎযাপন শুরু হয়। সময়ের সাথে রাসোৎসবের আকর্ষণ যেমন বেড়েছে তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে উৎসবে দর্শনার্থীর সমাগম। কোথায় কখন কি অনুষ্ঠান বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের আয়োজনে জোড়া মন্ডপ ও মণিপুরী ললিতকলা একাডেমীর প্রাঙ্গনে ১৩ নভেম্বর বৃহস্পতিবার সকাল ১১ টা থেকে গোধূলী লগ্ন পর্যন্ত গোপরাস (স্থানীয় ভাষায় রাখুয়াল) অনুষ্ঠিত হবে। এই রাস পুরুষদের। শ্রীকৃষ্ণ, সখা বলরাম ও অন্যান্য গোপবালকদের গোষ্ঠে গরু চরাতে গিয়ে সম্মুখীন নানা ঘটনার চিত্র এই রাসে রূপায়িত হয়।

মণিপুরী শাস্ত্রীয় নৃত্যের বৈষ্ণব ভক্তিভাবাপন্ন নরম কোমল ভাবের বিপরীতে এখানে তান্ডব ধারার নৃত্যই প্রধান। অজা বা গুরু বসেন মৃদঙ্গ নিয়ে। আর মানকসাপি বা যশোদা ও রোহিনী-রূপী নারীদ্বয় মন্ডলীর এককোনে বসে গান ও অভিনয় কর্ম সম্পন্ন করেন। ১২ টি কলাগাছ দিয়ে বেষ্টিত তিনটি পৃথক মঞ্চে শতাধিক তরুন ঐতিহ্যবাহী পোষাকে সজ্জিত হয়ে গোপরাস বা গোষ্ঠলীলায় অংশ নেয়। সন্ধ্যা ৬ টা থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত লোক ঐতিহ্যমুলক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

এই সময় দর্শকরা ঘুরে দেখতে পারেন রাস মেলা। রাস উৎসব প্রাঙ্গনেই বসে বিরাট এই গ্রাম্য মেলা। মেলায় অন্যান্য স্টলের পাশাপাশি বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার বইপত্র ও পত্রপত্রিকার অনেকগুলো স্টল থাকবে। মণিপুরী ভাষার অডিও ভিডিও গানের ক্যাসেট বা সিডির দোকানও থাকবে। তাছাড়া রাসমেলায় মণিপুরী হস্তচালিত তাঁতের কাপড়ের প্রদর্শনী ও বিক্রির ব্যবস্থা রাখা হবে।

এরপর রাত সাড়ে ৯ টা থেকে সাড়ে ১০ পর্যন্ত মণিপুরী নটপালা কীর্তন। রাত ১১ টা থেকে পরদিন ভোর পর্যন্ত চলবে শ্রীশ্রী কৃষ্ণের মহারাসলীলানুসরণ। বাঁশ ও কাগজ কেটে বিশেষ কারুকাজে রাসের মন্ডলী তৈরী করা হয়। মন্ডলীর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে বসে রাসধারী বা রাসের গুরু, সূত্রধারীগণ এবং বাদকগণ। পাশাপাশি তিনটি মন্ডপে আনুমানিক প্রায় ২০০ জন কিংবা ততোধিক সংখ্যক তরুণী এ রাসলীলায় অংশ নিয়ে থাকে।

রাসের সাধারণ ক্রম হচ্ছে- সূত্রধারী কর্তৃক রাগালাপ ও বন্দনা, বৃন্দার কৃষ্ণ আবাহন, কৃষ্ণ অভিসার, রাধা ও সখীদের অভিসার, রাধা ও কৃষ্ণের সাক্ষাৎ ও মান-অভিমান, ভঙ্গীপারেং, রাধার কৃষ্ণ-সমর্পন, যুগলরূপ প্রার্থনা, আরতি ইত্যাদি। মণিপুরী মৈতৈ সম্প্রদায়ের উদ্যোগে আদমপুর বাজারে সানাঠাকুর মন্ডপ প্রাঙ্গনে রাসলীলা উৎসবে কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে ১৩ নভেম্বর বৃহস্পতিবার সকাল ১১ টায় রাখাল নৃত্য, সন্ধ্যা ৬ টা থেকে ১০টা পর্যন্ত মণিপুরীদের ঐতিহ্যবাহী লোকনৃত্য ও মার্শাল আর্টের শিল্পিত রূপ থাঙ-টা পরিবেশনা। রাত ১১ টায় বরাবরের মতো পালা ও রাত ১২ টায় মহারাসলীলা। কিভাবে আসবেন উৎসবের আগের দিন ঢাকা থেকে ট্রেনে অথবা বাসযোগে আসতে পারেন। কমলাপুর রেল ষ্টেশন থেকে পারাবত, জয়ন্তিকা, কালনি বা উপবন ট্রেনে শ্রীমংগল এসে তারপর বাসযোগে ২০/২৫ মিনিটের রাস্তা অতিক্রম করলেই পাবেন ভানুগাছ বা কমলগঞ্জ থানা।

