সাহিত্যের সাইটhttp://www.samowiki.net। বইয়ের সাইট http://www.boierdokan.com
আজ পয়লা কার্তিক। কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়াতে লালন সাঁইয়ের মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হইতেছে। এইবার আর তীর্থে যাওয়া হলো না। তথাপি, মনে মনে তত্ত্বগানে মুখরিত ছেউড়িয়ার আমেজ টের পাইতেছি।
শহুরে মধ্যবিত্ত বৃদ্ধিজীবী সম্প্রদায় লালন সাঁইকে হিন্দু-মুসলমান মিলনের দর্শণ-ধারী হিসাবে চিনতে পারেন, আর এক ধরনের উদার মানবতাবাদী, আধুনিকতাবাদী দর্শনের মিলমিশ থেকেও তাকে পাঠ করার চেষ্টা করা হয়। ভাবুকরা বলেন, সেইটা ভুল পাঠ।
এ যাবত শহুরে লোকেরা লালনকে যেভাবে দেখার, বোঝার ও চর্চার চেষ্টা করেছেন তার মধ্যে ভ্রান্তি বেশি। লালনের চেয়ে শহুরে বুদ্ধিজীবীরা সেইখানে নিজেদেরকেই বেশি উপস্থাপন করতে চেয়েছেন। আমরা কীভাবে লালনকে দেখতে চাই? গেউরা বসন পরা ঝুঁটি বাঁধা এক গায়ক একতারা হাতে আকাশের দিকে তাকায়া নাচতেছে।
ইনি লালন? বেশ। লালনকে দার্শনিক হিসাবে না দেইখা আমরা গায়ক হিসাবে দেখতে চাই বইলা এইরকম রূপ জনপ্রিয়তা পাইছে। পাউক। আদতে যাঁর ছবি আমরা লালন হিসাবে চিনতে চাই তিনি লালন নন। আদতে লালনের একটি ছবিই যতদূর সম্ভব অথেনটিক হিসাবে বিচার করা হয়, সেটি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা।
সেইখানে মহাত্মা লালন সাঁই চেয়ারে বইসা আছেন। তার দর্শন বলে, চিত্রার্পিত হয়ে জগতে বিরাজ করা ইচ্ছা সাঁইজির আছিল না। ফলে, ছবি কেন, গানের মাধ্যমে চিন্তার ছবি ছাড়া আর কোনো ছবি, উত্তারাধিকার তিনি রাইখা যাইতে চান নাই। লালন দর্শন মোতাবেক, চিন্তাকে ধারণ করা, পালন করা ও বাস্তবায়ন করার চাইতে ছবি, মাজার ইত্যাদিকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয় নাই।
আজকে সকালে পত্রিকা পড়তে পড়তে নিউজের সাথে ভাস্কর্যের যে ছবি দেখলাম তাতে নাচনেঅলা যে বাউলকে দেখা যাইতেছে তিনি লালন নন বইলা প্রথমেই ওই ভাস্কর্যরে লালনের ভাস্কর্য হিসাবে চালানোর বুজরুকির বিরোধিতা করা দরকার বইলা মনে করছিলাম।
প্রথম কথা হইলো, এই ভাস্কর্যের সঙ্গে মহাত্মা লালন সাঁইয়ের কোনো সম্পর্ক স্থাপন করার চেষ্টা একটা অসমর্থন যোগ্য দাবি মাত্র।
বাংলাদেশের হাটে, বাজারে, শহরের মোড়ে যেসব কাঁচা হাতের ভাস্কর্য শোভা পায় সেইগুলা দেইখা কখনো হাসি লাগে, কখনো অভক্তি আসে আর কখনো করুণা হয়। বিমানবন্দরের সামনে যে ভাস্কর্য দেখতেছি সেইটা এর বেশি কিছু হইতে বইলা আমার এখন পর্যন্ত মনে হইতেছে না।
তাই এই ভাস্কর্য ফিরায়ে আনার দাবির প্রতি আমার তেমন একটা সায় নাই।
কিন্তু তাই বইলা কি আমি বিমানবন্দর এলাকার মোল্লা-মুসল্লিদের সমর্থনে আগায়া আসবো? না।
তাদের সমর্থনে আগায়া আসারও কোনো কারণ দেখি না। আমাদের প্রবল প্রতিপত্তিশালী সরকারগুলো ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ মোল্লাদের হাত থিকা বিমানবন্দরের মতো স্পর্শকাতর এলাকায় তথাকথিত 'জঙ্গি মাদ্রাসা' তৈরি হইতে দিছে এবং তারা সেই মাদ্রাসার লোকের সেইখানের একটা মোক্ষম জায়গায় অরাজকতা তৈরি করতেছে এবং সরকার সেইটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেছে না এইটা দেইখা একটু বিস্ময় লাগলো। জর্জ বুশ আইসা এই বিমানবন্দর দিয়া ঠিকমতো বাইত যাইতে পারবে তো? সন্দেহ থাকে।
ছবিতে যা দেখি মোল্লাদের সরানো কোনো ব্যাপার আছিল না। কিন্তু ছবির বাইরে যা দেখি তাতে মোল্লারা একটা ফ্যাক্টর এখন।
নইলে, কালকেই কেন বিশেষভাবে তাদের মূর্তি ভাঙার কথা হঠাৎ মনে হবে? ভাস্কর্য মেলা দিন থেকে তৈরি হইতেছে। ছোট-বড় হুজুরেরা উঁকি দিছে সেইখানে। তো আগেও তো ভাঙা যাইতে। নাকি? তো বিশেষভাবে আজকেই ভাঙলো মনে হয়, মুজাহিদ সাহেবকে বাঁচানোর জন্য। মুজাহিদ চিপায় পড়ার পরই হঠাৎ কইরা এই ভাস্কর্যের কথা মোল্লাদের মনে হইছে।
তারা একটা ইস্যু চায়। যেই ইস্যু ধইরা জামাত-সরকার-কওমীদের মধ্যে একটা রফা হইতে পারবে। মানুষজন ভুইলা যাবে মুজাহিদের সঙ্গে সরকারের আঁতাতের কথা। আর চাইলে এই ইস্যুরে বাড়ায়া নির্বাচন বাতিল পর্যন্ত আগায়ে নেওয়া যাইতে পারে। সারা দেশের 'ধর্মভীরু' লোকেরা যদি এখন রাস্তায় বারাইয়া ভাস্কর্য ভাঙা শুরু করে তাইলে সরকারকে কে বাঁচাবে?