ট্রেনের ভাড়াও খুব বেশী নয়, ২০০-২৫০ টাকার মধ্যে। ট্রেনগুলো ঢাকা থেকে ছাড়ে যথাক্রমে সকাল ৭টা, বেলা ১:৩০, বেলা ২:৩০ ও রাত ১০টায়, এবং পৌঁছার আনুমানিক সময় যথাক্রমে দুপুর ১২টা, সন্ধ্যা ৭টা, সন্ধ্যা ৮টা ও রাত ৩টা। জয়ন্তিকা ট্রেনে আসলে সরাসরি ভানুগাছ নামতে পারবেন। এছাড়া ঢাকার ফকিরেরপুল ও সায়েদাবাদ থেকে শ্যামলী, হানিফ ও মৌলবীবাজার সিটি পরিবহনের বাস নিয়মিত সার্ভিস দিচ্ছে। ভাড়া পড়বে ২৫০ টাকা।

ভানুগাছ চৌমুহনা থেকে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান সড়ক ধরে ৩ কিলোমিটার গেলেই মাধবপুর জোড়ামন্ডপ। অন্যদিকে কমলগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে কমলগঞ্জ-কুরমা সড়ক ধরে সোজা ৫ কিলোমিটার দক্ষিণে আদমপুরের সানামন্ডপ। এসব রাস্তায় নিয়মিত বাস, পিকআপ, সিএনজিচালিত অটোরিক্সা ও রিক্সা চলাচল করে। কোথায় থাকবেন ভোরে পৌঁছাতে পারলে থাকার জন্য হোটেল ভাড়া করার দরকার হবেনা। অনুষ্ঠান চলে সকাল থেকে রাতভর কাজেই পুরো দিনটা অনুষ্ঠানস্থলেই কাটিয়ে দেয়া যাবে।

আর থাকলে চাইলে শ্রীমংগল এবং মৌলবীবাজার সদর দুই জায়গাতেই থাকতে পারেন। মাঝারী এবং সস্তা দুমানেরই নানান রেস্টহাউজ ও আবাসিক হোটেল আছে শ্রীমংগল শহর এবং মৌলবীবাজার সদরে। তবে মৌলবীবাজার থেকে ভানুগাছ/কমলগঞ্জ আসতে দেড় থেকে দুইঘন্টা সময় লাগে, যেখানে শ্রীমংগল থেকে আসতে লাগে মাত্র ২০/২৫ মিনিট। এছাড়া মফস্বল শহর ভানুগাছ এবং শমশেরনগরেও কিছু ছোটখাট আবাসিক হোটেল রয়েছে। ভানুগাছ বাজার/ আদমপুর বাজারে খাবারের জন্য হোটেল আছে।

এছাড়া রাসমেলাতে কিছু সাময়িক রেস্টুরেন্ট থাকে, খাওয়ার কাজটা সেখানেও সারতে পারেন। আরো কয়েকটি দর্শনীয় স্থান ২/৩ দিন সময় নিয়ে এলে মণিপুরীদের মহারাস ছাড়াও অনেক কিছু উপভোগ করতে পারবেন। এ অঞ্চলের দর্শনীয় স্থানের মধ্যে কমলগঞ্জের নয়নাভিরাম হামহাম জলপ্রপাত, বড়লেখার মাধবকুন্ড জলপ্রপাত , লাওয়াছড়া রিজার্ভ ফরেস্ট , রাবার বাগান, মাধবপুর চা-বাগানের লেক ও ড্যামের নিসর্গ, মৌলভীবাজার শহরে হজরত শাহ মোস্তফা (রহঃ)এর মাজার শরিফ, শ্রীমংগলের চা গবেষনা কেন্দ্র বিটিআরআই, বৃটিশবিরোধী কৃষক আন্দোলন খ্যাত ভানুবিল গ্রাম, কুলাউরার পৃথিমপাশা নওয়াববাড়ী, কমলগঞ্জে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী হামিদুর রহমানের স্মৃতিসৌধ, মাগুরছড়া গ্যাসক্ষেত্র ইত্যাদি। অফ চান্সে শ্রীমংগলের ইস্পাহানি চা বাগানে খেয়ে আসতে পারেন নীল কন্ঠ চা কেবিনের এককাপ পাঁচ লেয়ারের চা । গত বছর অনুষ্ঠিত মণিপুরী মহারাসের কিছু ভিডিওচিত্র * গোপরাস বা রাখুয়াল * রাসমেলা * রাসলীলায় জনসমাগমের একাংশ * রাসলীলায় বৃন্দার কৃষ্ণ আবাহন ও কৃষ্ণ নর্ত্তন * গোপীদের নৃত্য মণিপুরী রাসলীলা সংক্রান্ত কিছু লিংক * Grand Observance of 165th Maha RasLila * প্রণমহি বঙ্গমাতার ফিল্ডওয়ার্ক পদ্ধতি - সাইমন জাকারিয়া * রাস উৎসব - এম হোসেইনের ব্লগ * আজ মহা রাসলীলা - ভাস্কর চৌধুরীর ব্লগ রাসোৎসব বা এ সংক্রান্ত কোন জিজ্ঞাসা থাকলে এখানে পোস্ট করতে পারেন।

আরেকটা কথা, এই সময়ে এদিকটায় শীতের প্রকোপটা দেশের অন্যান্য জায়গার তুলনায় একটু বেশীই, কাজেই শীতের কাপড় নিতে অবশ্যই ভুলবেন না। আপনার যাত্রা শুভ হোক। ব্লগের সবাইকে শারদীয় রাসপূর্ণিমার অগ্রীম শুভেচ্ছা।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।