আমার কথা হইলো, হুজুরেরা নিজেদের বুদ্ধিতে মাঠে নামে নাই।
লালন সাঁই শরিয়তি ইসলামের বিরুদ্ধে মেলা কথা কইছেন। মোল্লাদের কূপমন্ডুকতা নিয়া প্রশ্ন তুলছেন। বিমানবন্দর এলাকার মোল্লারা লালনের কথা শুইনা খেইপা গেছে এমন মনে হইতেছে না। মূর্তি, ছবি, ভাস্কর্য নিয়া তাদের অসুবিধা হইলে তো প্রথমে বিলবোর্ড ভাঙা উচিত। নইলে চোখে পর্দা করে চলা উচিত।
কিন্তু তা না কইরা যখন তারা ভাস্কর্য ভাঙতে আসে তখন বুঝা যায় :
১. মোল্লারা শক্তি পরীক্ষা করতেছে।
২. সরকারের মধ্যে মোল্লাপন্থীরা আমেরিকা পন্থীদের চেয়ে শক্তিশালী হয়া উঠতেছে।
৩. মোল্লাদের সামান্য উত্থান সামলানোর ক্ষমতা এই সরকারের নাই।
৪. সরকারের নতজানু মনোভাবে দেখে মনে হইতেছে তারা পলিটিকাল পার্টির মতো পলিটিকাল ইসলামের সঙ্গেও আপোষে আসতে চাচ্ছে।
ফলে, মোল্লাদের মাঠে নামায়ে ফায়দা যারা তুলতে চাচ্ছে তাদের দিকে আঙ্গুল তাক কইরা রাখতে হবে।
অনলাইন মিডিয়াগুলাতে দেখতেছি ভাস্কর্য বাঁচানোর মাতম শুরু হইছে। প্রথমত এই ভাস্কর্য শেষ হয় নাই। অর্ধেক ওই ভাস্কর্য কারো মনে কোনো স্মৃতি তৈরি করে নাই। এর কোনো ইতিহাস তৈরি হয় নাই। ফলে, এইটা শুধু ভাস্কর্য বইলা এইটারে রক্ষা করা শিক্ষিত লোকের দায়িত্ব এইটা আমার মনে হইতেছে না।
শিক্ষিত লোকদের লাফালাফি দেইখা মনে হইতেছে দেশে তালেবানরা ক্ষমতা দখল কইরা বামিয়ানের বৌদ্ধমূর্তি ভাঙা শুরু করছে। কথা হইলো, দেশে এই ঘটনা নতুন না। এর আগেও শহরে শহরে, যে বিশ্ববিদ্যালয়ে জামাত-শিবিরের আখড়া আছে সেইখানেই এইরাম ঘটছে। ইসলামের দোহাই দিয়া ভাস্কর্য ভাঙা হইলেও ১৯৭১-ই জামাতের ভাষ্কর্য বিরোধিতার কারণ। এবার বাউলের ভাস্কর্যতে হামলা হইছে।
হুজুরদের ইস্যু দরকার। তারা ইস্যু পায়া নাচতেছে।
এখন আমাদের কথা হইলো, আমেরিকা পন্থী একটা সরকার, বিমানবন্দরের মতো স্পর্শকাতর একটা জায়গায় জঙ্গি বেশধারী তালেবানদের একরকম শক্তিশালী উপস্থিতি কেমনে সয়? ভাস্কর্য নিয়া আমার মাথাব্যথা নাই। ওইখানে ইসলাম সম্মত ভাস্বর্য হউক আর অসম্মত হউক এইটাও বিষয় না। বিষয় হইলো, বিমানবন্দরে মোল্লাদের ঘাঁটি কেমনে তৈরি হইলো?
জর্জ বুশরে কোন মুখ নিয়া আমরা দাওয়াত দিবো এই দেশে?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।